অফিসে ঢুকতে আজ তার দুই মিনিট দেরি হয়ে যায়। তার মহামূল্যবান একদম সাম্প্রতিক মডেলের ল্যান্ডরোভার গাড়িটা যখন আধুনিক বাণিজ্যিক এলাকা হীরাঝিলের ইংলিশচত্বর পার হয়ে অফিসের মূল ভবনের কাছাকাছি চলে আসে, তখন উদ্ভ্রান্ত এক যুবক তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে। দু'বার বিকটা শব্দে হর্ন বাজায়। তিনি বিরক্তিতে নিচের ঠোঁট আর উপরের ঠোঁট একসঙ্গে ভাঁজ করে মুখের ভেতর নিয়ে যান। এটাই তার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। উদ্ভ্রান্ত ছেলেটা ত্রিশ সেকেন্ড তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর মৃদু পায়ে সরে যায়। ছেলেটা চলে যাওয়ার সময় তার গাড়ির জানালার কুচকুচে কালো আয়নার ভেতর দিয়ে তীক্ষষ্ট চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালার কাচ এতটাই কালো যে, বাইরে থেকে ভেতরে কে আছে তা বোঝার উপায় নেই। ছেলেটা তবুও নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে থাকে কালো কাচের ভেতর দিয়ে। তার নিজের চোখেও কালো চশমা। তিনি লক্ষ্য করেন গাড়ির কালো কাচ আর তার নিজের চশমার কালো কাচ দুটো ভেদ করে ছেলেটা একদম সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তারপর কেমন রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে যায়। তিনি বেশ অবাক হন পাগল এই ছেলেটার দৃষ্টির ক্ষমতা দেখে। এ ঘটনার জন্য তার দুই মিনিট দেরি হয়ে গেল। খুব দ্রুত অবাক হওয়া আর বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। কিন্তু সকাল সকাল এ ঘটনায় তিনি অবাক এবং বিরক্ত দুটোই হলেন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এই প্রথম দুই মিনিট দেরি করে তিনি অফিসে পৌঁছলেন। আজ পবিত্র মঙ্গলবার। সপ্তাহের শনিবার আর মঙ্গলবারকে নিজের জন্য তিনি পবিত্রতম ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণার খবর অবশ্য কেউ জানে না। নিজের দৈনন্দিন জীবন যাপন আর কাজকর্মে এমন অদ্ভুত কিছু নিয়মনীতি তিনি অনুসরণ করেন, যার খবর তিনি ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়। শনি আর মঙ্গলবারের বিষয়টা কেউ বুঝতে না পারলেও তার সঙ্গের কর্মরত লোকজন বুঝতে পারে এই দুই দিন তার কিছু একটা আছে। শনি আর মঙ্গলবার তার আচরণ আর কথাবার্তায় বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। এই দুই দিন অনেক বেশি সচেতন, কর্মঠ, সময় আর নিয়ম মেনে চলাসহ আনুষাঙ্গিক অনেক বিষয়ে তাকে প্রচণ্ড কর্মতৎপর আর কঠোর দেখা যায়। ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় নীল রঙের বিশতলা ভবনের প্রধান সিঁড়িতে তিনি যখন পা রাখেন, তখন লক্ষ্য করেন ভবনের মূল দেয়ালে শতবছরের পুরোনো দেয়ালঘড়িতে ৯টা দুই মিনিট বাজে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন তিনি। ঘড়িতে দেখাচ্ছে আজ টিউসডে,পবিত্র মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ। ১৩ তার জন্মতারিখ। এই সংখ্যাটাও তার জন্য শুভ সংখ্যা। বছরে খুব কম সময়ই তিনি এমন তারিখ আর দিনের মিল পেয়ে থাকেন। এমন একটা দিনে তার দেরি করে কাজ শুরু করা উচিত হয়নি। সময়ের কাঁটা ধরে চলা মানুষ তিনি। সময় আর কাজকে তিনি সম্মান দেখিয়েছেন, ফলে কাজ আর সময় তাকেও সম্মান দেখাচ্ছে। সফলতার এমন এক চূড়ায় তিনি পৌঁছে যাচ্ছেন ক্রমাগত, যেখানে পৌঁছার স্বপ্ন তিনি কখনও দেখেননি। এবং সফলতার যে চূড়ায় তিনি এখন অবস্থান করছেন সেখানে ইতঃপূর্বে কেউ পৌঁছাতেও পারেনি।
