
কবে কখন এইসব ঘটে গেছে সেসব প্রশ্ন আমাকে করো না। আমার মনে নেই। মনে আছে কিন্তু সারিবদ্ধভাবে নেই। এই যে আমার বাপ এক কাবুলিওয়ালার সাথে কথা বলবার সময় বারবার 'উধার' শব্দটা বলত। উধার মানে কী? ঐধারে? গ্রামের লোকে আঙুল তুলে বলত 'হেমরা' (হেই মুড়া? সেই দিক?), সেটা? দাদিয়া হেসে ফেলেছিল আমার কথা শুনে। কোন কথাটা? এই উধারের মানে শুনে? মানে শুনবার আগে না পরে? রিনরিন হাসির শব্দ করে বলে ফেলেছিল 'ওরে এর মানে ঋণ।' বলে ফেলেছিল, 'এক ঘণ্টা ধইরা হেই কাবুলি দ্যাখলাম এক পায়জামাই কাচতাছে। কাচতেই আছে। হুইইই ধারে।' হাসিটা তার আগে না পরে?
আমার জীবন উধার। ওইধারে। কিংবা ঋণ। ভাইদের- বাসেতের, শাহেদের। এসব আমি বলতেই চাই আর গুছিয়ে লিখতেই চাই। কিন্তু আকাশের লুব্ধক নিয়েও ভাবতে চাই। ফুলকিকে নিয়েও ভাবতেই চাই। কারও কোলে ছিলাম আমি, আমার গোটা গোটা ফুলো ফুলো কোমল শিশু পা ঝুলছিল কারও কাঁখ থেকে আঁকশির মতো। পা আমার কিন্তু আমি দেখছি আরেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই যে নিজের শরীর থেকে মরবার আগেই বিদেহী হয়ে গিয়ে নিজেকেই দেখতে থাকা, এটা কেন হয় আমার? ধরা যাক, আমি আর ফুলকি পাশাপাশি শুয়ে আছি, সে সময় আমি আমার শরীরের ভেতর থেকে উবে গিয়ে কর্পূরের মেঘের মতন মশারির চালে ভাসতে ভাসতে আমাদের দেখতে পাই, এটা কেন হবে? আমি দেখতে পাই ফুলকির পায়ের গোছের দিকে সে তার ফিকে সবুজ শাড়িটা একটু টেনে দিল আরেক পায়ের বুড়ো আঙুল আর তার পরের আঙুল দিয়ে। এই ভঙ্গিটা মানে এই মোটর স্কিলটা বোধহয় বানরের কাছ থেকে উধার নেওয়া। মানে, হুউইইই ধার থেকে নেওয়া। ফুলকি শুয়ে আছে আমার দিকে মুখ করে, তার একটা হাত নিজের কোলের কাছে ফেলা, সেই রোগা রোগা হাতে ঢলঢল করছে সোনার একটা সরু মকরমুখী বালা, বালাটা আমার মায়ের উধার, মানে ওইধারে আমার আম্মা চলে যাবার পরে বালাটা ফুলকি পেয়েছে। ফুলকি বোধহয় খুব সোনাদানা ভালোবাসে, মশারির চালে ভাসতে ভাসতেই আমি দেখতে পাচ্ছি, ফুলকির নাকে একটা তারার (লুব্ধক?) মতো নাকফুল আর তাতে নবরত্ন, এটা কি আমার মায়ের গয়না? সে কি আমার মায়ের সব গয়না দখল করে নিচ্ছে? ফুলকির হাতের বালার কথা আগেই বলেছি- বোধহয় দুই হাতেই বালা... আরেকটা হাত উ-ধারে মানে বালিশের নিচে তো, ফুলকির কানে একরত্তি সাঁওতালি মাকড়ি সেটা রিনরিন শব্দ করে, মানে হাসে; হাসির শব্দ মাঝে মাঝে আমাকে বধির করে দেয়, বালিশচাপা পড়া ওই কানেও মাকড়ি আছে কিনা সেটা দেখতে হলে আমায় ওকে উল্টে দেখতে হবে; আর সেটা করতে গেলেই খপ করে সে জেগে যাবে, জেগে গেলে সে পাশ ফিরেও শুতে পারে যা আমি চাই না। আমি ফুলকির সোনাদানা গুনছি। গলার ভাঁজে লেপটে আছে একটা সরু হার, তাতে একটা ছোট্ট ধুকধুকি, তার নিচে গলার তলায় ধুকধুক করছে এক ফোঁটা সুঁইয়ের খোঁচায় উদ্গত রক্তের মতো জমাট লাল ফুলকির তিল। ফুলকির গায়ে ক'টা তিল? ফুলকিকে দেখতে যেন দুর্গে বন্দিনী রাজকন্যা, যেন প্রতীক্ষমান, সূর্যদেব আসবে সামান্য আহ্বানেই, দেবরাজ জিউস এসে মেলে দেবে চারদিকে সোনালি রাংতা কুঁচির মতো কুয়াশা। চুলগুলো চকচকে কালো; কিন্তু অযত্নে ছাঁটা, দেখলে মনে হয় সে একদিন জেদের বশে মুঠো করে ধরে কেটে ফেলেছে। চোখগুলো এমনিতে ত্রস্ত, ভয়ে বিস্টম্ফারিত একরকমের চাহনি তাতে। তার ঘুম বেশ পাতলা, নীলচে চোখের পাতাগুলো চমকে চমকে ওঠে ঘুমের ভেতর। ঘুমের ভেতরই কোলের কাছে শাড়ি পেল্গন করে হাত দিয়ে। ফুলকির ফর্সা রঙে একটা নীল নীল ভাব আছে কেমন, ক্ষেতে বাঁধাকপির পাতায় সকালের হিম জমে থাকলে যেমন রঙ হয় তেমন। সারা শরীরে এমনকি পিঠে আর বুকেও একটা মিইয়ানো ভাব আছে তার, অধমর্ণের মতো, নাকি প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রীর মতো। হলদেটে সাদা একটা শাড়ি পরে আছে সে, যেদিন এ বাড়িতে এসেছিল প্রথম, সেদিন শাকের মতো সবুজ শাড়ি পরে এসেছিল সে। এখন এই হলদে শাড়ির পাড়ে কমলা সুতোয় পিঁপড়ে সারির মতো সেলাই ফোঁড় দেওয়া, যেন অজস্র পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছে তার শরীর। আমি পিঁপড়েগুলোকে অনুসরণ করে কোথাও পৌঁছে যাব নাকি যেখানে মিঠাই রাখা আছে?
