- কালের খেয়া
- যাত্রীর দিনলিপি পূর্বমুখী পঞ্জিকায় আর ভরে ওঠে না
প্রচ্ছদ
যাত্রীর দিনলিপি পূর্বমুখী পঞ্জিকায় আর ভরে ওঠে না

আমি নিয়মিত মায়ের গ্রামে গিয়ে থাকি তার সঙ্গে দেখা করতে। ফলে আমার সংগ্রহে গ্রামযাত্রা বিষয়ক অনেক গল্প থাকে। সেসব গল্প থেকে যা এখানে উপযোগী তার দু-একটা-
অনেক বছর আগে আমার পাশের যাত্রীকে আমি বিমানে ওঠার আগেই চিনেছিলাম দুবাই অপেক্ষাকালে ঢাকার পথে; এরপর বিমানে দেখা গেল আমরা পাশাপাশি বসেছি। আমার চলাফেরায় অনেকগুলো ব্যাপার আছে তাতে দু-একজনের আগ্রহ বা অনাগ্রহ জন্মাবার কারণ থাকে। বিমানে তার প্রধান হলো আমার মদ্যপান! বিমানের সেবক-সেবিকারা আমাকে এ বিষয়ে খুব সহযোগিতা করে থাকেন। আমার কথা শুনে তারা বুঝে ফেলেন যে, আমি এ জগতের আনাড়ি কেউ নই। ফলে বাঙালি সুরতের এই ঢাকা যাত্রীর প্রতি সহযাত্রীর প্রথম আগ্রহের বিষয় থাকে এটা। পাশের যাত্রীর ক্ষেত্রেও তেমন মনে হলো। তাকে আমি আগেই চিনেছি, তিনি একাধিকবার অতি প্রভাবশালী মন্ত্রী। তিনি মন্ত্রীর বাইরেও প্রভাবশালী। '৮০-র দশকে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর দিকে একবার সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি আমাকে তার গুলশানের বাসায় ডেকেছিলেন। অবশ্যই তিনি জানেন না যে, আমি তাকে চিনেছি। বিমানে আমাদের কথা হয়- পার্শ্ববর্তী আসনের যাত্রীদের যেমন বা যেভাবে হয়ে থাকে, অনেকটা আবহাওয়া নিয়ে। তিনি একটু নাড়িয়ে দেখেছেন আমি বাংলাদেশের কতটা বুঝি। আমি সচেতনে বুঝিয়েছি, বুঝি না ও আগ্রহীও নই। তিনি এমন সুযোগ দিয়েছেন যাতে আমি ব্যক্তিগত আলাপনে যেতে পারি। কিন্তু আমি এড়িয়ে গেছি। আমি তার কথায় ওহ্! আচ্ছা! এবং 'খুব ভালো কথা' এমন করে সাড়া দিয়েছি। বিমান ঘাটে ভিড়লে তিনি ভিআইপি এলাকা দিয়ে বেরিয়ে যান। আমি সাধারণ শ্রমিকরা যে পথে এই দেশে ফেরে, আমি সেই পথ ধরে ফিরে থাকি। যদিও সেখানে ইউএস নাগরিকদের জন্য আলাদা একটা লাইন থাকে। সেখানেও অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গেই লাইন দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে থাকি আমি।
আমি কেন মন্ত্রীর সঙ্গে অমন থেকেছি- তার কারণ আমার জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুর দরকার নেই। একটি দেশের মন্ত্রী গোত্রীয়দের সঙ্গে আমার এই গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক অর্থহীন।
ক'বছর আগে পাশে এক যাত্রী উঠলেন দুবাই থেকে, এক ভারতীয় আমেরিকান যুবক। এসব তথ্য তিনিই নিজে দিলেন। ওই যুবক আমেরিকার একটি বড় ব্যাংকের দুবাইকেন্দ্রিক কর্মকর্তা। আমি আমেরিকার বড় মিডিয়া কোম্পানিতে কাজ করি। তিনি ঘনিষ্ঠতা বোধ করলেন। অদ্ভুত কারণে তার নিউইয়র্ক অফিস আর আমার অফিস পাশাপাশি। ঢাকা যাচ্ছেন তার ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ কালের ঢাকাই বন্ধুর জন্মদিনে, সরকারের কাছের লোক। দেখলাম গল্পে একেবারে প্রধানমন্ত্রীর ভেতরের পারিবারিক তথ্য পর্যন্ত জানেন। যে বাসায় গিয়ে উঠবেন তাকে আমিও চিনি।? একদা মন্ত্রী ছিলেন, ক্ষমতার ভেতরের লোক এবং আমার ঢাকা জীবনের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধেয় ও ঘনিষ্ঠ সে সময়ে। ওই যুবক অবশ্য বুঝেছিলেন, আমি ঢাকার রাজনীতি বুঝি ও জানি। তাই প্রচ ধাক্কা খেলেন- যখন দেখলেন এ বিষয়ে আমি নির্মোহ। তার অবাক হওয়ার বিষয় ছিল, তিনি জীবনে কোনো ঢাকাবাসীকে দেখেননি যে ক্ষমতা বিষয়ে অনাগ্রহী। আমিই নাকি ব্যতিক্রম তার জ্ঞান মতে। ঘাটে নামার পর তিনি ভিআইপি পথে গেলেন; তার 'ভিআইপি' সুবিধার সোর্স বলে দিলেন। আমি শ্রমিকদের সঙ্গে, শ্রমিকদের কাতার ধরে ঢাকা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াই। এক শিল্পপতির ছেলের ভিনদেশি বন্ধু ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে ভিআইপি নন অথচ সেই সুবিধায় ঢাকা নামেন। আমরা শ্রম গোত্রের লোক। এসব বুঝি কিন্তু কিছু যায় আসে না।
আমাকে কোনোদিন কেউ বিমানবন্দরে রিসিভ করতে আসে না। কাস্টমসে আমার কোনোদিন কিছু ঘোষণা দিতে হয় না যে, আমার কাছে এমন কিছু আছে কিনা। আমার কাছে থাকে বড়জোর নিজের জন্য একটি হুইস্কি অথবা একটি কনিয়াক। ইউএস নাগরিক হিসেবে সে অধিকার আছে। এ ছাড়া এই আমার গ্রামের দেহখানি বাদে সঙ্গে কিছু থাকে না যা রাষ্ট্র বা সরকারকে ঘোষণা দেওয়ার মতন। আমার 'সি অফ' বলেও কিছু নেই। নিভৃত যাত্রী আমি। দু-একদিন গ্রামে থাকি দু-একদিন ঢাকায়।
