
-২০টা টাকা দেন।
সারাদিনের অফিস ক্যাচাল সেরে বেরিয়ে মাত্র সিগারেটটা ধরিয়েছি, ওমনি আচমকা হাঁক। চমকে তাকালাম। বোরখা পরা নেকাবে মুখ ঢাকা এক মহিলা। হয়তো মাঝবয়সী হবেন। ভদ্রমহিলাই হয়তো বলা যেত, কিন্তু ক'জন ভিক্ষুককে কি এই স্ট্যাটাস দেওয়া যায়? ভিক্ষারও যে রোজ কত আপগ্রেটেড তরিকা! এই যেমন- এই মহিলা ঠিক ২০ টাকাই কেন চাইছে? ১০ বা ১০০ কেন না?
মহিলা আমার ভাব বুঝে বলে উঠল, ২০টা টাকা দেন। রোজা রাখছি। ইফতার করমু।
এই দফায় আরও বিভ্রান্ত হলাম! মহিলা এই লাইনে নতুন নাকি ঝানু? এই লেবাসে সাধারণত কাঁচুমাচু হয়ে বলে- ভাই, আমি ভিক্ষুক না। স্বামী অসুস্থ...
তা ছাড়া এখন রোজার মাস না। মহররমের এই রোজা আম্মাও রাখেন। কিন্তু যাদের বাড়িতে বারো চান্দে নফল রোজার প্রচলন নাই তারা অবাক হতো, এখন কিসের রোজা? আর আপনি কি আমার ভরসায় রোজা রাখছিলেন যে ইফতার করাব?
আমি মুহূর্তকাল ভাবলাম। ২০ টাকা এখন এমন কোনো টাকাই না। রিকশাওয়ালাও রিকশায় কোমর ঠেকালেই ২০-এ রাজি হয় না। আমি দিনে কয়েকবার এই টাকা ধোঁয়ায় ওড়াই। দিয়ে দিলাম। মহিলা সালাম দিয়ে চলে গেলেন। ছোটবেলায় ফকিরদের ডাক দেওয়া দেখতাম। বাড়ির জানালার কাছে এসে উচ্চস্বরে- 'লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ...। মাগো কয়টা খয়রাত দেন গো মা...'
আমার মনে হতো, এসেই এই যে মুসলমান প্রমাণের জন্য কলেমা পড়ছে, হিন্দু বাড়ি হলে?
আরেকটা কমন দেখতাম, 'শাড়ি/লুঙ্গি ছিঁড়া গ্যাছে। নামাজ পড়বো, দেন।'
নামাজ না পড়লে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া যায় না? না নামাজের কথা বললে লোকে অবলিগেশনে পরে দিয়ে দেবে?
এই বিভ্রান্তি কেটেছিল বিয়ের পর হানিমুনে কলকাতা দিল্লি আজমির বেড়াতে গিয়ে। তখন দীপাবলি উৎসব চলছে। কলকাতার পথে ভিখারিণীর দল ধরেছিল,
-মা কালীর নামে দিয়ে দে, জলদিসে জুড়ি মিলে যাবে।
বললাম, জুড়ি তো মিলেই গেছে, সঙ্গে করেই তো এনেছি!
বউয়ের দিকে ফিরে সাথে সাথে লাইন পাল্টে গেল,
-মা কালী জলদিসে গোদ ভরিয়ে দেবে, কালীর নামে দিয়ে দে।
আমার বউ সংস্কারী মুসলিম পরিবারের। তাছাড়া দেশে সংখ্যাগুরু হিসেবে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য নামে ভিক্ষা আমরা শুনি না। তাই মা কালীর নামে দেওয়া ঠিক হবে কিনা দ্বিধান্বিত, দনোমনো করছিল বউ। তারাও নাছোড়বান্দা। বুঝলাম, এই হলো অস্থিতিশীল অর্থনীতির দেশের মনস্তত্ত্ব। যে দেশে যে ধর্মের প্রাধান্য, সে ধর্মের নামে ভয় বা আশা জাগিয়ে মানুষের দুর্বল জায়গায় হানা দিয়ে পয়সা আদায় করা। ধর্ম সব যুগে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক হাতিয়ার।
এই যে আমি মহিলাকে টাকাটা দিলাম, সে ল্যাংড়া আঁতুড় না। ছোট বাচ্চা না। কাজেই রোজার কথা না বললে এত সহজে কি দিতাম? কী জানি!