ফুলকি যে লোকটার সাথে এ বাড়িতে এসেছিল, তাকে আমি দোতলার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম। আসবার আগেই তাকে দেখেছিলাম নাকি আসবার পরে? আগে। নিশ্চয়ই আগে। ধলপরী গ্রামে তিন বোন থাকত- তিন পরী, মেঘছায়া ধরে নেই যাদের মাথায়, মানে বাপ-মা কেউ নেই... মিলিটারি আসবার আগে কিংবা পরে তিন পরী ঝোপে লুকিয়ে থাকত। দিনের কোনো একসময় লুকিয়ে এসে খেয়ে যেত ভাত, উধারে। পরীরা ভাতই খায় কিনা সেইসব জিজ্ঞেস করতে হবে আমার। দাদিয়াকেই জিজ্ঞেস করা উচিত। কিন্তু দাদিয়াকে জিজ্ঞেস করার যে কী বিপদ। ডাইনে-বাঁয়ে থু থু করে সেইসব কী জিনিস আমার গায়ে-মাথায়-মুখে মাখাতে আসবে। জিজ্ঞেস করার আগেই নাকি পরে? দাদিয়াকে কারা শিখিয়ে দিয়েছে আমার সাথে এমন করতে? দাদিয়াও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।
ছাদে গিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে আসি আমি। জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই। ছাদে ছাদে। উপুড় করা আকাশের পাত্র ভরা আলো। কপিলাগাছগুলো ভরা জুলজুলে সবুজ পাতা। মেঘহীন আকাশে কবুতরের উড়ান। আপনা থেকেই দেওয়া এসব প্রাচুর্য, কোনো উধার নেই। কবুতরের লাট খাওয়া দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল, লোকটার বাড়ি ছিল চাহার দরবেশ বা চারগাছা বা চরমোকাম। কী নাম জায়গাটার? কে খেলায় আমি খেলি-বা কেন, জাগিয়া ঘুমাই কুহকে যেন। তিন পরী ভাত খেতে নেমেছিল তারাদের ভিড় থেকে, আর ডানাকাটা গেছিল তাদের। কে ডানা কাটিয়েছিল তাদের? ওই লোকটা। আশ্চর্য সেদিন আমি লোকটাকে দেখামাত্র মনে করতে পেরেছিলাম এই লোকটা পরীদের ডানা কাটিয়ে দিয়েছিল, শোরগোল করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম আমি, কিন্তু লোকটা তো তার আগেই পালাল।
আঙিনায় নেমে দেখি কাসেদ একটা চুপসানো পরীর হাত ধরে তরুণ দাউদ নবীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ফুলকি। গোকুলধামের ছাদে এই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে যাওয়া যায়, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়া যায় গোলোকধামের ছাদে। কিন্তু আমার ছাদে ছাদে লাফানো নিষেধ। আঙিনায় পরীর ডানা থেকে ঝুরঝুর করে কত রুপালি আঁশ ঝরেছে। রুপালি নাকি নস্যিরঙ? পুরোনো কাশফুলের মতো রঙ। আমি জায়গায় দাঁড়িয়েই লাফাতে লাগলাম, আর কাসেদ অযথাই তরুবালা কাকিকে ডাকতে লাগল, ছন্দুকে ডাকতে লাগল, সেই আওয়াজর্ যাঁদা বুলাতে লাগল আমার গায়ে আর আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। ছন্দু নেমে এসে আমাকে বোঝাতে লাগল, কী বোঝাতে লাগল তা আমি বুঝলাম না, বুঝলাম আমার আসলে ছাদের ঘরে গিয়ে হেরোডেটাসের লেখাগুলো আসলে কাদের শোনাবার জন্য লেখা সেটাই দেয়ালে দেয়ালে লিখে ফেলা উচিত। এখানে আমাকে দরকার নেই। অবশ্য দরকার না থাকলেও আমি বিদেহী মেঘের মতো ভেসে বেড়াতে পারি এ-ধারে উ-ধারে, সেটা আবার ওরা জানে না। সব তীব্র তমোহরকে ঢেকে দিতে পারি। আচ্ছা, এটাও দেয়ালে লিখতে হবে।
২.
