- কালের খেয়া
- বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
তুমুল গাঢ় সমাচার
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
ধারাবাহকি

পর্ব ::৬১
পূর্বে প্রকাশিতের পর
প্রথম মহাযুদ্ধের কালের 'লড়াইয়ের মূল' প্রবন্ধে তিনি প্রতীকী ভাবে লিখেছিলেন :'সম্প্রতি পৃথিবীতে বৈশ্যরাজক যুগের পত্তন হইয়াছে। বাণিজ্য এখন আর নিছক বাণিজ্য নহে, সাম্রাজ্যের সঙ্গে একদিন তার গান্ধর্ব বিবাহ ঘটিয়া গেছে।' এই একই জিনিস দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও। এর কারণ- আমি যুক্তি দেখাবো যে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু দুজনেই এক্ষেত্রে ছিলেন একই পথের অনুসারী- গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলার মানুষ। এক্ষেত্রে দুজনেরই সামন্তবাদবিরোধী, উপনিবেশেবাদ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্পষ্ট অবস্থান ছিল। বয়সের সাথে সাথে দু'জনেই অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের পথকে অপরিহার্য বলে মনে করেননি। জনকল্যাণের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মূল মূল দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্মৃত হননি এবং বলা বাহুল্য, দুজনেই এক শোষনমুক্ত ও সুষম বন্টনের ন্যায়পরায়ণ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকেই জাতীয় অর্থনৈতিক সর্বোচ্চ স্বার্থ অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু 'জোট-নিরপেক্ষ নীতিকে' আঁকড়ে ধরেছিলেন। একটি উদাহরণ দেই। দেশের দুর্দিনে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে বিদেশী সাহায্য চাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এড়াতে বঙ্গবন্ধুর সরকার কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্য-সাহায্যের প্রত্যাশা করে নাই? কিন্তু সেই সাহায্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বে এসেছিল। তখন যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। তারপরও মুজিব কারো সাথে বৈরী সম্পর্ক চাননি। ১৯৭৫ সালে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, 'কারো সঙ্গে দুশমনি নাই। চায়না রিকগনিশন দিলো না। কিন্তু আমরা চায়নার সাথে বন্ধুত্ব চাই। তারা একটা বিগ কান্ট্রি। আমরা এখনো বন্ধুত্ব চাই। আমাদের সাথে বন্ধুত্ব আছে রাশিয়ার, আমার বন্ধুত্ব আছে ভারতবর্ষের সাথে, আমার বন্ধুত্ব আমেরিকার সাথে। এ বন্ধুত্ব সকলের সাথে চাই। আমরা কারো সাথে গোলমাল করতে চাই না। কারণ, আমি আমার দেশকে গড়তে চাই।' একথা বলার অর্থ এটা ছিল না যে বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিষয়ে নমনীয় ছিলেন। সেই একই বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন: 'যেখানে কোন অপ্রেসড ইন্টারন্যাশনাল পিপল থাকবে, আমরা তাদের মরাল সমর্থন দিতে পারি এবং দেব। যেখানেই থাকুক না কেন, আমরা দেব। আমরাও অপ্রেসড পিপল। আমরাও যুগ যুগ ধরে এটার সাথে পরিচিত। আমরাও মার খেয়েছি। দুনিয়ার শোষক-গোষ্ঠী, ইম্পিরিয়ালিস্ট পাওয়ার- আমাদের সম্পদ লুট করে নিয়েছে।' মার্কিন চাপকে অগ্রাহ্য করে তিনি সেদিনই বলেছিলেন, (যাতে তারা বুঝতে পারে সেজন্য ইংরেজিতেই বলেছিলেন) 'আমি বিশ্বাস করি, ক্যাম্বোডিয়া, আই শুড রিকগনাইজ ইট। আই ডোন্ট কেয়ার এনিবডি ইন দি ওয়ার্ল্ড হোয়েদার এনিবডি ইজ স্যাটিসফায়েড অর এনিবডি ইজ আনহ্যাপি অর এনিবডি ইজ হ্যাপি। আই ফিল দ্যাট দে আর ফাইটিং ফর দেয়ার ওন লিবার্টি। আই অ্যাম ইউথ দেম। আই সাপোর্ট পিআরজি [গ্রানাডা]। আই গিভ দেম রিকগনিশন বিকজ আই অ্যাম এ সাফারার, আই অ্যাম এ সাফারার ফর জেনারেশন টু জেনারেশন ফর দিস বেঙ্গলি নেশন। যে যুদ্ধ করছে তার মাতৃভূমির জন্য, তাকে সমর্থন দেবো। তাই বলে অন্যকে গালাগালি করবো না।'
