- কালের খেয়া
- অভিবাদন, প্রিয় সাহিত্যযোদ্ধা
আনোয়ারা সৈয়দ হকের ৮০তম জন্মবার্ষিকী
অভিবাদন, প্রিয় সাহিত্যযোদ্ধা
জন্মদিন
![আনোয়ারা সৈয়দ হক [জন্ম :৫ নভেম্বর, ১৯৪০]](https://samakal.com/uploads/2020/11/online/photos/Untitled-18-samakal-5fa433159a6d5.jpg)
আনোয়ারা সৈয়দ হক [জন্ম :৫ নভেম্বর, ১৯৪০]
আনোয়ারা সৈয়দ হক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর, যখন যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামটি কার্তিকের কুয়াশা কাটিয়ে জেগে উঠছে ধীরে। পিতা রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। মা আছিয়া খাতুন গৃহিণী।
শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন তিনি যশোরের শ্যামল প্রকৃতির হাতে হাত রেখে। দু'চোখে নিসর্গের নির্মল আলো মেখে বিস্ময়ে তাকিয়েছেন মহাপৃথিবীর সকল নতুনত্বে।
চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন মায়ের হাতে প্রথম পাঠ নিয়ে। মধুসূদন তারা প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেছিলেন জ্ঞান অর্জনের অপার অনুরাগে। অষ্টাদশ শতকেই এই মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মেছিলেন যশোরের 'দুগ্ধস্রোতরূপী' কপোতাক্ষ নদের পারে সাগরদাঁড়ি গ্রামে। যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পী, বাংলা কাব্যের প্রাণপুরুষ।
প্রতিভাধর যশোরের মাটি ধারণ করেছেন বহু কৃতী সন্তান। পঞ্চদশ শতকে এই মাটিতেই সনাতম গোস্বামী ও রূপ গোস্বামীর মতো চৈতন্য ভক্তের জন্ম। শ্রীচৈতন্যদেবের আদেশে এই ভ্রাতৃদ্বয়বৈষ্ণব ধর্মকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা জন্মেছে এই যশোরে। চল্লিশের দশকের আধুনিক কবি আবুল হোসেনের বাড়ি এই জেলায়। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও মানবতাবাদী ডা. লুৎফর রহমান, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম শহীদ বিপ্লবী বাঘা যতীন, সংগ্রামী কৃষক নেতা বিপ্লবী ইলা মিত্রসহ আরও বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়ে যশোর জেলার মাটি উর্বর হয়েছে ততোধিক।
এই জেলার মাটির গুণেই দুঃসাহসী অন্য এক বালিকাকে আমরা পেয়েছি, আনোয়ারা সৈয়দ হক যার নাম।
ইংরেজি সাহিত্য পাঠের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এই মেধাবী।
সুশ্রী, সুন্দরী, বিদুষী, প্রিয়দর্শিনী যে মেয়েটি জীবন সংগ্রামের দলিল হাতে নিয়ে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করে বেরিয়েছিলেন মানবসেবার অঙ্গীকার নিয়ে। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানব সেবার পাশাপাশি সাহিত্য সৃষ্টির সুগভীর প্রেরণা ও আকুতি থেকে নিরন্তর শব্দে শব্দে সৃষ্টি করে গেছেন নিজস্ব প্রত্যয়ের এক ভিন্নধর্মী শৈল্পিক রস-মূর্তি। উপন্যাস যার নাম, ছোটগল্প, শিশুতোষ, প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা, স্মৃতিকথা ছাড়াও কাব্যশিল্পে অলৌকিক মায়াস্রোতে অবগাহন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়।
২০২০ সালের ৫ নভেম্বর তারিখে বিদগ্ধ ৮০ বছর পূর্ণ হলো তার। একাশি বছরের ঋদ্ধ সময়-তরীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি শিল্পের অমৃত-ভেলা। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপন প্রতিভার স্বাক্ষরে তিনি ঢেলে দিয়েছেন শিল্পের সোনালি মুদ্রা যত। শুভ জন্মদিন আপনাকে, আনোয়ারা সৈয়দ হক।