'লুনাটিক অ্যাসাইলাম' কথাটা একটা ভারী বইয়ের মতো ঠক? করে টেবিলে রেখেছিল কেউ আব্বার সামনে। সাধারণত লোকে এখানে যেসব কথা বাংলায় বলতে অসুবিধে হয়, সেগুলো ইংরেজিতে বলে। আমি সারাদিন নানান ঘরে ঘোরাফেরা করি, পড়তে না হলে কোথাও বসি না, দাদিয়া প্রায়ই আমাকে ধরে এনে কী কী বিড়বিড় করে ফুঁ দেয় আর থুতু মাখিয়ে দেয়, তখন তার হাত থেকে ছুটবার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি; কিন্তু তাকে তো কামড়াই না। দেরাজ থেকে কাপড় বের করে আমি দেরাজ বন্ধ করি না, দাঁত মেজে মাঝে মাঝেই কুলকুচি করি না, সহজে হাসি না কিন্তু ভ্রুকুটি করি শুধু প্রাঞ্জলভাবে কিছু বুঝবার জন্য, মাঝে মাঝে আমি অন্যরা যা বলে তার প্রতিধ্বনি করতে থাকি শুধু, অবিকল তাই বলি যা ওরা বলে... ওরা যা বলে তাই বলবার জন্য আমাকে তাহলে এই রকম ভারী নামের জায়গায় পাঠাতে হবে কেন? ওদেরও তো পাঠানো উচিত ওখানে। আমার যুক্তি অবশ্য এরা কেউ শোনে না। দাদিয়া আরবি শব্দ আর ঝাপসা চেহারার ডাক্তাররা ভারী ভারী ইংরেজি শব্দ ঠক ঠক করে রাখতে থাকে আব্বার সামনে।
ফুলকি ছাদের ঘরে বসে সেলাই করে, আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি প্রতিটা ফোঁড় সমান মাপের, সমান টান দিয়ে তোলা... সেইসব দেখবার জন্য আমি ওর ঢের কাছে যাই। ফুলকি আমাকে ফুঁ দেয় না, কিছু মাখিয়ে দেয় না, টান মেরে বসিয়ে দেয় না, লাথি দিয়ে উঠিয়ে দেয় না। ছন্দু কিন্তু আজকাল আশপাশে কেউ না থাকলে আমাকে লাথিও দেয়। তখন ওর মুখে ভ্রুকুটি থাকে, কিন্তু কোনোকিছু প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পারার জন্য অভিনিবেশ নয় তাতে, উল্টোটা। মানে কোনো কিছু খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে এমন মুখ করে দেয়। যেন আমি জামশেদ না, অন্য কেউ, অন্য কারা। ছন্দুকে গিয়ে আমি ঘোষণা দিলাম আমাকে লুনাটিক অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়া হবে। ছন্দু ভ্রুকুটি করল, সেটা না বুঝবার ভ্রকুটি। আমি প্রাঞ্জল হেসে বললাম, 'পাগলা গারদ'। ছন্দুর ভ্রুকুটি গেল না, সে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, 'মেজদা, তার চেয়ে তোমার একটা বিয়া হোক। শুধরায় যাবা।' যেন ও-ও বিয়ের পর শুধরে গেছিল, হেঁচকি তুলে তুলে আর কারও জন্য কাঁদত না, খালি রবিন মণ্ডলের জুতা পালিশ করত।
রবিন মণ্ডলের কথা বলাটা ঠিক হবে কি হবে না সেটা ভাবতে ভাবতে দেখলাম ছন্দুর গায়ে মাথায় সকালের তেরছা রোদ এসে পড়েছে, যে রোদের রঙ কলুবাড়ির তেলের মতো। ছন্দুর গায়ে একটা সাদা সুতির থান, জামা নেই, বিধবার বেশ, তাতে রোদ এসে ঠিকরে পড়ছে তার মুখে, এত জ্যোতির্ময় আর এমন ভেজা ভেজা ভাব সেই মুখে, ভ্রুকুটিটা তখনও আছে, লোকে ওকে ঠাট্টা করে 'সায়রা বানু' ডাকত, ওর মাথার ওপর একটা ভোমরা উড়ছে... আমি সেটাকে হাত দিয়ে তাড়াতে যাব, ছন্দু সাথে সাথে আমাকে একটা লাথি দিল। মনে ভারী দুঃখ পেলাম। ওই বইটার মতো ভার। শব্দ হলো না অবশ্য।
কিছুক্ষণ পর যদিও ছন্দু এক পেয়ালা চা এনে সন্ধি করে নিল, আমিও ধরে নিলাম চা-টা করে দিলে আমায় লাথি-ফাথি দেওয়া যায়। ছন্দু সান্ত্বনা দেবার মতো করে জানালো, তরুবালা কাকির কোন জ্যাঠা পাগলা গারদে গেছিল পাগলদের দেখতে, চিড়িয়াখানার মতো করে। সেখানে এক পাগলী নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া বরকে ভাত দেবে বলে সারাদিন শিলপাটায় তরকারির মসলা পেষে, হাত আর নেই তার ঘষে ঘষে। এক পাগল ভারি মজার মুখ করে আরেক পাগলকে সারাক্ষণ উপদেশ দেয়- 'ওষুধ খা রে পাগল, ভালো হবি!' কিন্তু ছন্দু জরুরি কথাটাই বলল না, পাগল সেই উপদেশ শুনে ওষুধগুলো গেলে কি না, গিলে ভালো হয় কি না। আমি এইসব ভাবছিলাম, মানছি ভ্রুকুটি করেই ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ ছন্দু আমার মাথাটা পেছন থেকে তার বুকে জড়িয়ে ধরল। তার গায়ে জামা নেই, আমার কানের কাছে লেগে কী যেন শক্ত হয়ে উঠল ওর গায়ে, ও যখন উলের সোয়েটার বুনবার সময় আমার কাঁধের মাপ নেয়, তখনও এমন হয়। ও আমার মাথাটা ধরে কাত করে ঘুরিয়ে নিল, ওর বুকে নারকেল তেল- ঘাম-চন্দনবাটা এইসব কী কী সব মেশানো গন্ধ। আমি ভয়ে মাথা নাড়ালাম না, আমার ওকে বলা হয়নি আমি কোনোকিছুর কঠিন হয়ে ওঠা সইতে পারি না, আমার ভালো লাগে বিদেহী মেঘ। খালি আলতো গলায় বললাম, 'ওষুধ খা রে পাগল, ভালো হবি!'