অফিস ভবনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পুরো অফিসে হিমশীতল নীরবতা নেমে আসে। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাকে যমদূতের মতো ভয় পায়। তার ব্যক্তিত্বে এমন এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে, যেটা উপেক্ষা করার শক্তি কারও নেই। অফিসে কারও সঙ্গে তিনি উচ্চস্বরে কথা বলেন না। খুব মোলায়েম আর পরিচ্ছন্ন স্বরে তিনি কথা বলেন সবার সঙ্গে। তবে তার সেই সমস্ত কথায় সব সময় একধরনের দম্ভ আর অহংকারের সুর মিশে থাকে। এক কথা তাকে কখনও দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে হয় না। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। অনিয়ম করতে পারে না। তার কথার ওপর কথা বলার ক্ষমতা কারও নেই। এতটাই সম্মোহিত ক্ষমতা তার চোখে আর ব্যক্তিত্বে।
শান্তভাবে হেঁটে হেঁটে নিজের অফিস রুমের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। চারপাশে একবার চোখ বুলান। সবাই মনোযোগ দিয়ে মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তার রুমের সামনে দরজায় একটা কাঠের নেমপ্লেট। তাতে লেখা মোহাম্মদ ইউনুস। ব্যস এতটুকুই। কোনো পদবি কিংবা উপাধি কিছুই লেখা নেই। এই কাঠের নেমপ্লেটটা তিনি পেয়েছিলেন তার তুখোড় ব্যবসায়ী দাদার কাছ থেকে। পূর্বপুরুষের ব্যবসার কাজে তিনি যখন হাত দেন এবং প্রথম নিজের অফিসে এসে বসেন, তখন তার দাদা এই নেমপ্লেটটা তার কক্ষের দরজায় লাগিয়ে দেন। তিনি শুধু শান্তভাবে নেমপ্লেট দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, 'এখানে কি আর কোনো কিছু লেখার প্রয়োজন ছিল না দাদা?'
তার দাদা আরও শান্তভাবে উত্তর দিলেন, 'তোমার নাম লেখা আছে ওখানে, এটাই কি যথেষ্ট নয়?'
দাদার উত্তর শুনে তিনি কিছু বলেন না। আবেগহীন চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকেন। দাদাও তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, 'জীবনে আরও অনেক বড় হবে তুমি, অনেক উপাধি, পদবি পুরস্কার যোগ হবে তোমার নামের সাথে, কিন্তু সেই সবকিছু গৌণ বিষয়। ওগুলো প্রকাশ করার কিছু নয়। তোমার নাম আর কাজই হবে মৌলিক। নামের সম্মান করো। আর সম্মান করো নিজেকে। এই কক্ষে বসে আমি কাজ শুরু করেছিলাম। আমি তোমার জন্য এই কক্ষ ছেড়ে দিচ্ছি। আজ থেকে তুমি এখানে বসবে।'
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে দাদার কথায় সায় দেন। পূর্বপুরুষের যে ব্যবসা উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন, নিজের কর্মদক্ষতা আর বুদ্ধির জোরে সেটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিশাল মহিরুহে পাল্টে দিয়েছেন। তিনি যে ঘরে বসেন, সেই ঘরটাকেও ত্রিশ বছর আগে তার দাদা যে ঘরে বসে অফিস করতেন হুবহু সেই ঘরের মতো করে পুরোনো ঐতিহ্যের সুবাস মেখে সাজিয়েছেন।
তার ব্যক্তিগত অফিসরুমের সামনে তিনি এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিজের নাম লেখা নেমপ্লেটটা একবার দেখেন।
মোহাম্মদ ইউনুস। খোদাই করা ইউনুসের নিচে একটু বালু লেগে আছে মনে হলো। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে নেমপ্লেটটা একবার মোছেন। ভালো করে ঝাড়েন। তার রুমের দায়িত্বে যে পিওন আছে, তাকে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা আছে। তার মধ্যে একটি হলো কোনোভাবেই কেউ যেন তার নেমপ্লেটে হাত না দেয়। এটা তিনি প্রতিদিন নিজ হাতে পরিস্কার করেন।
