![সৈয়দ শামসুল হক [২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫-২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬], ছবি ::রাজিব পাল](https://samakal.com/uploads/2020/09/online/photos/Untitled-18-samakal-5f6cccb07a275.jpg)
সৈয়দ শামসুল হক [২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫-২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬], ছবি ::রাজিব পাল
সৈয়দ শামসুল হকের (জ. ১৯৩৫ মৃ. ২০১৬) সৃজন মননের জগৎটা কত বড়ো সেটা জানা যাবে তাঁর সৃষ্টির দুনিয়ায় প্রবেশ করলে। তাঁর সাহিত্য পাঠ করলে তবেই বোঝা যাবে তিনি কত বড়ো লেখক। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক, কাব্যনাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, চলচ্চিত্রের কাহিনি, সংলাপ, গান-এ ভরে আছে তাঁর সৃষ্টির ভান্ডার। তাই সব্যসাচী উপাধিটি তাঁর শিরোভূষণ হয়েছে! তাঁর সৃষ্টির মানচিত্র বড়ো থেকে আরও বড়ো হয়েছে তাঁর দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনে। ঢাকার যে কোনো লেখক আড্ডা, লেখক সম্মিলন বা কবিতা উৎসবে উপস্থিত থেকে তিনি আনন্দ আর প্রেরণার উৎস হয়েছেন বয়োকনিষ্ঠ ও বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদের। তাইতো খুব কাছ থেকে দেখা এই মহিরুহের মূল্যায়নে হয়তো প্রকৃত কথাটি উচ্চারণ করা হয়ে ওঠেনি আমাদের। বুঝতে পারিনি তাঁর সৃজন মানচিত্রের পরিধি কতটা বড়ো!
উনিশশ' সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশের জন্ম হলে ঢাকা হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। তখনও ঢাকার অবয়ব ছোটোখাটো এক শহরের মতো। পরিকল্পিত আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গাড়িঘোড়া অফিস-আদালত মানুষজন কম। এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সূচনা হয় নতুন এক সাহিত্য চর্চা। সৈয়দ শামসুল হক এই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নগর ঢাকায় তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তাঁর সাহিত্য গড়ে ওঠে গ্রাম নির্ভরতাকে বাদ দিয়ে নাগরিক চিন্তা-চেতনা ও নগরমনস্কতা দিয়ে, যা ছিল তখনকার সাহিত্যে মাইলস্টোন।
সেই চুয়ান্ন সাল থেকে দু'হাজার ষোলো পর্যন্ত দীর্ঘ লেখক জীবনে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের কলেবর বিশাল আকার ধারণ করে। এখানে কয়েকটি উপন্যাসের নাম উল্লেখ করছি- খেলারাম খেলে যা, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, স্মৃতিমেধ, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, এক যুবকের কালক্ষেপ, স্বপ্ন সংক্রান্ত, বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (অখণ্ড), নির্বাসিতা, নিষিদ্ধ লোবান, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, মহাশূন্যে পরান মাস্টার, চোখবাজি, অন্তর্গত, দূরত্ব, অন্য এক আলিঙ্গন, একমুঠো জন্মভূমি, অচেনা, রাজার সুন্দরী, কেরানিও দৌড়ে ছিল (২০১৫ শেষ করে যেতে পারেননি)।
খেলারাম খেলে যা (১৯৬২) উপন্যাসটি লিখে সৈয়দ হক ঢাকার লেখক পাঠকদের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্যের সূচনা করেন। উপন্যাস সাহিত্য বোঝেন এই ধরনের প্রগতিশীল পাঠকের সংখ্যা কম থাকায় সৈয়দ হকের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ অশ্নীলতার অভিযোগ আনে, যা লেখককে মর্মাহত করে। তিনি দুঃখ করে বলেন- 'খেলারাম খেলে যা প্রকাশিত হওয়ার কুড়ি বছর পরও আমার অন্যান্য রচনাগুলোর থেকে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়েছে, খেলারাম খেলে যা একটা ভুলবোঝা উপন্যাস, এই উপন্যাসের জন্য আমি লজ্জিত নই।' ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রসঙ্গ তোলা হলে বলা যায়, খেলারাম খেলে যা একটি আধুনিক উপন্যাস, তাঁর সময়ে অনেক লেখক এমন একটি নিরীক্ষাধর্মী সাহসী উপন্যাস লেখার কথা ভাবতে পারেননি, সৈয়দ হক সেটি করে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখককে সাহসী হতে হয়, অর্গল ভেঙে ফেলতে হয়। বাংলাদেশের উপন্যাস জগতে খেলারাম খেলে যা উপন্যাসের মধ্য দিয়েই সৈয়দ হক আমাদের উপন্যাসকে সাবালকত্ব এনে দিয়েছিলেন।
বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে। হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দীন পীর সাহেবের মাজার ঘিরে গড়ে ওঠা রংপুরের এক মফস্বল শহর জলেশ্বরী। জলেশ্বরী স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। আর বর্ষার প্রবল বর্ষণে জলেশ্বরীকে বিচ্ছিন্ন করে মরণকামড় দেওয়ার অপেক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহিউদ্দিনের গেরিলা বাহিনী। এর মধ্যে এসেছে মাজারের কিংবদন্তি, ইতিহাস, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা আর আত্মত্যাগ। লেখক মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র সব দিক তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে। কমান্ডার মহিউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করে থাকে বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি এলে পাকিস্তানিদের পরাজিত করা সহজ হবে। লেখক তখন জলেশ্বরী নদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আধকোশা নদীকে একজন গেরিলা হিসেবে দেখতে শুরু করেন। সৈয়দ হক লিখেছেন- 'গেরিলার সবচেয়ে বড় অস্ত্র এই আকস্মিকতা। আধকোশা আকস্মিকভাবেই এক নদী হয়ে যায়। আধকোশা আমাদের সবচেয়ে বড় গেরিলা।'
সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় বারবার জলেশ্বরী নামটি এসেছে, জলেশ্বরী আসলে বাংলাদেশের প্রতীক। বাঁশবনের ভেতর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহিউদ্দিন শুকনো একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে পায়ের তলার শুকনো পাতা সরিয়ে উবু হয়ে বসে মাটিতে দাগ কেটে একটা নকশা তৈরি করে। তার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধরাও তাকে ঘিরে বসে পড়ে ঘন বাঁশবনের ভেতর।
মহিউদ্দিন কঞ্চি দিয়ে প্রথমে একটি ঘোড়ার নাল আঁকে, তারপর নালের খোলা দুই মুখের দুই দিকে লম্বা করে লাইন টেনে দিয়ে হাসিমুখে সঙ্গীদের দিকে তাকায়। সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করে- কী এটা? কেউ কেউ অনুমান করতে পারলেও মুখে কিছু বলে না, মহিউদ্দিনও সত্যি সত্যি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আশা করে না, কারণ ঐ প্রশ্ন তার বক্তব্যের ভূমিকাসূচক অলংকার মাত্র।
মহিউদ্দিন দাগের ওপর কঞ্চি আর একবার বুলিয়ে বলে- এই হচ্ছে আধকোশা নদী, এই হচ্ছে নদীর গতিপথ।
সঙ্গীরা মনোযোগ দিয়ে নকশাটি দেখতে থাকে। তাদের সবারই জন্ম জলেশ্বরীতে, এই আধকোশা নদী কতবার তারা দেখেছে, কতবার এ নদীতে সাঁতার কেটেছে, কিন্তু এখন তাদের প্রত্যেকের কাছেই আধকোশাকে নতুন এক নদী মনে হয়।
মহিউদ্দিন বলে, আমরা জানি, বৃষ্টির মৌসুমে আমাদের এই আধকোশা নদী কি ভীষণ মূর্তি ধারণ করে। আধকোশা নদীর এই চেহারার কথা শত্রুরা জানে না, পাকিস্তানি মিলিটারিরা এর তেমন খোঁজ রাখে বলে মনে হয় না। মহিউদ্দিন চোখ তুলে সঙ্গীদের দিকে তাকায়, তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ এবং সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে শুনতে পায় তার সঙ্গীরা সমস্বরে বলছে, আমরা তাহলে বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব।
