খুব ছোটবেলা থেকে পশ্চিমের প্রতি রাগ জন্মেছিল। পশ্চিমমুখী স্বপ্ন দেখার প্রশ্নই ওঠে না। খুব ছোট যখন কত আর বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। ঢোলা হাফপ্যান্ট নামিয়ে 'হিসু' করতে গিয়ে বাড়ির মুরব্বির চাটি এসে পড়ত মাথার পেছনে! আর রাগত কণ্ঠে বলতেন- এই! ঐ দিকে পশ্চিম! আমি ঠিকই রাখতে পারতাম না তখন ঠিক কোন দিকে পশ্চিম। সেই রাগই আমায় বড় হওয়ার পরেও স্বপ্ন দেখতে দেয়নি পশ্চিমা দুনিয়ায় পাড়ি দিয়ে থিতু হওয়ার। স্কুলের মাঝারি ক্লাস থেকে নেশা পেয়ে বসেছিল হলিউডের ইংরেজি ছবি দেখার। পাকিস্তানি উর্দু ছবি বা বাংলা ছবি একটু কম টানত। দেশি ছবি একটু প্যানপেনা লাগত। 'দি গান অব নাভারন', 'ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই', 'রোমান হলিডে', ডনি ওয়েনের 'কাউবয়' এক বিশাল জগৎ চোখের সামনে খুলে দিত। তাই বলে কখনও ভাবিনি বিলেত কিংবা আমেরিকা যাব। অথচ তাই হলো আমার জীবনে! স্বপ্ন ছিল দেশেই একটু ফুলে-ফুলে ডালে-ডালে হালকা নাম করব। আমার কাজ দেখে মানুষ মুগ্ধ হবে। দু-একজন সুন্দরী নারী সই চাইতে এলে পাঁচ লাইন লিখে দেবো। এতেই খুশি। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে পাল্লা দিতে সবাই এক পথে এগোয়! আমি একই সঙ্গে দুই পথে বেশ আরামসে এগোচ্ছিলাম আঁকা ও লেখা। বিয়ের পর থেকেই শুরু হলো পশ্চিমমুখী বাতাস। বিয়ের সময় স্ত্রী চাকরি করত ডেনমার্ক দূতাবাসে। বিয়েতে অনেক ডেনিশ মেম সাহেব, সাহেব এসেছিলেন। বিয়ের দিন তাই তেমন একটা কথা না বলে পার পেয়ে গিয়েছি। পরে পুরোনো ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে মেম সাহেবরা আসছে শুনলেই মা ডাকছেন বা অসুখ বলে চট্টগ্রাম পালাতাম। কতদিন আর এভাবে পারা যায়। ধীরে ধীরে মুখোমুখি হতে লাগলাম। ভয়টাও হাল্ক্কা হতে লাগল। বিয়ের আগে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দু'রুমের বাসা অর্ধেক-অর্ধেক শেয়ার করে থাকতাম। বিয়ের পর সুরমার আজাদ রহমানের ৬৪/সি গ্রিন রোড চার তলায় নিজস্ব সংসার পাতলাম। দোতলায় পেলাম লিজ রাসমুশন ও শিল্পী বন্ধু কাজলকে। ডেনিশ এনজিও অফিস কাম-বাসা। প্রায় মাসে লিজ কাজলের বাসায় পার্টিতে ডেনিশ, সুইডিশ লোকদের সঙ্গে আলাপ হতো, ব্রিটিশ, জার্মানরাও আসত। তখনি স্ত্রী ডেনিশ রাষ্ট্রদূতের চিঠি নিয়ে গিয়ে ইউএস ভিসা নিয়ে এলেন। আমি পাসপোর্ট দিইনি, যেহেতু যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তখন ইউএস ভিসা অফিস মতিঝিলে পূর্বাণী হোটেলের সামনে ছিল। ছয় মাসের ভিসা শেষ হলো, স্ত্রীর যাওয়া হলো না। দ্বিতীয়বার আবার নিল এবার এক বছরের ভিসা, তাও যাওয়া হলো না। সময় গড়িয়েছে, আমাদের মেয়ে হয়েছে, রাহাত ভাই (খান) থেকে তাঁর পুরোনো পাবলিকা গাড়ি কিনেছি। স্ত্রী ডেনিশ দূতাবাস ছেড়ে কাছেই পরীবাগে বিশ্বব্যাংকে চাকরি নিয়েছে। আমিও জমিয়ে কাজ করছি বিটপীতে। ভাবলাম স্ত্রীর এই ইউএস বেড়ানোর ঝোঁক আর উঠবে না। কিন্তু উঠল আবার, এবার ভিসা অফিসার অবাক হয়ে বললেন, বার বার ভিসা নিয়ে তুমি যাও না কেন? তোমার স্বামীর ভিসার আবেদন করো না কেন? সে কি সেখানেই থাকে? আমার স্ত্রী যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
- আমার স্বামী তো যেতে চায় না, তাই পাসপোর্টও দেয় না।
- কী বলো আমেরিকা যেতে চায় না এমন লোক কি এদেশে আছে নাকি! কাল তোমার স্বামীকে যদি পাসপোর্টসহ সঙ্গে আনো তাহলে মাল্টিপল ভিসা পেয়ে যাবে।
আর রক্ষা হলো না। যেতে হলো। ভিসা অফিসার জিজ্ঞেস করলেন- সত্যি তুমি আমেরিকা যেতে চাও না? কেন?
