- কালের খেয়া
- এক দূর স্তেপবাসিনীর গল্প
এক দূর স্তেপবাসিনীর গল্প

কাজাখস্তানের বিস্তীর্ণ স্তেপ প্রান্তর
শিম্বুলাক পর্বতের পাদদেশের সমতল অববাহিকায় দাঁড়িয়ে অদূরে বহমান ঝরনার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পাই। আমার গো- প্রো ক্যামেরা দিয়ে সেটি ভিডিও করার উদ্যোগ নিলে বুঝতে পারি কোনো এক অজানা কারণে ক্যামেরার স্মৃতিকোষ পরিপূর্ণ। তাই ওটি দিয়ে এ মুহূর্তে আর কিছু করা সম্ভব নয়। ক্যামেরা নিয়ে আমার এই গুতোগুতি দেখে রিতা কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে ওঠে, 'এ জন্যেই আমি এসবের ঝামেলায় যাই না। যেখানেই যাই, মনের ক্যামেরাতেই ছবি তুলে রাখি।' তারপর আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বহু দূরে ঝলসে ওঠা তুষারস্নাত পাহাড়চূড়ার দিকে তাকায়। সেই চূড়াটিকে কিছুক্ষণের মাঝেই ঝাপসা করে ফেলে রিতার মুখনিঃসৃত সিগারেটের ধূম্র কুণ্ডলী। মেয়েটির ধূমপানের নেশা বোধ করি প্রবল। এখানে আসবার সময়ে বাসে বাদুড়ঝোলা অবস্থায় যে ত্রিশ মিনিট থাকতে হয়েছে, সেই সময়েই ওর হাত বেশ কয়েকবার আনমনে ছুঁয়েছে সিগারেটের টকটকে লাল মোড়ক। নেহাত-ই বাসের ভেতরে বলে হয়তো ওকে স্ব-নিবৃত্ত হতে হয়েছে।
এবারে এখানে বাস থেকে নামার পর একটু সুবিধেমতো জায়গা পেয়ে আগেই বলে নিয়েছে, হাইকিং-এ বউনি করার আগে কিছুটা ধোঁয়া না গিললে ওর পক্ষে এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। এমন নিরালা বিজনে স্থানীয় ভাষা জানা এই তরুণী যেহেতু আমার একমাত্র সম্বল, তাই কিছুটা সময়ের তাড়া থাকা সত্ত্বেও এটুকু বিলম্ব আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।
রিতা নামটি শুনে ভারতীয় মনে হলেও, আদতে ও ভারতীয় নয়। অন্যদিকে কাজাখ-ও যে নয়, সে-তো মুখশ্রী দেখেই আন্দাজ করা যায়। চেস্টনাট রঙের কুন্তলধারিণী এই রমণীর চোখের মণি টারকুইস পাথরের ন্যায় ঘন নীল। তবে কি ও রুশি? কাজাখস্তানে তো জনসংখ্যার প্রায় পনেরো শতাংশই রুশি। রুশি বাদে বাকিদের মুখের গড়ন কিছুটা মঙ্গোলয়েড ধাঁচের। কিন্তু না, রিতা নাকি রুশ-ও নয়। জাতপাতের পরিচয় নিতে গেলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ধমনীতে প্রবহমান রক্তের নিরিখে ওকে হয়তো জার্মান বলা যেতে পারে। পশ্চিম রাশিয়ার সীমান্তে এককালে বেশ সংখ্যক জার্মানের বসত ছিল। রিতার মায়ের দিককার বংশ তেমনই একটি পরিবার। তবে স্তালিনের সময়ে নির্বাসিত হয়ে চলে আসে ধু-ধু প্রান্তরের দেশ কাজাখস্তানের কারাগান্দিতে। শ্রমশিবিরে। সেখানেই রিতার মায়ের জন্ম। মায়ের দিককার বংশপরিচয় নিয়ে কিছুটা মুখ খুললেও পিতৃপরিচয়ের বেলায় কেবল ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করে পিতা দাগেস্তানের লোক। সেই সাথে মুখের মাংসপেশিতে কঠোরতার ঢেউ জাগিয়ে জানিয়ে রাখে, পিতাকে নিয়ে বেশি আলোচনায় ও আগ্রহী নয়।
রিতার সাথে পরিচয় ঘণ্টা দুয়েক আগে। আমার হোটেলের, মানে 'হোটেল কাজাখস্তান'-এর উল্টোদিকে কাজাখ পর্যটন দপ্তরের এক খুপরি ঘরে। আমি শিম্বুলাক পর্বতে হাইকিং-এ যাবার পথনিশানা চাইলে সেখানে কর্মরত কলেজ পড়ুয়া যুবক ছেলেটি রিতার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, 'আরে, এই মেয়েটিও তো একই পথের সন্ধান করছিল।'
মেয়েটিকে আমি আগেই এই যুবকের সাথে রুশ ভাষায় কথা কইতে দেখেছি। অতএব, সে যে আমার মত বিদেশি নয়, সেটি জলের মতো পরিস্কার। যুবক এবারে রিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা এই বিদেশিকে তোমার সাথে নিয়ে যাও না! তাহলে আমাকে আবার নতুন করে সবকিছু বোঝাতে হয় না। কাজ বাঁচে।'
মেয়েটি প্রথমে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। তারপর এমন এক প্রশ্ন করে বসে, যাতে আমি রীতিমতো বিষম খাই।
'তোমার কোনো কুমতলব নেই তো?'
