পর্ব ::০৪
পূর্বে প্রকাশিতের পর
আমরা দেখব আজফার আর হাসনার সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসনা মাঝেমাঝেই তুমুল ঝগড়া করবে। এক পর্যায়ে সে আলাদা ঘরেও শুতে আরম্ভ করবে। আজফার তাকে ফেরানোর চেষ্টা করবে- হাসনা, এর কোনো মানে হয় না।
হাসনা অবাক গলায় বলবে- তোমরা মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে জুয়া খেলবে, তার মানে হয়, আর আমার আলাদা ঘরে শোয়ার মানে হয় না!
আমরা বাজি না ধরলেই মানুষের মৃত্যু বন্ধ হয়ে যাবে?
কথা তো সেটা না। তোমরা কী পরিমাণ নোংরা কাজে জড়িয়ে পড়েছ, কথা সেটা।
তুমি নোংরা ভাবছ, তাই নোংরা।
এমনিতে নোংরা না?
আজফার চুপ করে থাকবে।
তোমরাও যদিও কম নয়, তোমাদের এই বাবলু ভাই লোকটা মহাহারামজাদা।
বলো। কিন্তু তার জন্যই দুটো পয়সা আসছে। একটা ব্যবসা গুছিয়ে বসতে পারব করোনা গেলে। যদিও করোনা খুব তাড়াতাড়ি যাবে না...।
যাবে না। হাসনাকে হতাশ দেখাবে। কে বলেছে?
বাবলু ভাই।
ওহ, সে তো বলবেই। সে তো তাই চায়।
ঠিক সেরকম না।... ধরো, কয়েকটা ওষুধ কোম্পানি করোনার ওষুধ বানিয়ে ফেলল, কিংবা ভ্যাকসিন, কোটি কোটি ডলার খরচ করবে তারা, অনেক লাভ না হওয়া পর্যন্ত তারা চাইবে করোনা যাক!
অদ্ভুত কথা। মামাবাড়ির আবদার। কীভাবে করোনা চালু রাখবে তারা, কে চালু রাখবে? তোমাদের বাবলু ভাই?
আজফার মাথা ঝাঁকাল।
মানে!
মানে,... আমার কথা না, বাবলু ভাই নিজেই বলেছেন- বাবলু ভাই তো সব জায়গায়ই আছে।
বড় করে শ্বাস ফেলে হাসনা বলল- আমি কী চাই, জানো? আল্লাহ আমাকে যত গুনাহ দিক, আমি চাই তোমাদের এই বাবলু ভাইয়ের করোনা হোক।

এরকম কত কথাই না লোকে বলে। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট, ঘৃণা থেকে বলে, তারপর ভুলে যায়। হাসনা ও আজফার দু'জনই এই কথা ভুলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। তারা ভোলার সময় পেল না। কারণ কয়েকদিনের মাথায় বাবলু ভাইয়ের করোনা ধরা পড়ল। বাবলু ভাই দু'দিন বাসায় থাকল, তৃতীয় দিন হাসপাতালে ভর্তির সময় আজফার ও রাজিনকে ফোন করে জানিয়ে গেল- এ তো কয়েকদিনের ব্যাপার, মানে, সুস্থ হতে যে ক'দিন লাগে আর কী, সে কটা দিন, না না, অন্য কোনো ভয় নেই, আজফার আর রাজিন যেন আরেকটু বেশি সক্রিয় থাকে, একটু বেশি সময় যেন দেয় শামীমকে, শামীম- যে এই নেটওয়ার্কের টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো দেখে, আর, যারা আছে বাজিতে, তাদের সংখ্যা যেন না কমে, বাড়ূক, বাড়লে বোনাস।
বাবলু ভাইয়ের করোনা হয়েছে শুনে হাসনা বলল- আল্লাহ আছে।... তওবা। কিন্তু আমি না বলে থাকতে পারছি না- আল্লহ আছে।
করোনা কত মানুষেরই হচ্ছে।
তোমাদের বাবলু ভাইয়েরও হয়েছে। ঠিক হয়েছে।
এভাবে বললে- আমারও হতে পারে।
তোমরা হচ্ছ চুনোপুঁটি, নাটের গুরুর হয়েছে, এরপর শিষ্যদের হবে, এর মধ্যে ওসব ছেড়েছুড়ে ভালো হয়ে যাও।
ছাড়তে তো হবেই। করোনা কি সারাজীবন থাকবে নাকি?