ড্রাইভারকে কল দিয়েছিলাম। গাড়িতে উঠে বসেই অন্ধকারে ইকবালকে নজরে এলো। আমার গাড়ি দেখেই আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ইকবাল এখানে কী করছে?
কোভিড-১৯ এর প্রকোপে হোম অফিস শুরুর গোড়ার দিকে ৩০ শতাংশ কর্মীকে অনির্দিষ্টকালীন অবৈতনিক বা সামান্য বেতনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, ইকবাল সেই ৩০ শতাংশের একজন। আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা এই ৩০ শতাংশকে হয়তো আর ফেরানো হবে না। হোম অফিস আমাদের অনেক অজানা কিছু জানিয়েছে। এই যে এত লোকের জন্য এত বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার না চালিয়ে এর অর্ধেক ছেড়ে দিলেও চলে। এতে কত খরচ বেঁচে যায়। কিন্তু এই ৩০ শতাংশর সংসার বা নিজের পেটই বা কি করে চলবে?
এই ৩০ শতাংশের কাজ ছিল ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে ঘিরেই। পিওন, অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট, ক্লিনার ইত্যাদি। কাজেই এদের কি আর ফেরা হবে?
আমাদের অফিস ইন্টারনেট কোম্পানির অফিস। এই কভিডের অতিমারিতে যে কিছু সেক্টর ভালো ছিল বা ভালো ব্যবসা করে নিয়েছে, আইএসপি সার্ভিস সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাড়ি বসে সবার সারাদিন ভালো নেট কানেকশন লাগছে, ওয়াইফাই লাগছে। ঘরে ঘরে অনলাইন ক্লাসের শিক্ষার্থী, বাবা-মায়েরা হোম অফিস করছে। কানেকশন দিয়ে কুলানো যাচ্ছে না। লাইনম্যানরা খুবই ব্যস্ত। কিন্তু অফিসের অন্য তৃতীয় শ্রেণিদের কাজ কমেছে।
অবস্থা দেখে আমি আতঙ্কিত। যেসব অফিসে ব্যবসা ঘাটতি হয়েছে, সেখানে তাহলে কেমন লোক ছাঁটাই হচ্ছে? বিবিসি এপ্রিলে রিপোর্ট করেছে বাংলাদেশে ছয় কোটি মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। এসব ভাবনা শরীরকেও প্রভাবিত করে। অথচ বলা হচ্ছে দুর্ভাবনা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। কিন্তু দুর্ভাবনা এড়িয়ে থাকি কী করে! সরকারি চাকরি ছাড়া এখন কে ভাবনাহীন? এই সেদিন কোটা আন্দোলনে ছেলেগুলোর দামালপনা দেখে মনে হচ্ছিল, চাকরি প্রার্থী পাঁচ কোটি, সরকারি চাকরির সিট হাজার পাঁচেক। কীসের জন্য তাহলে আন্দোলন? এখন টের পাচ্ছি এই সোনার হরিণ এই দেশে কত কাঙ্ক্ষিত, কত আবশ্যিক!
ইকবালকে ডেকে কিছু বলার সাহস হলো না! আমার আর কিচ্ছু করার নেই। প্রথম দিকে যেভাবে পেরেছি সাহায্য-সহযোগিতা করেছি, দেশের অন্য যে কোনো দুর্যোগের মতো। কিন্তু এই দুর্যোগের কোনো দিকনির্দেশনা নেই যে কবে পরিত্রাণ পাব। নিজের কষ্টেসৃষ্টে করা ফ্ল্যাট-গাড়ি আছে; সেভিংস নেই। লোন শোধ করতেই মাসে সব শেষ। নিজেকে বিপন্ন রেখে কদ্দিন আর কীভাবে পাশে দাঁড়াব?
কাউকে দেখলে বলি, কেমন আছ?
এখন সেই সাধারণ প্রশ্নের তর্জমা হলো- সুস্থ আছ তো? চাকরি এখনও আছে?
