
গাধাটার এখন তিনটে পা। বাকি যেটা- সেটা খোয়া গিয়েছে ঘাড়ে ভরাগাড়ি সমেত পানিতে ডোবা একটা গর্তে পড়ে। হাঁটুর কাছ থেকে এক্কেবারে উল্টে গিয়েছে সেটা। তারপরও গোঁয়ার চাষাটার হাতের লাঠির আগায় বাঁধা চামড়ার নাতিদীর্ঘ চাবুকটা নাকে মুখে নেমে আসতে দেরি হয়নি। হাঁটু দুটো মুড়ে দিয়ে রাস্তার ওপর যখন সে নুয়ে পড়েছিলো। পেছনের বাঁ পায়ের অসাড় অনুভূতির নিচে ততক্ষণে চাপা পড়ে গেছে হাড় ভাঙবার যন্ত্রণা। এখন সেসব ছাপিয়ে একটা ভয়... পেট ছোঁওয়া পানিতে কি নাক ডুবিয়েই তাকে মরতে হবে!
কাছের শুকনো উঁচু জমি বলতে এখনো হাত তিরিশেক দূরের একটা কালভার্ট। এ বছরের হঠাৎ বন্যায় যেটাকে এখন একটা এবাদতগাহের মতন উঁচু দেখাচ্ছে। গাড়োয়ান তার মুদি দোকানের জন্য কেনা ময়দার বস্তাটা কাঁধে তুলে নিয়েছে। তার আরেক হাতে কাগজের বড় এক ঠোঙার ভেতর নানান ছোট ছোট ঠোঙায় বেশি দামের সব মশলাপাতি। এলাচি, লবঙ্গ, জাফরং, জায়ফল আর আলু বোখারা।
মিছরির মুখ আটা বোতল, তেলের গালা করা টিন... একটু আধটু পানির ছিটেয় তাদের কোন ক্ষতি নেই। নুনের কুড়ি কেজির চটের ব্যাগটা যদিওবা পানি লাগলে গলে যাবে- তবুও অন্য দ্রব্যগুলোর তুলনায় তার দাম তো নেহাত বেশি নয়।
অন্তত আলু পেঁয়াজ ভর্তি বস্তাটার তুলনায় তো বটেই।
মেঘ বলতে কবিরা যা বোঝে... আকাশে তেমন কিছু আজ নেই। আর এই বন্যার পানিটুকুও এদেশের কোন পণ্য নয়-
অন্য দেশের পানি এই দেশটা পেরিয়ে যাবে সাগরে পৌঁছুতে। আর হ্যাপা পোহাতে হবে গাড়িটানা গাধা নয়তো মুদি দোকানদারদের।
সেই কোন আমলে তৈরি করা সংস্কারহীন রাস্তাটার ধার ঘেঁষে লম্বা নালা। তারপরে গমের ক্ষেত। এখন পানিতে সব সমান। নালাটার ওধারে ক'গাছা বেতি ঘাস, ফুর্তিতে কিনা তা কে বলবে... নড়ছে।
বোঝাই যাচ্ছে তারপর থেকেই গম খেত শুরু। মোটা ক'টা তার কামড়ে ধরে- যেন মনে হচ্ছে সেটাই তাদের শাস্তি... একসারি কয়েদির মতন অ্যালুমিনিয়ামের খুঁটিগুলো গোড়ালি ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেঘ নেই তবু আকাশের রং কেমন যেন ধোঁয়া-ধূসর।
পেছনের একটা পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গাধাটার চোখদুটোর রংও যেন সেইরকম। সামনে পেছনে মিলিয়ে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবার যে সহ্য শক্তি- সামনের মুড়ে রাখা হাঁটু দুটোয় এসে সেটা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবু সে গা ছেড়ে দিয়ে ঢলে পড়ছে না, শুধু নাক ডুবে যাবার ভয়ে। দোকানদার ততক্ষণে তার যাবতীয় শামানা কালভার্টের ওপরটাতে বয়ে এনেছে। অতঃপর সে টানা গাড়িটার জোয়াল থেকে গাধাটার বাঁধন খুলে দিলে প্রাণীটা উঠে দাঁড়ালো তিনপায়ে।
ঘাড়ে তখনো তবু ঘষটানো দাগের ওপর বেঁধে থাকল গাড়িটা।
দূরে দূরে পাথরের পাহাড়। অপ্রাসঙ্গিক রকমের সুন্দর।
গাধাটার কোন অন্তঃর্জাগতিক দুনিয়া ছিল না- এটাই বাঁচোয়া। সে নিজেকে এতদিন গাড়িটার একটা অংশ হিসেবেই ভাবতে পারতো। এটা তার অনেক কষ্টও কমিয়ে দিয়েছিল। সে জানতো তিনপেয়ে একটা গাধাকে কোন মনিবই দাঁড় করিয়ে রেখে খেতে দেবে না। গাঁয়ে ফিরতে পারলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, নয়তো তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এইরকমই তার মনে হলো।