ক'বছর আগে গাড়ি না পেলে একটা স্কুটারে করে আমি এয়ারপোর্টে এলাম। আমি তখন গ্রাম থেকে ফিরছি। একজন সম্পাদক বন্ধু ফোন করে বললেন- 'আরে আপনি কি ক্রেজি নাকি?' আমি হাসি, তিনি বলেন, 'ওভাবে নিরাপদও নয়।' আমি সাধারণদের লোক।
ক'বছর আগে বরিশাল থেকে আসার সময় আমার যে বন্ধু লঞ্চে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দেয়, সে বলল- আনোয়ার ভাই আপনার বন্ধুদের ফোন করেন আমি কেবিন জোগাড় করতে পারলাম না। বরিশালের প্রধান দুটি লঞ্চ কোম্পানির মালিকরা আমার বাল্যবন্ধু। আমি তখন আমার ওই বন্ধুকে বলি- 'তুমি চিন্তা কইরো না আমি লঞ্চের ডেকে ঘুমিয়ে সদরঘাট যাব, তাও ফোন করব না, কেননা নৈতিকভাবে এই ফোনের অর্থ হবে- আমি সুবিধা নিতে ফোন করেছি। বন্ধুত্বের জন্য নয়।'
আমার জীবনযাপনের বোধে এমন সব বিষয়-আশয় থাকে, যার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু যায় না বা লাগে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বা এমন কিছুর কোনো অর্থ আমার জীবনে নেই। সেসব অনর্থক।
আমি নিপাট গেরস্ত জীবন করি বলে কখনও কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করে না অর্থাৎ প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না, কৌশলগত নিঃসঙ্গ জীবন যেমন। কিন্তু কখনও আমাকে নিয়ে পেছনে প্রশ্ন যে থাকে, সে ধারণা আমার রয়েছে। বিশেষ করে আমার মতন লোক, যার সে সময়ের তুলনায় এক অর্থে সবকিছু ছিল; একেবারে প্রায় নাবালেগ-ছুঁই বয়সে বড় সাংবাদিক, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে 'উঠবস', দেখতে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি অথচ সেসব পেছনে ফেলে, পাশ্চাত্যে চলে গেলাম! আমি সে ইঙ্গিতই ওই বয়সে করেছি যে, আমাকে দিয়ে কথিত 'হবে' বা 'হতো' বা 'হতে পারত'। অথচ সেসবের এখন 'কিছুই হলো না', বিরাট 'অপদার্থ'- এই জাতীয়।
এখন আমরা যদি একটা 'বিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে সমষ্টিগত সংখ্যা বা অর্থ সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করি' তাহলে দেখতে পাই- যা আমার ওই সমাজ উপযোগী 'ছিল' বলে ধরা হয়ে থাকে এবং যে সম্ভাবনা আমি ফেলে এসেছি জলে একটা পরশন, সেসব আসলে কী? একজন সম্পাদক প্রকাশক (নাঈমুল ইসলাম খান), একজন টেলিভিশন প্রধান বা মালিক (মোজাম্মেল বাবু), একজন বড় পত্রিকা বা টেলিভিশন বা আরও অনেক কিছুর প্রধান (নঈম নিজাম), একজন সম্পাদক সাহিত্যিক (ইমদাদুল হক মিলন), একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক সংবাদপত্র কর্মকর্তা (আনিসুল হক), একজন অধ্যাপক সাহিত্যিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ (আসিফ নজরুল)। একজন প্রধান টক শো হোস্ট (জিল্লুর রহমান)। এই সফলতার তালিকা দীর্ঘ করা যেতে পারে, আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত বন্ধু তালিকার কথা উল্লেখ করলাম যা ভাবা হয়ে থাকে। আমার সম্ভবত আর একটি বাড়তি সম্ভাবনা ছিল তা হলো রাজনীতি। আমি এমপি হতে পারতাম, মন্ত্রী হতে পারতাম যারা আমার এই দিকটি জানেন, তাদের জন্য বললাম। এর চেয়ে বেশি কিছু অর্জন তো আর কেউ আশা করেনি, ওই যা আমার ছিল বলে কথিত ভিত হতে।
কিন্তু আমি নিজে এসব জাগতিক অর্জনের ঊর্ধ্বের ভাবনা জগতের মানুষ। ওই অর্থে বরং কিছু না হতে পারার ভেতরেই আমার সন্তুষ্টি এখন। অনেকেই এসব আমার নানাবিধ চালচলন থেকে জানেন। এমন নয় যে, মনে হয় যোগ্যতা হারিয়েছি বরং মনে হয় আগ্রহ হারিয়েছি! এই আলোচনা হতেই তা আমার সামনে কী পেছনে।
মিনার ভাইর মৃত্যুর সময় (মিনার মাহমুদ) সমকাল আয়োজিত মাহবুব আজীজের আমন্ত্রণে আমিও ছিলাম। নইম ভাই আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন 'যারা আমাদের জেনারেশনের সাংবাদিকদের ভেতর থেকে চলে গেছে, তাদের মধ্যে কেবল শাহাদাতকেই দেখি ও কিছু ফিরে পেতে চায় না। আমরা পেছনে সমালোচনা করি একটু ওকে নিয়ে যে ওর অনেক 'ভাব' কিন্তু আমার মনে হয় ও-ই ঠিক আছে, অর্থাৎ ওর নিজ উদ্যোগে মরতে হবে না।' ভালোমন্দ জানি না, এ ধরনের আলোচনা হয়তো আমাকে নিয়ে পেছনেও হয়।
এবং উল্লেখিত ওই- সবকিছুর সনে আমার বিনীত দ্বিমত আছে; এবং আমি জানি এই যে 'সব কিছু' বলে যা বোঝানো হয়, তা কী এবং আমার জন্যও যে ওই সব কিছু কী?