ঘরে ঢোকেন ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের চেয়ারম্যান ইউনুস সাহেব। সব কিছু ঝকঝকে তকতকে করে রাখা আছে। ড্রয়ার থেকে কফির কাপ বের করেন তিনি। নিজ হাতে গরম পানি দিয়ে সেটি পরিস্কার করেন। তারপর নিজেই কফি বানিয়ে চুমুক দেন। আজ অফিসে আসতে তার দুই মিনিট দেরি হয়েছে। এটা নিয়ে তার মন খারাপ ভাব ছিল। কফিতে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে তার মন ভালো হয়ে যায়। এই দুই মিনিট কীভাবে সামাল দেওয়া যায় সেটি ভাবতে থাকেন ইউনুস সাহেব। কফি খাওয়ার জন্য তার কাছে পাঁচ মিনিট ছিল। সময়ের এক মিনিট আগে কফি খাওয়া শেষ করেন। ঠিক ৯টা ৩০ মিনিটে তিনি উঠে দাঁড়ান। ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। বিশাল অফিসে প্রতিটা ডেস্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি হেঁটে হেঁটে রিপোর্টিং বিভাগ প্রধানের রুমের সামনে এসে দাঁড়ান। রিপোর্টিংয়ের প্রধান আসলাম সাহেব সকালের কফি খাওয়া তখনও শেষ করেননি। ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের চেয়ারম্যান ইউনুস সাহেবকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। ইউনুস সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, 'কফি শেষ করে আমার ঘরে আসুন।'
কথা শেষ করে ইউনুস সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। এভাবে প্রতিটা বিভাগীয় প্রধানের রুমে গিয়ে তিনি তাদের নিজের রুমে আসতে বলেন। তিনি ইচ্ছে করলে নিজের ঘর থেকে ফোন দিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই কাজটা করেন না। একজন সাধারণ কেরানিকেও ডাকতে হলে তিনি উঠে গিয়ে ভদ্রভাবে সেই কেরানির ডেস্কের সামনে গিয়ে তাকে নিজের রুমে আসতে বলেন। তার বিচিত্র সব গুণ আর স্বভাবের জন্য লোকজন তাকে ভয় পায়। সম্মোহিতভাবে তাকে শ্রদ্ধা করে।
ইউনুস সাহেবকে দেখতে যত শান্ত আর ভদ্র, সাদাসিধে মনে হয়, সত্যিকার অর্থে তিনি মোটেও সে রকম নন। তিনি খুবই ভদ্র; কিন্তু একই সাথে কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষ। ভেতরে ভেতরে অসম্ভব অহংকারী আর আত্মবিশ্বাসী। তার সেই অহংকারের তাপ মাঝে মাঝে তিনি কথার ছলে লোকদের বুঝিয়ে দেন। আর্থিক সাম্রাজ্যের বিশাল যেই জগৎ তিনি তৈরি করেছেন। মাঝে মাঝে তিনি অবাক হন এটা ভেবে যে, এই সাল্ফ্রাজ্য একশ' বছরেও ধ্বংস হবে না। তার মতো এত মেধাবী আর তুখোড় ব্যবসায়ী সারা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার কাটা কাটা অহংকারসুলভ তীক্ষষ্ট কথায় সবাই জর্জরিত। কিন্তু তার মুখে মুখে কারও কিছু বলার ক্ষমতা নেই। সম্পদের সুষম বণ্টনে তার বিশ্বাস নেই। তিনি মনে করেন সম্পদ বণ্টন হবে মেধা আর বুদ্ধির হিসাবে। এই পৃথিবীর তাবত সম্পদের মালিক হবে বুদ্ধিমান আর মেধাবীরা। অকাট মূর্খদের সম্পদের মালিক হওয়ার কোনো অধিকার নেই। পৃথিবী শাসন করবে বুদ্ধিমানরা। আর অধিকাংশ মূর্খ অমেধাবী লোকগুলো শুধু পরিশ্রম করে যাবে। সম্পদের খুব কম অংশের মালিক হবে সেই অমেধাবীরা। পথে বসে ভিক্ষা করবে অমেধাবী অলস মানুষেরা। তার মতো মেধাবী সম্পদশালীরা ইচ্ছে হলে সেই মূর্খ, অমেধাবী অলসদের সাহায্য করবে, ইচ্ছা না হলে করবে না। এখানে বাধ্যবাধকতার কিছু নেই। ফলে দান-খয়রাতে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি শুধু বিশ্বাস করেন পরিশ্রম, মেধা আর জ্ঞানে। এই তিনটি যার আছে, পৃথিবীর সম্পদ আর মালিকানা শুধু তার।