পরে আমি যখন রান্নাঘরের দাওয়ায় নীলুর সাথে লাটিম নিয়ে খেলছি, তখন ছন্দু এসে আমার পাশে বসে করল্লা কুটতে লাগল এমনভাবে যেন আমরা বন্ধু। তার জ্যোতি- জ্যোতি ভেজা- ভেজা অম্লানবদন। তার জামা নেই, গা আর শক্ত হয়ে নেই, এমন যেন পেশিগুলো মেঘের মতো অ-স্থূল। আবার ও রবিন মণ্ডলের বিধবা পত্নী হয়ে গেছে, যাকে রবিন ডাকত- 'সন্দা! সন্দা!' তরুবালা কাকি নারকেল কোরাতে কোরাতে সোৎসাহে আমাকে বোঝাতে লাগল, আমার বিয়ে হবে ফুলকির সাথে। ফুলকির সাথে বিয়ে হবার কথায় আমার আনন্দ হলো, কারণ করল্লা কুটতে থাকুক আর না থাকুক, চা দিয়ে যাক আর না যাক, ফুলকি সারাক্ষণ আমার বন্ধু থাকে... ছন্দুর মতন আমার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে আমার চুল টানতে টানতে বলে না, 'ইসস কী সুন্দর, পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হইয়া কাম কি!' আবার ছন্দুর মতন আমাকে আচমকা লাথিও মারে না। করল্লা কোটা বন্ধ রেখে নিচু গলায় ছন্দু তরুবালা কাকিকে জানাল, আমি যে উন্মাদ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই যে বিয়ের কথায় নেচে উঠছি, যে কোনো পাগলই নাকি বিয়ের কথা শুনলে আনন্দিত হয়। তরুবালা কাকি কোরা নারকেল থেকে চটকে চটকে দুধ বের করতে করতে হিহি করে হাসল আর জাতে-তালে মাতলামি বিষয়ে একটা নীচু রসিকতা করল। শুভবিবাহের প্রসঙ্গে এমন বিচ্ছিরি কথায় আমার মনটা আবার সেই বইটার মতো ভার হয়ে উঠল, ঠক করে আমার মনে পড়ল, আমি পাগল হলে ছন্দুর সুবিধে। আমার কথা কেউ বিশ্বাস না করলে ছন্দুর সুবিধে। মানে আমার কথা সবাই 'পাগলের কথা' বলে হুইইইই ধারে উড়িয়ে দিলে ছন্দুর সুবিধে।
বিয়ের কথা হবার পরে আমি উদার ভাবনা করতে শিখছিলাম। নাকি আগেই। ফুলকির ভরণপোষণ আমার করা উচিত বিধায় ফুলকিকে আমি আমার জমানো টাকাপয়সা দিয়ে এলাম। ফুলকি মানা করল না, আগ্রহও দেখাল না তেমন, মনোযোগ দিয়ে পয়সা ক'টা খুঁটে খুঁটে তুলে নিল, পাকিস্তানি রুপিতে বাংলায় 'বাংলা দেশ' রাবার স্ট্যাম্প মারা নোট উল্টেপাল্টে দেখে একবার শুধু বলল, 'এগুলি তো মনে হয় অচল এখন মেজদা।' আমি স্পষ্ট দেখলাম ফুলকি পয়সা হাতে নিয়ে শিউরে উঠছিল। এসব পয়সা দিয়ে এখন কী হবে? কাসেদ বলেছিল বুড়িগঙ্গার ধারে কারা যেন পয়সা গলিয়ে ঝরনাকলমের নিব বানায়, তাদের কাছে দিয়ে আসতে হবে আর কি। ফুলকির দিকে তাকিয়ে আর ভার বোধ করছিলাম না, আমার মনে স্নেহ এলো। কিংবা আগেই ছিল। ফুলকির সাথে সংসারযাত্রার একটা ছবি আমি সারাবেলা আঁকলাম।
বিয়ে আমাদের হয়ে গেল। ঘটা করে কিছুই হলো না। দক্ষিণের বড় ঘরটা সাফসুতরো করে খাট পাতা হয়েছে। ছন্দু যাদবমোহন বাবুর বাগানের গাছপালা থেকে কী কী সব ফুল এনে ছড়িয়ে দিয়েছে খাটে। আগরবাতি জ্বালিয়ে ঘরের ধুলো ধুলো গন্ধটা সরাবার চেষ্টা করেছিল কেউ, ঘরটায় মৃত্যুর গন্ধ থমকে আছে। ফুলকি সেই খাটে মশারি টাঙিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে জেগে তার এক পা দিয়ে আরেক পায়ের ওপর উঠে যাওয়া শাড়ির প্রান্ত টানা দেখলাম, তার গায়ের মামুলি গয়না গুনলাম, তার তিলগুলি খুঁজবার সুবিধে হলো না। শুতে গিয়ে দেখি বালিশের তলায় ন্যাকড়ায় প্যাঁচানো একখানা লোহার মাদুলি, ফুলকির চুলেও কালো সুতায় বাঁধা একটা মাদুলি, নির্ঘাত দাদিয়ার কাজ। দাদিয়া সকালবেলা জোর করে আমার হাতে একখানা শুকনো রুটি দিয়ে হুকুম করল, 'যা নীলুর মাদী কুকুরডারে খাওয়ায় আয়। তর কল্যাণ হইবো। বউ পায়ে পায়ে ঘুরবো।'
কুকুরটা এ বাড়িতে আগে ছিল না, যুদ্ধের আগে যাদবমোহন বাবুর বাড়িতে থাকত সে। ঘি ঘি রঙের লোমশ বড়সড় বিলিতি কুকুর, পাকিস্তানিরা যাদব বাবুদের বাড়ি লুটতরাজ করবার সময় কুকুরটা হয়তো বাধা দিয়েছিল। তার সারা গায়ে কোপ আর মার... যাদবমোহন বাবুরা প্রাণের ভয়ে কবেই পালিয়েছেন, কুকুরটা ছিল সেই শূন্য ঘরদোরের পাহারায়। আমি প্রায়ই দেখতে পাই, একটা খালি বাড়িতে বিশ্বস্ত একটি কুকুর প্রবল বিক্রমে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র লোকদের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মানুষ তার প্রতি দায়িত্ব ভুলতে পারে, সে তো আর মানুষের প্রতি তার দায়িত্বভার ভুলতে পারে না... এক গুলিতে তাকে শেষ না করে এমন করে মেরে রেখে গেছিল ওরা যে, কুকুরটা মরেনি সেটাই আশ্চর্যের। নীলু রাতদিন সেবা করে কুকুরটাকে বাঁচিয়েছে, কুকুরটাকে সে ডাকে 'বিস্কুট'। বিস্কুট আমার দাদিয়ার পরিকল্পনা মোতাবেক রুটিটা খেলো না, শুঁকে চলে গেল, আমি তাকে তোয়াজ করে বললাম, 'ঠিক করেছিস, বুড়ির শুধু দুর্বুদ্ধি।'
বিয়ের রাতটা আমার মনে থাকবে একটিই কারণে। আমার এতদিনকার জীবনে আমি এত সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে কখনও ঘুমাইনি। সম্ভাবনা দেখলে এমনিতে আমি ঘুমাতে পারি না। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, একটা দুরন্ত লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে আমার হাতের তেলোয় ফুলকি উঠে এসেছে, মসৃণ, নিরেট, লোহার শীর্ষটুকুতে আমার হাতের পাতায় শিহরণ হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে কত খেলা! একসময় এত খেলার উত্তেজনা না রাখতে পেরে আমি ডাক দিলাম- 'ফুলকি'!
