জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একসঙ্গে চলতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করলে তিন ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সম্প্রতি দুটি ঘটনা, নওগাঁর সুলতানা জেসমিন ও প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান– এখানে আইনের এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে।  তবে এ আইনটির খড়্গ আমরা একের পর এক ঘটনায় দেখে চলেছি। নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, মতপ্রকাশের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ আদালত সত্যিকারভাবে চাইলে মানুষের নিরাপত্তা পাওয়ার কথা। মাঝরাতে সাংবাদিকের বাড়ি থেকে তুলে আনায় তৎপর পুলিশকর্তা কোথায় থাকেন– এসব প্রশ্ন তোলা গেলে, উত্তর মিললে বোঝা যাবে আইনের শাসন আছে।

সমকাল: সম্প্রতি নওগাঁয় সুলতানা জেসমিন নামে এক নারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আটক হওয়া এবং র‌্যাবের হেফাজতে মৃত্যুর পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এখানে আইনটির অপব্যবহার হয়েছে। তাহলে আইনটির সুব্যবহারও আছে কিনা? একজন আইনজীবী হিসেবে আপনি এই আইনটিকে কীভাবে দেখছেন?

জেড আই খান পান্না: ধরা যাক, এক নারীর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি কেউ অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল। আবার একজনের ই-মেইল অসৎ উদ্দেশ্যে হ্যাক করে বিভিন্ন জনের কাছে উল্টাপাল্টা তথ্য ছড়িয়ে দিল। এ ক্ষেত্রে তিনি কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন? ডিজিটাল সুরক্ষা পেতে বিভিন্ন দেশেই আইন আছে। কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে; যেমন নওগাঁর জেসমিনের ক্ষেত্রে যা হলো কিংবা ভিন্নমত বন্ধ করতে বা সাংবাদিক দমনে যা হচ্ছে, তা তো রীতিমতো অন্যায়।  

সমকাল: ২০২১ সালে ১১ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ৮৩ ভাগ মামলা হয়েছে অনলাইনে মতপ্রকাশের জন্য। ৪০ ভাগ মামলার বাদী হচ্ছেন ক্ষমতাসীন সরকারি দলের লোকজন। এক-তৃতীয়াংশ মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসবের মধ্যে একটি বড় অংশই করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এতে কি বলা যায়– আইনটির সংগত ব্যবহার হচ্ছে?

জেড আই খান পান্না: প্রতিটি আইনের একটি পটভূমি থাকে। আমাদের দেশের যে দণ্ডবিধি আইন, তা কখন হয়েছিল, ভেবে দেখা দরকার। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, আর ১৮৬০ সালে হয়েছিল দণ্ডবিধি আইন। এর পর ১৮৬১ সালে হয় পুলিশ আইন। অর্থাৎ যে আইন ব্রিটিশরা করেছিল বিদ্রোহী সিপাহিদের দমন করতে, সেই আইনটিই হয়েছে পুলিশ আইন। এখনও সেই আইন দিয়ে পুলিশ আমাদের শায়েস্তা করে চলেছে। আমরা ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করেছিলাম। কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করে সেই সংবিধান এখনও আমাদের দেশে চলছে। এখন স্বাধীন দেশ পরিচালনার সময়ে যদি মান্ধাতার আমলের ব্রিটিশদের তৈরি পুলিশ আইন মানা হয়, তাহলে তা কী করে আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই হবে? আমি মনে করি, আমাদের সংবিধানটি একটি চমৎকার সংবিধান। সেই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন আইন বাতিল করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু আইন সংশোধন করতে হবে। যেমন– এখন সবার আগে বলতে হবে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা। একটি উদাহরণ আমরা দিতে পারি। ইংলিশ লেখক ডিএইচ লরেন্সের উপন্যাস ‘লেডি চ্যাটার্লিস লাভার’ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে তো জেলে যেতে হয়নি। কার্ল মার্কস যখন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখেছেন, তখন কিন্তু ব্রিটিশরা তাঁকে জেলে নেয়নি।

সমকাল: আমরা যদি আমাদের দেশের অতীতের কিছু ঘটনার দিকে তাকাই দেখতে পাব, একটা সময়ে যাঁরা ব্লাসফেমি আইনের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন, তাঁরাই এখন আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। এখন সেই ব্লাসফেমি আইনকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে আনা হয়েছে। তবে এখানে আওতা আরও বাড়ানো হয়েছে। তাহলে আমরা এগোলাম, না পেছালাম? 

জেড আই খান পান্না: এই একই প্রশ্ন তো আমিও করতে চাই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখন বেঁচে থাকলে কি কবিতা লিখতে পারতেন? সেই সময়ে যা করা গেছে, তা এখন করার কথা ভাবতে পারি কি?

সমকাল: এটা তো আজকাল বলা হচ্ছে যে, আমাদের আগের সমাজ এখনকার তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল ছিল...

জেড আই খান পান্না: অবশ্যই সহনশীল ছিল।

সমকাল: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিপীড়নমূলক আইন কেন করা হয়? 