সেই সব নিয়ে কথা বলার আগে কয়েকটি ভূমিকামূলক চিত্র লিখে নিলে হয়তো ভালো হবে মনে হয়। সব চিত্রকে আমি অবশেষে ওই 'পাশ্চাত্য' শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারব।
আমি তখন আজকের কাগজের বিশেষ প্রতিনিধি, আমার বিজনেস কার্ডে লেখা ইংরেজিতে- পলিটিক্যাল ও ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট-, কাজী শাহেদ ভাই নিজ হাতে লিখে দিলেন ওই পদ। তার আগে ব্যারিস্টার আমীর ভাই ফোনে আমার কথা শাহেদ ভাইকে বলে দিলেন। আমি আমীর ভাইকে বললাম, আমীর ভাই আমি চাকরি খুঁজছি, শাহেদ ভাইর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, একটু বলে দেবেন? আমীর ভাই বললেন, কখন যেতে চাও। তার আগে অবশ্য নাঈম ভাই (নাঈমুল ইসলাম খান) ও মতিউর রহমান আজকের কাগজ থেকে চলে গিয়ে ভোরের কাগজ প্রকাশ করেছেন, সেই শূন্যতায় আমার আজকের কাগজে যোগদান।
ততদিনে আমার বড় মেয়ের জন্ম হয়েছে। মালিবাগে তথা ঢাকার একজন বিখ্যাত নারী ডাক্তারের ক্লিনিকে, তার নাম ভুলে গেছি এখন। তার ছেলে আমার বউয়ের ক্লাসমেট ছিল। তার নামটা অবশ্য আমার এখনও মনে আছে (সজল)। ক্লিনিকের মালিকের তথা ডাক্তারের ছেলে আমার বউয়ের ক্লাসমেট বলে তারা বিল কমিয়ে রাখল।
এই যে কন্যা হওয়ার হাসপাতালের খরচ বাবদ দেনা টাকা কমিয়ে রাখা, তার মধ্যে একটা বেদনা বোধ হলো আমার। এর পেছনে আসল সত্য হলো আমার সামর্থ্য ছিল না বলেই তো এই ছাড় প্রশ্ন আসে। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই সমাজ উপযোগে খুব 'ইম্প্রেসিভ' বলে খ্যাত এবং আমি ওই সমাজে প্রচলিত সম্ভাব্য যেকোনো প্রতিযোগিতার জন্যই উপযুক্ত প্রার্থী! পরাজিত হওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু বিয়ের পর অনুভব করলাম আমার আর ঠিক আগের মতন অতটা এই যে 'ইমপ্রেস' করা সংস্কৃতি তেমন ভালো লাগে না। মেয়ের জন্মের পর দেখলাম আমাদের এক বন্ধু ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি টাকা নিচ্ছেন না, নিলেও খুব কম। এ সবের মধ্যে আমার কোথায় যেন অতটা স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। প্রায় সবাই জানে আমার জগতে যা আমার খুব বড় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, তার একটা পরোক্ষ ফল আমি পেতে থাকি।
আমরা দু'জনই সংবাদপত্রে চাকরি করি। আমি আজকের কাগজে, আমার স্ত্রী ডেইলি স্টারে সাব-এডিটর। আমার স্ত্রী আবার ছাত্রলীগের নেত্রী, তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রিয় ছাত্র নেত্রী বলেও খ্যাত। এ সবই আমাদের সেই 'ছিল' বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। সেখান থেকেই মনে করা হতো আমার বউয়ের ক্ষেত্রেও যে সেও কথিত বড় কিছু হাতড়াতে পারবেন, যদি 'শেখ হাসিনা' কোনোদিন ক্ষমতা আসেন। ফলে আমরা হলাম অনেক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, কথিত 'পাওয়ার কাপল'।
আমার দেশের রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর দপ্তর, সংসদ, মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব, শিক্ষাবিদ- হেন অঙ্গন নেই যেখানে অবাধ যাতায়াত অথবা ওঠাবসা নেই। মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে আমার সে সময়েই পেশাগত কারণে আড্ডা দেওয়ার সম্পর্ক ছিল।
এ রকম সময় '৯২ সালে, আমার পারিবারিক শ্রদ্ধাপূর্ণ বন্ধু বেলাল ভাই (ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক) আমেরিকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তার বাসায় তখন তিনি একদিন বললেন, আপনারা দু'জনই কাজ করছেন, কষ্ট করছেন, আমেরিকায় দেখে এলাম তো অনেক বাঙালি থাকেন, তারা ভালোই আছেন, ভাববেন নাকি যাওয়ার কথা? আমি দুষ্টুমি করে বললাম- যেতে পারি কিন্তু আমার কাছে তো বিমানের ভাড়া দেওয়ার অর্থ নেই। বেলাল ভাই বললেন, আপনার ভিসা হলে আমি টিকিটের পয়সা দেবো, তা নিয়ে ভাববেন না। তিনি জানতেন যে, আমার আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর থেকে শুরু করে এমবাসির সব উল্লেখযোগ্য লোকদের সঙ্গে জানাশোনা আছে। আমি যথানিয়মে ভিসা চাইতে পারি।
