মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ঢাকা সফর করে গেলেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সাক্ষাৎ ও সভায় তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার আশাবাদ ও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সোমবার আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁর দেশের পক্ষ থেকে। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত তাঁর বিশেষ সাক্ষাৎকারেও অভিন্ন অভিমুখ প্রতিফলিত হয়েছে- 'নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন চায় যুক্তরাষ্ট্র।' (সমকাল, ৮ নভেম্বর, ২০২২)।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন বলেই সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা কিন্তু নয়। যে জাতীয় নির্বাচন আগামীতে হবে, তাতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকবে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, বৈধ শাসন প্রক্রিয়া চালু থাকবে- এটা তো আমাদেরও প্রত্যাশা। বিদেশি কেউ এসে বলুন বা না বলুন- এ বিষয়ে আমাদের নিজেদেরই কথা বলা দরকার। বরং তিনি যা বলেননি, সেটাও আমাদের বলা উচিত।
আমাদের বলা উচিত- সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি যাঁরা দেশের নাগরিক, যাঁরা ভোটার, যাঁরা প্রজাতন্ত্রের মালিক তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও জরুরি। তাঁরা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। সাধারণ নাগরিকরা যাতে ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। কারণ নাগরিকরাই দেশের অগ্রগতি, অর্থনীতির চালিকাশক্তি। নাগরিকরাই যদি নির্বাচনে ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে না পারেন, তবে সবার অংশগ্রহণ হয়েছে বলে তো দাবি করা যাবে না।
এ ছাড়া এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক ছাড়া আরও যাঁরা অংশীজন রয়েছেন, সবাই মিলে যাতে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারি, সে কথা আমাদের সবারই বলা উচিত। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে যাতে বৈধতা দিতে পারি; সবার মতামত ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাম্প্রতিক বিভিন্ন কথার মধ্যেও অনেকে নানা অর্থ খুঁজতে শুরু করেছেন। যেমন তিনি সম্প্রতি 'ইন্দো-প্যাসিফিক' অঞ্চলে বাংলাদেশকে নিরাপত্তাবন্ধু হিসেবে পাওয়ার প্রত্যাশা করেছেন। এ ছাড়াও রয়েছে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন, সামাজিক ও পরিবেশগত বিপদ মোকাবিলায় সামর্থ্য বাড়ানো, শ্রম অধিকারের উন্নয়ন এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ জোরালোভাবেই বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য তারই ধারাবাহিকতা। নির্বাচন সামনে রেখে এখন গণতন্ত্র, ভোটাধিকার এসব বিষয়ে আলোচনা বাড়বে, বলা বাহুল্য।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে- একাত্তরে আমাদের দেশটি গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। এখন সেই গণতান্ত্রিক ধারা কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়; নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কীভাবে ধারাবাহিকতা থাকে ও নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে কথা বলতে হবে বৈকি। পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় যেমন রোহিঙ্গা সমস্যা, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা, জ্বালানির উচ্চমূল্য, জলবায়ু সংকট নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতারা সেসব কথাই বলছেন। আমরাও বলছি। কিন্তু যে কথাটি বলছি, তা কাজে প্রমাণ করতে হবে।
বস্তুত এসব বিষয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তা করা দরকার; অনুশীলন করা দরকার। বাইরে গিয়ে যদি আমরা শান্তির কথা বলি; আমাদের নিজেদের কাজের প্রেক্ষাপটেও তার প্রতিফলন থাকতে হবে। শুধু বাইরের ওপর অপেক্ষা করে থাকতে গেলে বাইরের ঝোড়ো হাওয়া আমাদের আঘাত করবে। আমরা যেন তা আগেই প্রতিরোধ করতে পারি। সে জন্য আমাদের জাতীয় পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। সবাইকে নিয়েই একটি প্রচেষ্টা দরকার। এর মধ্য দিয়ে যেসব ঝোড়ো হাওয়া বা আতঙ্কের আশঙ্কা আছে, উদ্যোগ আছে, সেগুলো যেন ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়।
যখন আশাহত হয়ে যায়, মানুষ যখন সামনে কিছু দেখে না, তখন কিন্তু সে যে কোনো কাজ করতে পারে। খারাপ-ভালো দুটিই। কাজেই সেই জায়গাটিতে তাদের জন্য ফেলে দেওয়া না হয় এবং আমরা কিন্তু সেটি চাই না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে। আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুরাও চেষ্টা করছেন। জাতিসংঘ বলেন, আসিয়ান বলেন। আইনগতভাবে হচ্ছে, কূটনৈতিকভাবে হচ্ছে। আমরা যেহেতু মনে করি, আন্তর্জাতিকভাবেই এ সমস্যার সমাধান আমাদের করতে হবে, সে অনযায়ী কাজ সম্ভবত হচ্ছে না। এখনও যেভাবে চাচ্ছি, সেভাবে সমাধান করতে পারছি না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে আমরা যেভাবে চাচ্ছি, সেভাবে পাচ্ছি না। যেমন ভারত, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রকে যদি কূটনৈতিকভাবে আরও সবল ও শক্তিশালীভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে হয়তো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়বে।
মনে রাখা জরুরি- আমরা যদি আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথা বলি, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুকে পাস কাটিয়ে বলা সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে আমরা গণতন্ত্র বলতে আসলে কী বুঝব- এও একটি বিষয়। আমরা যখন গণতন্ত্র কথাটি বলি, তখন যেন শুধু ভোট বিষয়টিকে গণতন্ত্র না বলি। প্রতিদিন একজন মানুষের বেঁচে থাকা, তাঁর জীবনযাপন, অধিকার, সুরক্ষা, ভবিষ্যৎ- এসব বিষয়কে সামগ্রিকভাবে যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তবেই তাকে আমরা গণতন্ত্র বলতে পারি। গণতন্ত্রকে আমরা শুধুই যে রাজনৈতিকভাবে দেখব, তা নয়। এখানে রাজনীতি থাকবে, সামাজিক সুরক্ষা থাকবে, মানবাধিকার থাকবে, জলবায়ু থাকবে। সবকিছু মিলিয়েই আমাদের গণতন্ত্রকে সাজাতে হবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করতে হবে, পৃথিবী এখন বিশ্বায়িত। অর্থাৎ বিশ্বায়নের ফলে আমার যেটা স্বার্থ, সেটা আরেকজনেরও স্বার্থ। একটা দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই আছে। আমি শুধু নেব; কিছুই দেব না- এটা ঠিক নয়। মূল্যবোধের দেওয়া-নেওয়াটা জরুরি। একটি দেশের কোনো বিষয়ে অন্যরা যদি জানতে আগ্রহী হয়, সেটাকে 'অপরাধ' হিসেবে দেখা যাবে না। একইভাবে অন্যের কিছু আমি জানতে চাইলেও সেটা অপরাধ হবে না।
আমাদের দেশের এক রাজনৈতিক দল অপর দলকে অভিযুক্ত করে এই বলে- তারা বিদেশিদের কাছে নালিশ করে। এটা সম্পূর্ণ বলব, নিজেদের প্রতি আস্থাহীনতা থেকেই এ ধরনের অভিযোগ সামনে আসে। তবে একটি স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে আত্মসম্মানের সঙ্গে নিজের কাজগুলো করা উচিত।
এম হুমায়ুন কবির :সাবেক রাষ্ট্রদূত