আজ পবিত্র মঙ্গলবার ১৩ মার্চ। এমন ম্যাজিক্যাল দিন তার জীবনে খুব কম আসে। বেছে বেছে বড় বড় সিদ্ধান্ত তিনি মঙ্গলবার নিয়ে থাকেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন, তার জীবনে সব সময় তা-ই ঘটেছে। এর কোনো হেরফের হয়নি। ১০টা থেকে শুরু করে পৌনে ১টা পর্যন্ত তিনি সব বিভাগীয় প্রধানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষ করেন। মিটিং শেষ করে তিনি বুঝতে পারেন খুব শিগগিরই তার কোম্পানি আরও দশ বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে যাচ্ছে। ইউনুস সাহেব চোখ বন্ধ করে হিসাবগুলো একবার মিলিয়ে ফেলেন। সম্পদের এই যে, বিশাল সাম্রাজ্য তিনি গড়ছেন, সেখান থেকে কোনো শক্তিই তাকে রাস্তার ভিখারি বানাতে পারবে না। শুধু মেধা আর পরিশ্রমের জোরেই তিনি আজ এখানে এসে পৌঁছেছেন।
ঘড়ির দিকে তাকান ইউনুস সাহেব। ১২টা ৫০ বাজে। ১২টা ৫০ থেকে ১টা ৩৫ পর্যন্ত তার লাঞ্চের সময়। ইউনুস সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। সেখান থেকে হেঁটে তিনি রাস্তার ওপাশে চলে যাবেন। হীরাঝিলের ওপাশের রাস্তার দু'ধারে বিস্তীর্ণ বাগান আর খাবারের ক্যাফেগুলো। সেখানে তার ছেলেবেলার বন্ধুর একটি ক্যাফে আছে। সেই ক্যাফেতেই তিনি সব সময় খেতে যান। ঘরোয়া পরিবেশে তার জন্য বিশেষ যত্নে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করা থাকে।
দুপুরের খাওয়ার আগে হেঁটে হেঁটে ক্যাফেতে যাওয়া আর খাওয়ার পর হেঁটে হেঁটে ফিরে আসা তার অনেক দিনের অভ্যাস। ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে খেতে খেতে গল্প করেন। শতচাপেও তিনি অভ্যাস থেকে সরে আসেন না। জীবনকে এভাবেই তিনি অভ্যস্ত করে ফেলেছেন। একা একা হাঁটাহাঁটি করতে তাকে অনেকেই নিষেধ করেছে। তিনি সেই নিষেধ শুনতে আগ্রহী নন। জীবনে ঝুঁকি থাকবেই। তাই বলে ঝুঁকির ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা চলবে না। ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে হেঁটে বের হয়ে ইউনুস সাহেব রাস্তার ওপাশে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকেন। চারপাশের পরিবেশ তার খুব ভালো লাগে। জীবনের সবচেয়ে বড় জ্যাকপট আজ তিনি পেয়েছেন। মিটিংয়ে সেই বিষয়গুলোই নিশ্চিত হলো। হাঁটতে হাঁটতে আনমনে কখন যে তিনি ক্যাফের রাস্তা ফেলে শহরের বাইরের রাস্তায় চলে এলেন বুঝতেই পারলেন না। হঠাৎ করে তার খেয়াল হলো তিনি আজ অন্য রাস্তায় হাঁটছেন। এই রাস্তায় তিনি এর আগে কখনোই আসেননি। এতটা আনমনা হয়ে পড়া তার স্বভাববিরুদ্ধ। সাথে সাথে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখেন এক উদ্ভ্রান্ত উস্কখুস্ক চুলের যুবক তার সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কিছু বলার আগেই যুবক তার কাঁধে হাত রাখল। ইউনুস সাহেব লক্ষ্য করলেন উস্কখুস্ক চুলের যুবক তার দিকে তীক্ষষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি থেকে ইউনুস সাহেব চোখ ফেরাতে পারলেন না। যুবকের শরীর থেকে হাল্ক্কা মিষ্টি একটি ফুলের সুবাস পেলেন তিনি। ফুলের সুবাসটুকু খুব অপার্থিব মনে হলো তার কাছে। তার মনে হলো এই যুবককে তিনি কোথাও দেখেছেন। ফুলের সুবাসে তিনি সব কিছু ভুলে গেলেন। তিনি কে কোথায় আছেন, তার কাজ কী, দুপুরের খাবার- সবকিছু ভুলে গেলেন তিনি। মনের ভেতর অন্যরকম একটি আনন্দ কাজ করছে।
'স্যার কেমন আছেন আপনি?'