হে বরেণ্য বাংলা ভাষার শিল্পী, কথাশিল্পী।
শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে আজ।
অন্তর্জালে উইকিপিডিয়ায় আপনার পরিচিতি প্রসঙ্গে লেখা আছে, আনোয়ারা সৈয়দ হক হলেন একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার রচনায় মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। পারিবারিক জীবনে তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী ছিলেন। এর বাইরেও রয়ে গেছে অনেক কথা, একজন নারীর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে লুকিয়ে থাকে ভিন্নতর এক সংগ্রামবহুল অভিযাত্রার কাহিনি। যে কাহিনিতে শুধু অমল-ধবল পাঠ নয়, নয় কেবল প্রেম-ভালোবাসার রোমান্টিকতা। ভাবের আদান-প্রদান কিংবা নারী-পুরুষের সমান অধিকারের খড়-বিচালিও নয় শুধু। যে গভীর তলদেশে লুকিয়ে থাকে নারীর আত্মসংকট, শোষণ প্রক্রিয়া, যৌন হয়রানির অকথিত গল্প, অবদমনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অপ্রকাশ বেদনা, তাকেও যে তুলে আনতে হয় বিষ পিঁপড়ের শত-সহস্র কামড় খেয়েও। ব্যক্তিজীবনের চরৈবেতি এবং তার শতসহস্র বিষাক্ত হুলের নীল বেদনা সহ্য করেও কাহিনিটি তাকেই টেনে নিয়ে যেতে হয় নিজস্ব গন্তব্যপানে।
আপনাকে যেটুকু পাঠ করেছি, তা থেকে অনুমান করি, তার অনেকটাই আপনি রচনার সুকৌশল বর্ণনার ভেতরে কুয়াশার এক বনায়ন সৃষ্টি করেই তা বলতে চেষ্টা করেছেন।
কখনো সরাসরি, কখনো বা রূপকের আধারে, কখনো বাদে-প্রতিবাদে, ক্ষোভে-বিক্ষোভে, ক্ষুব্ধ সংলাপে। প্রয়োজনে স্পষ্ট আর্ত চিৎকারে বলেছেন আপনারই কথা বিভিন্ন চরিত্রের মুখে। সবই তো আপনার জীবন দর্শন থেকেই উদ্ভূত, সংকলিত। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, অসামান্য আপনাকে পরিপূর্ণভাবে পাঠ করে শেষ করতে পারিনি এই সামান্য আমিও। তবু আপনার ৮০তম জন্মদিনের এই শুভ মহার্ঘ্য মুহূর্তে কিছু বলবো না, তাই কী হয়?
১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় আপনার ছোটগল্প 'পরিবর্তন' প্রকাশের মধ্য দিয়েই প্রথম সাহিত্য-যাত্রা। সাহিত্যকে ভালোবাসার প্রমাণ। সৃষ্টিশীল এষণায় দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে নিয়মিত লিখে হাত পোক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে। এ ছাড়া শুরুতে স্কুল, কলেজ, এমনকি মেডিকেলের জার্নালেও ছড়িয়ে আছে আপনার সাহিত্য চর্চার বহু বর্ণিল স্বাক্ষর। ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে তরুণ লেখক সৈয়দ শামসুল হকের 'তিন পয়সার জোসনা' কিনে পাঠ করে মুগ্ধ হলেন। এতটাই বিমুগ্ধ হলেন যে, সে আবেগের কথা লেখককে চিঠি লিখে জানালেন নির্দি্বধায়, অকপটে।
সেই পাঠ সূত্রের স্পর্শে এলো চিঠি, হেমন্তের ঝরাপাতার মতো উড়ে উড়ে এসে জমলো অনেক। পাহাড় হলো, নদী হলো, আকাশের নীল হলো কিছু, নক্ষত্র হয়ে উড়তে শুরু করে দিলো আপনার উন্মুখ হৃদয়াকাশের গভীর নীলে। অতঃপর গুলিস্তান সিনেমা হলের চিন-চাও চায়নিজ রেস্তোঁরায় দুজনের দেখা হলো তৃষা হরিয়ে। এক দেখায় প্রেমের প্রণতি ও অভিবাদন জানিয়ে যে শব্দবন্দনা রচনা করলেন কবি, কবিতার সেই অলৌকিক মায়ার জগতে প্রবেশমাত্রই বিমোহিত হলেন, শাশ্বতীর মতো একদা বাদল শেষের রাতে যেন আপনিও বিমূর্ত হলেন তার মর্মে।
থেমে গেল যেন কালের চিরচঞ্চল গতি। আপনার মনোভূমি কবিতার সমুদ্রজলে ভিজে কাদা কাদা হলো সবুজ শস্যক্ষেতের মতো। তাছাড়া, কবিকে ভালো না বেসে কি আর সেই মহামুক্তি মেলে?