এর থেকে একটা দিক স্পষ্ট হয়ে আসে। কারো প্রতি বৈরীতা নয়- এ নীতির অর্থ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতির পক্ষ সমর্থন করা থেকে নিজেকে সংকুচিত করা নয়। শোষিত জনগণের Self determination-এর আন্দোলনকে সমর্থন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব- ইমানুয়েল কান্টের সর্বোচ্চ নৈতিক 'ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভ'। অন্যের ন্যায্য সংগ্রামে নিশ্চুপ থাকাটা মুজিবের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রুচিতে বাঁধে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আই বিলিভ ইন পজিটিভ অ্যাপ্রোচ, নট এ নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ।' তারপরেও ইকনমিক ইম্পিরিয়ালিজম সম্পর্কে বলতে ছাড়েননি। স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থবিরোধী এক জটিল আন্তর্জাতিক আবর্তে পড়ে দেশ তখন প্রবল সংকটের মুখে। 'অবজেকটিভ পরিস্থিতি' সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন :
'টাকা ছাপিয়ে বাড়িয়ে দিলেই তো দেশের মুক্তি হবে না। ইনফ্লেশন হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলে তারপরেই আপনাদের উন্নতি হবে। না হলে উন্নতি হবে না। ... যেমন আমরা আজকে দেখেছি। কপাল। আমাদের কপাল। আমরা গরিব দেশ তো। আমাদের কপাল- আমাদের পাটের দাম নাই। আমার চায়ের দাম নাই। আমরা বেঁচতে গেলে অল্প পয়সায় আমাদের বিক্রি করতে হয়। আর আমি যখন কিনে আনি- যারা বড় বড় দেশ, তারা তাদের জিনিসের দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা এই জন্য বলি, তোমরা মেহেরবানি করে যুদ্ধের মনোভাব বন্ধ করো। আরমানেন্ট রেস বন্ধ করো। তোমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। আজকে তোমরা মনে করছো আমরা গরিব... যে দামেই হোক আমাকে বিক্রি করতে হবে। এইদিন থাকবে না।... যদি ডেভেলপ করতে পারি, ইনশাল্লাহ এই দিন থাকবে না। ... আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাই, তোমরা কিছু খয়রাত দিয়ে একটু মিষ্টি হাসো। হাসো, হাসো। দুঃখে পড়েছি, বিক্রিতো হয়েছি। তোমাদের কাছে হাত পাততে হবে, হাসো। অনেকে হেসেছে- যুগ যুগ ধরে হেসেছে। হাসো।' এত দুঃখ-বিলাপের মধ্যেও পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলতে ছাড়েননি : 'আরব ভাইদের সাথে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করছি। প্যালেস্টাইনের আরব ভাইদের ন্যায্য দাবি সমর্থন করে বাংলার মানুষ। আরব ভাইদের পেছনে তারা থাকবে প্যালেস্টাইন উদ্ধার করার জন্য। এও আমাদের পলিসি। যেখানে নির্যাতিত দুঃখী মানুষ সেখানে আমরা থাকবো।' এতে করে কেউ যদি তাকে সোভিয়েত শিবিরের সমর্থক ভাবে সেটা তাদের তাকে বোঝার সমস্যা- তিনি তাতে একটুকু বিচলিত নন। এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের 'আন্তর্জাতিক নীতি'- একে নিছক জাতীয় স্বার্থরক্ষার বাস্তববাদী 'Foreign Policy’ বললে তার দৃষ্টিভঙ্গীকে অত্যন্ত সংকীর্ন গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী- একথা ভুললে চলবে না।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে আরও একটি নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও প্রথাগত অর্থে বামপন্থি ছিলেন না। মন-মানসিকতার দিক থেকে তিনি 'লিবারেলদের মধ্যে লিবারেল'- উদারনৈতিক চিন্তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি হচ্ছেন মনস্বী কাজী আবদুল ওদুদ। এক বৈদগ্ধ্যপূর্ণ পরিশীলিত মানবিকতা তার সমস্ত লেখার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। ওদুদের উদারনৈতিক চিন্তার নমুনা হিসেবে একটি উদাহরণ দেওয়া এখানে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 'সংস্কৃতির কথা' প্রবন্ধের শেষটায় তিনি এভাবে উত্থাপন করেছেন তার ৫ দফা। উদ্ৃব্দতিটি কৌতূহলোদ্দীপক।