আমার বউ ইমির স্কুল প্রাইভেট। ছাত্ররা আসছে না। কাজেই বেতন নেই। অনলাইন ক্লাসেও ছাত্র টানা যায়নি। এই সময়ে নিজের ঘরেই দেখি প্রয়োজনের বাইরে খরচ না। এখন ঘরপ্রতি বাচ্চাপ্রতি কম্পিউটার কী করে বাবা-মা কিনবেন? মোবাইলের ছোট স্ট্ক্রিনে পড়া বোঝা যায় না। আমাদের বাচ্চা একটাই- সে এখন মায়ের ল্যাপটপ দখল করেছে। যদি ইমির স্কুলটা চালু থাকত, তাহলে ছেলের ল্যাপটপ কিনতে হতো।
ইমির স্কুল চালু থাকার সময়ে ক'জন বাচ্চাও বাড়িতে পড়তে আসত। ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। তাই প্রথম প্রথম হোম অফিসে ইমি খুব আনন্দে ছিল। রান্না আর ফটো, ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার দেবার কী ধুম! এরপর কিটো ডায়েট, কী সব ওয়ার্ক আউট।
এখন ইমির বিষণ্ণ উদ্বিগ্ন চোখ টিভির পর্দায় আর পুরোনো না পড়া বইতে প্রাণহীন দৃষ্টি বুলায়। ছেলে কম্পিউটারে গেম খেলে আর নেটফ্লিক্স মুভি দেখেও এখন বিতৃষ্ণ। ছোট বোনটাকে মাত্র বিয়ে দিয়েছিলাম চায়নাপ্রবাসী ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলের চায়নায় চাকরি চলে গেছে। আসতেও পারছে না দেশে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছোট বোনকে আর আম্মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তবু এই বদ্ধ ঘরে আটকে না থেকে শ্বাস নিক। রোজ রোজ কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছে না।
আমাদের ফ্ল্যাটের অনেকে চলে গেছে; কিন্তু টেলিকমের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লতিফ যেদিন চলে গেল গ্রামের বাড়িতে, সবকিছু নিয়ে সপরিবারে ট্রাকের পেছনে নিজেদের ফার্নিচারের ওপর বসে, সেদিন আমার হতবাক হওয়া সীমা ছাড়িয়েছে! লতিফ অবশ্য বলেছে, ওদের হোম অফিস দিয়েছে, ডিসেম্বরের আগে নিয়মিত অফিস চালু হবার সম্ভাবনা নেই, তাই চলে যাওয়া। কিন্তু বুঝতে তো পারি এত দীর্ঘদিনের হোম অফিসে কোনো কোম্পানি নিশ্চয়ই পুরো বেতন দেবে না। এভাবেও অনেক কোম্পানি খরচ কমাচ্ছে। আমাদের হয়তো কিছুদিন পরে শুরু হবে। কিন্তু টেলিকমদের ব্যবসা তো পড়েনি! আমার লজিক বলছে, এই বেতন আর আগের জায়গায় ফিরবে না। এরপর ইনক্রিমেন্ট এখান থেকেই শুরু হবে! উন্নত দেশেও তাই হবার আশঙ্কা, সেখানে উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ নৈতিকতা দুরাশা।
ফেসবুকে দেখছি সবাই ডেইরি ফার্ম খুলছে! আমাদের সৃজনশীলতাও কম, কেউ কিছু করে সফল হলে সবাই চোখ বুজে তাই করছে! যেন পরানের গহিনে ভিতরে কেউ ইস্রাফিলের ফুঁক শুনে দিগ্ভ্রান্ত। কেউ একজন শেয়ার করেছে 'ডিপ্রেশন, অস্থিরতা হলো ঈশ্বর আর তোমার মাঝে দূরত্ব।' আমি মনে-প্রাণে ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছি।
অন্ধকারে বারন্দায় বসে ইকবালের কথা ঘুরেফিরে মাথায় আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই অতিমারীর প্রকোপ কাটতে দুই বছর লাগবে। ততদিনে আমার চাকরি থাকবে তো? চাকরি চলে গেলে আমিও কি রোজ সকালে বেরিয়ে ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বুঝ দিব আমার চাকরি আছে? না ট্রাকে মালপত্র তুলে গ্রামে চলে যাব? ফ্ল্যাট, গাড়িটা লোনের কিস্তি না পেলে ব্যাংক নিয়েই যাবে? আর আমার বউ কি তখন লুকিয়ে বোরখা- নেকাবে মুখ ঢেকে রাস্তায় দাঁড়াবে?