প্রজাপতি ডানায় উড়ে উড়ে কেটে গেল অনেকটা সময়, ইতোমধ্যে সময়ের নিরিবিলি চরায় জেগে উঠল অবিনাশী সেই প্রেম, বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এই প্রণয় রূপকথা ১৯৬৫ সালে খুঁজে পেলো তার গৃহ। নিভৃত বন-মধ্যে যেন ছায়াচ্ছন্ন এক বহুবর্ণিল পুষ্প উদ্যান।
দুজনের অপার ভালোবাসায় এই ধরায় এসেছে দুজন সন্তান, কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক, পুত্র দ্বিতীয়-সৈয়দ হক। আরো জন্ম নিলো অমৃতের কতিপয় সন্তান। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'তৃষিতা' প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে। ১৯৬৮ সালে 'সচিত্র সন্ধানী' পাক্ষিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো উপন্যাস 'সেই প্রেম, সেই সময়'। অসাধারণ আধুনিক এই উপন্যাসে আপনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বর্ণনায়, চরিত্র চিত্রণে, কাহিনি নির্মানে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিলেন।
তরতর করে উজানে-ভাটিতে বয়ে চললো আপনার শিল্পতরী। বহু বাঁক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও আপনার স্পষ্ট লক্ষ ছিল সমুদ্রসঙ্গমে বয়ে যাওয়া। কর্মজীবন ও সংসার যাপনের বাইরে বেরিয়ে তাই নিজস্ব একান্ত বিশ্রাম ও ঘুমের সময়টুকু আপনি কেড়ে নিয়ে, তার ব্যয় বাড়ালেন শিল্প অন্বেষায়। কি দুর্মর আকুতি। এমন না হলে কী আর সৃষ্টিশীলভাবে বেঁচে থাকা হয়? চেতন-অবচেতনে এমন প্রেরণা, সৃষ্টির বীজ হৃদয়ে উপ্ত হলে, উন্মুক্ত হলেই বুঝি, অর্ধনারীশ্বরের মতো অবলীলায় বলা যায়-
'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সূর্যকরে পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।'
নিরন্তর এই শিল্প-যাত্রায় একজন প্রকৃত ভাষাশিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকে লিখেছেন আপনি ৩৩টি উপন্যাস। ভাবা যায় না, কত শ্রমসাধ্য এই কাজ। প্রান্তবাসী নারীর জীবন, জীবিকা, নারীর আদিম পেশার সংকট নিয়ে আপনার নিরীক্ষাধর্মী অসাধারণ এক উপন্যাস 'ব্যবহূতা' পাঠে আমি বিমুগ্ধ হয়েছি। আমাদের চোখের আড়ালে থাকা যৌন পেশা নিয়ে জানতে পেরেছি অনেক অজানা তথ্য। এ ছাড়া নরক ও ফুলের কাহিনী, নারী :বিদ্রোহী, ঘুমন্ত খেলোয়াড়, খাদ, নিঃশব্দতার ভাঙচুর, উদয় মিনাকে চায়, অস্থিরতার কাল, ভালোবাসার সময় ইত্যাদি।
ছোটগল্প, 'হেলাল যাচ্ছিলো রেশমার সাথে দেখা করতে'- এ রকম অনন্য কিছু গল্পসহ প্রায় ১১টি গল্প আছে।
শিশুতোষ রচনার অনেকটা জুড়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ, ঘটনা ও কাহিনির চমৎকার বয়ান। যে পাঠ থেকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বাহিত দেশপ্রেমের মন্দাকিনী। এ ছাড়া শিশুদের মনোভূমি বিনির্মাণে নীতিনৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ২৫টি রচনা রয়েছে আপনার। প্রবন্ধের ৭টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য, ক্ষুব্ধ সংলাপ, মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি, পিকাসোর নারীরা, নারীর কিছু কথা।
কাব্যগ্রন্থেও তিনি নারীর মুক্তি খুঁজেছেন নিজের মতো করে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'কিছু কি পুড়ে যাচ্ছে কোথাও'।
'তুমি আগে যাবে, না আমি,
স্বপ্নের ভেতর, তুমি এক অলৌকিক বাড়িঅলা,
কাল খুব কষ্টে ছিলাম' মিলে ৬টি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে আপনার, তাই না?