- ভয় লাগত। স্ত্রীর জন্য যেতেই হবে। সেই ভিসা পেয়ে দুই বছর পার, আর মাস তিনেক বাকি থাকতেই মন্ট্রিয়লবাসী স্ত্রীর ছোট বোন ক্যালিফোর্নিয়ার আরেক কাউন্টিতে নিউপোর্ট বিচ সিটিতে বিচের পাশেই ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করল। লস এঞ্জেলেস থেকে মাত্র এক ঘণ্টা ড্রাইভ দূরে। সে এলো কানাডা মন্ট্রিয়ল থেকে, আমরা গেলাম ঢাকা থেকে। সেই লস এঞ্জেলেস। স্বপ্নের মতো দিন কাটতে লাগল প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে নিউপোর্ট বিচে। চার বছরের অগ্নিলাকে নিয়ে ড্রিমল্যান্ডে যাই, স্ত্রীসহ ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে গোটা দিন ঘুরি, মাটি ছুঁয়ে দেখি এখানেই কাউবয় আমেরিকান হিরো জন ওয়েন, ক্লাইন্ট ইস্টউড ঘোড়ায় পিস্তল উঁচিয়ে কী ছুটতেন! সান দিয়াগো মেক্সিকান বর্ডারের লাগোয়া শহর। সি ওয়ার্ল্ড সেখানে বিশ্ববিখ্যাত। আমি ঢাকায় পাবলিকা চালিয়ে চালিয়ে ভালোই গাড়ি চালাতে শিখেছি। তবে আমেরিকান ফ্রি ওয়েতে ৬৫ মাইল স্পিডে গাড়ি চালানো বৈধ হলেও ৭০ কিংবা ৭৫ মাইলে সবাই গাড়ি চালায়। না আছে কোনো লাল-সবুজ সিগন্যাল না কোনো বাধা। একটানা গাড়ি চালিয়ে এক শহর থেকে এক শহর তো অবশ্যই, অন্য দেশ যেমন- মেক্সিকো বা কানাডাও চলে যাওয়া যায়।
স্বপ্নিল দুই মাস যেন চোখের পলকে পার। স্ত্রীর বিশ্বব্যাংকে চাকরি, ছুটি নিয়ে গেছে, তার ছোট বোনের সবকিছু কানাডার মন্ট্রিয়লে, তারও ফিরতে হবে। আমি স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললাম। যা ডলার সঙ্গে আমরা এনেছিলাম, সবই রয়ে গেছে। একটা উপন্যাস লেখার জন্য এখানের বাঙালি জীবনটা আরও একটু দেখতে আমি কয়েক সপ্তাহ থাকি। অভিনেতা খলিল সাহেবের সুপুত্র মোহাম্মদ মুসা সাদরে তার বাসায় থাকতে দেবে। সেই যে স্ত্রী আমাকে রেখে মেয়েকে নিয়ে ঢাকা গেল, আমার ফিরতে দুই বছর পার। এমন নয় যে, আমার আমেরিকায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। শুধু এই বিচিত্র দেশ, মানুষ, জীবনযাপন ভালো করে দেখতে ইচ্ছায় এই থাকা। বৈধভাবে থাকার জন্য পাসাডিনায় প্লেট আর্ট ইনস্টিটিউটে দুই বছরের ফাইন আর্টে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। তখনও কম্পিউটার গ্রাফিক আসেনি। হাতেই নানা ধরনের গ্রাফিক ডিজাইন করে দিতাম। তারাও কোনো আমেরিকান ডিজাইনারকে যে ডিজাইন চারশ' ডলার দেওয়ার কথা, আমাকে দুইশ' ডলার দিত। আমার সেটাই অনেক। সারা মাসে অনেক কাজ, ক্যাশে কাজ করি। কারণে অকারণে ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রি ওয়েতে শুধু গাড়ি নিয়ে ছুটতাম। আমার জীবনে এই সময়টাতেই দামি ও কম দামি আটটি গাড়ি বদলিয়েছি। তাতে দামি সিআরএস হোন্ডা স্পোর্টস কারও ছিল আবার ছয়শ' ডলারের আধভাঙা করোলাও ছিল।
একদিন গ্রিন রোডের স্পার্কেল ভিডিওর হালিম, মেক্সিকান বর্ডার পেরিয়ে লস এঞ্জেলেস এলো, এসব '৯০ এর কথা। বলল, আপনার ঠিকানা নিতে ঢাকায় বাসায় গিয়েছিলাম। আপনার মেয়ের দুই বছর বয়স বেড়েছে, সামনের দুটি দাঁত পড়েছে। আকাশে প্লেনের শব্দ পেলে ছুটে ব্যালকনিতে যায় চিৎকার করতে করতে- বাবা আসছে। বাবা আসছে। এ কথা শোনার পর মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা ফিরে এলাম।