-২০টা টাকা দেন। রোজা রাখছি, ইফতার করমু।
সারাদিনের অফিস ক্যাচাল সেরে বেরিয়ে মাত্র সিগারেটটা ধরিয়েছি, ওমনি আচমকা হাঁক। চমকে তাকালাম। বোরখা পরা নেকাবে মুখ ঢাকা এক মহিলা। হয়তো মাঝবয়সী হবেন। ভদ্রমহিলাই হয়তো বলা যেত, কিন্তু ক'জন ভিক্ষুককে কি এই স্ট্যাটাস দেওয়া যায়? ভিক্ষারও যে রোজ কত আপগ্রেটেড তরিকা! এই যেমন- এই মহিলা ঠিক ২০ টাকাই কেন চাইছে? ১০ বা ১০০ কেন না?
মহিলা আমার ভাব বুঝে বলে উঠল, ২০টা টাকা দেন। রোজা রাখছি। ইফতার করমু।
এই দফায় আরও বিভ্রান্ত হলাম! মহিলা এই লাইনে নতুন নাকি ঝানু? এই লেবাসে সাধারণত কাঁচুমাচু হয়ে বলে- ভাই, আমি ভিক্ষুক না। স্বামী অসুস্থ...
তা ছাড়া এখন রোজার মাস না। মহররমের এই রোজা আম্মাও রাখেন। কিন্তু যাদের বাড়িতে বারো চান্দে নফল রোজার প্রচলন নাই তারা অবাক হতো, এখন কিসের রোজা? আর আপনি কি আমার ভরসায় রোজা রাখছিলেন যে ইফতার করাব?
আমি মুহূর্তকাল ভাবলাম। ২০ টাকা এখন এমন কোনো টাকাই না। রিকশাওয়ালাও রিকশায় কোমর ঠেকালেই ২০-এ রাজি হয় না। আমি দিনে কয়েকবার এই টাকা ধোঁয়ায় ওড়াই। দিয়ে দিলাম। মহিলা সালাম দিয়ে চলে গেলেন। ছোটবেলায় ফকিরদের ডাক দেওয়া দেখতাম। বাড়ির জানালার কাছে এসে উচ্চস্বরে- 'লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ...। মাগো কয়টা খয়রাত দেন গো মা...'
আমার মনে হতো, এসেই এই যে মুসলমান প্রমাণের জন্য কলেমা পড়ছে, হিন্দু বাড়ি হলে?
আরেকটা কমন দেখতাম, 'শাড়ি/লুঙ্গি ছিঁড়া গ্যাছে। নামাজ পড়বো, দেন।'
নামাজ না পড়লে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া যায় না? না নামাজের কথা বললে লোকে অবলিগেশনে পরে দিয়ে দেবে?
এই বিভ্রান্তি কেটেছিল বিয়ের পর হানিমুনে কলকাতা দিল্লি আজমির বেড়াতে গিয়ে। তখন দীপাবলি উৎসব চলছে। কলকাতার পথে ভিখারিণীর দল ধরেছিল,
-মা কালীর নামে দিয়ে দে, জলদিসে জুড়ি মিলে যাবে।
বললাম, জুড়ি তো মিলেই গেছে, সঙ্গে করেই তো এনেছি!
বউয়ের দিকে ফিরে সাথে সাথে লাইন পাল্টে গেল,
-মা কালী জলদিসে গোদ ভরিয়ে দেবে, কালীর নামে দিয়ে দে।
আমার বউ সংস্কারী মুসলিম পরিবারের। তাছাড়া দেশে সংখ্যাগুরু হিসেবে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য নামে ভিক্ষা আমরা শুনি না। তাই মা কালীর নামে দেওয়া ঠিক হবে কিনা দ্বিধান্বিত, দনোমনো করছিল বউ। তারাও নাছোড়বান্দা। বুঝলাম, এই হলো অস্থিতিশীল অর্থনীতির দেশের মনস্তত্ত্ব। যে দেশে যে ধর্মের প্রাধান্য, সে ধর্মের নামে ভয় বা আশা জাগিয়ে মানুষের দুর্বল জায়গায় হানা দিয়ে পয়সা আদায় করা। ধর্ম সব যুগে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক হাতিয়ার।
এই যে আমি মহিলাকে টাকাটা দিলাম, সে ল্যাংড়া আঁতুড় না। ছোট বাচ্চা না। কাজেই রোজার কথা না বললে এত সহজে কি দিতাম? কী জানি!