বিপুল বর্ণাঢ্য আপনার এই শিল্পসম্ভার এবং তার স্বীকৃতিও এসেছে দেশের অধিকাংশ পুরস্কার প্রাপ্তিযোগে। মহতী অপর এক শিল্পীর সঙ্গে শিল্পিত জীবন যাপন আপনার আরাধ্য ছিল। আপনি তাকে শেষ পর্যন্ত সেভাবেই নিয়ন্ত্রণে রেখে যাপন করেছেন।
শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন তিনি যশোরের শ্যামল প্রকৃতির হাতে হাত রেখে। দু'চোখে নিসর্গের নির্মল আলো মেখে বিস্ময়ে তাকিয়েছেন মহাপৃথিবীর সকল নতুনত্বে।
চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন মায়ের হাতে প্রথম পাঠ নিয়ে। মধুসূদন তারা প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেছিলেন জ্ঞান অর্জনের অপার অনুরাগে। অষ্টাদশ শতকেই এই মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মেছিলেন যশোরের 'দুগ্ধস্রোতরূপী' কপোতাক্ষ নদের পারে সাগরদাঁড়ি গ্রামে। যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পী, বাংলা কাব্যের প্রাণপুরুষ।
প্রতিভাধর যশোরের মাটি ধারণ করেছেন বহু কৃতী সন্তান। পঞ্চদশ শতকে এই মাটিতেই সনাতম গোস্বামী ও রূপ গোস্বামীর মতো চৈতন্য ভক্তের জন্ম। শ্রীচৈতন্যদেবের আদেশে এই ভ্রাতৃদ্বয়বৈষ্ণব ধর্মকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা জন্মেছে এই যশোরে। চল্লিশের দশকের আধুনিক কবি আবুল হোসেনের বাড়ি এই জেলায়। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও মানবতাবাদী ডা. লুৎফর রহমান, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম শহীদ বিপ্লবী বাঘা যতীন, সংগ্রামী কৃষক নেতা বিপ্লবী ইলা মিত্রসহ আরও বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়ে যশোর জেলার মাটি উর্বর হয়েছে ততোধিক।
এই জেলার মাটির গুণেই দুঃসাহসী অন্য এক বালিকাকে আমরা পেয়েছি, আনোয়ারা সৈয়দ হক যার নাম।
ইংরেজি সাহিত্য পাঠের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এই মেধাবী।
সুশ্রী, সুন্দরী, বিদুষী, প্রিয়দর্শিনী যে মেয়েটি জীবন সংগ্রামের দলিল হাতে নিয়ে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করে বেরিয়েছিলেন মানবসেবার অঙ্গীকার নিয়ে। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানব সেবার পাশাপাশি সাহিত্য সৃষ্টির সুগভীর প্রেরণা ও আকুতি থেকে নিরন্তর শব্দে শব্দে সৃষ্টি করে গেছেন নিজস্ব প্রত্যয়ের এক ভিন্নধর্মী শৈল্পিক রস-মূর্তি। উপন্যাস যার নাম, ছোটগল্প, শিশুতোষ, প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা, স্মৃতিকথা ছাড়াও কাব্যশিল্পে অলৌকিক মায়াস্রোতে অবগাহন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়।
২০২০ সালের ৫ নভেম্বর তারিখে বিদগ্ধ ৮০ বছর পূর্ণ হলো তার। একাশি বছরের ঋদ্ধ সময়-তরীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি শিল্পের অমৃত-ভেলা। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপন প্রতিভার স্বাক্ষরে তিনি ঢেলে দিয়েছেন শিল্পের সোনালি মুদ্রা যত। শুভ জন্মদিন আপনাকে, আনোয়ারা সৈয়দ হক।
হে বরেণ্য বাংলা ভাষার শিল্পী, কথাশিল্পী।
শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে আজ।
