বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে নির্দেশনা থাকলেও নির্বাচনের অন্যতম অংশীজন রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি কথাও উল্লেখ নেই। রাজনৈতিক দলই সম্ভবত একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যার কোনো স্বতন্ত্র অডিট হয় না। সে সম্পর্কে কোনো আইন বা নির্দেশিকাও নেই। তাই অধিকাংশ দলেরই কোনো অডিট হয় না। কারও যদি হয়ও, তা নিজেদের কর্মী দিয়েই এবং কোনো দলকেই অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয় না। এমনকি নিজ দলের কোনো সদস্যও কখনও সেই অডিট রিপোর্ট দেখতে পান না। তাঁদের তহবিলে কোথা থেকে কত টাকা এলো– তা কাউকে জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, তা নিয়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মধ্যে এর ছিটেফোঁটা না থাকলেও কেউ কখনও মুখ খোলেন না। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দলে নির্বাচন বা মনোনয়নের কোনো রেওয়াজ নেই। প্রায় সব দলেরই প্রার্থিতা নিরূপণ হয় নেতাদের বিশেষ করে শীর্ষ নেতার বদান্যতায়।

ভারতে ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন রায় দিয়েছিল– রাজনৈতিক দলগুলো তথ্য জানার অধিকারের আইনের আওতায় পড়ে। তবে সে রায় ভারতে কোনো দলই কখনও মানেনি; বরং সেই তথ্য কমিশনই ২০১৯ সালে রায় দেয়– রাজনৈতিক দলের অর্থসংক্রান্ত তথ্য জনতার জানার অধিকার নেই। এসব ত্রুটিই রাজনৈতিক দলকে কালক্রমে ‘পারিবারিক’ সংস্থায় পর্যবসিত হতে সাহায্য করে।

এমন একটি দেশে আমরা জন্মেছি, যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক কোলাহল, বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই রয়েছে। এগুলোর ওপর আমাদের তেমন হাত থাকে না, যদিও আমরা সাধারণ মানুষ এগুলোর কারণে ভুক্তভোগী।

তৃতীয় বিশ্বে জোট রাজনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে সেই সত্তর দশক থেকেই। কোনো একটা ভোটের দামামা বাজলেই দেশের সবাই ‘বিরোধী ঐক্য’ হলো কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামায়। ভোটের বাজারে বিরোধীরা একাট্টা হয়ে শাসকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে– এটাই যেন দস্তুর। এমন রাজনীতির গসাগু হলো– শুধুই শাসকের বিরোধিতা। নীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ কিছুই তখন আর সামনে আসে না। মানুষের জন্য কাজ কতটা হলো, ভোটার কী চাইছে– দেখার সময় নেই শাসক দল এবং বিরোধী দলের নেতাদের। সেসব ছিল পুরোনো ফ্যাশন। এখন নতুন নিয়ম। মোড়কটা চাই ঝাঁ-চকচকে। ভেতরটা ফাঁপা হলেও মানুষ তা দেখতে পাচ্ছে না। মানুষ কীভাবে চাল-ডাল কিনছে; মাস শেষে কত টাকা বাড়ি নিতে পারছে– এসব ভাবতে রাজনৈতিক দলগুলোর বয়েই গেল! ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীর দল নিজেদের নীতি ও আদর্শ প্রচার করবে; সবার প্রধান লক্ষ্যই থাকবে সাধারণ মানুষকে নিজেদের দলে টানা– কখনও কর্মী হিসেবে, কখনও সমর্থক বা ভোটার হিসেবে। এটাই ছিল রাজনীতির দস্তুর। কিন্তু এখন আর তার দেখা নেই। ওসব বাসি কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনের রাজনীতিতে।

ধরা যাক, একটি বড় রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কোনো এক পদে তিনজন সদস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রথম প্রার্থী রাজনৈতিকভাবে প্রতিভাধর। তাঁর জনমত গঠন করার ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয়জনের প্রতিভা মাঝারি মানের এবং তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তৃতীয়জনের রাজনৈতিক প্রতিভা নেই বললেই চলে। এই শেষের জন নিজের স্বার্থেই দলের নেতাকে সর্বদা খুশি রাখার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেন– প্রতিযোগিতামূলক চাটুকারিতায় তিনি হয়তো পেরে উঠবেন না, কিন্তু চেষ্টা করতে বাধা নেই। তাই তিনিও যেটুকু প্রতিভা ছিল, তা জলাঞ্জলি দিয়ে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চেষ্টা করেন নেতার কৃপা পাওয়ার। প্রথমজন জানেন– নেতা তাঁকে কোনোদিন ক্ষমতার কাছাকাছি আনবেন না। কারণ তিনি নেতার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতার কারণ। নিশ্চিতভাবে জেনে নিন– সর্বময় নেতা ওই নিম্ন প্রতিভার ব্যক্তিকেই কৃপা দেখাবেন। 

সুধীর সাহা: কলাম লেখক
ceo@ilcb.net