আমার জীবন উধার। ওইধারে। কিংবা ঋণ। ভাইদের- বাসেতের, শাহেদের। এসব আমি বলতেই চাই আর গুছিয়ে লিখতেই চাই। কিন্তু আকাশের লুব্ধক নিয়েও ভাবতে চাই। ফুলকিকে নিয়েও ভাবতেই চাই। কারও কোলে ছিলাম আমি, আমার গোটা গোটা ফুলো ফুলো কোমল শিশু পা ঝুলছিল কারও কাঁখ থেকে আঁকশির মতো। পা আমার কিন্তু আমি দেখছি আরেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই যে নিজের শরীর থেকে মরবার আগেই বিদেহী হয়ে গিয়ে নিজেকেই দেখতে থাকা, এটা কেন হয় আমার? ধরা যাক, আমি আর ফুলকি পাশাপাশি শুয়ে আছি, সে সময় আমি আমার শরীরের ভেতর থেকে উবে গিয়ে কর্পূরের মেঘের মতন মশারির চালে ভাসতে ভাসতে আমাদের দেখতে পাই, এটা কেন হবে? আমি দেখতে পাই ফুলকির পায়ের গোছের দিকে সে তার ফিকে সবুজ শাড়িটা একটু টেনে দিল আরেক পায়ের বুড়ো আঙুল আর তার পরের আঙুল দিয়ে। এই ভঙ্গিটা মানে এই মোটর স্কিলটা বোধহয় বানরের কাছ থেকে উধার নেওয়া। মানে, হুউইইই ধার থেকে নেওয়া। ফুলকি শুয়ে আছে আমার দিকে মুখ করে, তার একটা হাত নিজের কোলের কাছে ফেলা, সেই রোগা রোগা হাতে ঢলঢল করছে সোনার একটা সরু মকরমুখী বালা, বালাটা আমার মায়ের উধার, মানে ওইধারে আমার আম্মা চলে যাবার পরে বালাটা ফুলকি পেয়েছে। ফুলকি বোধহয় খুব সোনাদানা ভালোবাসে, মশারির চালে ভাসতে ভাসতেই আমি দেখতে পাচ্ছি, ফুলকির নাকে একটা তারার (লুব্ধক?) মতো নাকফুল আর তাতে নবরত্ন, এটা কি আমার মায়ের গয়না? সে কি আমার মায়ের সব গয়না দখল করে নিচ্ছে? ফুলকির হাতের বালার কথা আগেই বলেছি- বোধহয় দুই হাতেই বালা... আরেকটা হাত উ-ধারে মানে বালিশের নিচে তো, ফুলকির কানে একরত্তি সাঁওতালি মাকড়ি সেটা রিনরিন শব্দ করে, মানে হাসে; হাসির শব্দ মাঝে মাঝে আমাকে বধির করে দেয়, বালিশচাপা পড়া ওই কানেও মাকড়ি আছে কিনা সেটা দেখতে হলে আমায় ওকে উল্টে দেখতে হবে; আর সেটা করতে গেলেই খপ করে সে জেগে যাবে, জেগে গেলে সে পাশ ফিরেও শুতে পারে যা আমি চাই না। আমি ফুলকির সোনাদানা গুনছি। গলার ভাঁজে লেপটে আছে একটা সরু হার, তাতে একটা ছোট্ট ধুকধুকি, তার নিচে গলার তলায় ধুকধুক করছে এক ফোঁটা সুঁইয়ের খোঁচায় উদ্গত রক্তের মতো জমাট লাল ফুলকির তিল। ফুলকির গায়ে ক'টা তিল? ফুলকিকে দেখতে যেন দুর্গে বন্দিনী রাজকন্যা, যেন প্রতীক্ষমান, সূর্যদেব আসবে সামান্য আহ্বানেই, দেবরাজ জিউস এসে মেলে দেবে চারদিকে সোনালি রাংতা কুঁচির মতো কুয়াশা। চুলগুলো চকচকে কালো; কিন্তু অযত্নে ছাঁটা, দেখলে মনে হয় সে একদিন জেদের বশে মুঠো করে ধরে কেটে ফেলেছে। চোখগুলো এমনিতে ত্রস্ত, ভয়ে বিস্টম্ফারিত একরকমের চাহনি তাতে। তার ঘুম বেশ পাতলা, নীলচে চোখের পাতাগুলো চমকে চমকে ওঠে ঘুমের ভেতর। ঘুমের ভেতরই কোলের কাছে শাড়ি পেল্গন করে হাত দিয়ে। ফুলকির ফর্সা রঙে একটা নীল নীল ভাব আছে কেমন, ক্ষেতে বাঁধাকপির পাতায় সকালের হিম জমে থাকলে যেমন রঙ হয় তেমন। সারা শরীরে এমনকি পিঠে আর বুকেও একটা মিইয়ানো ভাব আছে তার, অধমর্ণের মতো, নাকি প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রীর মতো। হলদেটে সাদা একটা শাড়ি পরে আছে সে, যেদিন এ বাড়িতে এসেছিল প্রথম, সেদিন শাকের মতো সবুজ শাড়ি পরে এসেছিল সে। এখন এই হলদে শাড়ির পাড়ে কমলা সুতোয় পিঁপড়ে সারির মতো সেলাই ফোঁড় দেওয়া, যেন অজস্র পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছে তার শরীর। আমি পিঁপড়েগুলোকে অনুসরণ করে কোথাও পৌঁছে যাব নাকি যেখানে মিঠাই রাখা আছে?