সেদিনই- না বললে, থাকবে অনেকদিন, তোমাদের বাবলু ভাই বলেছে... এই লোকের বয়স কত?
বাবলু ভাইয়ের? আছে। আমাদের চেয়ে তো বড়ই। তবে বয়সটা ঠিক বোঝা যায় না।
এভাবে বলতে হয় না, তবু বলি- কোনো ক্রনিক অসুখ নেই, সামলে নিতে পারবে?
এই প্রশ্নে আজফার চিন্তিত বোধ করবে, তবে সেটা সে হাসনাকে বুঝতে দিতে চাইবে না- কী বলো! বাবলু ভাই ঠিকই...।
রাজিনকে সে অবশ্য বলবে- চিন্তায় পড়ে গেলাম। না?
হুম। বাবলু ভাই না থাকলে এটা আমরা চালাতে পারব না।
তোর কী মনে হয়? বাবলু ভাই কি...?
বাজি ধরে তো কিছু বলা যায় না ...।
আজফারের চোখ হঠাৎই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে- কী বললি তুই, বাজি?
হ্যাঁ, বাজি। বাজিই তো। বাজি ধরে কী বলা যায়, বাবলু ভাই বাঁচবে কি মরবে?
এই, এটাই আমার কথা।... দাঁড়া...।
আজফার ফোন করবে বাবলু ভাইকে- বাবলু ভাই, সুস্থ হয়ে উঠছেন, না?
এইটা তো আজফার ঠিক কইতে পারি না। তোমরা কাজকর্ম চালায়া নিতেছ?
জি জি, ওটা নিয়ে ভাববেন না, চলছে। কিন্তু আপনার শরীর কেমন?
ক্যামনে কই! ডাক্তাররা এইটা কয় ওইটা হয়। কিছুই বুঝি না। কখনও মনে হয় গেছি গা, কখনও মনে হয় আছি। তবে আজফার, বাবলু ভাইয়ের জান শক্ত।
এই কথা, কথায় কথায় আজফারের মুখ থেকে শুনে হাসনা বলবে- আমার সঙ্গে বাজি ধরবে তুমি?
কী বাজি?
যতই বাহাদুরি করুক আর বলুক জান শক্ত- তোমাদের বাবলু ভাই এবার যাবে।
তাই! আজফার হাসবে। কবে?
তা জানি না, তবে যাবে।
এই কথা মাথার ভেতর ঢুকে যাবে আজফারের। সে রাজিনকে বলবে- তোকে আগেও বলেছি, বাবলু ভাইয়ের কিছু হলে এ ব্যবসা পড়ে যাবে।
যাক। টাকা তো বেশ কামিয়েছি আমরা।
একটা বাম্পার মেরে সরে যাব? পরে বাবলু ভাই না থাকলে কিন্তু নানা ঝামেলাও হতে পারে।
কী বাম্পার?
বাবলু ভাইকে নিয়ে একটা বাজি ছেড়ে দিই মার্কেটে। বেশি রেটে?
কী রকম?
বাজিটা হবে এরকম- বাবলু ভাই মরবে কবে? আমরা এক সপ্তাহ সময় দেব। এর মধ্যে যে যার দিন-তারিখের ওপর বাজি ধরবে। কমাবে-বাড়াবে।
তুই বাবলু ভাইয়ের হাতে খুন হতে চাস?
না।... তোর একটা বড় সমস্যা কী, জানিস? তুই খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু বাবলু ভাইকে বোঝার ক্ষেত্রে তুই বড়ই নাদান।
আচ্ছা! তা, তুই ভালো বুঝিস বাবলু ভাইকে?
আজফার সে কথার উত্তর না দিয়ে বাবলু ভাইকে ফোন করল। তাকে নিরুত্তাপ ও নিশ্চিত দেখাল। বাবলু ভাইকে অবশ্য সহজে পাওয়া গেল না। তার ফোন ব্যস্ত, অনেকক্ষণ ধরে ব্যস্ত। একবার রিং হলো তো, তিনি নিজেই সেটা কেটে দিলেন। আজফারকে কিছুটা হতাশ দেখাল। তবে মিনিট বিশেক পর বাবলু ভাই যখন নিজেই ফোন করল, তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বাবলু ভাই বলল- আর কইও না মিয়া...।
কী হলো, বাবলু ভাই?
