জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, সংলাপের দরজা সব সময়ই খোলা। রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সংলাপ হতেই পারে। তবে এই ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে আসতে হবে।

সমকালের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, 'কখনোই চামড়া বাঁচানোর রাজনীতি করিনি। মানুষের পাশে থেকেছি। মানুষের কথা বলছি। মানুষের জন্য আমার এই পথ চলা অব্যাহত থাকবে। চোখের পাতা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আমি শুধুই মানুষের জন্য অবিরাম সামনের দিকে হাঁটব।'
মতিয়া চৌধুরী সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি সংসদ নেতা শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন। তাঁর (সংসদ নেতা) পাশে সহায়তাকারীর ভূমিকায় থাকবেন। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংসদে থাকা সম্ভব হয় না। ওই সময়ে দলের এমপিদের নিয়ে কার্যকর ও অর্থবহ ভূমিকা পালন করবেন মতিয়া চৌধুরী। এ সব দায়িত্ব পালনের বেলায় তিনি কখনোই বিবেককে ফাঁকি দেবেন না।

তবে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতি অনুভব করছেন মতিয়া চৌধুরী। তাই তাঁর প্রত্যাশা, গণতান্ত্রিক ধারায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাস থাকলে বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসবে। তিনি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চান। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মতিয়া চৌধুরীর আপত্তি রয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই। তিনি উপনেতা হিসেবে ইতোমধ্যেই তাঁর করণীয় নির্ধারণ করেছেন। বলেছেন, সংসদ ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করাই তাঁর একমাত্র করণীয় কর্তব্য।

সাক্ষাৎকারে বেশ খোলামেলা কথা বলেছেন সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত মতিয়া চৌধুরী। এতে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে তাঁর কারাজীবন এবং ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদানসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক চারবারের এমপি। তিনি তিন দফায় মন্ত্রীত্ব সামলিয়েছেন।

১৯৫২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতে খড়ি তাঁর। অগ্নিকন্যা-খ্যাত মতিয়া চৌধুরী তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে ১৫ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এক সময়কার তুখোড় বামপন্থি রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদে সহসভাপতি (ভিপি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদকের (জিএস) দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি।
১৯৬৭ সালে কারাগারে থাকাকালে তাঁর নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ-মোজাফফর)। পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ন্যাপে ফিরে যান মতিয়া চৌধুরী।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ১৯৭৫ সালের ১০ ডিসেম্বর। আর কারাগারেই তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে প্রয়াত উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে। এরই পথ ধরে তিনি ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মতিয়া চৌধুরী আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, 'আমাকে দিয়েই সাজেদা আপার শূন্য স্থান পূরণ করা হবে তা কখনও ভাবিনি।'

তিনি বলেছেন, 'শেখ হাসিনাই আমাকে উপনেতা বানিয়েছেন। তিনিই (শেখ হাসিনা) ১৯৮৬ সালে আমাকে প্রথমে আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক এবং পরে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত করেছেন।' বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হতে পারতেন না বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায়, 'যাঁদের মুখে প্রগতির কথা শুনেছি, প্রগতিশীল রাজনীতির বাণী শুনেছি, আওয়ামী লীগে যোগদানের পর আমি তাঁদের কাছে ছিলাম শুধুই 'মাগনা কামলা'।

আওয়ামী লীগে যোগদানের স্মৃতিচারণ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগে যোগদানের দিনে দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক তাঁর রাজধানীর সিদ্দিক বাজারের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে বলেছিলেন- 'চৌধুরী (মতিয়া চৌধুরী), আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েন না। আপনি এই পার্টি করতে পারবেন না।' তাঁর কথায় এক ধরনের চাপ এবং শুভাকার সুর ছিল। মতিয়া চৌধুরী প্রতিত্তোরে বলেছিলেন, 'আমি আওয়ামী লীগে যোগ দেব। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ অফিস ঝাড়ূ দেব। আওয়ামী লীগে আমার পদ চাই না।' আবদুর রাজ্জাক দুই দফায় সাধারণ সম্পাদক থাকা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো পদ-পদবি পাননি মতিয়া চৌধুরী।
'রাজনীতিতে সহনশীলতা কমছে কেন' এমন জিজ্ঞাসার জবাবে সংসদের উপনেতা বলেন, 'এটা কাম্য নয়। তবে, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন? এ জন্যই আওয়ামী লীগ সহনশীল।' তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই। তবে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করাটাই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ একমত না হলে জনগণ তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে।

মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, 'গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একমাত্র মানুষই বিচারকের ভূমিকায় থাকে। সেই মানুষকে সেবা দেওয়া, তাঁদের ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে দেওয়া এবং তাঁদের উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ মানবকল্যাণ নিশ্চিত করাটাই রাজনৈতিক দলের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সেই উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এটাই আমার জীবনের শেষ টার্গেট।'