ঊষর প্রান্তর বহুল একটা অঞ্চলে তিনটে পা নিয়ে তার বেঁচে থাকবার চেষ্টাটা কেমন আকার নিতে পারে এসব সম্বন্ধে ধারণা করতে না পারার সুবিধাটাই যে একটা গাধা জীবনের সব সাফল্যের চাবিকাঠি এ সমস্ত অনুভবে পৌঁছনোর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায় তার চিন্তার সীমানা। একটা খেতের নধর মুলো... তার ঝাঁঝালো মিষ্টি স্বাদ... এর বেশি বড় নয় তার হূৎপিণ্ডের আকার।
দোকানদারের মতো হিসেব লিখতে পারে না বলেই সে পড়তে পারেনি যে, স্বাধীনতার ব্যাপারে ধারণা করতে না পারাটাই একটা আরামদায়ক স্বাধীনতা। তাই গাধাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কালভার্টটার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। কংক্রিটের উপর সে আর উঠে দাঁড়ালো না।
পানিতে হাঁটু ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার ভালো লাগছে। মসজিদের মতো উঁচু কালভার্টটায় তার মনে হলো- করুণাময় আজ অনুপস্থিত। দোকানদার সেখানে তার পুঁজি গুছিয়ে রাখছে। একটা নির্বোধ সহ্যশক্তির ওপর ভর দিয়ে গাধাটা আরো দু পা এগিয়ে গিয়ে মুখ নামিয়ে আনলো গেঁয়ো কালভার্টটার গোঁড়ায় এখনো জেগে থাকা মুথাঘাসগুলোর উপর।
দোকানদারের মনে অনেকদিন ধরে ভালো লিখে এসে এক্ষুনি কালি ফুরোনো একটা বলপেনের উপর লেখকের যেমন স্নেহ স্নেহ বোধ হয় গাধাটার জন্য সেইরকম একটা অনুভুতি হলো। আর মনে পড়লো... গাধার চামড়ার বাজার দর।
এমন সময় চুবনি খেয়ে উঠে কানঝাড়া দেবার শব্দ করে একটা কুকুর নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ভদ্দর লোকদের মতো এসে দাঁড়ালো। একটা দূরের পথ সাঁতরে এলেও এতক্ষণ কেউ তাকে খেয়াল করেনি। ময়দার বস্তাটার চারধারে আবছা-সাদা একটা জ্যোতিবলয়ের দিকে সে তাকালো। সন্ন্যাসীদের ছবির দিকে ভক্তরা যেভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়- সেইভাবে। তারপরই দোকানদারের চাবুকটা সে দেখতে পেল।
ততক্ষণে জল ঝরে গিয়ে প্রথমেই শুকিয়ে উঠলো তার বাঁকানো লেজটা। ফুলো লোমে এখন যেটাকে বেশ চৌকস দেখাচ্ছে।
কুকুরের অন্তর্জগৎটা গাধাটার থেকে বিস্তৃত ছিল- সেটা তেমন কিছু বলবার বিষয় নয়। তারপরেও সেটা কার্পেন্তিয়েরের কুকুর নিয়ে লেখা সেই গল্পটা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল কিনা- 'ঘেউ' বলে একবার ডেকে উঠবার ভেতর সে সেই সত্যিটা গোপন করে রাখলো।
চারিদিকের পানি আর দোকানদারের গাধা চাবকানো চাবুকটা... কোণঠাসা কুকুরটার অন্তর্লোকে দরকার পড়লে দোকানদারের কণ্ঠনালি কামড়ে ধরবার একটা জান্তব প্রত্যয়- জানালার ঘুলঘুলির পেছনে সঞ্চয়ী গেরস্ত বৌদের লুকিয়ে রাখা কাপড়ের ছোট পুঁটলিটার মতন লুকোনোই রইল। অতঃপর সে অত্যন্ত অনুগত একজন কৃষ্ণকায় দাসের মতন বস্তাটার চারধারে মিহি ময়দার গোল জ্যোতিবলয়টার দিকে গুড়িগুড়ি এগিয়ে গেল... চেটে খাবে তাই।
এদিকে এতসব কিছু যখন ঘটছে- তখন পশ্চিমদিকের নিউইয়র্ক বলে একটা শহরে একজন চাকা-চেয়ার আরোহী বিজ্ঞানীর সাথে পেনরোজ বলে আর একজন বিজ্ঞানীর একটা গাণিতিক মডেল নিয়ে তুমুল বচসা শুরু হলো। হতে পারে এদিকের এই কালভার্টটা ঘিরে যেমন আমাদের দোকানদার আর তাকে সাহায্য করতে আসতে পারে এমন একজন কাল্পনিক আগন্তুক... একটা টেবিল ঘিরে সেখানে সেই বিজ্ঞানী দুজনও সেই রকম। আর দোকানদারের যেমন মালসামানা বিজ্ঞানীদের জন্যে নিজস্ব তত্ত্বগুলোও যেন তাই। যে যারটা রক্ষা করতে ব্যস্ত!