ক্ষণিকের জন্যে মনে প্রশ্ন জাগে, আমার চেহারা কি বাংলা সিনেমার নারী-নিপীড়ক খলনায়কদের মতো? নতুবা মেয়েটির মনে এমন প্রশ্ন জাগবে কেন? নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা ত্বরিত সামলে নিয়ে বলি, 'সত্যিকারের কুমতলব যদি থেকেও থাকে, তবুও-বা তোমার কাছে সুড়সুড় করে কবুল করব কেন? তুমি কি থানার বড় দারোগা? তার চেয়ে বলি কী, আমার সাথে বরং দু-চার কদম চলেই দেখ। নিজেই বুঝে নেবে ক্ষণ কেমন ধারার লোক আমি!'
সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিতা অভ্যেসমাফিক সিগারেট ধরায়। হাতে ধরে রাখা প্যাকেটটির গায়ে লেখা 'এল-ডি' সাইন দেখে বুঝি সেটি প্রখ্যাত রুশ সিগারেট কোম্পানি লিগে ডুকাত-এর প্যাকেট। আমাদের উল্টোদিকের রাস্তায় পিচঢালার কাজ চলছে। পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে সড়ক মেরামতের কাজে লাগবার মিহি বালি। সেখানে কিছুটা ছাই ফেলে রিতা উল্টোদিকের কাজাখস্তান হোটেলের ছাব্বিশ তলা ভবনটির দিকে নির্দেশ করে বলে, 'সো, আর ইউ স্টেয়িং ইন দিস হোটেল?' ছাদের মাথায় রাজমুকুটের ন্যায় নকশা লাগানো এই হোটেলটি তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত জমানায়। সেকালে আলমাটি কিন্তু ছিল কাজাখ প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। কাজেই এই হোটেলটি ছিল শহরের মধ্যমণি। পরে অবশ্য কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভের পর তেল বিক্রির কড়কড়ে টাকায় বিরান মরুভূমির মাঝে আস্তানা নামক শহরে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর থেকে কিছুটা হলেও গুরুত্ব হারায় আলমাটি, জৌলুস হারায় হোটেল কাজাখস্তান। এ শহরে এসে এমন এক ঐতিহ্যবাহী হোটেলে থাকবার লোভ সামলাতে পারিনি। উঠেছি তেরো তলার কোণের দিকের রুমে, জানালা খুললে পুরো আলমাটি শহরটা যেখান থেকে ঝলমলিয়ে ওঠে। আমি তাই রিতার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লে বুর্জোয়াদের প্রতি ছুড়ে দেয়া বামপন্থিদের শ্নাঘাশ্রিত বক্রোক্তির মতোই আমাকে শুনতে হয়, ' ও, ইউ মাস্ট বি এ রিচ পারসন দেন।' যদিও সত্যি কথা হলো, পড়ন্ত গ্রীষ্ফ্মের সময় বলে এখন হোটেলের খরচ বেজায় কম, আর যে টাকায় এখানে সুইট ভাড়া পেয়েছি, সে টাকায় আমেরিকায় সবচেয়ে সস্তা হোটেল-মোটেল সিঙ্কেও এক রাত থাকা সম্ভব নয়। তবে সে-সব নিয়ে রিতার সাথে তক্ক বাধিয়ে লাভ নেই। আমি তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করি, 'তা তুমি কি আলমাটি'তে এই প্রথম? ওখানে ম্যাপ দেখে সারা শহরের রাস্তা বুঝে নিচ্ছিলে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করলাম।'
'ছোট শহরের মেয়ে আমি। তবে তাই বলে আবার ভেব না, দিন-দুনিয়ার আর কোথাও যাইনি। বছর তিন আগে আমেরিকা গিয়েও ঘুরে এসেছি। আলমাটিতে আসা হয়নি যদিও এর আগে।' রিতা আমেরিকায় গিয়েছিল পর্যটন ভিসায়। এক মাসের জন্যে। তবে শেষ অবধি টেনিসির গেটলিনবার্গ নামক এক শৈলনিবাসে গুজারাটি মালিকের মোটেলে ক্যাশ টাকায় কাজ জুটে যাওয়ায় আরও ছয় মাস কাটিয়ে তবেই দেশে ফেরে। তাতে করে অবশ্য ভালো হয় যে, ইংরেজিটা বেশ করে শেখা হয় ওর। আমার সাথে যে বেশ নির্বিঘ্নে আলাপ করছে, সেটা করতে পারছে সেই সময়ে শেখা ইংরেজির কল্যাণেই।