মহিউদ্দিন চোখ তুলে তাদের দিকে তাকায়, প্রত্যেকের দিকে আলাদা করে তাকায় সে, তারপর আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে, এবং সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে বলে- আমরা বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব। বৃষ্টির অপেক্ষা করে এই বাংলাদেশ। চাষি অপেক্ষা করে, ঘরের বউ অপেক্ষা করে, কবি অপেক্ষা করে। গ্রীষ্ফ্মের পুড়ে যাওয়া সবুজের ভেতর দাঁড়িয়ে আগুনের মতো আকাশের নিষ্ঠুরতার দিকে তাকিয়ে থাকে চাষা- কখন বৃষ্টি নামবে আকাশ থেকে। এবারের এই গ্রীষ্ফ্মে আরও একটি দল বৃষ্টির অপেক্ষা করে। তারা গেরিলা, গেরিলারা অপেক্ষা করে।
বৃষ্টি আর নদীর ফঁাঁদে আটকে মহিউদ্দিন তার গেরিলা বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মরণকামড় দিতে চায়। সে জন্যেই সে যুদ্ধের কৌশলের নকশা কেটে সঙ্গীদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়।
বাঙালির পক্ষে, হিন্দু মুসলিম মিলিত বাংলার দরিদ্র মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে, এক বৈজ্ঞানিক বোধ জাগ্রত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজ বংশের সকল ধর্মান্ধতা, পীরপূজা, মাজার পূজা, বংশগত কুসংস্কার ইত্যাদি চিরতরে বিনাশ করবার লক্ষ্যে মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, ইতিহাসের অধ্যাপক এবং জালালউদ্দিনের মতো পিতার সন্তান, ওই মাজারে যিনি ঘুমিয়ে আছেন শত শত বছর ধরে সেই পীর কুতুবউদ্দিন তার পূর্বপুরুষ, 'মহিউদ্দিন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল এক উন্নত মানব জীবন কল্পনার দিকে, জন্ডিসে আক্রান্ত হবার পর রোগশয্যায় শায়িত সে এই প্রথম বিশাল বাংলার কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল, সেই মহিউদ্দিনের পক্ষে কিন্তু এত স্বপ্ন ও ব্যগ্রতা সত্ত্বেও জলেশ্বরী মুক্ত করবার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি।'
চিকিৎসার জন্যে ভারতে যেতে কিছুতেই রাজি হয়নি মহিউদ্দিন। সময়টা ছিল খুব উত্তেজনার ভেতর। মহিউদ্দিনেরই সহযোদ্ধা সুলতান, যে ধরা পড়ে বুড়ির চর থেকে বকচরে ফেরার পথে, সুলতান বকচরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে শত্রুদের। মহিউদ্দিনের জেদাজেদিতে তার ভালোবাসার নারী ফুলকি তাকে ভারতে নিয়ে যাবার আশা ত্যাগ করে রওনা হয় নবগ্রামের দিকে।
মুক্তিযোদ্ধা মাজহার যখন জলেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালাবার প্রস্তুতি নেয়, অসুস্থ মহিউদ্দিনের কাছে নবগ্রামে সে আসে পরামর্শ করতে, কারণ মহিউদ্দিন পরিকল্পিত খালকাটা সম্পন্ন হবার পরপরই নেমে আসে অকাল বর্ষা, জলেশ্বরী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়ে অকস্মাৎ- ঠিক যেমনটি মহিউদ্দিন ভেবেছিল। মাজহার দেখতে পায়, এখনই সুযোগ চূড়ান্ত আঘাত হানবার, মাজহারের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও মহিউদ্দিন- সে তখন সামান্য সুস্থ, ফুলকিকে বিন্দুমাত্র না জানিয়ে- ফুলকি যখন তার পথ্য তৈরির জন্য রান্নাঘরে, তখন সে বেরিয়ে পড়ে, যখন রাজার হাটে এসে মাজহারের কাছে উপস্থিত হয়, তখন মাজহার মহিউদ্দিনের হঠকারিতার জন্যে মৃদু তিরস্কার করে সত্য, কিন্তু তাকে নবগ্রামে আবার ফেরত পাঠাবার কোনো উপায়, সুযোগ বা সময় আর ততক্ষণে নেই। অপারেশনের মুহূর্ত একেবারেই সন্নিকট।