মাঝখান থেকে ওয়ার্নার ইসরায়েল বলে আরেকজন, বলা যায় তিনি এই হঠাৎ আসা কুকুরটার মতন এসে বললেন, যদি একটি সংকোচায়মান তারকা পুরোপুরি গোলাকৃতি না হয় তবে এর সিঙ্গুলারিটি হবে অনাবৃত। অর্থাৎ এটা বাইরের দর্শকদের কাছে দৃশ্যমান হবে। এটা বোঝায় যে, একটি সংকোচায়মান তারকার সিঙ্গুলারিটি বিন্দুতে সাধারণ আপেক্ষিকতার ভেঙে পড়বার বিষয়টি বাকি মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ অনুমান করবার বিষয়ে আমাদের ক্ষমতাও বিলুপ্ত করবে। বাকিতে নিলে দেড়া দামধরা দোকানদার কালভার্টটার ওপরে বসে থেকে সেই বৈজ্ঞানিকদের ঝগড়ার কারণে কিনা তা কে জানে- তাকে সাহায্য করতে এই পথে কেউ আসবে কি আসবে না এই ভবিষ্যৎ অনুমান করতে ব্যর্থ হলো। গালপাট্টার নিচে আর পুরু ঝোলানো গোঁফের মাঝখানে তার গালটা তুবড়ে এলো আরো। ভাবলো সন্ধ্যার আগ দিয়ে পানি খানিকটা কমে এলে মালবোঝাই গাড়িটা সে একাই টেনে নিতে পারবে। রাত দশটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছুতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
এই সমস্ত জায়গায় এসে যাবতীয় গল্পগুলো শেষ হয়ে যায়। কেননা সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, এটা যদি একজন পাঁড় গল্পকারের গল্পও হতো, তবু তার আর তেমন কিছু বলবার থাকতো না। এবং দেখা যায় যে, ঠিক এইরকম সময় থেকেই শুরু হয় অপেক্ষা। আর অপেক্ষার প্রশমন চিরকাল ধরেই ঘাপটি মেরে থাকে একটা দুর্গম পাহাড়ের অন্য ঢালে। বোঝা যায় না যে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তার ওপরে ক্রিয়াশীল হবে কিনা।
এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে জানে না দুপুরের খানিক বাদে বিকেল হবে। কিন্তু আজকের এই কালভার্টটা ঘিরে যে দৃশ্যটা চিত্রিত হয়েছে, ছবি হবার শর্তে আজ যেন সেখানে কোন বিকেল নেই। এখানে একটা লম্বা দুপুর যেন ঝুলেই পড়েছে। কালি-তুলি-রং নিয়ে আজ যে নাড়াচাড়া করছে সে আদতেই যেন প্রাকৃতিক দর্শনের একজন একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক। অপেক্ষা হচ্ছে তার আঁকবার বিষয়... আর এইসব দৃশ্যে চমকে উঠবার কোন ব্যবস্থাই থাকে না। তবে কী করে ভুলে যাওয়া চলে যে, দৃশ্য মাত্রই গল্প!
