- সাক্ষাৎকার
- রাষ্ট্রদূতের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কূটনৈতিক দায়
সমকালীন প্রসঙ্গ
রাষ্ট্রদূতের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কূটনৈতিক দায়

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঘিরে সম্প্রতি যে অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভব হয়েছে, তাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ সামান্যই। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হওয়া, তা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে তো বটেই, এমনিতেও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী যে কোনো দেশের কূটনীতিকের নিরাপত্তা দেওয়া স্বাগতিক দেশের কর্তব্য। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কূটনীতিকদের যেমন স্বাগতিক দেশ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেবে, তেমনি তাঁদের পরিবারও এর সুরক্ষার আওতার মধ্যে পড়ে। একজন কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মোটামুটি বড় ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে তিনি বা তাঁরা স্বাগতিক দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর- এগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও কাজ করতে পারেন। ভিয়েনা কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী, এ ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা বাঞ্ছনীয় নয়।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটেছিল ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন তিনি 'মায়ের ডাক' সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির নিখোঁজ নেতার রাজধানীর বাসায় যান। তবে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন 'মায়ের কান্না' নামে আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা। তাঁরা সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় কিছুটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে মায়ের ডাকের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে বেরিয়ে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এর পর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই কেবল সেখানে থেমে থাকেনি। এর পর এ বিষয়ে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে সে দেশের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বৈঠক করেছে। তাঁরা পিটার ডি হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান। এর অর্থ, বিষয়টিকে তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার জন্য আরও অধিকতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। বলার অপেক্ষা রাখে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু রাষ্ট্র। আমরা দেখছি, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এখন বিস্তৃত ও গভীর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে একক রপ্তানি বাজার; আমাদের রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবেও দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অগ্রসর রাষ্ট্র। সাম্প্রতিককালে কভিডের ভ্যাকসিন দিয়েও দেশটি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। আগামী দিনেও ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং আগামী দিনেও এটি অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশাবাদী। সবশেষে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অন্যতম সুনামের জায়গা জাতিসংঘ শান্তি মিশনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবস্থানকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে চলমান দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতার জায়গাটি আরও সম্প্রসারিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সেই আলোকেই দুই দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ও সম্ভাবনাকে নির্বিঘ্ন রাখতে ছোটখাটো বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এবারের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেমন খারাপ দৃষ্টান্ত, তেমনি ২০১৮ সালের আগস্টে ঢাকার মোহাম্মদপুরে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার বিষয়ও আরেকটি নেতিবাচক উদাহরণ হয়ে আছে। এগুলোর পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে অহেতুক ও অপ্রত্যাশিত ক্ষত তৈরি করতে পারে। সে জন্যই সতর্কতা জরুরি। এবারের ঘটনার পর পররাষ্ট্র সচিবও বলেছেন, একটা ঘটনা বা এ ধরনের আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সম্পর্কের অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা না থাকলেও সতর্কতার জায়গায় যে ছাড় দেওয়া উচিত নয়- এ ঘটনা থেকে সেটাও শিক্ষণীয়।
মনে রাখতে হবে, কূটনীতিতে বল প্রয়োগের কোনো স্থান নেই। এখানে শিষ্টাচার, সভ্যতা ও ভব্যতা মেনেই পারস্পরিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করতে হয়। অন্য দেশের সঙ্গে যখন আমরা কাজ করছি, তখন যেমন সেই দেশটির আত্মমর্যাদা সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে, তেমনি আমাদের মর্যাদা ও ভাবমূর্তির বিষয়ও বিচেনায় রাখা প্রয়োজন। কূটনীতি উচ্চমাত্রার একটি সৃজনশীল কাজ। এখানে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া এবং এ ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় উভয়ই পরিত্যাজ্য।
আমি আগেও বলেছি, আমরা পৃথিবীকে একভাবে দেখি, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখে অন্যভাবে। আমেরিকা বড় দেশ হিসেবে তাদের একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে আমাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছে। আবার বৈশ্বিক শান্তিত রক্ষা মিশনে আমরাও তার সহযোগী। আমাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। সুতরাং আমাদের দিক থেকে দেশটির কূটনীতিকদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ভালো আচরণ প্রদর্শনই প্রত্যাশিত।
আমরা জানি, বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের নীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। সেদিক থেকেও যে কোনো দেশের সঙ্গে আমরা ভালো ব্যবহার করি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বহুপক্ষীয় বিচারে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সর্বোচ্চ শিষ্টাচার প্রদর্শন করতে হবে। একই সঙ্গে আমি এটিও বলতে চাই, বাংলাদেশ যেমন তার দিক থেকে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হবে, তেমনি কূটনীতিকদেরও সংবেদনশীলতার দিকটি অনুধাবন করা উচিত। তাঁদের এমন কোনো অসংবেদনশীল আচরণ করা ঠিক হবে না, যার কারণে কারও মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
মোটের ওপর বলতে গেলে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, সেটি আমাদের জন্য ভালো বিষয় নয়। তাঁর পথ আটকানো এবং তৎপরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়াগুলো আসছে, সেখানেও আমরা ইতিবাচক কিছু দেখছি না। এ অবস্থায় বাংলাদেশের উচিত হবে, আমেরিকাকে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে আশ্বস্ত করা; বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে আন্তরিক ও উদার, সেটিও তাদের বোঝানো। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে ভুল ধারণার অপনোদন হবে এবং ভালো সম্পর্কের মধ্যে কোনো ধরনের কালিমা পড়বে না বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যও আমাদের দায়িত্বশীলতা জরুরি।
এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
মন্তব্য করুন