মাজহার একটা নিরাপদ বাড়িতে মহিউদ্দিনকে রেখে যায়, সঙ্গে একদল মুক্তিযোদ্ধাকেও থাকতে বলে, কারণ মহিউদ্দিন জলেশ্বরীর রেলপথের সবকিছু চেনে জানে।
মাজহারের আক্রমণের ফলে যখন জলেশ্বরীর পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুরের দিকে পিছু হটতে শুরু করে, তখন মহিউদ্দিন তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবার জন্যে নবগ্রাম থেকে তিস্তা পর্যন্ত রেলপথের ও সড়কপথের ব্রিজগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার অপারেশন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে থাকে।
পরপর তিনটি ব্রিজ ধ্বংস করবার পর, নবগ্রাম ও রাজারহাটের মাঝখানে চিল্লারহাট ব্রিজ উড়িয়ে দেবার সময় জন্ডিসে আক্রান্ত মহিউদ্দিন হঠাৎ দুর্বলতার কারণে সে পেছনে থেকে যায়, তার দলকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে। এবং এক মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সে বিশ্রাম নিচ্ছে- তখন রংপুরের দিকে পলায়নপর পাকিস্তানি মিলিটারির ছোট একটা দল এসে উপস্থিত হয়- তাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মহিউদ্দিন পাকিস্তানি দলটির সব ক'জন সৈন্য খতম করে- কিন্তু এই অ্যামবুশ যুদ্ধে মহিউদ্দিনের বুকে সরাসরি এসে বেঁধে একটি বুলেট এবং আর একটি বুলেটে তার মাথার খুলির একপাশ সম্পূর্ণ উড়ে যায়।
মহিউদ্দিনের মা শামসি বেগমই ফুলকিকে তাঁর পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পরিবার ও সমাজের সকল বাধা, সমালোচনা ও ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও। তখন ফুলকির গর্ভে মহিউদ্দিনের সন্তান। সৈয়দ বংশের সবচেয়ে মুরব্বি, তিনি সবার বড়দাদি, তিনি শামসি বেগমকে ডেকে বললেন, 'এ তুমি কী করছো বেটি! ওর পেটে জারজ সন্তান। মহি মিয়ার সাথে তার বিবাহ হয় নাই।'
তখন শামসি বেগম দৃঢ়কণ্ঠে বলেন- 'বিবাহ তো আমারও হয় নাই। আমার তখন তিন বৎসর বয়স, মহির বাবা পনের বৎসর। বিবাহ আপনারা দিয়েছিলেন বলেন। বিবাহ আমাদের সজ্ঞানে বা সম্মতিতে হয় নাই। তবুও আমরা সংসার করেছি। আমাদের সন্তান হয়েছে। ফুলকির সন্তান যদি জারজ হয়, তাহলে আমার মহিউদ্দিন আর ময়নাও ছিল জারজ।'
শামসি বেগম তাঁর নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাতির নাম রাখেন শামসুদ্দিন। 'শামসুদ্দিন মানে দ্বীনের যে শাম্স, ধর্মের যে সূর্য। আর ধর্ম তো আর কিছুই নয়, ধর্ম হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তাই- যা আমাদের ধারণ করে।'
বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ মূলত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান। উপন্যাসটি বিশাল অবয়বের, এর বিশাল কলেবরে শুধু যুদ্ধের কথা শোনাননি লেখক, এতে বিধৃত হয়েছে বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুই অঞ্চলের দুটি ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি, ভাষা, আলাদা আলাদা ধর্মীয় মূল্যবোধ, বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণার ইতিহাস, আছে পরতে পরতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর সেই মহামন্ত্র- 'তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।'
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এই জনপদের সাহসের ইতিহাসকে মহাকাব্যের আদলে তুলে ধরেছেন তাঁর বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসে।