হয়তো সে কারণেই একটা সারিবাঁধা বিকেলের দল একের পর এক গড়িয়ে গিয়ে এঁকে রাখা একটা দুপুরকে বিকেলের দিকে ঠেলতে থাকলে যেমন হবার কথা... কালভার্টটার ওপরের দুপুরটাও সেইরকম বিপর্যস্ত রকমের ঘোলাটে মতন হয়ে আসতে লাগলো। কোথা থেকে একগাদা মেঠো পিঁপড়ে এসে যেন সেই ঝিমোনো দুপুরটাকে কামড়ে কামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে বিকেলমুখো হতে বাধ্য করেছে। দোকানদার অপেক্ষা করতে লাগল পানি নেমে যাবার... কুকুরটা অপেক্ষা করতে লাগলো দোকানদারটার তন্দ্রা লাগার। যেন সেই অবসরে ময়দার বস্তাটা একবার হিঁচড়ে দেখা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে খিদে মেশানো ক্লান্তিতে কুকুরটার নিজেরই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসলো। সে স্বপ্নে দেখলো, তার চেনা খেয়াঘাটটার টং দোকানগুলোর তলা এখনো শুকনো। যেখানে সে দোকানদারটার ফুলে ঢোল হওয়া ভেজা চামড়ার জুতোটা চিবুতে পারছে। আর গাধা হবার সুবিধার ভেতর ঠ্যাংভাঙা গাধাটার মনের মধ্যে একটা নিরপেক্ষতার তত্ত্বও যেন ক্রিয়াশীল হয়ে উঠলো।
একটা তিনপেয়ে গর্দভকে নিয়ে কারো কোনো ভবিষ্যদ্বাণী আছে কিনা সেসব একটা পুরোনো পাণ্ডুলিপির হারানো পৃষ্ঠার মতন... সেখানে কী লেখা ছিলো তা ধারণা করতে দিল না। কিন্তু অতিস্থবির একটা চিত্রপটের তলায় সেটা জীবন অথবা সময়- তা সে যাই হোক কিছু একটা যে বয়ে যাচ্ছে, গাধা হবার পরেও গাধাটা যেন কেমন করে সেটা ধারণা করতে পারছিলো। আর আশ্চর্যজনকভাবে গাধাটা আর সেই বিজ্ঞানী দু'জন একই সাথে ঠিক তক্ষুনি অনুমান করলেন যে, হতে পারে মাত্রাটা অতি সূক্ষ্ণ, তবুও কোনো না কোনো ধরনের সচেতনতা ছাড়া কোথাও কোনো নড়াচড়া থাকতে পারে না। এমনকি কুকুরটার চেটে খাওয়া সেই ময়দার কণাগুলো তার পেটের মধ্যে এখনো সচেতন। তারা কিছু না কিছু করছে।
প্রশমিত হওয়া যেহেতু অপেক্ষার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য সেই তত্ত্ব মেনে দোকানদারের প্রত্যাশা মতন পানি যেন কমতে শুরু করে দিলো। দেখা চোখের কোন প্রমাণ তাদের কারো কাছে ধরা না পড়লেও তবু তাদের মনে হতে লাগল- পানি বুঝি কমছে। আর কুকুরটার অপেক্ষা প্রশমিত হয়ে আসলো দোকানদারের চোখ মুদে আসা তন্দ্রার ভেতর দিয়ে। ময়দার বস্তাটায় দোকানদার তখন ঠেস দিয়েছে।
অগত্যা কুকুরটা দোকানদারের ভিজে নরম হয়ে আসা একপাটি জুতো কামড়ে ধরেই পানিতে ঝাঁপ দিলো। ক্লান্তিকর একটা দীর্ঘ পথ সাঁতরে এসে ডাঙায় উঠে কুকুরটা যখন গা-ঝাড়া দিচ্ছে- নিউইয়র্কে তখন রাত্রি। টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হচ্ছে সেই হুইলচেয়ার আরোহী বিজ্ঞানীর একটা সাক্ষাৎকার। তিনি বলছেন আমি মনে করি না যে, ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই। আমরা এখানে কেন; এর কারণটিকেই মানুষ নাম দিয়েছে ঈশ্বর।
এই ধরনের গল্পগুলোর যেহেতু কোন লেখক থাকে না; ফলত জানাও গেল না যে আলোচ্য দোকানদার একপাটি জুতো পায়ে দিয়েই সেদিন বাড়ি পৌঁছুতে পেরেছিলো কিনা, অথবা গাধাটারই বা কী হয়েছিলো। মহাসম্প্রসারমাণ এই মহাবিশ্বের একটা অতিক্ষুদ্র বিন্দু নিউইয়র্কেও জানা গেল না যে, সেদিন বিজ্ঞানীরাও একমত হতে পেরেছিলেন কিনা; যে সম্প্রসারণশীলতা শেষ হলে একটা মহাসংকোচন পৃথিবীব্যাপী অজস্র কালভার্টগুলোর জন্যে অপেক্ষা করছে- নাকি করছে না...।