ঠিক ওই রকম সময়ে একদিন নাঈম ভাই (নাঈমুল ইসলাম খান) ফোন করলেন, বললেন আনোয়ার তুমি কি একটু আমার বাসায় আসবে? তিনি তখন থাকেন দিলু রোডের সেই দিকটায়, যেটা মগবাজারের রাস্তায় মেলে। এখন মনে নেই মিনার ভাই সেই মিটিংয়ে ছিলেন কিনা সে সময়ে। তবে তিনি বললেন- তুমি, মিনার আর আমি মিলে একটা কাগজ করতে চাই (হতে পারে আমি সময় ভুল করছি)। নাঈম ভাই মনে করতেন আমি এসব কাজে মন্দ নই হয়তো। তিনি সে কথা ওইসব দিনে একাধিকবার বলেছেন। এর সবই ওই কাতারে পরে আমার যা 'ছিল' বলে ধরে নেওয়া হয়।
ফলে আমার এই যে 'পশ্চিমে যাত্রা' তা নিয়ে কৌতূহল অনেকের থাকতে পারে বা আছে, তা আমি জানি। সেসব নিয়ে আমি বিবিধ গল্প ফাঁদি। বলি- সেই প্রায় জন্মের পর থেকে যখন প্রথম কদম ফেলে হাঁটা শিখি, সেটা পশ্চিমেই ছিল! এরপর গপ্পো ভাঙিয়ে বলি- আমার মা-বাবার ঘর হলো পুবের ভিটায়, আর দাদি-দাদার ভিটা পশ্চিমে, ফলে আমি যখন প্রথম পা ফেলে হাঁটি স্বভাবতই আমার দাদির ডাকে প্রথম কদমেই পশ্চিমে যাত্রা! আমাদের গ্রামের লোকেরা পুবে যায় বাজার-সদায়, 'উত্তর'-এর হালটে গরু খেদায়, কলাই শাক তোলে, আমাদের মহিষের বাচ্চা হলে সাঁতারের জন্য ছেড়ে দিতে হয় দক্ষিণের খালে। নেয়ামতের হাটে যাত্রাপালায় গ্রামের লোকেরা, 'পশ্চিমের-যাত্রা'য় যায় সেই গ্রাম থেকে পশ্চিমে বলে। সে যাত্রাপালা দক্ষিণে হলে তারা দক্ষিণ যাত্রায় যেত, উত্তরে হলে উত্তর আর পুবে হলে পুবের যাত্রার যাত্রী হয়ে তাদের 'ডায়েরি' সাজাতে পারত।
তার পরও আমি বুঝি আমাদের সংস্কৃতিতে সে যেমন বিশ্বাসে আবার অবিশ্বাসেও ওই পশ্চিমেই ভর করে। পশ্চিমে মাথা কোটে ও ঠোকে, পশ্চিমে দেহ কোটে, পশ্চিমে লোটে।
পশ্চিমে শ্রমের বাজারদর ভালো, ফলে মজুরেরা পশ্চিমে যায়। যেমন- ফসল মৌসুমে মজুররা উজান থেকে ভাটিতে কি ভাটি থেকে উজানে চলে। সে কখনও পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে; আসলে শ্রম ফেরিওয়ালারা যে কোনো দিকেই যায়। কাবুলিওয়ালারা যেমন পুবে আসত। মজুরদের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কাছে বিশেষ 'দিক' বলে কিছু নেই।
আমার বড় মেয়েটিকে দেখা গেল ওর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ও এক মহাপাঠক হয়ে উঠেছে। আমাদের দু'জনের লাইব্রেরি কার্ডে ছুটির দিনে ২৫টা করে ৫০টি ওর বয়স উপযোগী বই তুলে আমরা জ্যাকসন হাইটসে বাজারে যেতাম। আমরা যখন গাড়ির পেছনের আসনে ওর পাশে থেকে বইগুলো ঘরে নিতে চাইতাম, ও বলত বইগুলো নিতে হবে না ওর পড়া শেষ। পঞ্চাশটা বই পড়া শেষে পরের দিন বিকেলে আমারা আবার লাইব্রেরিতে যাই। পরে জেনেছিলাম ওর তখন রিডিং লেভেল সপ্তম শ্রেণির। এই গল্পটি বলার কারণ- আমার 'যা কিছু ছিল' তা আমার মেয়ের ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ৫০টা বই পড়ার জোগান ঢাকায় থাকলে কীভাবে হতো- ভাবি কখনও।
এই মুহূর্তে আমাদের শহরের কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে এখন তার অভিমানী নাগরিকদের খুঁজছে। ফোনে না পেয়ে এখন গণমাধ্যম এমনকি ইউটিউবে বিবিধ বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এই বলে যে, তোমরা কিন্তু আর অনিরাপদ ভেবো না, আমরা কভিডকে ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে এনেছি, ফলে তোমাদের যে নিয়মিত হাসপাতাল কাজ থাকে, দয়া করে এসো কিন্তু, আমরা নিশ্চিত করছি আমাদের হাসপাতাল থেকে কোনোদিন তোমাদের কভিড ধরবে না।
আমি নিজে এই অভিমানী গোত্রের একজন। আমার বার্ষিক মেডিকেল চেকআপ ছিল ফেব্রুয়ারিতে, সেটা পিছিয়ে গেলে ওরা মে মাস থেকে আমাকে খুঁজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছে, আমি প্রতিমাসে 'না' করে দিচ্ছি। এখন যেতে অনুরোধ করছে, যেন আমি যাই। নাগরিক হিসেবে এই যে আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য বোধ- এমন হাজারো কারণ থাকে যখন একজন 'পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি'র পাতাগুলো আর পুবমুখী কোনো দিনপঞ্জির বর্ণনায় ভরে উঠতে দেখা যায় না প্রিয় সব 'প্রশ্নসমূহ' আমার।