তাঁর কবিতা, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস সব বিষয়েই শুরু থেকেই সব সৃষ্টিতে তিনি বাংলা ভাষার আর পাঁচজন গতানুগতিক লেখক কবি থেকে নিজেকে চিনিয়েছেন সাহসী প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে, বাংলা ভাষাকে তিনি শৌর্য-বীর্যমণ্ডিত এক গতিশীল আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে আধুনিক দুনিয়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর কাব্যনাটক, তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্যই তার প্রমাণ। খেলারাম খেলে যা থেকে মৃত্যুর আগের 'কেরানিও দৌড়ে ছিল' পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি একজন আলাদা কণ্ঠস্বর, এই কৃতী মানুষটা বাংলাদেশের সাহিত্যকে যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন, আর কোনো একক লেখকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তিনিই সব্যসাচী, আমাদের সৈয়দ শামসুল হক।
উনিশশ' সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশের জন্ম হলে ঢাকা হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। তখনও ঢাকার অবয়ব ছোটোখাটো এক শহরের মতো। পরিকল্পিত আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গাড়িঘোড়া অফিস-আদালত মানুষজন কম। এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সূচনা হয় নতুন এক সাহিত্য চর্চা। সৈয়দ শামসুল হক এই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নগর ঢাকায় তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তাঁর সাহিত্য গড়ে ওঠে গ্রাম নির্ভরতাকে বাদ দিয়ে নাগরিক চিন্তা-চেতনা ও নগরমনস্কতা দিয়ে, যা ছিল তখনকার সাহিত্যে মাইলস্টোন।
সেই চুয়ান্ন সাল থেকে দু'হাজার ষোলো পর্যন্ত দীর্ঘ লেখক জীবনে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের কলেবর বিশাল আকার ধারণ করে। এখানে কয়েকটি উপন্যাসের নাম উল্লেখ করছি- খেলারাম খেলে যা, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, স্মৃতিমেধ, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, এক যুবকের কালক্ষেপ, স্বপ্ন সংক্রান্ত, বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (অখণ্ড), নির্বাসিতা, নিষিদ্ধ লোবান, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, মহাশূন্যে পরান মাস্টার, চোখবাজি, অন্তর্গত, দূরত্ব, অন্য এক আলিঙ্গন, একমুঠো জন্মভূমি, অচেনা, রাজার সুন্দরী, কেরানিও দৌড়ে ছিল (২০১৫ শেষ করে যেতে পারেননি)।
খেলারাম খেলে যা (১৯৬২) উপন্যাসটি লিখে সৈয়দ হক ঢাকার লেখক পাঠকদের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্যের সূচনা করেন। উপন্যাস সাহিত্য বোঝেন এই ধরনের প্রগতিশীল পাঠকের সংখ্যা কম থাকায় সৈয়দ হকের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ অশ্নীলতার অভিযোগ আনে, যা লেখককে মর্মাহত করে। তিনি দুঃখ করে বলেন- 'খেলারাম খেলে যা প্রকাশিত হওয়ার কুড়ি বছর পরও আমার অন্যান্য রচনাগুলোর থেকে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়েছে, খেলারাম খেলে যা একটা ভুলবোঝা উপন্যাস, এই উপন্যাসের জন্য আমি লজ্জিত নই।' ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রসঙ্গ তোলা হলে বলা যায়, খেলারাম খেলে যা একটি আধুনিক উপন্যাস, তাঁর সময়ে অনেক লেখক এমন একটি নিরীক্ষাধর্মী সাহসী উপন্যাস লেখার কথা ভাবতে পারেননি, সৈয়দ হক সেটি করে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখককে সাহসী হতে হয়, অর্গল ভেঙে ফেলতে হয়। বাংলাদেশের উপন্যাস জগতে খেলারাম খেলে যা উপন্যাসের মধ্য দিয়েই সৈয়দ হক আমাদের উপন্যাসকে সাবালকত্ব এনে দিয়েছিলেন।
বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে। হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দীন পীর সাহেবের মাজার ঘিরে গড়ে ওঠা রংপুরের এক মফস্বল শহর জলেশ্বরী। জলেশ্বরী স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। আর বর্ষার প্রবল বর্ষণে জলেশ্বরীকে বিচ্ছিন্ন করে মরণকামড় দেওয়ার অপেক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহিউদ্দিনের গেরিলা বাহিনী। এর মধ্যে এসেছে মাজারের কিংবদন্তি, ইতিহাস, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা আর আত্মত্যাগ। লেখক মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র সব দিক তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে। কমান্ডার মহিউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করে থাকে বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি এলে পাকিস্তানিদের পরাজিত করা সহজ হবে। লেখক তখন জলেশ্বরী নদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আধকোশা নদীকে একজন গেরিলা হিসেবে দেখতে শুরু করেন। সৈয়দ হক লিখেছেন- 'গেরিলার সবচেয়ে বড় অস্ত্র এই আকস্মিকতা। আধকোশা আকস্মিকভাবেই এক নদী হয়ে যায়। আধকোশা আমাদের সবচেয়ে বড় গেরিলা।'
সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় বারবার জলেশ্বরী নামটি এসেছে, জলেশ্বরী আসলে বাংলাদেশের প্রতীক। বাঁশবনের ভেতর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহিউদ্দিন শুকনো একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে পায়ের তলার শুকনো পাতা সরিয়ে উবু হয়ে বসে মাটিতে দাগ কেটে একটা নকশা তৈরি করে। তার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধরাও তাকে ঘিরে বসে পড়ে ঘন বাঁশবনের ভেতর।
মহিউদ্দিন কঞ্চি দিয়ে প্রথমে একটি ঘোড়ার নাল আঁকে, তারপর নালের খোলা দুই মুখের দুই দিকে লম্বা করে লাইন টেনে দিয়ে হাসিমুখে সঙ্গীদের দিকে তাকায়। সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করে- কী এটা? কেউ কেউ অনুমান করতে পারলেও মুখে কিছু বলে না, মহিউদ্দিনও সত্যি সত্যি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আশা করে না, কারণ ঐ প্রশ্ন তার বক্তব্যের ভূমিকাসূচক অলংকার মাত্র।
মহিউদ্দিন দাগের ওপর কঞ্চি আর একবার বুলিয়ে বলে- এই হচ্ছে আধকোশা নদী, এই হচ্ছে নদীর গতিপথ।
সঙ্গীরা মনোযোগ দিয়ে নকশাটি দেখতে থাকে। তাদের সবারই জন্ম জলেশ্বরীতে, এই আধকোশা নদী কতবার তারা দেখেছে, কতবার এ নদীতে সাঁতার কেটেছে, কিন্তু এখন তাদের প্রত্যেকের কাছেই আধকোশাকে নতুন এক নদী মনে হয়।
মহিউদ্দিন বলে, আমরা জানি, বৃষ্টির মৌসুমে আমাদের এই আধকোশা নদী কি ভীষণ মূর্তি ধারণ করে। আধকোশা নদীর এই চেহারার কথা শত্রুরা জানে না, পাকিস্তানি মিলিটারিরা এর তেমন খোঁজ রাখে বলে মনে হয় না। মহিউদ্দিন চোখ তুলে সঙ্গীদের দিকে তাকায়, তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ এবং সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে শুনতে পায় তার সঙ্গীরা সমস্বরে বলছে, আমরা তাহলে বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব।
মহিউদ্দিন চোখ তুলে তাদের দিকে তাকায়, প্রত্যেকের দিকে আলাদা করে তাকায় সে, তারপর আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে, এবং সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে বলে- আমরা বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব। বৃষ্টির অপেক্ষা করে এই বাংলাদেশ। চাষি অপেক্ষা করে, ঘরের বউ অপেক্ষা করে, কবি অপেক্ষা করে। গ্রীষ্ফ্মের পুড়ে যাওয়া সবুজের ভেতর দাঁড়িয়ে আগুনের মতো আকাশের নিষ্ঠুরতার দিকে তাকিয়ে থাকে চাষা- কখন বৃষ্টি নামবে আকাশ থেকে। এবারের এই গ্রীষ্ফ্মে আরও একটি দল বৃষ্টির অপেক্ষা করে। তারা গেরিলা, গেরিলারা অপেক্ষা করে।