ড্রাইভারকে কল দিয়েছিলাম। গাড়িতে উঠে বসেই অন্ধকারে ইকবালকে নজরে এলো। আমার গাড়ি দেখেই আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ইকবাল এখানে কী করছে?
কোভিড-১৯ এর প্রকোপে হোম অফিস শুরুর গোড়ার দিকে ৩০ শতাংশ কর্মীকে অনির্দিষ্টকালীন অবৈতনিক বা সামান্য বেতনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, ইকবাল সেই ৩০ শতাংশের একজন। আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা এই ৩০ শতাংশকে হয়তো আর ফেরানো হবে না। হোম অফিস আমাদের অনেক অজানা কিছু জানিয়েছে। এই যে এত লোকের জন্য এত বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার না চালিয়ে এর অর্ধেক ছেড়ে দিলেও চলে। এতে কত খরচ বেঁচে যায়। কিন্তু এই ৩০ শতাংশর সংসার বা নিজের পেটই বা কি করে চলবে?
এই ৩০ শতাংশের কাজ ছিল ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে ঘিরেই। পিওন, অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট, ক্লিনার ইত্যাদি। কাজেই এদের কি আর ফেরা হবে?
আমাদের অফিস ইন্টারনেট কোম্পানির অফিস। এই কভিডের অতিমারিতে যে কিছু সেক্টর ভালো ছিল বা ভালো ব্যবসা করে নিয়েছে, আইএসপি সার্ভিস সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাড়ি বসে সবার সারাদিন ভালো নেট কানেকশন লাগছে, ওয়াইফাই লাগছে। ঘরে ঘরে অনলাইন ক্লাসের শিক্ষার্থী, বাবা-মায়েরা হোম অফিস করছে। কানেকশন দিয়ে কুলানো যাচ্ছে না। লাইনম্যানরা খুবই ব্যস্ত। কিন্তু অফিসের অন্য তৃতীয় শ্রেণিদের কাজ কমেছে।
অবস্থা দেখে আমি আতঙ্কিত। যেসব অফিসে ব্যবসা ঘাটতি হয়েছে, সেখানে তাহলে কেমন লোক ছাঁটাই হচ্ছে? বিবিসি এপ্রিলে রিপোর্ট করেছে বাংলাদেশে ছয় কোটি মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। এসব ভাবনা শরীরকেও প্রভাবিত করে। অথচ বলা হচ্ছে দুর্ভাবনা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। কিন্তু দুর্ভাবনা এড়িয়ে থাকি কী করে! সরকারি চাকরি ছাড়া এখন কে ভাবনাহীন? এই সেদিন কোটা আন্দোলনে ছেলেগুলোর দামালপনা দেখে মনে হচ্ছিল, চাকরি প্রার্থী পাঁচ কোটি, সরকারি চাকরির সিট হাজার পাঁচেক। কীসের জন্য তাহলে আন্দোলন? এখন টের পাচ্ছি এই সোনার হরিণ এই দেশে কত কাঙ্ক্ষিত, কত আবশ্যিক!
ইকবালকে ডেকে কিছু বলার সাহস হলো না! আমার আর কিচ্ছু করার নেই। প্রথম দিকে যেভাবে পেরেছি সাহায্য-সহযোগিতা করেছি, দেশের অন্য যে কোনো দুর্যোগের মতো। কিন্তু এই দুর্যোগের কোনো দিকনির্দেশনা নেই যে কবে পরিত্রাণ পাব। নিজের কষ্টেসৃষ্টে করা ফ্ল্যাট-গাড়ি আছে; সেভিংস নেই। লোন শোধ করতেই মাসে সব শেষ। নিজেকে বিপন্ন রেখে কদ্দিন আর কীভাবে পাশে দাঁড়াব?
কাউকে দেখলে বলি, কেমন আছ?
এখন সেই সাধারণ প্রশ্নের তর্জমা হলো- সুস্থ আছ তো? চাকরি এখনও আছে?