জেড আই খান পান্না: এসব করা হয় বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে। অথচ আইন হওয়া উচিত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে। আর এখানে বড় অপরাধীদের সুরক্ষা দিতেই এমন আইন করা হয়।

সমকাল: তাহলে বিশেষ কোনো ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে কিংবা কোনো ব্যবস্থার সুবিধায় যে আইন হয়, তাকে কি আইনের শাসন বলে দাবি করা যায়?

জেড আই খান পান্না: আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই। নাম বলেই উল্লেখ করি। ঢাকার লালবাগে নির্বাচন। সেখানে প্রার্থী হয়েছেন দুই বিখ্যাত হাজি সাহেব। সেখানকার এক ভোটার ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আমি তাঁকে বললাম, ভোট কাকে দেবেন? তিনি বললেন, জুতার পিটুনি খেতে হবে। কিন্তু সেটা ডান গালে খাব, নাকি বাঁ গালে– সেটাই প্রশ্ন। আমি প্রথমে বুঝিনি, পরে বুঝলাম। তাহলে এখন আমার দেশের গণতন্ত্র বলতে কী বুঝব? আমার দেশের গণতন্ত্র মানে তো নির্বাচন। এখানে সবকিছু আইন মেনে হবে– এটা কীভাবে প্রত্যাশা করব!

সমকাল: কিন্তু এসব আইন তো সাধারণ মানুষ, যারা সরাসরি ক্ষমতার বলয়ের বাইরে তাদের ওপরেই বেশি প্রয়োগ করা হয়...

জেড আই খান পান্না: আমি একটি কথা প্রায়ই বলি, আইন হচ্ছে মাকড়সার জাল। সেখানে ছোটখাটো পোকামাকড় সহজেই আটকে যাবে। কিন্তু বড় পাখি ঠিকই উড়ে চলে যাবে। ঈগলরা তো টেরই পাবে না– এখানে মাকড়সার জাল ছিল।

সমকাল: আমরা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ সম্প্রতি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে দেখলাম। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে ভোর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। তার পর প্রায় ২০ ঘণ্টা ‘অজ্ঞাত’ অবস্থায় রাখা হলো। পরে জানা গেল, তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। একই আইনে পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমানের নামেও মামলা হলো। এ ছাড়া এই সময়ে আরও কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও এই আইনে মামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনা কী নির্দেশ করে? বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একসঙ্গে চলতে পারে? 

জেড আই খান পান্না: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একই সঙ্গে চলতে পারে না। এই কথাটি স্পষ্টভাবে আমাদের সবার আগে জানা উচিত ছিল। সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে– কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করলে ৩ ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ দিতে হবে। সম্প্রতি দুটি ঘটনা নওগাঁর জেসমিন এবং প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান– এখানে আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে।  

সমকাল: কিন্তু এই আইনটির খড়্গ আমরা একের পর এক ঘটনায় দেখে চলেছি। নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, মতপ্রকাশের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। এমন অবস্থায় মানুষ কোথায় যেতে পারে? দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ ক্ষেত্রে মানুষের সহায়ক হতে পারে কীভাবে?

জেড আই খান পান্না: সর্বোচ্চ আদালত সত্যিকারভাবে চাইলে নিশ্চয়ই পারার কথা। যদি আইনের শাসন দাবি করা হয়, তাহলে তো পারার কথা। প্রায় প্রতি মাসেই ঢাকার বস্তিতে আগুন লাগে। কই, কাউকে কি জেলে যেতে হয়েছে? হয়নি। বস্তির ঘর পুড়ে যাওয়া শিশুটির কি নাগরিক অধিকার নেই? থাকলে তা কে বুঝিয়ে দেবে? কেউ তো দিচ্ছে না। কই, ব্যাংক লুটপাট হয়ে যায়! যারা করে তাদের তো জেলে যেতে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লকার হ্যাক করা হয়, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোথায় থাকে? এসব প্রশ্ন তোলা গেলে এবং উত্তর পাওয়া গেলে বোঝা যাবে আইনের শাসন আছে।

সমকাল: এই আইনে প্রথম আলো সম্পাদক ছয় সপ্তাহের জামিন পেলেন। এটা কী নির্দেশ করে? মামলার ভিত্তি দুর্বল ছিল কি?

জেড আই খান পান্না: অবশ্যই মামলার গ্রাউন্ড দুর্বল ছিল। আমাদের এক কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’। এমন অবস্থা যদি থাকে, তাহলে কেন কথা বলা যাবে না? আবার ‘ভাত দে’ নামে একটি চলচ্চিত্রও আছে। সেখানে শাবানা অভিনয় করেছিলেন। আমরা দেখলাম, প্রথম আলোর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। যদিও এই মামলার বাদীর নিযুক্ত করা আইনজীবী মশিউর মালেক। আমরা শুরুতেই বলেছি– রাষ্ট্রপক্ষ তো এখানে যুক্ত হওয়ার কথা নয়। যে বাদী মামলা করেছেন, তিনি থাকতে রাষ্ট্রপক্ষের কেন যুক্ত হতে হবে? মামলার গ্রাউন্ড এবং প্রথম আলোর মতো বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকের সম্পাদকের এসব বিবেচনায় নিয়েই জামিন হয়েছে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।

জেড আই খান পান্না: আপনাদের জন্য শুভকামনা, সমকালকেও ধন্যবাদ।