বৃষ্টি আর নদীর ফঁাঁদে আটকে মহিউদ্দিন তার গেরিলা বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মরণকামড় দিতে চায়। সে জন্যেই সে যুদ্ধের কৌশলের নকশা কেটে সঙ্গীদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়।
বাঙালির পক্ষে, হিন্দু মুসলিম মিলিত বাংলার দরিদ্র মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে, এক বৈজ্ঞানিক বোধ জাগ্রত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজ বংশের সকল ধর্মান্ধতা, পীরপূজা, মাজার পূজা, বংশগত কুসংস্কার ইত্যাদি চিরতরে বিনাশ করবার লক্ষ্যে মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, ইতিহাসের অধ্যাপক এবং জালালউদ্দিনের মতো পিতার সন্তান, ওই মাজারে যিনি ঘুমিয়ে আছেন শত শত বছর ধরে সেই পীর কুতুবউদ্দিন তার পূর্বপুরুষ, 'মহিউদ্দিন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল এক উন্নত মানব জীবন কল্পনার দিকে, জন্ডিসে আক্রান্ত হবার পর রোগশয্যায় শায়িত সে এই প্রথম বিশাল বাংলার কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল, সেই মহিউদ্দিনের পক্ষে কিন্তু এত স্বপ্ন ও ব্যগ্রতা সত্ত্বেও জলেশ্বরী মুক্ত করবার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি।'
চিকিৎসার জন্যে ভারতে যেতে কিছুতেই রাজি হয়নি মহিউদ্দিন। সময়টা ছিল খুব উত্তেজনার ভেতর। মহিউদ্দিনেরই সহযোদ্ধা সুলতান, যে ধরা পড়ে বুড়ির চর থেকে বকচরে ফেরার পথে, সুলতান বকচরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে শত্রুদের। মহিউদ্দিনের জেদাজেদিতে তার ভালোবাসার নারী ফুলকি তাকে ভারতে নিয়ে যাবার আশা ত্যাগ করে রওনা হয় নবগ্রামের দিকে।
মুক্তিযোদ্ধা মাজহার যখন জলেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালাবার প্রস্তুতি নেয়, অসুস্থ মহিউদ্দিনের কাছে নবগ্রামে সে আসে পরামর্শ করতে, কারণ মহিউদ্দিন পরিকল্পিত খালকাটা সম্পন্ন হবার পরপরই নেমে আসে অকাল বর্ষা, জলেশ্বরী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়ে অকস্মাৎ- ঠিক যেমনটি মহিউদ্দিন ভেবেছিল। মাজহার দেখতে পায়, এখনই সুযোগ চূড়ান্ত আঘাত হানবার, মাজহারের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও মহিউদ্দিন- সে তখন সামান্য সুস্থ, ফুলকিকে বিন্দুমাত্র না জানিয়ে- ফুলকি যখন তার পথ্য তৈরির জন্য রান্নাঘরে, তখন সে বেরিয়ে পড়ে, যখন রাজার হাটে এসে মাজহারের কাছে উপস্থিত হয়, তখন মাজহার মহিউদ্দিনের হঠকারিতার জন্যে মৃদু তিরস্কার করে সত্য, কিন্তু তাকে নবগ্রামে আবার ফেরত পাঠাবার কোনো উপায়, সুযোগ বা সময় আর ততক্ষণে নেই। অপারেশনের মুহূর্ত একেবারেই সন্নিকট।
মাজহার একটা নিরাপদ বাড়িতে মহিউদ্দিনকে রেখে যায়, সঙ্গে একদল মুক্তিযোদ্ধাকেও থাকতে বলে, কারণ মহিউদ্দিন জলেশ্বরীর রেলপথের সবকিছু চেনে জানে।
মাজহারের আক্রমণের ফলে যখন জলেশ্বরীর পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুরের দিকে পিছু হটতে শুরু করে, তখন মহিউদ্দিন তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবার জন্যে নবগ্রাম থেকে তিস্তা পর্যন্ত রেলপথের ও সড়কপথের ব্রিজগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার অপারেশন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে থাকে।