কাছের শুকনো উঁচু জমি বলতে এখনো হাত তিরিশেক দূরের একটা কালভার্ট। এ বছরের হঠাৎ বন্যায় যেটাকে এখন একটা এবাদতগাহের মতন উঁচু দেখাচ্ছে। গাড়োয়ান তার মুদি দোকানের জন্য কেনা ময়দার বস্তাটা কাঁধে তুলে নিয়েছে। তার আরেক হাতে কাগজের বড় এক ঠোঙার ভেতর নানান ছোট ছোট ঠোঙায় বেশি দামের সব মশলাপাতি। এলাচি, লবঙ্গ, জাফরং, জায়ফল আর আলু বোখারা।
মিছরির মুখ আটা বোতল, তেলের গালা করা টিন... একটু আধটু পানির ছিটেয় তাদের কোন ক্ষতি নেই। নুনের কুড়ি কেজির চটের ব্যাগটা যদিওবা পানি লাগলে গলে যাবে- তবুও অন্য দ্রব্যগুলোর তুলনায় তার দাম তো নেহাত বেশি নয়।
অন্তত আলু পেঁয়াজ ভর্তি বস্তাটার তুলনায় তো বটেই।
মেঘ বলতে কবিরা যা বোঝে... আকাশে তেমন কিছু আজ নেই। আর এই বন্যার পানিটুকুও এদেশের কোন পণ্য নয়-
অন্য দেশের পানি এই দেশটা পেরিয়ে যাবে সাগরে পৌঁছুতে। আর হ্যাপা পোহাতে হবে গাড়িটানা গাধা নয়তো মুদি দোকানদারদের।
সেই কোন আমলে তৈরি করা সংস্কারহীন রাস্তাটার ধার ঘেঁষে লম্বা নালা। তারপরে গমের ক্ষেত। এখন পানিতে সব সমান। নালাটার ওধারে ক'গাছা বেতি ঘাস, ফুর্তিতে কিনা তা কে বলবে... নড়ছে।
বোঝাই যাচ্ছে তারপর থেকেই গম খেত শুরু। মোটা ক'টা তার কামড়ে ধরে- যেন মনে হচ্ছে সেটাই তাদের শাস্তি... একসারি কয়েদির মতন অ্যালুমিনিয়ামের খুঁটিগুলো গোড়ালি ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেঘ নেই তবু আকাশের রং কেমন যেন ধোঁয়া-ধূসর।
পেছনের একটা পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গাধাটার চোখদুটোর রংও যেন সেইরকম। সামনে পেছনে মিলিয়ে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবার যে সহ্য শক্তি- সামনের মুড়ে রাখা হাঁটু দুটোয় এসে সেটা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবু সে গা ছেড়ে দিয়ে ঢলে পড়ছে না, শুধু নাক ডুবে যাবার ভয়ে। দোকানদার ততক্ষণে তার যাবতীয় শামানা কালভার্টের ওপরটাতে বয়ে এনেছে। অতঃপর সে টানা গাড়িটার জোয়াল থেকে গাধাটার বাঁধন খুলে দিলে প্রাণীটা উঠে দাঁড়ালো তিনপায়ে।
ঘাড়ে তখনো তবু ঘষটানো দাগের ওপর বেঁধে থাকল গাড়িটা।
দূরে দূরে পাথরের পাহাড়। অপ্রাসঙ্গিক রকমের সুন্দর।
গাধাটার কোন অন্তঃর্জাগতিক দুনিয়া ছিল না- এটাই বাঁচোয়া। সে নিজেকে এতদিন গাড়িটার একটা অংশ হিসেবেই ভাবতে পারতো। এটা তার অনেক কষ্টও কমিয়ে দিয়েছিল। সে জানতো তিনপেয়ে একটা গাধাকে কোন মনিবই দাঁড় করিয়ে রেখে খেতে দেবে না। গাঁয়ে ফিরতে পারলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, নয়তো তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এইরকমই তার মনে হলো।
ঊষর প্রান্তর বহুল একটা অঞ্চলে তিনটে পা নিয়ে তার বেঁচে থাকবার চেষ্টাটা কেমন আকার নিতে পারে এসব সম্বন্ধে ধারণা করতে না পারার সুবিধাটাই যে একটা গাধা জীবনের সব সাফল্যের চাবিকাঠি এ সমস্ত অনুভবে পৌঁছনোর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায় তার চিন্তার সীমানা। একটা খেতের নধর মুলো... তার ঝাঁঝালো মিষ্টি স্বাদ... এর বেশি বড় নয় তার হূৎপিণ্ডের আকার।