রেকর্ড আছে- শহীদ কাদরী তার পরও ফিরেছে; সফেদ কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে শহীদ মিনারে শুয়েছে। অনেকের হয়তো ফেরার অমন সামর্থ্যও থাকে না। তবুও ফিরতে চায় সে, হয়তো ওই বেড়ে ওঠা স্মৃতির দেনা শোধের উদ্যোগ মাত্র। আমি নিজে এসব 'রোমান্টিকতা'র ঊর্ধ্বে। লাশও যা, জীবন্তও তা; ফেরাও যা না ফেরাও তা। কিছু স্মৃতি, কিছু সত্য, কিছু সময় তা জীবনের সঙ্গে থাকে; তার সঙ্গে ফেরা না ফেরা বা পশ্চিম-পুবের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনেক বছর আগে আমার পাশের যাত্রীকে আমি বিমানে ওঠার আগেই চিনেছিলাম দুবাই অপেক্ষাকালে ঢাকার পথে; এরপর বিমানে দেখা গেল আমরা পাশাপাশি বসেছি। আমার চলাফেরায় অনেকগুলো ব্যাপার আছে তাতে দু-একজনের আগ্রহ বা অনাগ্রহ জন্মাবার কারণ থাকে। বিমানে তার প্রধান হলো আমার মদ্যপান! বিমানের সেবক-সেবিকারা আমাকে এ বিষয়ে খুব সহযোগিতা করে থাকেন। আমার কথা শুনে তারা বুঝে ফেলেন যে, আমি এ জগতের আনাড়ি কেউ নই। ফলে বাঙালি সুরতের এই ঢাকা যাত্রীর প্রতি সহযাত্রীর প্রথম আগ্রহের বিষয় থাকে এটা। পাশের যাত্রীর ক্ষেত্রেও তেমন মনে হলো। তাকে আমি আগেই চিনেছি, তিনি একাধিকবার অতি প্রভাবশালী মন্ত্রী। তিনি মন্ত্রীর বাইরেও প্রভাবশালী। '৮০-র দশকে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর দিকে একবার সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি আমাকে তার গুলশানের বাসায় ডেকেছিলেন। অবশ্যই তিনি জানেন না যে, আমি তাকে চিনেছি। বিমানে আমাদের কথা হয়- পার্শ্ববর্তী আসনের যাত্রীদের যেমন বা যেভাবে হয়ে থাকে, অনেকটা আবহাওয়া নিয়ে। তিনি একটু নাড়িয়ে দেখেছেন আমি বাংলাদেশের কতটা বুঝি। আমি সচেতনে বুঝিয়েছি, বুঝি না ও আগ্রহীও নই। তিনি এমন সুযোগ দিয়েছেন যাতে আমি ব্যক্তিগত আলাপনে যেতে পারি। কিন্তু আমি এড়িয়ে গেছি। আমি তার কথায় ওহ্! আচ্ছা! এবং 'খুব ভালো কথা' এমন করে সাড়া দিয়েছি। বিমান ঘাটে ভিড়লে তিনি ভিআইপি এলাকা দিয়ে বেরিয়ে যান। আমি সাধারণ শ্রমিকরা যে পথে এই দেশে ফেরে, আমি সেই পথ ধরে ফিরে থাকি। যদিও সেখানে ইউএস নাগরিকদের জন্য আলাদা একটা লাইন থাকে। সেখানেও অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গেই লাইন দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে থাকি আমি।
আমি কেন মন্ত্রীর সঙ্গে অমন থেকেছি- তার কারণ আমার জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুর দরকার নেই। একটি দেশের মন্ত্রী গোত্রীয়দের সঙ্গে আমার এই গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক অর্থহীন।
ক'বছর আগে পাশে এক যাত্রী উঠলেন দুবাই থেকে, এক ভারতীয় আমেরিকান যুবক। এসব তথ্য তিনিই নিজে দিলেন। ওই যুবক আমেরিকার একটি বড় ব্যাংকের দুবাইকেন্দ্রিক কর্মকর্তা। আমি আমেরিকার বড় মিডিয়া কোম্পানিতে কাজ করি। তিনি ঘনিষ্ঠতা বোধ করলেন। অদ্ভুত কারণে তার নিউইয়র্ক অফিস আর আমার অফিস পাশাপাশি। ঢাকা যাচ্ছেন তার ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ কালের ঢাকাই বন্ধুর জন্মদিনে, সরকারের কাছের লোক। দেখলাম গল্পে একেবারে প্রধানমন্ত্রীর ভেতরের পারিবারিক তথ্য পর্যন্ত জানেন। যে বাসায় গিয়ে উঠবেন তাকে আমিও চিনি।? একদা মন্ত্রী ছিলেন, ক্ষমতার ভেতরের লোক এবং আমার ঢাকা জীবনের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধেয় ও ঘনিষ্ঠ সে সময়ে। ওই যুবক অবশ্য বুঝেছিলেন, আমি ঢাকার রাজনীতি বুঝি ও জানি। তাই প্রচ ধাক্কা খেলেন- যখন দেখলেন এ বিষয়ে আমি নির্মোহ। তার অবাক হওয়ার বিষয় ছিল, তিনি জীবনে কোনো ঢাকাবাসীকে দেখেননি যে ক্ষমতা বিষয়ে অনাগ্রহী। আমিই নাকি ব্যতিক্রম তার জ্ঞান মতে। ঘাটে নামার পর তিনি ভিআইপি পথে গেলেন; তার 'ভিআইপি' সুবিধার সোর্স বলে দিলেন। আমি শ্রমিকদের সঙ্গে, শ্রমিকদের কাতার ধরে ঢাকা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াই। এক শিল্পপতির ছেলের ভিনদেশি বন্ধু ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে ভিআইপি নন অথচ সেই সুবিধায় ঢাকা নামেন। আমরা শ্রম গোত্রের লোক। এসব বুঝি কিন্তু কিছু যায় আসে না।
আমাকে কোনোদিন কেউ বিমানবন্দরে রিসিভ করতে আসে না। কাস্টমসে আমার কোনোদিন কিছু ঘোষণা দিতে হয় না যে, আমার কাছে এমন কিছু আছে কিনা। আমার কাছে থাকে বড়জোর নিজের জন্য একটি হুইস্কি অথবা একটি কনিয়াক। ইউএস নাগরিক হিসেবে সে অধিকার আছে। এ ছাড়া এই আমার গ্রামের দেহখানি বাদে সঙ্গে কিছু থাকে না যা রাষ্ট্র বা সরকারকে ঘোষণা দেওয়ার মতন। আমার 'সি অফ' বলেও কিছু নেই। নিভৃত যাত্রী আমি। দু-একদিন গ্রামে থাকি দু-একদিন ঢাকায়।