সাতাশ নম্বর বাস শম্বুক গতিতে আমাদের সামনে এসে থামে। ভেতরে বসার জায়গা নেই। হাতল ধরে ঝুলে থাকি অগত্যা। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বাস চলতে শুরু করলে রিতার কাছ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্নের বুলেটে বিদ্ধ হই, 'তোমরা ভারতীয়রা পয়সা নিয়ে ঝামেলা কর কেন বলত?' অদ্ভুত ব্যাপার। আমি? ভারতীয়? পয়সা? মানে কী? এমন বেখাপ্পা প্রশ্ন শুনে ইচ্ছে হয়, কলতলায় গিয়ে কয়েক ঘটি ঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে একটু ধাতস্থ হই। যাই হোক, সেসব যেহেতু এই চলন্ত বাসে সম্ভব নয়, তাই রিতাকে ওর প্রশ্নের মর্মোদ্ধার করবার আহ্বান জানাই। তাতে যা জানতে পারি সেটি হলো এমনূ গণ্ডগোলটি বাধে সেই গুজরাটি মালিকের মোটেলে। ওর যেহেতু কাজের পারমিট নেই, তাই রফা হয়, মালিক ওকে ক্যাশে পেমেন্ট দেবে। চেকে নয়। আর সেখানেই সেই মালিক চাতুরীর আশ্রয় নেয়। ঘণ্টাভিত্তিক মজুরি তো ওকে কম দিত-ই, সেই সাথে বারো ঘণ্টা কাজ করলে ধরিয়ে দিত আট ঘণ্টার টাকা। অর্থাৎ, ওর পরিস্থিতির সুযোগ নিত সেই অর্থগৃধ্নু অসাধু ব্যক্তি। সেই থেকে ভারতীয় চেহারার যে কাউকে দেখলেই রিতা অতিমাত্রায় সরলকৃত সমীকরণ কষে বিরাট একটা ভুল করে বসে।
রিতা আর আমি ক্যাবল কারে চাপি। শুধু আমরা দু'জনেই। এই দুপুরের সময়টায় তেমন একটা ভিড়ভাট্টা নেই। আমি বসেছি ওপরের সামিটের দিকে মুখ করে, আর রিতা নিচের ভ্যালিকে চোখের সামনে রেখে। কারের ভেতরটায় দু'দিকে বড় করে এয়ার-আস্তানার বিজ্ঞাপন।
খুব ধীরে পাহাড় বেয়ে উঠছে ক্যাবল কারটি। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দেখা যায়, নিচে কার্পেটের মতো ছড়িয়ে থাকা লাইলাকের ঝোপ। দুপুরের মিঠে রোদ সেই গালিচায় প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে বেগুনিবর্ণা আলোক তরঙ্গ। আরও বহু দূরে খাড়া এক পাহাড়ের পাথর ধরে উঁচুতে ওঠার কসরতরত কয়েক অভিযাত্রীকে দেখায় অনেকটা যেন পেয়ারা গাছের কাণ্ড বেয়ে ওঠা পিঁপড়ের সারির মতো। আমি সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে রিতার সমুদ্রনীল চোখের মণিতে ফোকাস করি। আমার দৃষ্টিতে প্রশংসাসূচক কিছু একটা আঁচ করতে পেরে রিতা ব্যাকপ্যাক থেকে পার্স বের করে ঝট করে ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় কিছুটা উজ্জ্বল লিপস্টিক। পাশের জানালার কাচটিকে আয়না বানিয়ে ও যখন দেখে নিচ্ছে লিপস্টিকের রেখা, তখন আমি আচমকাই জিজ্ঞেস করি, 'রোহিত বিদায় নেবার পর আর কেউ আসেনি তোমার জীবনে?'
যেন এক মহা খেলো প্রশ্ন করে ফেলেছি, তাই কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ও বলে, 'আসবে না কেন? এসেছে। এই ধরো, সেলুনে চুল কাটার নাপিত কিংবা বাড়ি ঠিক করার রাজমিস্ত্রি। কিছু ডেটিং অ্যাপের সাহায্য-ও নিয়েছিলাম। কাজ হয়নি। ছোট শহর। উপযুক্ত পাত্র নাই।'
'তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, আমার মাঝে মেয়েলিপনার অভাব-ই হয়তো আমার সঙ্গী না জোটার কারণ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রিতা বলে। মধ্যবর্তী পাহাড়ে গেঁথে থাকা এক পোল থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁক নেয়ায় আমাদের বগিটি ঠিক সে ক্ষণে বিপজ্জনকভাবে দুলে ওঠে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে দরজার হাতল চেপে ধরি। রিতার মধ্যে অবশ্য তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। বগির কম্পনটা কিছুটা কমে এলে আমি বলি, 'কাউকে দ্রুত নিরীক্ষা করে ছকে ফেলে দেয়াটা মস্ত অনুচিত কাজ বলে মনে হয়। তোমার জীবনের কতটাই-বা জানি আমি!'