'আজকার অসার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তর থেকে সার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তরে উপনীত হতে হলে যে সব ধাপ আমাদের অতিক্রম করতে হবে, তার কিছু নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে এই ভাবে :
১. দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না।
২. একান্ত বীভৎস না হলে কোনো সমাজেরই ধর্মাচার অশ্রদ্ধেয় বিবেচিত হবে না, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে, যা প্রাচীন তা প্রাচীন বলেই বরণীয় নয়, বরণীয় তার বর্তমান কার্যকারিতার জন্যে।
৩. হিন্দু-মুসলমানের পোশাক ও নামের ব্যবধান থাকবে না অথবা অস্বীকার হবে।
৪. সামাজিক আদান-প্রদান- বিবাহ-আদি সমেত- সর্বত্র সহজ হবে।
৫. আইন সমস্ত দেশের জন্য এক হবে।'
১৯৪১ সালের লেখায় কাজী আবদুল ওদুদের এরকম দৃষ্টিভঙ্গি সেকালে এবং একালেও সর্বত্র দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এ রকম বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিকতার প্রাক-পটভূমি ছাড়া আওয়ামী মুসলিম লীগ অনায়াসে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হতে পারত না, বা বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্ম স্বীকারের সেক্যুলার আদর্শ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেত না, এ কথা হলফ করে বলা যায়। এটা ঠিক যে, যে পরিমাণে মনোযোগ ওদুদকে আমাদের দেওয়ার কথা তা তিনি সেভাবে কখনোই পাননি। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য বিষয়ে ১৯৩৫ সালে বিশ্বভারতীর 'নিজাম বক্তৃতা' দেওয়ার জন্য ওদুদ সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ দেশের সংবিধানে পরবর্তীকালে সংযোজিত সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ যুক্ত হওয়ার পেছনের সামাজিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজতে গেলে ওদুদের দ্বারস্থ আমাদের হতে হবেই। যাই হোক, দেশভাগের এক বছর আগে তার 'গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে' প্রবন্ধে উদারনীতিবাদী কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন : 'নাৎসী আদর্শের চাইতে বোলশেভিক আদর্শের বরং আমাদের দেশে বেশি কার্যকর হবার সম্ভাবনা। কেননা মানবতার দাবি বোলশেভিক আদর্শে স্বীকৃত হয়েছে, জগতের বঞ্চিতদের পক্ষ সমর্থন তাতে বেশি আছে বলে তা জগতের মানুষের হৃদয়ের উপরে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের ভাবা দরকার যে রুশ জাতি এই মতবাদ সার্থক করে তোলার ভার নিয়েছে তাদের দুর্ধর্ষতার কথা, তাদের অপূর্ব সাহিত্য-সম্পদের কথা।' ওদুদ এখানে সমাজ পরিবর্তনের পেছনে প্রেরণা-যোগানো সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ভিত্তি খুঁজছেন, এটা তাৎপর্যপূর্ণ। এবং সে কথা পার্টিশনের সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে তার সহযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়েও দিতে চাচ্ছেন :'আমার জবরদস্ত বন্ধুদের কাছে আমাদের পরম বিনীত নিবেদন : ধীরে বন্ধু ধীরে। নগরকে আলোকমালায় উজ্জ্বল করা আর তাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো এক কথা নয় কোনোদিন। অগ্নিকাণ্ড অল্পকালেই ঘটানো যায় সন্দেহ নেই, কিন্তু আলোকমালায় সজ্জিত করার জন্য চাই পর্যাপ্ত আয়োজন।'
সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি উদারনৈতিক চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদের পক্ষপাতিত্ব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসিবাদের পরাজয়ের কারণে উচ্চারিত হয়েছিল এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। অসহযোগ আন্দোলনকে উপলক্ষ করে ১৯২০ সালে লেখা 'নন-কো-অপারেশন বা অসহযোগিতা' শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবন্ধে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারায় কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ থিসিস উত্থাপন করেন ওদুদ। এটি মুজিবের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণা বোঝার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আমাদের সাহায্য করবে। এ থেকে বোঝা যাবে যে, নিছক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছকে ওদুদের 'গণশক্তি-ভিত্তিক' গণতন্ত্র বা মুজিবের 'শোষিতের গণতন্ত্র' কোনটিকেই আবদ্ধ বা সংকীর্ণ করা চলে না। দু'জনেই সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও সংগ্রামের বিশ্বজোড়া অভিঘাত স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের 'গণশক্তির' জাগরণ ঘটেছে এটা প্রত্যক্ষ করেছেন। ওদুদের উদ্ৃব্দতিটি দীর্ঘ, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২০ সালের 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় প্রকাশিত উপরোক্ত প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ বলছেন : ' ... এ কথা নিশ্চয়ই সকলকে স্বীকার করিতে হইবে যে, যাহারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া সমস্ত উদ্ভাবনাকে সিদ্ধি দান করে তাহাদের জন্য উপযুক্ত অভাব মোচনের বন্দোবস্ত করাও সকলের কর্তব্য। এত যুগ-যুগের সভ্যতা সত্ত্বেও তাদের এই ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। ... আধুনিকগণ এই সমস্ত অভাব-অভিযোগের মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছে। এবং সেইজন্য কী উপায়ে রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ পরিচালনার উপরও প্রভাব বিস্তার করিয়া সে নিজের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করিতে পারে, সে সম্বন্ধে তাহার চেষ্টার অন্ত নাই। এই দিক দিয়া ইউরোপে শ্রমজীবীর ধর্মঘট, বোলশেভিকবাদ ইত্যাদি যে সমস্ত আন্দোলন চলিয়াছে, অবশ্য তাহার সবই যে মানবের সামাজিক আদর্শ ও সভ্যতার দিক দিয়া দেখিতে গেলে ভালো বোধ হইবে এমন নহে; তবু এই সমস্ত অতিরিক্ততার ভেতর দিয়া যে একটা সত্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে, তাহাকে তো কেহ অস্বীকার করিতে পারে না। ... তবে ইহার ভেতরে একটি প্রচ্ছন্ন দুর্বলতাও আছে, সেটি হইতেছে ইহার অসহিষ্ণুতা। ... গণ তো সবে মাত্র জাগিয়া উঠিয়াছে। ইহার এরূপ চেষ্টা, অসহিষ্ণুতা অতিরিক্ততা ইত্যাদির ভেতর দিয়াই গণ তাহার নির্দিষ্ট স্বচ্ছন্দ অবস্থা বুঝিয়া পাইবে। তখন আর ইহাকে এমন ব্যতিব্যস্ত হইয়া ফিরিতে হইবে না। সমাজ-মনই ইহার দাবি-দাওয়া জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে বুঝিয়া দিবে। সেটি হইতেছে ভবিষ্যতের আশা। তবে সেই অবস্থায় যতদিন সমাজ না পৌঁছায়, অথবা স্বাধীনতা যতদিন সকলের ভাগ্যে সমপরিমাণে না ঘটে ও বিজ্ঞানের চেষ্টা যত দিন নির্ভীক সর্বপ্রকার সংস্কার-বিমুক্ত পূর্ণ সত্যান্বেষণে পর্যবসিত না হয়, ততদিন ঘোর বিপ্লবই হইবে সমাজের রীতি।'
[ক্রমশ]
মন্তব্য করুন