ফুলকি যে লোকটার সাথে এ বাড়িতে এসেছিল, তাকে আমি দোতলার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম। আসবার আগেই তাকে দেখেছিলাম নাকি আসবার পরে? আগে। নিশ্চয়ই আগে। ধলপরী গ্রামে তিন বোন থাকত- তিন পরী, মেঘছায়া ধরে নেই যাদের মাথায়, মানে বাপ-মা কেউ নেই... মিলিটারি আসবার আগে কিংবা পরে তিন পরী ঝোপে লুকিয়ে থাকত। দিনের কোনো একসময় লুকিয়ে এসে খেয়ে যেত ভাত, উধারে। পরীরা ভাতই খায় কিনা সেইসব জিজ্ঞেস করতে হবে আমার। দাদিয়াকেই জিজ্ঞেস করা উচিত। কিন্তু দাদিয়াকে জিজ্ঞেস করার যে কী বিপদ। ডাইনে-বাঁয়ে থু থু করে সেইসব কী জিনিস আমার গায়ে-মাথায়-মুখে মাখাতে আসবে। জিজ্ঞেস করার আগেই নাকি পরে? দাদিয়াকে কারা শিখিয়ে দিয়েছে আমার সাথে এমন করতে? দাদিয়াও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।
ছাদে গিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে আসি আমি। জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই। ছাদে ছাদে। উপুড় করা আকাশের পাত্র ভরা আলো। কপিলাগাছগুলো ভরা জুলজুলে সবুজ পাতা। মেঘহীন আকাশে কবুতরের উড়ান। আপনা থেকেই দেওয়া এসব প্রাচুর্য, কোনো উধার নেই। কবুতরের লাট খাওয়া দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল, লোকটার বাড়ি ছিল চাহার দরবেশ বা চারগাছা বা চরমোকাম। কী নাম জায়গাটার? কে খেলায় আমি খেলি-বা কেন, জাগিয়া ঘুমাই কুহকে যেন। তিন পরী ভাত খেতে নেমেছিল তারাদের ভিড় থেকে, আর ডানাকাটা গেছিল তাদের। কে ডানা কাটিয়েছিল তাদের? ওই লোকটা। আশ্চর্য সেদিন আমি লোকটাকে দেখামাত্র মনে করতে পেরেছিলাম এই লোকটা পরীদের ডানা কাটিয়ে দিয়েছিল, শোরগোল করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম আমি, কিন্তু লোকটা তো তার আগেই পালাল।
আঙিনায় নেমে দেখি কাসেদ একটা চুপসানো পরীর হাত ধরে তরুণ দাউদ নবীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ফুলকি। গোকুলধামের ছাদে এই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে যাওয়া যায়, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়া যায় গোলোকধামের ছাদে। কিন্তু আমার ছাদে ছাদে লাফানো নিষেধ। আঙিনায় পরীর ডানা থেকে ঝুরঝুর করে কত রুপালি আঁশ ঝরেছে। রুপালি নাকি নস্যিরঙ? পুরোনো কাশফুলের মতো রঙ। আমি জায়গায় দাঁড়িয়েই লাফাতে লাগলাম, আর কাসেদ অযথাই তরুবালা কাকিকে ডাকতে লাগল, ছন্দুকে ডাকতে লাগল, সেই আওয়াজর্ যাঁদা বুলাতে লাগল আমার গায়ে আর আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। ছন্দু নেমে এসে আমাকে বোঝাতে লাগল, কী বোঝাতে লাগল তা আমি বুঝলাম না, বুঝলাম আমার আসলে ছাদের ঘরে গিয়ে হেরোডেটাসের লেখাগুলো আসলে কাদের শোনাবার জন্য লেখা সেটাই দেয়ালে দেয়ালে লিখে ফেলা উচিত। এখানে আমাকে দরকার নেই। অবশ্য দরকার না থাকলেও আমি বিদেহী মেঘের মতো ভেসে বেড়াতে পারি এ-ধারে উ-ধারে, সেটা আবার ওরা জানে না। সব তীব্র তমোহরকে ঢেকে দিতে পারি। আচ্ছা, এটাও দেয়ালে লিখতে হবে।
২.
'লুনাটিক অ্যাসাইলাম' কথাটা একটা ভারী বইয়ের মতো ঠক? করে টেবিলে রেখেছিল কেউ আব্বার সামনে। সাধারণত লোকে এখানে যেসব কথা বাংলায় বলতে অসুবিধে হয়, সেগুলো ইংরেজিতে বলে। আমি সারাদিন নানান ঘরে ঘোরাফেরা করি, পড়তে না হলে কোথাও বসি না, দাদিয়া প্রায়ই আমাকে ধরে এনে কী কী বিড়বিড় করে ফুঁ দেয় আর থুতু মাখিয়ে দেয়, তখন তার হাত থেকে ছুটবার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি; কিন্তু তাকে তো কামড়াই না। দেরাজ থেকে কাপড় বের করে আমি দেরাজ বন্ধ করি না, দাঁত মেজে মাঝে মাঝেই কুলকুচি করি না, সহজে হাসি না কিন্তু ভ্রুকুটি করি শুধু প্রাঞ্জলভাবে কিছু বুঝবার জন্য, মাঝে মাঝে আমি অন্যরা যা বলে তার প্রতিধ্বনি করতে থাকি শুধু, অবিকল তাই বলি যা ওরা বলে... ওরা যা বলে তাই বলবার জন্য আমাকে তাহলে এই রকম ভারী নামের জায়গায় পাঠাতে হবে কেন? ওদেরও তো পাঠানো উচিত ওখানে। আমার যুক্তি অবশ্য এরা কেউ শোনে না। দাদিয়া আরবি শব্দ আর ঝাপসা চেহারার ডাক্তাররা ভারী ভারী ইংরেজি শব্দ ঠক ঠক করে রাখতে থাকে আব্বার সামনে।