পরপর তিনটি ব্রিজ ধ্বংস করবার পর, নবগ্রাম ও রাজারহাটের মাঝখানে চিল্লারহাট ব্রিজ উড়িয়ে দেবার সময় জন্ডিসে আক্রান্ত মহিউদ্দিন হঠাৎ দুর্বলতার কারণে সে পেছনে থেকে যায়, তার দলকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে। এবং এক মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সে বিশ্রাম নিচ্ছে- তখন রংপুরের দিকে পলায়নপর পাকিস্তানি মিলিটারির ছোট একটা দল এসে উপস্থিত হয়- তাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মহিউদ্দিন পাকিস্তানি দলটির সব ক'জন সৈন্য খতম করে- কিন্তু এই অ্যামবুশ যুদ্ধে মহিউদ্দিনের বুকে সরাসরি এসে বেঁধে একটি বুলেট এবং আর একটি বুলেটে তার মাথার খুলির একপাশ সম্পূর্ণ উড়ে যায়।
মহিউদ্দিনের মা শামসি বেগমই ফুলকিকে তাঁর পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পরিবার ও সমাজের সকল বাধা, সমালোচনা ও ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও। তখন ফুলকির গর্ভে মহিউদ্দিনের সন্তান। সৈয়দ বংশের সবচেয়ে মুরব্বি, তিনি সবার বড়দাদি, তিনি শামসি বেগমকে ডেকে বললেন, 'এ তুমি কী করছো বেটি! ওর পেটে জারজ সন্তান। মহি মিয়ার সাথে তার বিবাহ হয় নাই।'
তখন শামসি বেগম দৃঢ়কণ্ঠে বলেন- 'বিবাহ তো আমারও হয় নাই। আমার তখন তিন বৎসর বয়স, মহির বাবা পনের বৎসর। বিবাহ আপনারা দিয়েছিলেন বলেন। বিবাহ আমাদের সজ্ঞানে বা সম্মতিতে হয় নাই। তবুও আমরা সংসার করেছি। আমাদের সন্তান হয়েছে। ফুলকির সন্তান যদি জারজ হয়, তাহলে আমার মহিউদ্দিন আর ময়নাও ছিল জারজ।'
শামসি বেগম তাঁর নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাতির নাম রাখেন শামসুদ্দিন। 'শামসুদ্দিন মানে দ্বীনের যে শাম্স, ধর্মের যে সূর্য। আর ধর্ম তো আর কিছুই নয়, ধর্ম হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তাই- যা আমাদের ধারণ করে।'
বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ মূলত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান। উপন্যাসটি বিশাল অবয়বের, এর বিশাল কলেবরে শুধু যুদ্ধের কথা শোনাননি লেখক, এতে বিধৃত হয়েছে বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুই অঞ্চলের দুটি ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি, ভাষা, আলাদা আলাদা ধর্মীয় মূল্যবোধ, বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণার ইতিহাস, আছে পরতে পরতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর সেই মহামন্ত্র- 'তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।'
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এই জনপদের সাহসের ইতিহাসকে মহাকাব্যের আদলে তুলে ধরেছেন তাঁর বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসে।
তাঁর কবিতা, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস সব বিষয়েই শুরু থেকেই সব সৃষ্টিতে তিনি বাংলা ভাষার আর পাঁচজন গতানুগতিক লেখক কবি থেকে নিজেকে চিনিয়েছেন সাহসী প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে, বাংলা ভাষাকে তিনি শৌর্য-বীর্যমণ্ডিত এক গতিশীল আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে আধুনিক দুনিয়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর কাব্যনাটক, তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্যই তার প্রমাণ। খেলারাম খেলে যা থেকে মৃত্যুর আগের 'কেরানিও দৌড়ে ছিল' পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি একজন আলাদা কণ্ঠস্বর, এই কৃতী মানুষটা বাংলাদেশের সাহিত্যকে যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন, আর কোনো একক লেখকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তিনিই সব্যসাচী, আমাদের সৈয়দ শামসুল হক।
মন্তব্য করুন