ক্যাবল কার আমাদেরকে সামিটে নামিয়ে দেয়।
আমরা পাথরের সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পয়দলে যাত্রা শুরু করি। দু'জনে ঠিক একই কদমে চলা সম্ভব হচ্ছে না। আমি বেশ এগিয়ে চলেছি। কয়েকশ' ফুট যাবার পর চারদিকে কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা এসে গ্রাস করল। শুধু শুনতে পাই পেছনে রিতার পায়ে লেগে গড়িয়ে পড়া প্রস্তরখণ্ডের ছন্দায়িত শব্দ। এ পথে খুব বেশি হাইকারও নেই। এ পর্যন্ত কেবল একজনকে চোখে পড়েছে। কাঁধে বিশাল এক ব্যাকপ্যাক নিয়ে ভদ্রলোক নিচে নেমে চলেছেন। খুব সম্ভবত ইনি ওপরে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, সাথের সাজ সরঞ্জাম তেমনটাই নির্দেশ করে। ফ্লাক্স খুলে জল খাবার মুহূর্তে তার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়। ডান হাতে হাইকিং স্টিক উঁচিয়ে তিনি 'জয় হোক' ধরনের একটি ভঙ্গিমা করেন। এদিকে রিতা কিন্তু বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। ধূসর দুটি পর্বতের মাঝকার পথে বাঁক নেবার মুহূর্তে হটাৎ মনে হয়, আমাদের দু'জনের মাঝে দূরত্ব খুব বেশি না রাখাই হয়তো ভালো। এতটা উঁচুতে যদিও বাঘ-ভালুকের ভয় নেই, তবুও সাবধানের মার নেই। আমি তাই সমতল পৃষ্ঠের একটি পাথর খুঁজে বের করে সেখানে রিতার প্রতীক্ষায় বসে থাকি।
'আর ইউ অলরেডি টায়ার্ড?' হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রিতার প্রশ্ন। যদিও কে যে বেশি টায়ার্ড, সেটি ওর বুকের হাঁপর-ই বলে দিচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে আবারও এগোবার উপক্রম করলে রিতা আমার পাশেই ধপ করে বসে পড়ে। 'ম্যান, আই এম ডুইং দিস হাইকিং আফটার আ লং টাইম।' তারপর আর যেন এগোবার একদম ইচ্ছে নেই, এই ভঙ্গিতে পা ছড়িয়ে আবারও সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ায়। এখানে হাওয়াটা ভারি, কিছুটা জমাট বাঁধা। মনে হয়, যেন একই হাওয়া ঘনায়িত হয়ে খুব ধীরে ঘুরপাক খাচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝে। এমন এক পরিবেশে সিগারেটের এই কৃত্রিম ধোঁয়াটাকে কিছুটা অস্বস্তিকর মনে হয়। কিন্তু চারপাশে তো আর কোথাও 'ধূমপান নিষেধ' এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি টানানো নেই, তাই রিতাকে ঠেকায় কে? আমি অগত্যা একটু তফাতে গিয়ে ভিন্ন এক পাথরের ওপর বসি।
'আচ্ছা, তুমি কখনও রাশিয়ায় গিয়েছ?'- আমি জিজ্ঞেস করি। পোড়া কপাল আমার। এই আপাত নিরীহ প্রশ্নটি যেন সমুদ্রতলে ডুবে থাকা তীক্ষষ্ট হিমবাহ খণ্ডের মতো চিরে দেয় রিতার অন্তরাত্মা। হাতের মুঠোয় থাকা ছাই বর্ণা ছোট নুড়িপাথরকে বহু দূরে ছুড়ে দিয়ে আক্রোশ মিশ্রিত কণ্ঠে ও বলে, 'গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। আমার এক জ্ঞাতি বোনের শহর আস্ত্রাখানে। তবে না গেলেই হয়তো ভালো হতো। অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যের মুখোমুখি হতে হতো না।' রিতার চোখের কোণে আর্দ্রতার উপস্থিতিটা আমি ঠিকই ধরে ফেলি। সেই মুহূর্তে খুব ধীরে এক পাল মেঘ এসে ঢেকে দেয় শিম্বুলাকের ধবল চূড়াকে। তাতে করে রোদের ঝলমলে ভাবটা কেটে গিয়ে চারদিক ঢেকে যায় ছায়ামালার রিক্ত বসনে। সেই একই রিক্ততা, একই তমসা যেন আচ্ছন্ন করে রিতার মুখায়বকেও। ওর গলায় ঝুলে থাকা ব্রোঞ্জের যে ক্রসটি এতক্ষণ সূর্যালোকে ঝলমল করছিল, সেটিও এক্ষণে হটাৎ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। নতমুখী হয়ে অনামিকার নখ খুঁটিয়ে নেলপলিশের আস্তর খুবলে নেবার মুহূর্তে খুব ধীরে আমাকে শোনায়, ' আমার জন্মের কয়েক বছর পরেই আমার বাপ মা- কে ফেলে দাগেস্তানে চলে যায়। তারপর আর কখনও আমার কিংবা মায়ের কোনো খোঁজখবর নেয়নি। সে-বারে রাশিয়া গিয়ে জানলাম, দাগেস্তানে গিয়ে সে জুটে গিয়েছিল এক মৌলবাদী চরমনপন্থি দলের সাথে। ফলাফল যা হবার তা-ই। একদিন সরকারি বাহিনীর অ্যামবুশে হঠাৎ মারা পড়ে।' দু'হাত দিয়ে নিজের মুখটাকে আড়াল করে ও এবারে ফিসফিসিয়ে বলে, 'এই অপদার্থ বাপের কথা এখানে যদি কেউ জানতে পারে, তবে পুলিশ হয়তো আমাকেও অনেক ভোগাবে। বেঁচে থাকার কালেও শান্তি দিল না, আর এখন মরে গিয়েও যেন দোরের কাছটায় বাবলা গাছের কাঁটা বিছিয়ে গেছে।' রিতার শেষ কথাগুলো যেন গুমোট হাওয়ার আবর্তে পড়ে আশেপাশেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। শুধু সেই হাওয়া-ই নয়, বহু দূর আকাশে তাকিয়ে দেখি, নিশানা ঠিক করে মেঘের অন্তরালে চক্রাকারে ঘুরছে বিশালাকারের সোনালি ঈগল। কাজাখস্তানের জাতীয় পাখি। ঈগলটা কি এবারে নিচে নেমে আসতে চাইছে? নাকি আকাশের কক্ষপথেই ঘুরপাক খেয়ে খুঁজে নিচ্ছে সম্ভাব্য শিকার? সেসব নিয়ে চিন্তায় স্পষ্টতই ব্যাঘাত ঘটে, যখন দেখি রিতা পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও হাঁটার জন্যে দম নিচ্ছে। আমাকেও অগত্যা উঠতে হয়। আজ সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই পুরোটা পথ পরিভ্রমণ শেষ হবে কিনা কে জানে!