ফুলকি ছাদের ঘরে বসে সেলাই করে, আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি প্রতিটা ফোঁড় সমান মাপের, সমান টান দিয়ে তোলা... সেইসব দেখবার জন্য আমি ওর ঢের কাছে যাই। ফুলকি আমাকে ফুঁ দেয় না, কিছু মাখিয়ে দেয় না, টান মেরে বসিয়ে দেয় না, লাথি দিয়ে উঠিয়ে দেয় না। ছন্দু কিন্তু আজকাল আশপাশে কেউ না থাকলে আমাকে লাথিও দেয়। তখন ওর মুখে ভ্রুকুটি থাকে, কিন্তু কোনোকিছু প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পারার জন্য অভিনিবেশ নয় তাতে, উল্টোটা। মানে কোনো কিছু খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে এমন মুখ করে দেয়। যেন আমি জামশেদ না, অন্য কেউ, অন্য কারা। ছন্দুকে গিয়ে আমি ঘোষণা দিলাম আমাকে লুনাটিক অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়া হবে। ছন্দু ভ্রুকুটি করল, সেটা না বুঝবার ভ্রকুটি। আমি প্রাঞ্জল হেসে বললাম, 'পাগলা গারদ'। ছন্দুর ভ্রুকুটি গেল না, সে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, 'মেজদা, তার চেয়ে তোমার একটা বিয়া হোক। শুধরায় যাবা।' যেন ও-ও বিয়ের পর শুধরে গেছিল, হেঁচকি তুলে তুলে আর কারও জন্য কাঁদত না, খালি রবিন মণ্ডলের জুতা পালিশ করত।
রবিন মণ্ডলের কথা বলাটা ঠিক হবে কি হবে না সেটা ভাবতে ভাবতে দেখলাম ছন্দুর গায়ে মাথায় সকালের তেরছা রোদ এসে পড়েছে, যে রোদের রঙ কলুবাড়ির তেলের মতো। ছন্দুর গায়ে একটা সাদা সুতির থান, জামা নেই, বিধবার বেশ, তাতে রোদ এসে ঠিকরে পড়ছে তার মুখে, এত জ্যোতির্ময় আর এমন ভেজা ভেজা ভাব সেই মুখে, ভ্রুকুটিটা তখনও আছে, লোকে ওকে ঠাট্টা করে 'সায়রা বানু' ডাকত, ওর মাথার ওপর একটা ভোমরা উড়ছে... আমি সেটাকে হাত দিয়ে তাড়াতে যাব, ছন্দু সাথে সাথে আমাকে একটা লাথি দিল। মনে ভারী দুঃখ পেলাম। ওই বইটার মতো ভার। শব্দ হলো না অবশ্য।
কিছুক্ষণ পর যদিও ছন্দু এক পেয়ালা চা এনে সন্ধি করে নিল, আমিও ধরে নিলাম চা-টা করে দিলে আমায় লাথি-ফাথি দেওয়া যায়। ছন্দু সান্ত্বনা দেবার মতো করে জানালো, তরুবালা কাকির কোন জ্যাঠা পাগলা গারদে গেছিল পাগলদের দেখতে, চিড়িয়াখানার মতো করে। সেখানে এক পাগলী নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া বরকে ভাত দেবে বলে সারাদিন শিলপাটায় তরকারির মসলা পেষে, হাত আর নেই তার ঘষে ঘষে। এক পাগল ভারি মজার মুখ করে আরেক পাগলকে সারাক্ষণ উপদেশ দেয়- 'ওষুধ খা রে পাগল, ভালো হবি!' কিন্তু ছন্দু জরুরি কথাটাই বলল না, পাগল সেই উপদেশ শুনে ওষুধগুলো গেলে কি না, গিলে ভালো হয় কি না। আমি এইসব ভাবছিলাম, মানছি ভ্রুকুটি করেই ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ ছন্দু আমার মাথাটা পেছন থেকে তার বুকে জড়িয়ে ধরল। তার গায়ে জামা নেই, আমার কানের কাছে লেগে কী যেন শক্ত হয়ে উঠল ওর গায়ে, ও যখন উলের সোয়েটার বুনবার সময় আমার কাঁধের মাপ নেয়, তখনও এমন হয়। ও আমার মাথাটা ধরে কাত করে ঘুরিয়ে নিল, ওর বুকে নারকেল তেল- ঘাম-চন্দনবাটা এইসব কী কী সব মেশানো গন্ধ। আমি ভয়ে মাথা নাড়ালাম না, আমার ওকে বলা হয়নি আমি কোনোকিছুর কঠিন হয়ে ওঠা সইতে পারি না, আমার ভালো লাগে বিদেহী মেঘ। খালি আলতো গলায় বললাম, 'ওষুধ খা রে পাগল, ভালো হবি!'