দোকানদারের মতো হিসেব লিখতে পারে না বলেই সে পড়তে পারেনি যে, স্বাধীনতার ব্যাপারে ধারণা করতে না পারাটাই একটা আরামদায়ক স্বাধীনতা। তাই গাধাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কালভার্টটার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। কংক্রিটের উপর সে আর উঠে দাঁড়ালো না।
পানিতে হাঁটু ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার ভালো লাগছে। মসজিদের মতো উঁচু কালভার্টটায় তার মনে হলো- করুণাময় আজ অনুপস্থিত। দোকানদার সেখানে তার পুঁজি গুছিয়ে রাখছে। একটা নির্বোধ সহ্যশক্তির ওপর ভর দিয়ে গাধাটা আরো দু পা এগিয়ে গিয়ে মুখ নামিয়ে আনলো গেঁয়ো কালভার্টটার গোঁড়ায় এখনো জেগে থাকা মুথাঘাসগুলোর উপর।
দোকানদারের মনে অনেকদিন ধরে ভালো লিখে এসে এক্ষুনি কালি ফুরোনো একটা বলপেনের উপর লেখকের যেমন স্নেহ স্নেহ বোধ হয় গাধাটার জন্য সেইরকম একটা অনুভুতি হলো। আর মনে পড়লো... গাধার চামড়ার বাজার দর।
এমন সময় চুবনি খেয়ে উঠে কানঝাড়া দেবার শব্দ করে একটা কুকুর নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ভদ্দর লোকদের মতো এসে দাঁড়ালো। একটা দূরের পথ সাঁতরে এলেও এতক্ষণ কেউ তাকে খেয়াল করেনি। ময়দার বস্তাটার চারধারে আবছা-সাদা একটা জ্যোতিবলয়ের দিকে সে তাকালো। সন্ন্যাসীদের ছবির দিকে ভক্তরা যেভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়- সেইভাবে। তারপরই দোকানদারের চাবুকটা সে দেখতে পেল।
ততক্ষণে জল ঝরে গিয়ে প্রথমেই শুকিয়ে উঠলো তার বাঁকানো লেজটা। ফুলো লোমে এখন যেটাকে বেশ চৌকস দেখাচ্ছে।
কুকুরের অন্তর্জগৎটা গাধাটার থেকে বিস্তৃত ছিল- সেটা তেমন কিছু বলবার বিষয় নয়। তারপরেও সেটা কার্পেন্তিয়েরের কুকুর নিয়ে লেখা সেই গল্পটা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল কিনা- 'ঘেউ' বলে একবার ডেকে উঠবার ভেতর সে সেই সত্যিটা গোপন করে রাখলো।
চারিদিকের পানি আর দোকানদারের গাধা চাবকানো চাবুকটা... কোণঠাসা কুকুরটার অন্তর্লোকে দরকার পড়লে দোকানদারের কণ্ঠনালি কামড়ে ধরবার একটা জান্তব প্রত্যয়- জানালার ঘুলঘুলির পেছনে সঞ্চয়ী গেরস্ত বৌদের লুকিয়ে রাখা কাপড়ের ছোট পুঁটলিটার মতন লুকোনোই রইল। অতঃপর সে অত্যন্ত অনুগত একজন কৃষ্ণকায় দাসের মতন বস্তাটার চারধারে মিহি ময়দার গোল জ্যোতিবলয়টার দিকে গুড়িগুড়ি এগিয়ে গেল... চেটে খাবে তাই।
এদিকে এতসব কিছু যখন ঘটছে- তখন পশ্চিমদিকের নিউইয়র্ক বলে একটা শহরে একজন চাকা-চেয়ার আরোহী বিজ্ঞানীর সাথে পেনরোজ বলে আর একজন বিজ্ঞানীর একটা গাণিতিক মডেল নিয়ে তুমুল বচসা শুরু হলো। হতে পারে এদিকের এই কালভার্টটা ঘিরে যেমন আমাদের দোকানদার আর তাকে সাহায্য করতে আসতে পারে এমন একজন কাল্পনিক আগন্তুক... একটা টেবিল ঘিরে সেখানে সেই বিজ্ঞানী দুজনও সেই রকম। আর দোকানদারের যেমন মালসামানা বিজ্ঞানীদের জন্যে নিজস্ব তত্ত্বগুলোও যেন তাই। যে যারটা রক্ষা করতে ব্যস্ত!