ক'বছর আগে গাড়ি না পেলে একটা স্কুটারে করে আমি এয়ারপোর্টে এলাম। আমি তখন গ্রাম থেকে ফিরছি। একজন সম্পাদক বন্ধু ফোন করে বললেন- 'আরে আপনি কি ক্রেজি নাকি?' আমি হাসি, তিনি বলেন, 'ওভাবে নিরাপদও নয়।' আমি সাধারণদের লোক।
ক'বছর আগে বরিশাল থেকে আসার সময় আমার যে বন্ধু লঞ্চে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দেয়, সে বলল- আনোয়ার ভাই আপনার বন্ধুদের ফোন করেন আমি কেবিন জোগাড় করতে পারলাম না। বরিশালের প্রধান দুটি লঞ্চ কোম্পানির মালিকরা আমার বাল্যবন্ধু। আমি তখন আমার ওই বন্ধুকে বলি- 'তুমি চিন্তা কইরো না আমি লঞ্চের ডেকে ঘুমিয়ে সদরঘাট যাব, তাও ফোন করব না, কেননা নৈতিকভাবে এই ফোনের অর্থ হবে- আমি সুবিধা নিতে ফোন করেছি। বন্ধুত্বের জন্য নয়।'
আমার জীবনযাপনের বোধে এমন সব বিষয়-আশয় থাকে, যার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু যায় না বা লাগে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বা এমন কিছুর কোনো অর্থ আমার জীবনে নেই। সেসব অনর্থক।
আমি নিপাট গেরস্ত জীবন করি বলে কখনও কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করে না অর্থাৎ প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না, কৌশলগত নিঃসঙ্গ জীবন যেমন। কিন্তু কখনও আমাকে নিয়ে পেছনে প্রশ্ন যে থাকে, সে ধারণা আমার রয়েছে। বিশেষ করে আমার মতন লোক, যার সে সময়ের তুলনায় এক অর্থে সবকিছু ছিল; একেবারে প্রায় নাবালেগ-ছুঁই বয়সে বড় সাংবাদিক, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে 'উঠবস', দেখতে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি অথচ সেসব পেছনে ফেলে, পাশ্চাত্যে চলে গেলাম! আমি সে ইঙ্গিতই ওই বয়সে করেছি যে, আমাকে দিয়ে কথিত 'হবে' বা 'হতো' বা 'হতে পারত'। অথচ সেসবের এখন 'কিছুই হলো না', বিরাট 'অপদার্থ'- এই জাতীয়।
এখন আমরা যদি একটা 'বিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে সমষ্টিগত সংখ্যা বা অর্থ সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করি' তাহলে দেখতে পাই- যা আমার ওই সমাজ উপযোগী 'ছিল' বলে ধরা হয়ে থাকে এবং যে সম্ভাবনা আমি ফেলে এসেছি জলে একটা পরশন, সেসব আসলে কী? একজন সম্পাদক প্রকাশক (নাঈমুল ইসলাম খান), একজন টেলিভিশন প্রধান বা মালিক (মোজাম্মেল বাবু), একজন বড় পত্রিকা বা টেলিভিশন বা আরও অনেক কিছুর প্রধান (নঈম নিজাম), একজন সম্পাদক সাহিত্যিক (ইমদাদুল হক মিলন), একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক সংবাদপত্র কর্মকর্তা (আনিসুল হক), একজন অধ্যাপক সাহিত্যিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ (আসিফ নজরুল)। একজন প্রধান টক শো হোস্ট (জিল্লুর রহমান)। এই সফলতার তালিকা দীর্ঘ করা যেতে পারে, আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত বন্ধু তালিকার কথা উল্লেখ করলাম যা ভাবা হয়ে থাকে। আমার সম্ভবত আর একটি বাড়তি সম্ভাবনা ছিল তা হলো রাজনীতি। আমি এমপি হতে পারতাম, মন্ত্রী হতে পারতাম যারা আমার এই দিকটি জানেন, তাদের জন্য বললাম। এর চেয়ে বেশি কিছু অর্জন তো আর কেউ আশা করেনি, ওই যা আমার ছিল বলে কথিত ভিত হতে।
কিন্তু আমি নিজে এসব জাগতিক অর্জনের ঊর্ধ্বের ভাবনা জগতের মানুষ। ওই অর্থে বরং কিছু না হতে পারার ভেতরেই আমার সন্তুষ্টি এখন। অনেকেই এসব আমার নানাবিধ চালচলন থেকে জানেন। এমন নয় যে, মনে হয় যোগ্যতা হারিয়েছি বরং মনে হয় আগ্রহ হারিয়েছি! এই আলোচনা হতেই তা আমার সামনে কী পেছনে।
মিনার ভাইর মৃত্যুর সময় (মিনার মাহমুদ) সমকাল আয়োজিত মাহবুব আজীজের আমন্ত্রণে আমিও ছিলাম। নইম ভাই আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন 'যারা আমাদের জেনারেশনের সাংবাদিকদের ভেতর থেকে চলে গেছে, তাদের মধ্যে কেবল শাহাদাতকেই দেখি ও কিছু ফিরে পেতে চায় না। আমরা পেছনে সমালোচনা করি একটু ওকে নিয়ে যে ওর অনেক 'ভাব' কিন্তু আমার মনে হয় ও-ই ঠিক আছে, অর্থাৎ ওর নিজ উদ্যোগে মরতে হবে না।' ভালোমন্দ জানি না, এ ধরনের আলোচনা হয়তো আমাকে নিয়ে পেছনেও হয়।
এবং উল্লেখিত ওই- সবকিছুর সনে আমার বিনীত দ্বিমত আছে; এবং আমি জানি এই যে 'সব কিছু' বলে যা বোঝানো হয়, তা কী এবং আমার জন্যও যে ওই সব কিছু কী?