আমি হইলাম করোনার রোগী, রেস্ট দরকার, কিন্তু ফোনের জ্বালায়...।
শরীর কেমন আপনার?
ওই আগের মতো।
কবে ছাড়া পাবেন, ভাই?
সেইটা জানে ডাক্তাররা।... কও, তোমগো কথা কও।
একটা পরিকল্পনা ছিল, আপনি হয়তো অ্যাপ্রিশিয়েট করবেন...।
না শুনলে ক্যামনে কই...।
এদিকে ব্যবসা ধরেন, আল্লাহর দোয়ায়, আপনার রহমতে- ভালো। হঠাৎ আজ একটা বুদ্ধি আসল- ব্যবসায় একটা বাম্পার মারতে পারি।
খুইলা কও, আজফার। প্যাঁচাইও না।
আজফার খুলে বলবে। শুনে ওপাশে বাবলু ভাই হাসতে আরম্ভ করল। বাবলু ভাইয়ের হাসি প্রায়-সবসময়ই একরকম, ফলে বুঝতে অসুবিধা হয়, হাসিটা কীসের। তবে এ হাসি যে আনন্দ ও ফুর্তির, সেটা বোঝা যাবে বাবলু ভাই মুখ খুললে- তোমাগো ব্রেইন খুলছে। আরম্ভ কইরা দেও।
আপনার নামে?
তো কার নামে! আমার নামে করবা বইলাই-না অনুমতি নিলা!
আপনি মজা পাবেন, জানতাম।
এমন মজা বহুদিন পাই নাই। আবার পয়সাও আসবে, আবার পাবলিসিটি ভি হইব।
আজফার তখন হাসি মুখে রাজিনের দিকে তাকাবে।
বাসায় ফিরে কিছু সময় নেবে আজফার, হাসনাকে বলার মতো একটা সুযোগ খুঁজবে সে, যখন পাবে, বলবে- ওসব ছেড়ে দিচ্ছি।
হাসনাকে দেখে মনে হবে সে আজফারের কথা বুঝতে পারেনি।
এই, এই সব জুয়া, বাজি। বাবলু ভাই বলল, যাবে যখন যাও। তবে লাস্ট একটা বাজি ধরার ব্যবস্থা করে যাও। ... এরপর আর বাবলু ভাইয়ের সঙ্গেও থাকব না।
হাসনা চোখে সন্দেহ নিয়ে আজফারের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
আহা, বিশ্বাস করো, সত্যি বলছি। এটাই শেষবার।
বেশ। দেখব।
বাজিটা কী নিয়ে, শুনবে না?
ওই তো, ওরকমই কিছু হবে। ... কী বাজি?
বাবলু ভাই মরবে কবে- এই নিয়ে।
এটা কী ধরনের বাজি?
এটাই, এটাই। এটা জমবে।
কত টাকা বাজি ধরতে হয়?
মিনিমাম দশ হাজার। তারপর বাড়তেও পারে।
হাসনা আলমারি খুলে দশ হাজার টাকা আজফারের হাতে দিয়ে বলবে- আমার জমানো টাকা থেকে দিলাম। তোমাদের বাবলু ভাই মরবে- এই আমার বাজি।
কবে, তা বলতে হবে।
তা হলে আমি একটু ভেবে বলি।
কিন্তু দিন যেতে লাগল, বাবলু ভাই মরল না। সে নিজেই মাঝে মাঝে ফোন করল আজহারকে- কী অবস্থা, আজহার?
টাকা তো শুধু বাড়ছে, বাবলু ভাই। একেকজন একেকটা ডেট বলছে, সেটা পার হয়ে গেলে টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে নতুন ডেটে বাজি ধরছে।
বাবলু ভাই যতবার আজফারের মুখে এমন শোনেন, ততবার ঠাঠা করে হাসেন- বোকার দল। আমি হচ্ছি ডাইনোসর। আমার কী মরা সাজে!
ডাইনোসর কিন্তু...।
সেটা প্রাচীন যুগের কথা। এখন বাবলু ভাই বাইরে-বাইরে ডাইনোসর, ভেতরে তার তেলেপোকার মতো বেঁচে থাকা।... টাকা তুলে যাও, আজফার।
[সমাপ্ত]

বিষয় : ধারাবাহিক গল্প

মন্তব্য করুন