লাল শুধু পরিণয়ের মাঙ্গলিক রং নয়; তার মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর শৃঙ্গার সংকেত- এই বিশ্বাসকে কালচে অন্ধকারে রহস্যময় ও বিষণ্ণ আবহে যিনি সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন, তিনি ভারতীয় শিল্পী অমৃতা শেরগিল। তার আঁকা ব্রহ্মচারী চিত্রটি সে সাক্ষ্যই বহন করে, যেখানে তার ব্যক্তিগত যৌন জীবনের প্রতিবাদী রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন আশ্চর্য সাবলীলতায়। শুধু তাই নয়; ভারতীয় সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের একটি নিদিষ্ট প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বিস্ময়কর সংবেদনশীলতা দেখিয়েছিলেন সমস্ত সৃজনকর্মে। তার চিত্রকর্ম কঠিন বাস্তবতায় চিত্রিত করার দক্ষতার সাথে তিনি মানব মনের কুয়াশাচ্ছন্ন অনুভূতির স্তরকেও ভীষণ নিপুণতায় প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যা তার সমসাময়িক কোনো শিল্পীর মতো ছিল না। প্রাচ্যের চিত্রকলাকে আলোড়িত করে তোলা প্রাণশক্তিতে সমৃদ্ধ এই নারী শিল্পীকে নিয়ে যেমন আছে রহস্যময়তা তেমনি আছে তার প্রথা ভাঙার অদম্য সাহস সঞ্চারিত রং ও তুলির নিজস্ব অভিব্যক্তি।

তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন ক্ষণজন্মা হিসাবে, মাত্র আঠারো বছরেই সৃজন পরিবৃত্ত জীবনকে বিদায় জানিয়েছিলেন। জন্মেছিলেন ১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। অভিজাত শিখ পিতা উমরাও সিং শের-গিল মজীদিয়ায়, যিনি সংস্কৃত ও ফার্সির বিদ্বান ছিলেন এবং মাতা মারি আন্তোনিটেক গটস্‌মান ছিলেন হাঙ্গেরির ইহুদি অপেরা গায়ক। দুই কন্যার মধ্যে অমৃতা ছিলেন বড়। জন্মের পর থেকে হাঙ্গেরীয়-ইওরোপীয় সংস্কৃতিতে বড় হলেও অমৃতার আঁকা ছবি প্রমাণ করে, সচেতনভাবেই তিনি কত গভীরভাবে পিতৃভূমিকে লালন করতেন। অমৃতা পিতৃভূমি ভারতকেই নিজের স্বদেশচেতনায় স্থান দিয়েছিলেন। সেটা কি তার জীবনে, কি তার শিল্পচর্চায়। স্কুলে অধ্যয়নকালে ক্যাথলিক আচার-অনুষ্ঠানের নিন্দা করার অপরাধে ১৯২৪ সালে তিনি স্কুল থেকে বহিস্কৃৃত হন এবং শেষ পর্যন্ত এই কারণেই তার আনুষ্ঠানিক স্কুল শিক্ষার অবসান ঘটেছিল এবং পরে বেশিরভাগ সময় চিত্রাঙ্কন এবং পিয়ানো বাজানো শেখার জন্য ব্যয় করেছিলেন। অমৃতা তার জীবনে সর্বদাই একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। পরে তার অঙ্কনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তার চিত্রশিল্পী চাচা এরভিন বাকাতায়ের পরামর্শে প্যারিসের অন্যতম সেরা আর্ট স্কুল একাডেমি দে লা গ্র্যান্ডে চৌমিয়ার ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি ক্লাসের নীতি ও ধরন অনুসরণ না করে নিজস্ব স্টাইলের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।

তবে শিগগিরই তিনি সেখানে শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৩০ থেকে ৩২ সালের মধ্যে অমৃতা ৬০টির অধিক চিত্রকর্ম তৈরি করেছিলেন, যার বেশিরভাগে বিষয় হিসেবে ছিল জড় জীবন, ল্যান্ডস্কেপ এবং তার আত্ম প্রতিকৃতি। 'ইয়ং গার্ল' শিরোনামের একটি চিত্রকর্মের জন্য তিনি ১৯৩৩ সালে গ্র্যান্ড সেলন থেকে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। পরে তিনি ফ্রান্সের গ্র্যান্ড সেলনের এশীয়দের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, প্রথম ও একমাত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন, যা এখনও অনন্য রেকর্ড। তিনি তার অন্তর্নিহিত শিল্পের টানে দেশে ফিরে আসার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষার সূত্র ধরে ১৯৩৫ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং শিমলার গেটি থিয়েটারে কনসার্ট শিল্পী হিসেবেও নিয়োগ পান। বছরখানিক পরে দেশীয় ঐতিহ্যের সন্ধানে অমৃতা ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা শুরু করেন। যার ফলে তার পরবর্তী ছবিগুলোতে মিশ্রণ ঘটেছে ব্যক্তিগত জীবনে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার নানা বর্ণের সঙ্গে ভারতের দুর্দশাগ্রস্ত দরিদ্রদের মলিনতা। সেই সঙ্গে নারীমনের কামনা-বাসনা শক্তিমানরূপে প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্টিতে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে থ্রি গার্লস, ট্রাইবাল ওমেন শিরোনামের কাজ। ১৯৩৬ সালে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো শের-গিলের কাজ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে শুরু করে এবং এ সময় তিনি নয়াদিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস সোসাইটির ৫ম বার্ষিক প্রদর্শনীতে দুটি পুরস্কারও জিতেছিলেন। একই বছরে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে তার সেরা চিত্রকর্মের কয়েকটি হলো- গ্রুপ অব ইয়াং গার্লস, বালিকা বধূ, হিল উইমেন, পোর্ট্রেট অব মাই ফাদার এবং ভিলেজারস।