মাঝখান থেকে ওয়ার্নার ইসরায়েল বলে আরেকজন, বলা যায় তিনি এই হঠাৎ আসা কুকুরটার মতন এসে বললেন, যদি একটি সংকোচায়মান তারকা পুরোপুরি গোলাকৃতি না হয় তবে এর সিঙ্গুলারিটি হবে অনাবৃত। অর্থাৎ এটা বাইরের দর্শকদের কাছে দৃশ্যমান হবে। এটা বোঝায় যে, একটি সংকোচায়মান তারকার সিঙ্গুলারিটি বিন্দুতে সাধারণ আপেক্ষিকতার ভেঙে পড়বার বিষয়টি বাকি মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ অনুমান করবার বিষয়ে আমাদের ক্ষমতাও বিলুপ্ত করবে। বাকিতে নিলে দেড়া দামধরা দোকানদার কালভার্টটার ওপরে বসে থেকে সেই বৈজ্ঞানিকদের ঝগড়ার কারণে কিনা তা কে জানে- তাকে সাহায্য করতে এই পথে কেউ আসবে কি আসবে না এই ভবিষ্যৎ অনুমান করতে ব্যর্থ হলো। গালপাট্টার নিচে আর পুরু ঝোলানো গোঁফের মাঝখানে তার গালটা তুবড়ে এলো আরো। ভাবলো সন্ধ্যার আগ দিয়ে পানি খানিকটা কমে এলে মালবোঝাই গাড়িটা সে একাই টেনে নিতে পারবে। রাত দশটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছুতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
এই সমস্ত জায়গায় এসে যাবতীয় গল্পগুলো শেষ হয়ে যায়। কেননা সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, এটা যদি একজন পাঁড় গল্পকারের গল্পও হতো, তবু তার আর তেমন কিছু বলবার থাকতো না। এবং দেখা যায় যে, ঠিক এইরকম সময় থেকেই শুরু হয় অপেক্ষা। আর অপেক্ষার প্রশমন চিরকাল ধরেই ঘাপটি মেরে থাকে একটা দুর্গম পাহাড়ের অন্য ঢালে। বোঝা যায় না যে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তার ওপরে ক্রিয়াশীল হবে কিনা।
এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে জানে না দুপুরের খানিক বাদে বিকেল হবে। কিন্তু আজকের এই কালভার্টটা ঘিরে যে দৃশ্যটা চিত্রিত হয়েছে, ছবি হবার শর্তে আজ যেন সেখানে কোন বিকেল নেই। এখানে একটা লম্বা দুপুর যেন ঝুলেই পড়েছে। কালি-তুলি-রং নিয়ে আজ যে নাড়াচাড়া করছে সে আদতেই যেন প্রাকৃতিক দর্শনের একজন একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক। অপেক্ষা হচ্ছে তার আঁকবার বিষয়... আর এইসব দৃশ্যে চমকে উঠবার কোন ব্যবস্থাই থাকে না। তবে কী করে ভুলে যাওয়া চলে যে, দৃশ্য মাত্রই গল্প!