এবারে এখানে বাস থেকে নামার পর একটু সুবিধেমতো জায়গা পেয়ে আগেই বলে নিয়েছে, হাইকিং-এ বউনি করার আগে কিছুটা ধোঁয়া না গিললে ওর পক্ষে এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। এমন নিরালা বিজনে স্থানীয় ভাষা জানা এই তরুণী যেহেতু আমার একমাত্র সম্বল, তাই কিছুটা সময়ের তাড়া থাকা সত্ত্বেও এটুকু বিলম্ব আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।
রিতা নামটি শুনে ভারতীয় মনে হলেও, আদতে ও ভারতীয় নয়। অন্যদিকে কাজাখ-ও যে নয়, সে-তো মুখশ্রী দেখেই আন্দাজ করা যায়। চেস্টনাট রঙের কুন্তলধারিণী এই রমণীর চোখের মণি টারকুইস পাথরের ন্যায় ঘন নীল। তবে কি ও রুশি? কাজাখস্তানে তো জনসংখ্যার প্রায় পনেরো শতাংশই রুশি। রুশি বাদে বাকিদের মুখের গড়ন কিছুটা মঙ্গোলয়েড ধাঁচের। কিন্তু না, রিতা নাকি রুশ-ও নয়। জাতপাতের পরিচয় নিতে গেলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ধমনীতে প্রবহমান রক্তের নিরিখে ওকে হয়তো জার্মান বলা যেতে পারে। পশ্চিম রাশিয়ার সীমান্তে এককালে বেশ সংখ্যক জার্মানের বসত ছিল। রিতার মায়ের দিককার বংশ তেমনই একটি পরিবার। তবে স্তালিনের সময়ে নির্বাসিত হয়ে চলে আসে ধু-ধু প্রান্তরের দেশ কাজাখস্তানের কারাগান্দিতে। শ্রমশিবিরে। সেখানেই রিতার মায়ের জন্ম। মায়ের দিককার বংশপরিচয় নিয়ে কিছুটা মুখ খুললেও পিতৃপরিচয়ের বেলায় কেবল ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করে পিতা দাগেস্তানের লোক। সেই সাথে মুখের মাংসপেশিতে কঠোরতার ঢেউ জাগিয়ে জানিয়ে রাখে, পিতাকে নিয়ে বেশি আলোচনায় ও আগ্রহী নয়।
রিতার সাথে পরিচয় ঘণ্টা দুয়েক আগে। আমার হোটেলের, মানে 'হোটেল কাজাখস্তান'-এর উল্টোদিকে কাজাখ পর্যটন দপ্তরের এক খুপরি ঘরে। আমি শিম্বুলাক পর্বতে হাইকিং-এ যাবার পথনিশানা চাইলে সেখানে কর্মরত কলেজ পড়ুয়া যুবক ছেলেটি রিতার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, 'আরে, এই মেয়েটিও তো একই পথের সন্ধান করছিল।'
মেয়েটিকে আমি আগেই এই যুবকের সাথে রুশ ভাষায় কথা কইতে দেখেছি। অতএব, সে যে আমার মত বিদেশি নয়, সেটি জলের মতো পরিস্কার। যুবক এবারে রিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা এই বিদেশিকে তোমার সাথে নিয়ে যাও না! তাহলে আমাকে আবার নতুন করে সবকিছু বোঝাতে হয় না। কাজ বাঁচে।'
মেয়েটি প্রথমে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। তারপর এমন এক প্রশ্ন করে বসে, যাতে আমি রীতিমতো বিষম খাই।
'তোমার কোনো কুমতলব নেই তো?'
ক্ষণিকের জন্যে মনে প্রশ্ন জাগে, আমার চেহারা কি বাংলা সিনেমার নারী-নিপীড়ক খলনায়কদের মতো? নতুবা মেয়েটির মনে এমন প্রশ্ন জাগবে কেন? নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা ত্বরিত সামলে নিয়ে বলি, 'সত্যিকারের কুমতলব যদি থেকেও থাকে, তবুও-বা তোমার কাছে সুড়সুড় করে কবুল করব কেন? তুমি কি থানার বড় দারোগা? তার চেয়ে বলি কী, আমার সাথে বরং দু-চার কদম চলেই দেখ। নিজেই বুঝে নেবে ক্ষণ কেমন ধারার লোক আমি!'
সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিতা অভ্যেসমাফিক সিগারেট ধরায়। হাতে ধরে রাখা প্যাকেটটির গায়ে লেখা 'এল-ডি' সাইন দেখে বুঝি সেটি প্রখ্যাত রুশ সিগারেট কোম্পানি লিগে ডুকাত-এর প্যাকেট। আমাদের উল্টোদিকের রাস্তায় পিচঢালার কাজ চলছে। পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে সড়ক মেরামতের কাজে লাগবার মিহি বালি। সেখানে কিছুটা ছাই ফেলে রিতা উল্টোদিকের কাজাখস্তান হোটেলের ছাব্বিশ তলা ভবনটির দিকে নির্দেশ করে বলে, 'সো, আর ইউ স্টেয়িং ইন দিস হোটেল?' ছাদের মাথায় রাজমুকুটের ন্যায় নকশা লাগানো এই হোটেলটি তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত জমানায়। সেকালে আলমাটি কিন্তু ছিল কাজাখ প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। কাজেই এই হোটেলটি ছিল শহরের মধ্যমণি। পরে অবশ্য কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভের পর তেল বিক্রির কড়কড়ে টাকায় বিরান মরুভূমির মাঝে আস্তানা নামক শহরে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর থেকে কিছুটা হলেও গুরুত্ব হারায় আলমাটি, জৌলুস হারায় হোটেল কাজাখস্তান। এ শহরে এসে এমন এক ঐতিহ্যবাহী হোটেলে থাকবার লোভ সামলাতে পারিনি। উঠেছি তেরো তলার কোণের দিকের রুমে, জানালা খুললে পুরো আলমাটি শহরটা যেখান থেকে ঝলমলিয়ে ওঠে। আমি তাই রিতার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লে বুর্জোয়াদের প্রতি ছুড়ে দেয়া বামপন্থিদের শ্নাঘাশ্রিত বক্রোক্তির মতোই আমাকে শুনতে হয়, ' ও, ইউ মাস্ট বি এ রিচ পারসন দেন।' যদিও সত্যি কথা হলো, পড়ন্ত গ্রীষ্ফ্মের সময় বলে এখন হোটেলের খরচ বেজায় কম, আর যে টাকায় এখানে সুইট ভাড়া পেয়েছি, সে টাকায় আমেরিকায় সবচেয়ে সস্তা হোটেল-মোটেল সিঙ্কেও এক রাত থাকা সম্ভব নয়। তবে সে-সব নিয়ে রিতার সাথে তক্ক বাধিয়ে লাভ নেই। আমি তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করি, 'তা তুমি কি আলমাটি'তে এই প্রথম? ওখানে ম্যাপ দেখে সারা শহরের রাস্তা বুঝে নিচ্ছিলে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করলাম।'
'ছোট শহরের মেয়ে আমি। তবে তাই বলে আবার ভেব না, দিন-দুনিয়ার আর কোথাও যাইনি। বছর তিন আগে আমেরিকা গিয়েও ঘুরে এসেছি। আলমাটিতে আসা হয়নি যদিও এর আগে।' রিতা আমেরিকায় গিয়েছিল পর্যটন ভিসায়। এক মাসের জন্যে। তবে শেষ অবধি টেনিসির গেটলিনবার্গ নামক এক শৈলনিবাসে গুজারাটি মালিকের মোটেলে ক্যাশ টাকায় কাজ জুটে যাওয়ায় আরও ছয় মাস কাটিয়ে তবেই দেশে ফেরে। তাতে করে অবশ্য ভালো হয় যে, ইংরেজিটা বেশ করে শেখা হয় ওর। আমার সাথে যে বেশ নির্বিঘ্নে আলাপ করছে, সেটা করতে পারছে সেই সময়ে শেখা ইংরেজির কল্যাণেই।
সাতাশ নম্বর বাস শম্বুক গতিতে আমাদের সামনে এসে থামে। ভেতরে বসার জায়গা নেই। হাতল ধরে ঝুলে থাকি অগত্যা। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বাস চলতে শুরু করলে রিতার কাছ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্নের বুলেটে বিদ্ধ হই, 'তোমরা ভারতীয়রা পয়সা নিয়ে ঝামেলা কর কেন বলত?' অদ্ভুত ব্যাপার। আমি? ভারতীয়? পয়সা? মানে কী? এমন বেখাপ্পা প্রশ্ন শুনে ইচ্ছে হয়, কলতলায় গিয়ে কয়েক ঘটি ঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে একটু ধাতস্থ হই। যাই হোক, সেসব যেহেতু এই চলন্ত বাসে সম্ভব নয়, তাই রিতাকে ওর প্রশ্নের মর্মোদ্ধার করবার আহ্বান জানাই। তাতে যা জানতে পারি সেটি হলো এমনূ গণ্ডগোলটি বাধে সেই গুজরাটি মালিকের মোটেলে। ওর যেহেতু কাজের পারমিট নেই, তাই রফা হয়, মালিক ওকে ক্যাশে পেমেন্ট দেবে। চেকে নয়। আর সেখানেই সেই মালিক চাতুরীর আশ্রয় নেয়। ঘণ্টাভিত্তিক মজুরি তো ওকে কম দিত-ই, সেই সাথে বারো ঘণ্টা কাজ করলে ধরিয়ে দিত আট ঘণ্টার টাকা। অর্থাৎ, ওর পরিস্থিতির সুযোগ নিত সেই অর্থগৃধ্নু অসাধু ব্যক্তি। সেই থেকে ভারতীয় চেহারার যে কাউকে দেখলেই রিতা অতিমাত্রায় সরলকৃত সমীকরণ কষে বিরাট একটা ভুল করে বসে।
