সিলেট সিটি করপোরেশনে দুইবারের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, যিনি বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা। এবার সিটি নির্বাচনের আগেই আলোচনার কেন্দ্রে তিনি। নির্বাচন করবেন কিনা, তা এখনও স্পষ্ট করেননি। যদিও নির্বাচন বর্জন করার দলীয় সিদ্ধান্ত বহাল আছে। তবে আরিফুলকে নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। সিটি নির্বাচন নিয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য জানতে উন্মুখ সিলেটবাসী। এ জন্য সমকাল একান্তে কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে সিটি করপোরেশনে ১০ বছর দায়িত্ব পালনকালে পূর্ণতা-অপূর্ণতার নানা বক্তব্যও তুলে ধরেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলেট ব্যুরোর মুকিত রহমানী ও ফয়সল আহমদ বাবলু
সিলেট সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের ‘অতিউৎসাহী কর্মকর্তাদের তৎপরতা’য় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এই সন্দেহ গভীর হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে থাকবেন বলে ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এ সদস্য। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে সিটি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও আরিফ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। আগামী ২০ মে নগরীর রেজিস্ট্রি মাঠে জনসভা করে তিনি টানা তৃতীয়বারের মতো মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা, জানাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

মেয়র আরিফ বলেন, নির্বাচনের আগে এত ভয় কীসের? আগ থেকেই কেন ইঞ্জিনিয়ারিং? আমি তো এখনও নির্বাচন করব কিনা– ঘোষণাই দিইনি। তারপরও সবার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। আমাকে নানাভাবে চাপে রাখা হচ্ছে। আমি নির্বাচন করব কিনা, ২০ মে জানাব। কারণ, জনগণ আমাকে দুইবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের মতামত নিচ্ছি। সে জন্য সিদ্ধান্ত জানাতে দেরি হচ্ছে। সিলেট সিটি নির্বাচন সামনে রেখে নিজের অবস্থান ও সার্বিক বিষয়ে সমকালকে এমন কথাই বলেছেন বর্তমান মেয়র, বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। শনিবার রাতে নগরীর কুমারপাড়ায় ব্যক্তিগত কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ নিয়ে জোরালো আপত্তি তোলেন তিনি। আরিফুল হক নির্বাচন না করলে দলে বড় পদ পাবেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে নির্বাচন করবেন কিনা– তা স্পষ্ট করবেন বলে জানিয়েছিলেন মেয়র। কিন্তু ফেরার পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও সিদ্ধান্ত জানাননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দল নির্বাচনে যাবে না– আমাকে কর্মী হিসেবে তা মানতে হবে। কারণ যাঁরা নির্বাচন করবেন, তাঁরা দলীয় শাস্তির মুখে পড়বেন। সেই শাস্তি কোনোদিন হয়তো তুলে নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, নগরবাসী আমাকে দুইবার নির্বাচিত করেছে। এখন ৪২টি ওয়ার্ড হয়েছে। সব ওয়ার্ডের বাসিন্দার মতামত নিচ্ছি। হুট করে কিছু ঘোষণা দেওয়া মানে জনগণের মনের কথা না বোঝা। আমরা তাদের কথা বুঝি না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পছন্দের লোক আজ মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছে।

সিলেট সিটি নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, নির্বাচনের আগে আমার দলের লোকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আমার মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে। এটা কীসের আলামত? তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা কে দেবে? ভোটের আগে একজন প্রার্থীকে নিয়ে এত পরিকল্পনা চলছে! তাহলে ভোটের প্রয়োজন কী? টেন্ডারের মাধ্যমেই প্রার্থী বাছাই করে নিলে ভালো হতো। সে জন্য সবকিছু বিশ্লেষণ ও চিন্তা করতে আমি সময় নিচ্ছি। ২০ মে নির্বাচন করব কিনা– জনসভা করে জানাব। এটাকে যে যা-ই বলুক; এটা কোনো নাটক নয়। এটাই বাস্তবতা।
নির্বাচন নিয়ে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা কী– এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, নির্দেশনা একটাই– পরিস্থিতির উন্নতি তথা দাবি না মানলে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। আমার বেলায়ও একই নির্দেশনা। নির্বাচন করা-না করা নিয়ে যে যা-ই বলুক, আমি ঠিক সময়ে সব খোলাসা করব।

দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে অর্জন প্রসঙ্গে আরিফুল হক বলেন, দু্‌ই মেয়াদের ১০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু আমি দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে অবস্থানসহ নানা কারণে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমার কাজের মূল্যায়ন করবে আমার জনগণ। ২০১৩ সালে জামিলুর রেজাকে উপদেষ্টা করে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে কাজ শুরু করি। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করে স্থানীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছি। তারা এখন বলছে, সিলেটে ওয়াসা হয়েছে; তারাই দেখবে। কিন্তু ওয়াসা কবে দেখবে? এর আগে পানির জন্য তো নগরবাসী বসে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। চারবার সিলেট সিটি করপোরেশন প্রথম হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আমি ভালো কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রীও ভালো কাজ করছেন। রোহিঙ্গা নিয়ে তিনি শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছেন। বিশ্বনেতাদের নজর কাড়তে তিনি সক্ষম হয়েছেন।

আরিফুল হক বলেন, সিলেটের একজন এমপি সিটির প্রকল্প বরাদ্দে বিরোধিতা করেছেন। দেশের অন্য সিটি করপোরেশন বিভিন্ন প্রকল্পে শতভাগ বরাদ্দ পেলেও আমরা ৮০ ভাগ পাচ্ছি। সরকার অন্য সিটিতে চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছে। আমাকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প। বর্তমানে ৯টি প্রকল্পই পাইপলাইনে রয়েছে উল্লেখ করে আরিফ বলেন, কতগুলো প্রকল্প আমি বাস্তবায়ন করেছি, তা নগরবাসী জানেন।

কসমেটিকস উন্নয়নের অভিযোগ ও ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বিষয়ে মেয়র বলেন, কসমেটিক উন্নয়ন করলে প্রধানমন্ত্রী বরাদ্দ দিতেন না; প্রকল্প পাস হতো না। কত টাকা কোথায় সরকার দিয়েছে এবং ব্যয় হয়েছে তার হিসাব রয়েছে।
ইভিএমের পাসওয়ার্ড কার হাতে থাকবে– প্রশ্ন তুলে মেয়র বলেন, ইভিএমের ভোটের ভরসা কোথায়? আমরা দাবি জানিয়ে আসছি তা বাতিলের জন্য। নির্বাচনের পরিবেশ সবার আগে সৃষ্টি করতে হবে। সিটি নির্বাচন না করে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে লোকজন বলাবলি করছে– এ বিষয়ে মেয়র বলেন, অনেকে অনেক কথাই বলেন। আমি জানি না, অথচ তাঁরা জানেন। অনেক কথাই আমাকে নিয়ে বলানো হচ্ছে। কারা কেন বলেন, তা তাঁরাই ভালো জানেন। আমার এমন কোনো উদ্দেশ্য এখনও হয়নি।

নির্বাচন করবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা অতি উৎসাহী হয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন (বিএনপি নেতাকর্মীকে)। ব্যাপক ধরপাকড় করা হচ্ছে। অনেক কর্মকর্তাকে বদলিও করা হচ্ছে।
এগুলো নির্বাচনকে প্রভাবিত করারই ইঙ্গিত। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও ভোটে আস্থা ফেরানোর আহ্বান জানিয়ে মেয়র আরিফ বলেন, ‘যদি আমি নির্বাচন না করি, তাহলে বুঝতে হবে প্রশাসনের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা এর জন্য দায়ী।

গত ২ এপ্রিল যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সিটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন মেয়র আরিফ। এর পর ‘শীর্ষ নেতার কাছ থেকে সিগন্যাল’ পাওয়ার কথা নিশ্চিত করলেও তা লাল, না সবুজ– তিনি স্পষ্ট করেননি। অথচ লন্ডনে যুবদলের এক সভায় তিনি নির্বাচন না করার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। আবার দেশে ফিরে মহান মে দিবসের এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন করার পক্ষে ইঙ্গিত দেন। এ অবস্থায় ২০ মে তিনি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানাবেন।

নির্বাচন করলে আপনার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, আগে নির্বাচনের ঘোষণা দিই, তারপর না চ্যালেঞ্জ। আমি নির্বাচন করব– এ কথা এখনও বলিনি। ব্যক্তি আরিফ আর মেয়র আরিফ হিসেবে কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন– এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আরিফ হিসেবে চলতে চাই। জনপ্রতিনিধি না থাকলে আমাকে আরিফ হয়ে নগরবাসীর কাছে থাকতে হবে।