সেই সব নিয়ে কথা বলার আগে কয়েকটি ভূমিকামূলক চিত্র লিখে নিলে হয়তো ভালো হবে মনে হয়। সব চিত্রকে আমি অবশেষে ওই 'পাশ্চাত্য' শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারব।
আমি তখন আজকের কাগজের বিশেষ প্রতিনিধি, আমার বিজনেস কার্ডে লেখা ইংরেজিতে- পলিটিক্যাল ও ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট-, কাজী শাহেদ ভাই নিজ হাতে লিখে দিলেন ওই পদ। তার আগে ব্যারিস্টার আমীর ভাই ফোনে আমার কথা শাহেদ ভাইকে বলে দিলেন। আমি আমীর ভাইকে বললাম, আমীর ভাই আমি চাকরি খুঁজছি, শাহেদ ভাইর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, একটু বলে দেবেন? আমীর ভাই বললেন, কখন যেতে চাও। তার আগে অবশ্য নাঈম ভাই (নাঈমুল ইসলাম খান) ও মতিউর রহমান আজকের কাগজ থেকে চলে গিয়ে ভোরের কাগজ প্রকাশ করেছেন, সেই শূন্যতায় আমার আজকের কাগজে যোগদান।
ততদিনে আমার বড় মেয়ের জন্ম হয়েছে। মালিবাগে তথা ঢাকার একজন বিখ্যাত নারী ডাক্তারের ক্লিনিকে, তার নাম ভুলে গেছি এখন। তার ছেলে আমার বউয়ের ক্লাসমেট ছিল। তার নামটা অবশ্য আমার এখনও মনে আছে (সজল)। ক্লিনিকের মালিকের তথা ডাক্তারের ছেলে আমার বউয়ের ক্লাসমেট বলে তারা বিল কমিয়ে রাখল।
এই যে কন্যা হওয়ার হাসপাতালের খরচ বাবদ দেনা টাকা কমিয়ে রাখা, তার মধ্যে একটা বেদনা বোধ হলো আমার। এর পেছনে আসল সত্য হলো আমার সামর্থ্য ছিল না বলেই তো এই ছাড় প্রশ্ন আসে। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই সমাজ উপযোগে খুব 'ইম্প্রেসিভ' বলে খ্যাত এবং আমি ওই সমাজে প্রচলিত সম্ভাব্য যেকোনো প্রতিযোগিতার জন্যই উপযুক্ত প্রার্থী! পরাজিত হওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু বিয়ের পর অনুভব করলাম আমার আর ঠিক আগের মতন অতটা এই যে 'ইমপ্রেস' করা সংস্কৃতি তেমন ভালো লাগে না। মেয়ের জন্মের পর দেখলাম আমাদের এক বন্ধু ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি টাকা নিচ্ছেন না, নিলেও খুব কম। এ সবের মধ্যে আমার কোথায় যেন অতটা স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। প্রায় সবাই জানে আমার জগতে যা আমার খুব বড় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, তার একটা পরোক্ষ ফল আমি পেতে থাকি।
আমরা দু'জনই সংবাদপত্রে চাকরি করি। আমি আজকের কাগজে, আমার স্ত্রী ডেইলি স্টারে সাব-এডিটর। আমার স্ত্রী আবার ছাত্রলীগের নেত্রী, তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রিয় ছাত্র নেত্রী বলেও খ্যাত। এ সবই আমাদের সেই 'ছিল' বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। সেখান থেকেই মনে করা হতো আমার বউয়ের ক্ষেত্রেও যে সেও কথিত বড় কিছু হাতড়াতে পারবেন, যদি 'শেখ হাসিনা' কোনোদিন ক্ষমতা আসেন। ফলে আমরা হলাম অনেক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, কথিত 'পাওয়ার কাপল'।
আমার দেশের রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর দপ্তর, সংসদ, মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব, শিক্ষাবিদ- হেন অঙ্গন নেই যেখানে অবাধ যাতায়াত অথবা ওঠাবসা নেই। মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে আমার সে সময়েই পেশাগত কারণে আড্ডা দেওয়ার সম্পর্ক ছিল।
এ রকম সময় '৯২ সালে, আমার পারিবারিক শ্রদ্ধাপূর্ণ বন্ধু বেলাল ভাই (ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক) আমেরিকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তার বাসায় তখন তিনি একদিন বললেন, আপনারা দু'জনই কাজ করছেন, কষ্ট করছেন, আমেরিকায় দেখে এলাম তো অনেক বাঙালি থাকেন, তারা ভালোই আছেন, ভাববেন নাকি যাওয়ার কথা? আমি দুষ্টুমি করে বললাম- যেতে পারি কিন্তু আমার কাছে তো বিমানের ভাড়া দেওয়ার অর্থ নেই। বেলাল ভাই বললেন, আপনার ভিসা হলে আমি টিকিটের পয়সা দেবো, তা নিয়ে ভাববেন না। তিনি জানতেন যে, আমার আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর থেকে শুরু করে এমবাসির সব উল্লেখযোগ্য লোকদের সঙ্গে জানাশোনা আছে। আমি যথানিয়মে ভিসা চাইতে পারি।