রিতা আর আমি ক্যাবল কারে চাপি। শুধু আমরা দু'জনেই। এই দুপুরের সময়টায় তেমন একটা ভিড়ভাট্টা নেই। আমি বসেছি ওপরের সামিটের দিকে মুখ করে, আর রিতা নিচের ভ্যালিকে চোখের সামনে রেখে। কারের ভেতরটায় দু'দিকে বড় করে এয়ার-আস্তানার বিজ্ঞাপন।
খুব ধীরে পাহাড় বেয়ে উঠছে ক্যাবল কারটি। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দেখা যায়, নিচে কার্পেটের মতো ছড়িয়ে থাকা লাইলাকের ঝোপ। দুপুরের মিঠে রোদ সেই গালিচায় প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে বেগুনিবর্ণা আলোক তরঙ্গ। আরও বহু দূরে খাড়া এক পাহাড়ের পাথর ধরে উঁচুতে ওঠার কসরতরত কয়েক অভিযাত্রীকে দেখায় অনেকটা যেন পেয়ারা গাছের কাণ্ড বেয়ে ওঠা পিঁপড়ের সারির মতো। আমি সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে রিতার সমুদ্রনীল চোখের মণিতে ফোকাস করি। আমার দৃষ্টিতে প্রশংসাসূচক কিছু একটা আঁচ করতে পেরে রিতা ব্যাকপ্যাক থেকে পার্স বের করে ঝট করে ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় কিছুটা উজ্জ্বল লিপস্টিক। পাশের জানালার কাচটিকে আয়না বানিয়ে ও যখন দেখে নিচ্ছে লিপস্টিকের রেখা, তখন আমি আচমকাই জিজ্ঞেস করি, 'রোহিত বিদায় নেবার পর আর কেউ আসেনি তোমার জীবনে?'
যেন এক মহা খেলো প্রশ্ন করে ফেলেছি, তাই কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ও বলে, 'আসবে না কেন? এসেছে। এই ধরো, সেলুনে চুল কাটার নাপিত কিংবা বাড়ি ঠিক করার রাজমিস্ত্রি। কিছু ডেটিং অ্যাপের সাহায্য-ও নিয়েছিলাম। কাজ হয়নি। ছোট শহর। উপযুক্ত পাত্র নাই।'
'তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, আমার মাঝে মেয়েলিপনার অভাব-ই হয়তো আমার সঙ্গী না জোটার কারণ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রিতা বলে। মধ্যবর্তী পাহাড়ে গেঁথে থাকা এক পোল থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁক নেয়ায় আমাদের বগিটি ঠিক সে ক্ষণে বিপজ্জনকভাবে দুলে ওঠে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে দরজার হাতল চেপে ধরি। রিতার মধ্যে অবশ্য তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। বগির কম্পনটা কিছুটা কমে এলে আমি বলি, 'কাউকে দ্রুত নিরীক্ষা করে ছকে ফেলে দেয়াটা মস্ত অনুচিত কাজ বলে মনে হয়। তোমার জীবনের কতটাই-বা জানি আমি!'
ক্যাবল কার আমাদেরকে সামিটে নামিয়ে দেয়।
আমরা পাথরের সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পয়দলে যাত্রা শুরু করি। দু'জনে ঠিক একই কদমে চলা সম্ভব হচ্ছে না। আমি বেশ এগিয়ে চলেছি। কয়েকশ' ফুট যাবার পর চারদিকে কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা এসে গ্রাস করল। শুধু শুনতে পাই পেছনে রিতার পায়ে লেগে গড়িয়ে পড়া প্রস্তরখণ্ডের ছন্দায়িত শব্দ। এ পথে খুব বেশি হাইকারও নেই। এ পর্যন্ত কেবল একজনকে চোখে পড়েছে। কাঁধে বিশাল এক ব্যাকপ্যাক নিয়ে ভদ্রলোক নিচে নেমে চলেছেন। খুব সম্ভবত ইনি ওপরে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, সাথের সাজ সরঞ্জাম তেমনটাই নির্দেশ করে। ফ্লাক্স খুলে জল খাবার মুহূর্তে তার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়। ডান হাতে হাইকিং স্টিক উঁচিয়ে তিনি 'জয় হোক' ধরনের একটি ভঙ্গিমা করেন। এদিকে রিতা কিন্তু বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। ধূসর দুটি পর্বতের মাঝকার পথে বাঁক নেবার মুহূর্তে হটাৎ মনে হয়, আমাদের দু'জনের মাঝে দূরত্ব খুব বেশি না রাখাই হয়তো ভালো। এতটা উঁচুতে যদিও বাঘ-ভালুকের ভয় নেই, তবুও সাবধানের মার নেই। আমি তাই সমতল পৃষ্ঠের একটি পাথর খুঁজে বের করে সেখানে রিতার প্রতীক্ষায় বসে থাকি।