অজন্তা ও ইলোরা গুহার নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি দক্ষিণ ভারতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। অমৃতার দক্ষিণ ভারতীয় এই সফর তার সবচেয়ে বড় অর্জন বলে বিবেচিত হয়। এ সময়েই তার তিনটি উল্লেখযোগ্য কর্মের সূচনা হয়। যার প্রথমটি ছিল ব্রাইড টয়লেট, দ্বিতীয়টি ব্রহ্মচারী এবং তৃতীয়টি ছিল সাউথ ইন্ডিয়ান ভিলেজার গোয়িং টু মার্কেট। চিত্রকর্মগুলোকে বলা হয় শতাব্দীর সেরা চিত্রকর্ম। এসব ছবিতে অমৃতার লাল রঙের ব্যবহারে বিশেষ যত্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি বিষয়ের আবেদনে একটুখানি লালের মিশ্রণ যেন ভীষণ রহস্যে ঘেরা বিষণ্ণ আবহ সৃষ্টি করেছে। তার ভিন্ন আঙ্গিকে আঁকা ব্রহ্মচারী চিত্রটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পাঁচজন কিশোর সংসারত্যাগী ব্রাহ্মণকে ব্রহ্মচারীরূপে চিত্রপটে কী পবিত্রভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন! ছবিটির কোমল আলো-ছায়া দর্শককে যেন এক মায়াজালে আবদ্ধ করে বহির্মুখী আবহ থেকে অন্তর্মুখী টানে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি অসংখ্য ন্যুড চিত্র অঙ্কনে অনন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ন্যুড পেইন্টিং 'স্লিপিং ওমেন'। এটি শুভ্র বিছানায় ঘুমন্ত একজন নগ্ন যুবতী নারীর দৃশ্য। এই চিত্রটি যেন অবলীলায় মনে করিয়ে দেয় শিল্পী গুস্তাভ কুরবেটের 'স্লিপিং ন্যুড ওমেন'-এর দৃশ্যপট। কিন্তু অন্য শিল্পীদের ন্যুড ছবির পরিবর্তে অমৃতার এই তুলির ব্যঞ্জনা যেন অন্য রকম সুর তুলে চারপাশকে এক গভীর নিস্তব্ধতায় ভরিয়ে দেয়। যেখানে নগ্নতাকে ছাপিয়ে ঘুমের সৌন্দর্য কতটা মোহনীয় ও সুখকর হতে পারে তা অনুভব করা যাচ্ছে। তাহিতি দ্বীপে নগ্ন আত্মপ্রতিকৃতি তার সাহসিকতার আর এক প্রকাশ ঘটে। তিনি এখানে নিজেকে তাহিতি দ্বীপের একজন রমণী হিসেবে তুলে ধরেছেন। নিজেকে এই রূপে প্রকাশের মধ্যে তিনি যেন এক অসীম প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। কেননা, তার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল চিত্রশিল্পী মাস্টার পল গগ্যার দর্শন। তিনি অসম্ভব মুক্তপ্রাণ শক্তিতে পরিপূর্ণ একজন স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। শিখদের মাঝে জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রচলন নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ১৯৩৮ সালে প্রথাবিরোধী হয়েই জ্ঞাতি ভাই ইগানকেই বিয়ে করেন তিনি। এই মুক্তি বোধটি সব সময় তার শিল্প ও জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে বারবার দৃশ্যমান। অমৃতার ছবিজীবনের ইতি ঘটে 'ক্যমেলস' ও 'অ্যানসিয়েন্ট স্টোরিটেলার' শিরোনামের ছবি দুটির মধ্য দিয়েই। ১৯৪১ সালের ৫ ডিসেম্বর জরায়ুর রক্তপাতজনিত ইনফেকশনে এই মহান স্রষ্টার জীবনাবসান ঘটে।
নিঃসন্দেহে অমৃতার সময় থেকে তার ভাবনার গতিময়তা ছিল কয়েক প্রজন্ম আধুনিক। তিনি কেবল নিজের জীবন দিয়ে উদাহরণ স্থাপন করেননি, বরং বিভিন্নভাবে শিল্পকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিন্তু ভীষণ দুঃখজনক হলেও সত্যি, নানা জটিলতা আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সৃষ্ট অমৃতার অনন্য সাহসী, চিত্তাকর্ষক ও শৈল্পিক পরিচয়ে অনবদ্য সমস্ত শিল্পকে কণ্ঠরুদ্ধ করে বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে তার শারীরিক সৌন্দর্য ও ব্যক্তিগত যৌনজীবন। আবার কখনও অমৃতাকে ছাপিয়ে তার বিশেষ পরিচিতি হয়েছে 'ভারতীয় ফ্রিদা কালো' হিসেবে। তাতে বেশ অবাক হওয়ার মতো বিষয় আছে। অমৃতার সৃষ্টি কি তার নিজস্ব পরিচিতির জন্য যথেষ্ট নয়? স্পষ্টতই তার শিল্পকর্ম অন্য কারও তুলনার ঊর্ধ্বে। তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলে এক নির্বাক মুগ্ধতা যেন আপন মনেই বলে ওঠে- অমৃতা নিজেই নিজের পরিপূরক।