উদ্ভ্রান্ত যুবকের কথা শুনে তার মন ভালো হয়ে গেল। তিনি ফুরফুরে মেজাজে বললেন, 'ভালো আছি। তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে করতে পারছি না। বয়স হয়েছে তো। অনেক কিছুই ভুলে যাই।'
উদ্ভ্রান্ত যুবক ইউনুস সাহেবের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে হাতের মুঠো ধরেন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তারা হ্যান্ডশেক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
'আপনার তো কোনো কিছু ভুলে যাওয়ার কথা নয়। অসম্ভব মেধাবী আপনি।' যুবক হাত ধরেই কথা বলতে থাকেন।
'যত মেধাবীই হই না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মে সবকিছুরই ক্ষয় হয়। আমিও তার বাইরে নই। এই যেমন ধরো- আমি এখন নিজের নামটাই মনে করতে পারছি না।' তিনি আমতা আমতা করে বললেন।
'নিজের নাম মনে করতে না পারা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আপনি এখন আমার কথা মতো চলবেন।'
তিনি হাসতে হাসতে শিশুর মতো বলেন, 'তোমার কথা মতো চলতে আমার ভালোই লাগছে। কী করতে হবে বলো।'
'আপনার পকেটে কি মানিব্যাগ আছে?'
'হ্যাঁ, আছে তো। বেশ কিছু টাকা আছে মানিব্যাগে।'
'ঠিক আছে ব্যাগটা আমাকে দিন।'
ইউনুস সাহেব সুবোধ বালকের মতো মানিব্যাগটা দিয়ে দিলেন।
'ডেবিট কার্ড আর ক্রেডিট কার্ডগুলো কোথায়?'
'আমার সাথেই আছে।'
'ঠিক আছে পাশের ওই বুথে গিয়ে যতটা সম্ভব টাকা তুলে নিয়ে আসুন। আমি এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।'
ইউনুস সাহেব শান্তভাবে বুথে গেলেন। পকেটভর্তি করে টাকা নিয়ে ফিরে এলেন।
রহস্যময় যুবক টাকাগুলো নিজের পকেটে পুরে নিল। মানিব্যাগটা ইউনুস সাহেবকে ফিরিয়ে দিল।
'দেখতেই পাচ্ছেন আপনি আমার কথার বাইরে যেতে পারবেন না। আমি যা বলব, আপনাকে তা করতেই হবে।'
'তোমার কথা মতো চলতে আমার বেশ ভালো লাগছে। আর কী করতে হবে বলো। যা বলবে সব করতে পারব আমি।'
'আপনার যে অনেক টাকা-পয়সা সেটি আপনি জানেন?'
ইউনুস সাহেব কিছু সময় থ মেরে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, 'সত্যি কথা বলতে কী নিজের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।'
'আপনি প্রচণ্ড অহংকারী একজন মানুষ।'
'হতে পারে।'
'পৃথিবীর সকল মানুষকে আপনি শুধু বুদ্ধি আর সম্পদ দিয়ে হিসাব করেন।'
'হতে পারে।'
'আপনি নিজেকে ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাশালী মনে করেন।'
'হতে পারে।'
'বুঝতেই পারছেন আপনি আসলে তা নন। আপনি স্রেফ একজন মাটির মানুষ।'
'হতে পারে।'
'আপনার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা আমার দেখতেই পাচ্ছেন। এত ক্ষমতার পরেও আমি এসব ব্যবহার করি না। মাঝে মাঝে যখন প্রয়োজন হয়, তখনই শুধু ব্যবহার করি।'
'হতে পারে।'
'এটাই সত্যি। বাপেরও বাপ থাকে। আমরা অধিকাংশ সময় সেটি ভুলে যাই। আপনার শরীরের কোটটা খুলে সেটি দিয়ে মাথাটা ঢেকে ফেলুন।'
ইউনুস সাহেব বাধ্য ছেলের মতো শরীরের কোট দিয়ে মাথা ঢেকে ফেললেন।
'এবার হীরাঝিলের ওই সংযোগ ব্রিজের নিচের রাস্তায় বসে আরও যে দু-একজন ভিখারি বসে ভিক্ষা করছে, তাদের পাশে গিয়ে ভিক্ষা করতে বসুন।'
ইউনুস সাহেব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুঁজো হয়ে দ্রুত ব্রিজের নিচে চলে গেলেন। তারপর আরও দু'জন ভিখারির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে ঝুঁকে ঝুঁকে বিড়বিড় শব্দে সুর করে ভিক্ষা চাইতে শুরু করলেন।
লাঞ্চের পরপরই ব্রিজের নিচ দিয়ে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। লোকজন ওই উদ্ভট ভিখারিকে দেখে বেশ অবাক চোখে তাকায়। কেউ ভিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। পাশের ভিখারিরাও অবাক হয়। কিন্তু মাথা ঢেকে রাখা পরিস্কার পোশাকের এই নতুন উদ্ভট ভিখারিকে কিছু বলার সাহস পায় না তারা।