'আর ইউ অলরেডি টায়ার্ড?' হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রিতার প্রশ্ন। যদিও কে যে বেশি টায়ার্ড, সেটি ওর বুকের হাঁপর-ই বলে দিচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে আবারও এগোবার উপক্রম করলে রিতা আমার পাশেই ধপ করে বসে পড়ে। 'ম্যান, আই এম ডুইং দিস হাইকিং আফটার আ লং টাইম।' তারপর আর যেন এগোবার একদম ইচ্ছে নেই, এই ভঙ্গিতে পা ছড়িয়ে আবারও সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ায়। এখানে হাওয়াটা ভারি, কিছুটা জমাট বাঁধা। মনে হয়, যেন একই হাওয়া ঘনায়িত হয়ে খুব ধীরে ঘুরপাক খাচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝে। এমন এক পরিবেশে সিগারেটের এই কৃত্রিম ধোঁয়াটাকে কিছুটা অস্বস্তিকর মনে হয়। কিন্তু চারপাশে তো আর কোথাও 'ধূমপান নিষেধ' এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি টানানো নেই, তাই রিতাকে ঠেকায় কে? আমি অগত্যা একটু তফাতে গিয়ে ভিন্ন এক পাথরের ওপর বসি।
'আচ্ছা, তুমি কখনও রাশিয়ায় গিয়েছ?'- আমি জিজ্ঞেস করি। পোড়া কপাল আমার। এই আপাত নিরীহ প্রশ্নটি যেন সমুদ্রতলে ডুবে থাকা তীক্ষষ্ট হিমবাহ খণ্ডের মতো চিরে দেয় রিতার অন্তরাত্মা। হাতের মুঠোয় থাকা ছাই বর্ণা ছোট নুড়িপাথরকে বহু দূরে ছুড়ে দিয়ে আক্রোশ মিশ্রিত কণ্ঠে ও বলে, 'গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। আমার এক জ্ঞাতি বোনের শহর আস্ত্রাখানে। তবে না গেলেই হয়তো ভালো হতো। অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যের মুখোমুখি হতে হতো না।' রিতার চোখের কোণে আর্দ্রতার উপস্থিতিটা আমি ঠিকই ধরে ফেলি। সেই মুহূর্তে খুব ধীরে এক পাল মেঘ এসে ঢেকে দেয় শিম্বুলাকের ধবল চূড়াকে। তাতে করে রোদের ঝলমলে ভাবটা কেটে গিয়ে চারদিক ঢেকে যায় ছায়ামালার রিক্ত বসনে। সেই একই রিক্ততা, একই তমসা যেন আচ্ছন্ন করে রিতার মুখায়বকেও। ওর গলায় ঝুলে থাকা ব্রোঞ্জের যে ক্রসটি এতক্ষণ সূর্যালোকে ঝলমল করছিল, সেটিও এক্ষণে হটাৎ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। নতমুখী হয়ে অনামিকার নখ খুঁটিয়ে নেলপলিশের আস্তর খুবলে নেবার মুহূর্তে খুব ধীরে আমাকে শোনায়, ' আমার জন্মের কয়েক বছর পরেই আমার বাপ মা- কে ফেলে দাগেস্তানে চলে যায়। তারপর আর কখনও আমার কিংবা মায়ের কোনো খোঁজখবর নেয়নি। সে-বারে রাশিয়া গিয়ে জানলাম, দাগেস্তানে গিয়ে সে জুটে গিয়েছিল এক মৌলবাদী চরমনপন্থি দলের সাথে। ফলাফল যা হবার তা-ই। একদিন সরকারি বাহিনীর অ্যামবুশে হঠাৎ মারা পড়ে।' দু'হাত দিয়ে নিজের মুখটাকে আড়াল করে ও এবারে ফিসফিসিয়ে বলে, 'এই অপদার্থ বাপের কথা এখানে যদি কেউ জানতে পারে, তবে পুলিশ হয়তো আমাকেও অনেক ভোগাবে। বেঁচে থাকার কালেও শান্তি দিল না, আর এখন মরে গিয়েও যেন দোরের কাছটায় বাবলা গাছের কাঁটা বিছিয়ে গেছে।' রিতার শেষ কথাগুলো যেন গুমোট হাওয়ার আবর্তে পড়ে আশেপাশেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। শুধু সেই হাওয়া-ই নয়, বহু দূর আকাশে তাকিয়ে দেখি, নিশানা ঠিক করে মেঘের অন্তরালে চক্রাকারে ঘুরছে বিশালাকারের সোনালি ঈগল। কাজাখস্তানের জাতীয় পাখি। ঈগলটা কি এবারে নিচে নেমে আসতে চাইছে? নাকি আকাশের কক্ষপথেই ঘুরপাক খেয়ে খুঁজে নিচ্ছে সম্ভাব্য শিকার? সেসব নিয়ে চিন্তায় স্পষ্টতই ব্যাঘাত ঘটে, যখন দেখি রিতা পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও হাঁটার জন্যে দম নিচ্ছে। আমাকেও অগত্যা উঠতে হয়। আজ সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই পুরোটা পথ পরিভ্রমণ শেষ হবে কিনা কে জানে!
বিষয় : সঞ্জয় দে স্তেপবাসিনী
মন্তব্য করুন