আমার বউ ইমির স্কুল প্রাইভেট। ছাত্ররা আসছে না। কাজেই বেতন নেই। অনলাইন ক্লাসেও ছাত্র টানা যায়নি। এই সময়ে নিজের ঘরেই দেখি প্রয়োজনের বাইরে খরচ না। এখন ঘরপ্রতি বাচ্চাপ্রতি কম্পিউটার কী করে বাবা-মা কিনবেন? মোবাইলের ছোট স্ট্ক্রিনে পড়া বোঝা যায় না। আমাদের বাচ্চা একটাই- সে এখন মায়ের ল্যাপটপ দখল করেছে। যদি ইমির স্কুলটা চালু থাকত, তাহলে ছেলের ল্যাপটপ কিনতে হতো।
ইমির স্কুল চালু থাকার সময়ে ক'জন বাচ্চাও বাড়িতে পড়তে আসত। ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। তাই প্রথম প্রথম হোম অফিসে ইমি খুব আনন্দে ছিল। রান্না আর ফটো, ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার দেবার কী ধুম! এরপর কিটো ডায়েট, কী সব ওয়ার্ক আউট।
এখন ইমির বিষণ্ণ উদ্বিগ্ন চোখ টিভির পর্দায় আর পুরোনো না পড়া বইতে প্রাণহীন দৃষ্টি বুলায়। ছেলে কম্পিউটারে গেম খেলে আর নেটফ্লিক্স মুভি দেখেও এখন বিতৃষ্ণ। ছোট বোনটাকে মাত্র বিয়ে দিয়েছিলাম চায়নাপ্রবাসী ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলের চায়নায় চাকরি চলে গেছে। আসতেও পারছে না দেশে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছোট বোনকে আর আম্মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তবু এই বদ্ধ ঘরে আটকে না থেকে শ্বাস নিক। রোজ রোজ কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছে না।
আমাদের ফ্ল্যাটের অনেকে চলে গেছে; কিন্তু টেলিকমের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লতিফ যেদিন চলে গেল গ্রামের বাড়িতে, সবকিছু নিয়ে সপরিবারে ট্রাকের পেছনে নিজেদের ফার্নিচারের ওপর বসে, সেদিন আমার হতবাক হওয়া সীমা ছাড়িয়েছে! লতিফ অবশ্য বলেছে, ওদের হোম অফিস দিয়েছে, ডিসেম্বরের আগে নিয়মিত অফিস চালু হবার সম্ভাবনা নেই, তাই চলে যাওয়া। কিন্তু বুঝতে তো পারি এত দীর্ঘদিনের হোম অফিসে কোনো কোম্পানি নিশ্চয়ই পুরো বেতন দেবে না। এভাবেও অনেক কোম্পানি খরচ কমাচ্ছে। আমাদের হয়তো কিছুদিন পরে শুরু হবে। কিন্তু টেলিকমদের ব্যবসা তো পড়েনি! আমার লজিক বলছে, এই বেতন আর আগের জায়গায় ফিরবে না। এরপর ইনক্রিমেন্ট এখান থেকেই শুরু হবে! উন্নত দেশেও তাই হবার আশঙ্কা, সেখানে উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ নৈতিকতা দুরাশা।
ফেসবুকে দেখছি সবাই ডেইরি ফার্ম খুলছে! আমাদের সৃজনশীলতাও কম, কেউ কিছু করে সফল হলে সবাই চোখ বুজে তাই করছে! যেন পরানের গহিনে ভিতরে কেউ ইস্রাফিলের ফুঁক শুনে দিগ্ভ্রান্ত। কেউ একজন শেয়ার করেছে 'ডিপ্রেশন, অস্থিরতা হলো ঈশ্বর আর তোমার মাঝে দূরত্ব।' আমি মনে-প্রাণে ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছি।
অন্ধকারে বারন্দায় বসে ইকবালের কথা ঘুরেফিরে মাথায় আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই অতিমারীর প্রকোপ কাটতে দুই বছর লাগবে। ততদিনে আমার চাকরি থাকবে তো? চাকরি চলে গেলে আমিও কি রোজ সকালে বেরিয়ে ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বুঝ দিব আমার চাকরি আছে? না ট্রাকে মালপত্র তুলে গ্রামে চলে যাব? ফ্ল্যাট, গাড়িটা লোনের কিস্তি না পেলে ব্যাংক নিয়েই যাবে? আর আমার বউ কি তখন লুকিয়ে বোরখা- নেকাবে মুখ ঢেকে রাস্তায় দাঁড়াবে?
-২০টা টাকা দেন। রোজা রাখছি, ইফতার করমু।
মন্তব্য করুন