আমার পশ্চিমা জীবন দেখা হয়ে গেছে, ফ্রি ওয়েতে লক্ষ লক্ষ মাইল গাড়ি চালানো হয়ে গেছে। পাশে মেক্সিকো আর চিলি দেখাও হয়ে গেছে। এবার শুধু ঢাকাতে আঁকতে হবে, নিয়তি বলে কিছু যে আছে তা টের পেলাম। মাত্র ক'টা বছর পেরোতেই স্ত্রীর করা কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের চিঠি এলো। স্ত্রীর ইন্টারভিউ হয়ে গেছে, শুধু আমারটাই বাকি। স্ত্রীকে বললাম, ইন্টারভিউ ঢাকায় হলে আছি, সিঙ্গাপুর কিংবা দিল্লি হলে আমি নেই। এমন কপাল ঠিকই ঢাকায় পড়ল ইমিগ্রেশন ইন্টারভিউ। সপরিবার পেয়েও গেলাম কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন। এক বছর মেয়াদ ইমিগ্রেশন ভিসার। পুরোটা বছরই দ্বিধায় ভুগলাম। থাকা ভালো! নাকি যাওয়া ভালো। শেষ পর্যন্ত এসে নামলাম ভিসা যেদিন শেষ তার আগের দিন। সেই শুরু কানাডার জীবন।
বিদেশে বেড়াতে যাওয়া বা দু-এক বছরের জন্য স্কলারশিপে গিয়ে থাকা আর ইমিগ্রেশন নিয়ে এসে চিরতরে থিতু হতে আসার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। যারাই এভাবে আসেন তারা দেশে একটা পর্যায় থেকে পাকা ফলের মতো টুপ করে বিদেশের মাটিতে শূন্য হয়ে আসেন। এক জীবনে দু'বার শূন্য থেকে শুরু তো সবার জন্য সহজ হয় না। আর যারা ক্রিয়েটিভ মানুষ তা সে যে কোনো মাধ্যমের হোক না কেন, তাদের আবার নিজস্ব শিকড় দিয়ে নিজস্ব মাটি থেকেই টেনে নিতে হয়। এটা বুঝেছিলেন বলেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ সময় মতো ফিরে গেছেন। তবে কিছুটা সুবিধা আছে আঁকিয়ে শিল্পীদের। যেহেতু মাঝখানে ভাষার বাধা নেই। আঁকায় যদি দম থাকে, আঁকা যদি গ্লোবাল হয়, তাহলে যে কোনো দেশের দর্শককে তা টানবে।
ল্যান্ডেড ইমিগ্র্যান্ট আমরা তিনজন আমি, স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা এসে ল্যান্ড করেছিলাম কানাডার ফরাসি ভাষাভাষির প্রদেশ কুইবেকের বড় শহর মন্ট্রিয়লে। সেখানেই বসবাস করেন আমার স্ত্রীর ছোট ভাই ও বোন। তারা ছোট বয়সে ছাত্রছাত্রী হিসেবে পড়তে এসে মূলধারায় মিশে গেছে। দু'জনই বিয়ে করেছে স্থানীয় ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান। তাদের হার্ডওয়ার্কিং বিষয়, সম্পত্তি বিশাল। জীবনের মধ্যভাগে এসে চাইলেও তাদের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী একটু সময় নিলেও বুঝলেন ব্যাপারটি। নামুর সাবওয়ে স্টেশনের কাছে নামুর আর্ট গ্যালারিতে এন্ট্রি একটু সহজে হলো। তারা আমার 'টিয়ার্স অব নেচার' সিরিজের কিছু ছবি তাদের গ্যালারিতে রাখলেন। প্রথম মাসেই তিনটি ছবি বিক্রি হলে তাদের আমার কাজ সম্পর্কে একটা আস্থা গড়ে উঠল। কানাডার প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক 'বাংলাবার্তা'র সম্পাদক মামুনুর রশীদের রু পাপিনোর বাসায় কিছুদিন ছিলাম। সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে 'টিম হরটন' কফি শপে আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি এক গ্রিক দেবতার মতো কার্লি লম্বা চুলের তরুণ, আর কি অপূর্ব হাসি তার, সবার সঙ্গে হাত মেলায়। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে খুব খাতির। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন- ও হচ্ছে জাস্টিন ট্রুডো, ওর বাবা পিয়ের ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই আধুনিক কানাডা গড়ে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে উৎফুল্ল হলো, বাড়ি চট্টগ্রাম শুনে জড়িয়ে ধরল। আমি তো অবাক ব্যাপারটা কী! জাস্টিন ট্রুডো আজ নিজেই প্রধানমন্ত্রী; শিশুর মতো আনন্দে লাফিয়ে বলল- আমি গিয়েছি চট্টগ্রামে। আমার ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে। তার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যুশয্যায়, সেন্ট প্লাসিড চার্চ পাথরঘাটার প্রিস্ট ছিলেন তিনি, তাকে দেখতে এসেছিলেন। তখনকার প্রেসিডেন্ট মিস্টার রহমান হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছিলেন।
ভালোই জমে উঠেছিল প্যারিসের ছায়ামাখা মন্ট্রিয়ল শহরে। তবে মুশকিল হলো মেয়ের স্কুল নিয়ে ফ্রেঞ্চ স্কুলে আবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে। সে ছোট্ট থেকে ঢাকার গ্রিন হেরাল্ড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টোতে পাড়ি জমালাম। টরন্টোতে সব ইংরেজি। সহজে মেয়ের ভর্তি হয়ে গেল। আমি টরন্টো ডাউন টাউনে আমেরিকার বিখ্যাত অ্যাড ফার্ম লিউ কার্নেটের অফিস বিশাল অট্টালিকায় গেলাম। ঢাকায় বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থার এই লিউ বার্নেটের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন ছিল। এদের কত এক্সপার্ট ঢাকায় ট্রেনিং ওয়ার্কশপ করতে যেত। আমি বিটপীর সিনিয়র আর্ট ডিরেক্টর ছিলাম। এখানে অন্তত এন্ট্রি লেভেলের কোনো কাজ তো জুটবে। সুযোগ পেলে প্রমাণ করব আমি কতটা কাজের। দু'জন আর্ট ডিরেক্টর হাতে পুরোনো অ্যানুয়াল রিপোর্ট গ্লোবাল নিয়ে এসেছেন। তাতে আমার করা ঢাকা 'মবিল' কোম্পানির বিশাল অ্যাড ক্যাম্পেইনের বিস্তারিত ছাপা হয়েছিল। কাজের ব্যাপারে বললেন, তোমার তো এখানকার অ্যাডভার্টাইজিং-এ মাস্টার্স নেই তাছাড়া বয়সও হয়েছে। তেরোজন ফ্রেঞ্চ পাস করে এন্ট্রির জন্য লাইনে আছে।
আমি বুঝলাম এখানে এসব চাকরি-বাকরি হবে না। বাংলা টাউনে দেখি সব ব্যবস্থা আছে শুধু প্রিন্টিং অ্যান্ড ডিজাইন নেই। তরুণ বন্ধু বাঙালি রনি ডি রোজারিওকে নিয়ে 'ইনডিজাইন ডিজাইন অ্যান্ড প্রিন্টিং' বাঙালি কমিউনিটিতে প্রথম শুরু করলাম। এখন সম্ভবত চার-পাঁচজন এই ডিজাইন অ্যান্ড প্রিন্টিং বিজনেসে এসে ভালোই করছে। মুশকিলটা হলো- আমার ছবি আঁকা ও প্রদর্শনী নিয়ে। এই জগতে এখানে ঢোকা আরও কঠিন। প্রায় ত্রিশের ওপরে বাঙালি শিল্পী আছে তবে প্রফেশনাল আর্ট প্রাক্টিস নেই। কোনোদিন ভালো কোনো আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী করা সুযোগ করে উঠতে পারেননি।
বাংলা কমিউনিটির গুরুজনরা আশ্বাস দিলেন- চিন্তা করবেন না। আপনার নাম আমরা দেশের পত্রপত্রিকায় অনেক দেখেছি। আমরা আপনার ছবি প্রদর্শনী করব বাংলা টাউনে মক্কা রেস্টুরেন্টের দেয়ালে পেরেক ঠুকে। আমাদের ফোকাল বাংলা সাপ্তাহিকে তার কভারেজ যাবে। আমি মিনমিন করে বললাম- এখানকার প্রফেশনাল আর্ট গ্যালারি পাবো না! এখানকার নম্বর ওয়ান ইংরেজি দৈনিক 'টরন্টো স্টারে' কভারেজ কি ছাপা হতে পারে না?