ঠিক ওই রকম সময়ে একদিন নাঈম ভাই (নাঈমুল ইসলাম খান) ফোন করলেন, বললেন আনোয়ার তুমি কি একটু আমার বাসায় আসবে? তিনি তখন থাকেন দিলু রোডের সেই দিকটায়, যেটা মগবাজারের রাস্তায় মেলে। এখন মনে নেই মিনার ভাই সেই মিটিংয়ে ছিলেন কিনা সে সময়ে। তবে তিনি বললেন- তুমি, মিনার আর আমি মিলে একটা কাগজ করতে চাই (হতে পারে আমি সময় ভুল করছি)। নাঈম ভাই মনে করতেন আমি এসব কাজে মন্দ নই হয়তো। তিনি সে কথা ওইসব দিনে একাধিকবার বলেছেন। এর সবই ওই কাতারে পরে আমার যা 'ছিল' বলে ধরে নেওয়া হয়।
ফলে আমার এই যে 'পশ্চিমে যাত্রা' তা নিয়ে কৌতূহল অনেকের থাকতে পারে বা আছে, তা আমি জানি। সেসব নিয়ে আমি বিবিধ গল্প ফাঁদি। বলি- সেই প্রায় জন্মের পর থেকে যখন প্রথম কদম ফেলে হাঁটা শিখি, সেটা পশ্চিমেই ছিল! এরপর গপ্পো ভাঙিয়ে বলি- আমার মা-বাবার ঘর হলো পুবের ভিটায়, আর দাদি-দাদার ভিটা পশ্চিমে, ফলে আমি যখন প্রথম পা ফেলে হাঁটি স্বভাবতই আমার দাদির ডাকে প্রথম কদমেই পশ্চিমে যাত্রা! আমাদের গ্রামের লোকেরা পুবে যায় বাজার-সদায়, 'উত্তর'-এর হালটে গরু খেদায়, কলাই শাক তোলে, আমাদের মহিষের বাচ্চা হলে সাঁতারের জন্য ছেড়ে দিতে হয় দক্ষিণের খালে। নেয়ামতের হাটে যাত্রাপালায় গ্রামের লোকেরা, 'পশ্চিমের-যাত্রা'য় যায় সেই গ্রাম থেকে পশ্চিমে বলে। সে যাত্রাপালা দক্ষিণে হলে তারা দক্ষিণ যাত্রায় যেত, উত্তরে হলে উত্তর আর পুবে হলে পুবের যাত্রার যাত্রী হয়ে তাদের 'ডায়েরি' সাজাতে পারত।
তার পরও আমি বুঝি আমাদের সংস্কৃতিতে সে যেমন বিশ্বাসে আবার অবিশ্বাসেও ওই পশ্চিমেই ভর করে। পশ্চিমে মাথা কোটে ও ঠোকে, পশ্চিমে দেহ কোটে, পশ্চিমে লোটে।
পশ্চিমে শ্রমের বাজারদর ভালো, ফলে মজুরেরা পশ্চিমে যায়। যেমন- ফসল মৌসুমে মজুররা উজান থেকে ভাটিতে কি ভাটি থেকে উজানে চলে। সে কখনও পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে; আসলে শ্রম ফেরিওয়ালারা যে কোনো দিকেই যায়। কাবুলিওয়ালারা যেমন পুবে আসত। মজুরদের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কাছে বিশেষ 'দিক' বলে কিছু নেই।
আমার বড় মেয়েটিকে দেখা গেল ওর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ও এক মহাপাঠক হয়ে উঠেছে। আমাদের দু'জনের লাইব্রেরি কার্ডে ছুটির দিনে ২৫টা করে ৫০টি ওর বয়স উপযোগী বই তুলে আমরা জ্যাকসন হাইটসে বাজারে যেতাম। আমরা যখন গাড়ির পেছনের আসনে ওর পাশে থেকে বইগুলো ঘরে নিতে চাইতাম, ও বলত বইগুলো নিতে হবে না ওর পড়া শেষ। পঞ্চাশটা বই পড়া শেষে পরের দিন বিকেলে আমারা আবার লাইব্রেরিতে যাই। পরে জেনেছিলাম ওর তখন রিডিং লেভেল সপ্তম শ্রেণির। এই গল্পটি বলার কারণ- আমার 'যা কিছু ছিল' তা আমার মেয়ের ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ৫০টা বই পড়ার জোগান ঢাকায় থাকলে কীভাবে হতো- ভাবি কখনও।
এই মুহূর্তে আমাদের শহরের কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে এখন তার অভিমানী নাগরিকদের খুঁজছে। ফোনে না পেয়ে এখন গণমাধ্যম এমনকি ইউটিউবে বিবিধ বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এই বলে যে, তোমরা কিন্তু আর অনিরাপদ ভেবো না, আমরা কভিডকে ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে এনেছি, ফলে তোমাদের যে নিয়মিত হাসপাতাল কাজ থাকে, দয়া করে এসো কিন্তু, আমরা নিশ্চিত করছি আমাদের হাসপাতাল থেকে কোনোদিন তোমাদের কভিড ধরবে না।
আমি নিজে এই অভিমানী গোত্রের একজন। আমার বার্ষিক মেডিকেল চেকআপ ছিল ফেব্রুয়ারিতে, সেটা পিছিয়ে গেলে ওরা মে মাস থেকে আমাকে খুঁজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছে, আমি প্রতিমাসে 'না' করে দিচ্ছি। এখন যেতে অনুরোধ করছে, যেন আমি যাই। নাগরিক হিসেবে এই যে আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য বোধ- এমন হাজারো কারণ থাকে যখন একজন 'পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি'র পাতাগুলো আর পুবমুখী কোনো দিনপঞ্জির বর্ণনায় ভরে উঠতে দেখা যায় না প্রিয় সব 'প্রশ্নসমূহ' আমার।
রেকর্ড আছে- শহীদ কাদরী তার পরও ফিরেছে; সফেদ কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে শহীদ মিনারে শুয়েছে। অনেকের হয়তো ফেরার অমন সামর্থ্যও থাকে না। তবুও ফিরতে চায় সে, হয়তো ওই বেড়ে ওঠা স্মৃতির দেনা শোধের উদ্যোগ মাত্র। আমি নিজে এসব 'রোমান্টিকতা'র ঊর্ধ্বে। লাশও যা, জীবন্তও তা; ফেরাও যা না ফেরাও তা। কিছু স্মৃতি, কিছু সত্য, কিছু সময় তা জীবনের সঙ্গে থাকে; তার সঙ্গে ফেরা না ফেরা বা পশ্চিম-পুবের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিষয় : কালের খেয়া
মন্তব্য করুন