পরে আমি যখন রান্নাঘরের দাওয়ায় নীলুর সাথে লাটিম নিয়ে খেলছি, তখন ছন্দু এসে আমার পাশে বসে করল্লা কুটতে লাগল এমনভাবে যেন আমরা বন্ধু। তার জ্যোতি- জ্যোতি ভেজা- ভেজা অম্লানবদন। তার জামা নেই, গা আর শক্ত হয়ে নেই, এমন যেন পেশিগুলো মেঘের মতো অ-স্থূল। আবার ও রবিন মণ্ডলের বিধবা পত্নী হয়ে গেছে, যাকে রবিন ডাকত- 'সন্দা! সন্দা!' তরুবালা কাকি নারকেল কোরাতে কোরাতে সোৎসাহে আমাকে বোঝাতে লাগল, আমার বিয়ে হবে ফুলকির সাথে। ফুলকির সাথে বিয়ে হবার কথায় আমার আনন্দ হলো, কারণ করল্লা কুটতে থাকুক আর না থাকুক, চা দিয়ে যাক আর না যাক, ফুলকি সারাক্ষণ আমার বন্ধু থাকে... ছন্দুর মতন আমার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে আমার চুল টানতে টানতে বলে না, 'ইসস কী সুন্দর, পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হইয়া কাম কি!' আবার ছন্দুর মতন আমাকে আচমকা লাথিও মারে না। করল্লা কোটা বন্ধ রেখে নিচু গলায় ছন্দু তরুবালা কাকিকে জানাল, আমি যে উন্মাদ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই যে বিয়ের কথায় নেচে উঠছি, যে কোনো পাগলই নাকি বিয়ের কথা শুনলে আনন্দিত হয়। তরুবালা কাকি কোরা নারকেল থেকে চটকে চটকে দুধ বের করতে করতে হিহি করে হাসল আর জাতে-তালে মাতলামি বিষয়ে একটা নীচু রসিকতা করল। শুভবিবাহের প্রসঙ্গে এমন বিচ্ছিরি কথায় আমার মনটা আবার সেই বইটার মতো ভার হয়ে উঠল, ঠক করে আমার মনে পড়ল, আমি পাগল হলে ছন্দুর সুবিধে। আমার কথা কেউ বিশ্বাস না করলে ছন্দুর সুবিধে। মানে আমার কথা সবাই 'পাগলের কথা' বলে হুইইইই ধারে উড়িয়ে দিলে ছন্দুর সুবিধে।
বিয়ের কথা হবার পরে আমি উদার ভাবনা করতে শিখছিলাম। নাকি আগেই। ফুলকির ভরণপোষণ আমার করা উচিত বিধায় ফুলকিকে আমি আমার জমানো টাকাপয়সা দিয়ে এলাম। ফুলকি মানা করল না, আগ্রহও দেখাল না তেমন, মনোযোগ দিয়ে পয়সা ক'টা খুঁটে খুঁটে তুলে নিল, পাকিস্তানি রুপিতে বাংলায় 'বাংলা দেশ' রাবার স্ট্যাম্প মারা নোট উল্টেপাল্টে দেখে একবার শুধু বলল, 'এগুলি তো মনে হয় অচল এখন মেজদা।' আমি স্পষ্ট দেখলাম ফুলকি পয়সা হাতে নিয়ে শিউরে উঠছিল। এসব পয়সা দিয়ে এখন কী হবে? কাসেদ বলেছিল বুড়িগঙ্গার ধারে কারা যেন পয়সা গলিয়ে ঝরনাকলমের নিব বানায়, তাদের কাছে দিয়ে আসতে হবে আর কি। ফুলকির দিকে তাকিয়ে আর ভার বোধ করছিলাম না, আমার মনে স্নেহ এলো। কিংবা আগেই ছিল। ফুলকির সাথে সংসারযাত্রার একটা ছবি আমি সারাবেলা আঁকলাম।
বিয়ে আমাদের হয়ে গেল। ঘটা করে কিছুই হলো না। দক্ষিণের বড় ঘরটা সাফসুতরো করে খাট পাতা হয়েছে। ছন্দু যাদবমোহন বাবুর বাগানের গাছপালা থেকে কী কী সব ফুল এনে ছড়িয়ে দিয়েছে খাটে। আগরবাতি জ্বালিয়ে ঘরের ধুলো ধুলো গন্ধটা সরাবার চেষ্টা করেছিল কেউ, ঘরটায় মৃত্যুর গন্ধ থমকে আছে। ফুলকি সেই খাটে মশারি টাঙিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে জেগে তার এক পা দিয়ে আরেক পায়ের ওপর উঠে যাওয়া শাড়ির প্রান্ত টানা দেখলাম, তার গায়ের মামুলি গয়না গুনলাম, তার তিলগুলি খুঁজবার সুবিধে হলো না। শুতে গিয়ে দেখি বালিশের তলায় ন্যাকড়ায় প্যাঁচানো একখানা লোহার মাদুলি, ফুলকির চুলেও কালো সুতায় বাঁধা একটা মাদুলি, নির্ঘাত দাদিয়ার কাজ। দাদিয়া সকালবেলা জোর করে আমার হাতে একখানা শুকনো রুটি দিয়ে হুকুম করল, 'যা নীলুর মাদী কুকুরডারে খাওয়ায় আয়। তর কল্যাণ হইবো। বউ পায়ে পায়ে ঘুরবো।'
কুকুরটা এ বাড়িতে আগে ছিল না, যুদ্ধের আগে যাদবমোহন বাবুর বাড়িতে থাকত সে। ঘি ঘি রঙের লোমশ বড়সড় বিলিতি কুকুর, পাকিস্তানিরা যাদব বাবুদের বাড়ি লুটতরাজ করবার সময় কুকুরটা হয়তো বাধা দিয়েছিল। তার সারা গায়ে কোপ আর মার... যাদবমোহন বাবুরা প্রাণের ভয়ে কবেই পালিয়েছেন, কুকুরটা ছিল সেই শূন্য ঘরদোরের পাহারায়। আমি প্রায়ই দেখতে পাই, একটা খালি বাড়িতে বিশ্বস্ত একটি কুকুর প্রবল বিক্রমে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র লোকদের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মানুষ তার প্রতি দায়িত্ব ভুলতে পারে, সে তো আর মানুষের প্রতি তার দায়িত্বভার ভুলতে পারে না... এক গুলিতে তাকে শেষ না করে এমন করে মেরে রেখে গেছিল ওরা যে, কুকুরটা মরেনি সেটাই আশ্চর্যের। নীলু রাতদিন সেবা করে কুকুরটাকে বাঁচিয়েছে, কুকুরটাকে সে ডাকে 'বিস্কুট'। বিস্কুট আমার দাদিয়ার পরিকল্পনা মোতাবেক রুটিটা খেলো না, শুঁকে চলে গেল, আমি তাকে তোয়াজ করে বললাম, 'ঠিক করেছিস, বুড়ির শুধু দুর্বুদ্ধি।'
বিয়ের রাতটা আমার মনে থাকবে একটিই কারণে। আমার এতদিনকার জীবনে আমি এত সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে কখনও ঘুমাইনি। সম্ভাবনা দেখলে এমনিতে আমি ঘুমাতে পারি না। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, একটা দুরন্ত লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে আমার হাতের তেলোয় ফুলকি উঠে এসেছে, মসৃণ, নিরেট, লোহার শীর্ষটুকুতে আমার হাতের পাতায় শিহরণ হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে কত খেলা! একসময় এত খেলার উত্তেজনা না রাখতে পেরে আমি ডাক দিলাম- 'ফুলকি'!
মন্তব্য করুন