সবার সেদিন সেকি অট্টহাসি। হাসি থামতে বললেন সবাই- ইকবাল ভাই আপনার এখানে আর একটি জন্ম লাগবে। তখন সব হবে।
- আমি তো এই জন্মে চাই! হাতে সময়ও বেশি নেই।
আবার অট্টহাসি সহ্য করতে হলো। তবে বেশি দিন নয়, পরের বছরেই ইমাগো অল কানাডা আর্ট কম্পিটিশনে এন্ট্রির জন্য তিনটি ডিজিটাল ইমেজ দিতে চাইলাম। স্ত্রী বাধা দিলো, ৫০ ডলার এন্ট্রি ফি অনেক, ২০০২ সালের কথা বলছি। ফেরেশতার মতো তখনই সুরসাধক কলিম শরাফীর কন্যা আলিয়া শরাফী এলেন। তাঁর মায়া হলো, তিনি নিজের ক্রেডিট কার্ড থেকে ৫০ ডলার দিয়ে এন্ট্রি করিয়ে দিলেন। পরের মাসে দেখা গেল কানাডার ১০টা প্রদেশের ৮০০ আর্টিস্টের ১৪০০ ছবির মধ্যে মাত্র ১০টি ছবি ফাইনালিস্ট হয়েছে। আমার 'টিয়ারস অব নেচার-২৫' ছবিটিকে প্রটেস্ট অব গ্লোবাল ওয়ার্মিং থিমে আঁকা ওন্টারিও প্রদেশের ফাইনালিস্ট করা হয়েছে। এই ১০টি ছবি থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হবে। এর পরেই টরন্টো ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান স্টাডি বিভাগ স্পন্সর করল আমার ও অন্য একজন ভারতীয় শিল্পীর সাউথ এশিয়ান ওমেন বিষয়ে ২৫টি ছবির টু ম্যান শো। আমার 'আওয়ার ওমেন' সিরিজের দুটি ছবি তাদের সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসের পার্মানেন্ট আর্ট গ্যালারির জন্য সংগ্রহ করল। এর পরেই ১২ জন জুরি মনোনীত করে। সিডারিজ তিন রুমের আর্ট গ্যালারি ছয় একর জায়গার মধ্যে। এই ঐতিহ্যবাহী গ্যালারিতে মনোনীত হলাম একক ছবির প্রদর্শনীর জন্য। আমাকে যেতে হলো না। 'টরন্টো স্টার'-এর রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার প্রদর্শনীতে এলো ইন্টারভিউ নিতে, ছবি তুলতে। একই গ্যালারিতে পর পর দুই বছর ব্যবধানে তিনবার হলো আমার একক প্রদর্শনী। শেষটি নিজের ১৮তম একক ২০১৯ সালে করে দেশে গেলাম আর্ট সামিট ও বইমেলায়। দেশে যেমন বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস- কত জায়গায় পর পর নিজের প্রদর্শনী করেছি, টরন্টোতেও সেই মানে নিজেকে উন্নীত করেছি। অন্য কেউ করেনি নিজকেই করতে হয়েছে। এরই ফসল ২০১৯ সালের একক প্রদর্শনীর ক্যাটালগে আমার ছবি নিয়ে টরন্টোর রয়েল ওন্টারিও মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর সাউথ এশিয়ান আর্টের বিশেষজ্ঞ ড. দীপালী দেওয়ান ছয় পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি লেখেন।
তবে জীবনে দিক নির্ধারণ এখনও হয়নি। যখনই পশ্চিমে থাকি, পূর্বে নিজের দেশের জন্য প্রাণ টানে। আবার পূর্বে যখন নিজের দেশে থাকি, পশ্চিমে প্রিয় কানাডার সৎ ও সংগ্রামী মানুষের জন্য দায়িত্ববোধ তীব্রভাবে টানে। আসলে কিছু মানুষের জীবনই এমন, পাখির মতো ডাল থেকে ডালে বিচরণ করে। আমারও হয়তো সেই পক্ষিজীবন।