হয়তো সে কারণেই একটা সারিবাঁধা বিকেলের দল একের পর এক গড়িয়ে গিয়ে এঁকে রাখা একটা দুপুরকে বিকেলের দিকে ঠেলতে থাকলে যেমন হবার কথা... কালভার্টটার ওপরের দুপুরটাও সেইরকম বিপর্যস্ত রকমের ঘোলাটে মতন হয়ে আসতে লাগলো। কোথা থেকে একগাদা মেঠো পিঁপড়ে এসে যেন সেই ঝিমোনো দুপুরটাকে কামড়ে কামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে বিকেলমুখো হতে বাধ্য করেছে। দোকানদার অপেক্ষা করতে লাগল পানি নেমে যাবার... কুকুরটা অপেক্ষা করতে লাগলো দোকানদারটার তন্দ্রা লাগার। যেন সেই অবসরে ময়দার বস্তাটা একবার হিঁচড়ে দেখা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে খিদে মেশানো ক্লান্তিতে কুকুরটার নিজেরই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসলো। সে স্বপ্নে দেখলো, তার চেনা খেয়াঘাটটার টং দোকানগুলোর তলা এখনো শুকনো। যেখানে সে দোকানদারটার ফুলে ঢোল হওয়া ভেজা চামড়ার জুতোটা চিবুতে পারছে। আর গাধা হবার সুবিধার ভেতর ঠ্যাংভাঙা গাধাটার মনের মধ্যে একটা নিরপেক্ষতার তত্ত্বও যেন ক্রিয়াশীল হয়ে উঠলো।
একটা তিনপেয়ে গর্দভকে নিয়ে কারো কোনো ভবিষ্যদ্বাণী আছে কিনা সেসব একটা পুরোনো পাণ্ডুলিপির হারানো পৃষ্ঠার মতন... সেখানে কী লেখা ছিলো তা ধারণা করতে দিল না। কিন্তু অতিস্থবির একটা চিত্রপটের তলায় সেটা জীবন অথবা সময়- তা সে যাই হোক কিছু একটা যে বয়ে যাচ্ছে, গাধা হবার পরেও গাধাটা যেন কেমন করে সেটা ধারণা করতে পারছিলো। আর আশ্চর্যজনকভাবে গাধাটা আর সেই বিজ্ঞানী দু'জন একই সাথে ঠিক তক্ষুনি অনুমান করলেন যে, হতে পারে মাত্রাটা অতি সূক্ষ্ণ, তবুও কোনো না কোনো ধরনের সচেতনতা ছাড়া কোথাও কোনো নড়াচড়া থাকতে পারে না। এমনকি কুকুরটার চেটে খাওয়া সেই ময়দার কণাগুলো তার পেটের মধ্যে এখনো সচেতন। তারা কিছু না কিছু করছে।
প্রশমিত হওয়া যেহেতু অপেক্ষার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য সেই তত্ত্ব মেনে দোকানদারের প্রত্যাশা মতন পানি যেন কমতে শুরু করে দিলো। দেখা চোখের কোন প্রমাণ তাদের কারো কাছে ধরা না পড়লেও তবু তাদের মনে হতে লাগল- পানি বুঝি কমছে। আর কুকুরটার অপেক্ষা প্রশমিত হয়ে আসলো দোকানদারের চোখ মুদে আসা তন্দ্রার ভেতর দিয়ে। ময়দার বস্তাটায় দোকানদার তখন ঠেস দিয়েছে।
অগত্যা কুকুরটা দোকানদারের ভিজে নরম হয়ে আসা একপাটি জুতো কামড়ে ধরেই পানিতে ঝাঁপ দিলো। ক্লান্তিকর একটা দীর্ঘ পথ সাঁতরে এসে ডাঙায় উঠে কুকুরটা যখন গা-ঝাড়া দিচ্ছে- নিউইয়র্কে তখন রাত্রি। টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হচ্ছে সেই হুইলচেয়ার আরোহী বিজ্ঞানীর একটা সাক্ষাৎকার। তিনি বলছেন আমি মনে করি না যে, ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই। আমরা এখানে কেন; এর কারণটিকেই মানুষ নাম দিয়েছে ঈশ্বর।
এই ধরনের গল্পগুলোর যেহেতু কোন লেখক থাকে না; ফলত জানাও গেল না যে আলোচ্য দোকানদার একপাটি জুতো পায়ে দিয়েই সেদিন বাড়ি পৌঁছুতে পেরেছিলো কিনা, অথবা গাধাটারই বা কী হয়েছিলো। মহাসম্প্রসারমাণ এই মহাবিশ্বের একটা অতিক্ষুদ্র বিন্দু নিউইয়র্কেও জানা গেল না যে, সেদিন বিজ্ঞানীরাও একমত হতে পেরেছিলেন কিনা; যে সম্প্রসারণশীলতা শেষ হলে একটা মহাসংকোচন পৃথিবীব্যাপী অজস্র কালভার্টগুলোর জন্যে অপেক্ষা করছে- নাকি করছে না...।
বিষয় : গল্প
মন্তব্য করুন