অন্তর্জালে উইকিপিডিয়ায় আপনার পরিচিতি প্রসঙ্গে লেখা আছে, আনোয়ারা সৈয়দ হক হলেন একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার রচনায় মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। পারিবারিক জীবনে তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী ছিলেন। এর বাইরেও রয়ে গেছে অনেক কথা, একজন নারীর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে লুকিয়ে থাকে ভিন্নতর এক সংগ্রামবহুল অভিযাত্রার কাহিনি। যে কাহিনিতে শুধু অমল-ধবল পাঠ নয়, নয় কেবল প্রেম-ভালোবাসার রোমান্টিকতা। ভাবের আদান-প্রদান কিংবা নারী-পুরুষের সমান অধিকারের খড়-বিচালিও নয় শুধু। যে গভীর তলদেশে লুকিয়ে থাকে নারীর আত্মসংকট, শোষণ প্রক্রিয়া, যৌন হয়রানির অকথিত গল্প, অবদমনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অপ্রকাশ বেদনা, তাকেও যে তুলে আনতে হয় বিষ পিঁপড়ের শত-সহস্র কামড় খেয়েও। ব্যক্তিজীবনের চরৈবেতি এবং তার শতসহস্র বিষাক্ত হুলের নীল বেদনা সহ্য করেও কাহিনিটি তাকেই টেনে নিয়ে যেতে হয় নিজস্ব গন্তব্যপানে।
আপনাকে যেটুকু পাঠ করেছি, তা থেকে অনুমান করি, তার অনেকটাই আপনি রচনার সুকৌশল বর্ণনার ভেতরে কুয়াশার এক বনায়ন সৃষ্টি করেই তা বলতে চেষ্টা করেছেন।
কখনো সরাসরি, কখনো বা রূপকের আধারে, কখনো বাদে-প্রতিবাদে, ক্ষোভে-বিক্ষোভে, ক্ষুব্ধ সংলাপে। প্রয়োজনে স্পষ্ট আর্ত চিৎকারে বলেছেন আপনারই কথা বিভিন্ন চরিত্রের মুখে। সবই তো আপনার জীবন দর্শন থেকেই উদ্ভূত, সংকলিত। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, অসামান্য আপনাকে পরিপূর্ণভাবে পাঠ করে শেষ করতে পারিনি এই সামান্য আমিও। তবু আপনার ৮০তম জন্মদিনের এই শুভ মহার্ঘ্য মুহূর্তে কিছু বলবো না, তাই কী হয়?
১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় আপনার ছোটগল্প 'পরিবর্তন' প্রকাশের মধ্য দিয়েই প্রথম সাহিত্য-যাত্রা। সাহিত্যকে ভালোবাসার প্রমাণ। সৃষ্টিশীল এষণায় দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে নিয়মিত লিখে হাত পোক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে। এ ছাড়া শুরুতে স্কুল, কলেজ, এমনকি মেডিকেলের জার্নালেও ছড়িয়ে আছে আপনার সাহিত্য চর্চার বহু বর্ণিল স্বাক্ষর। ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে তরুণ লেখক সৈয়দ শামসুল হকের 'তিন পয়সার জোসনা' কিনে পাঠ করে মুগ্ধ হলেন। এতটাই বিমুগ্ধ হলেন যে, সে আবেগের কথা লেখককে চিঠি লিখে জানালেন নির্দি্বধায়, অকপটে।
সেই পাঠ সূত্রের স্পর্শে এলো চিঠি, হেমন্তের ঝরাপাতার মতো উড়ে উড়ে এসে জমলো অনেক। পাহাড় হলো, নদী হলো, আকাশের নীল হলো কিছু, নক্ষত্র হয়ে উড়তে শুরু করে দিলো আপনার উন্মুখ হৃদয়াকাশের গভীর নীলে। অতঃপর গুলিস্তান সিনেমা হলের চিন-চাও চায়নিজ রেস্তোঁরায় দুজনের দেখা হলো তৃষা হরিয়ে। এক দেখায় প্রেমের প্রণতি ও অভিবাদন জানিয়ে যে শব্দবন্দনা রচনা করলেন কবি, কবিতার সেই অলৌকিক মায়ার জগতে প্রবেশমাত্রই বিমোহিত হলেন, শাশ্বতীর মতো একদা বাদল শেষের রাতে যেন আপনিও বিমূর্ত হলেন তার মর্মে।
থেমে গেল যেন কালের চিরচঞ্চল গতি। আপনার মনোভূমি কবিতার সমুদ্রজলে ভিজে কাদা কাদা হলো সবুজ শস্যক্ষেতের মতো। তাছাড়া, কবিকে ভালো না বেসে কি আর সেই মহামুক্তি মেলে?
প্রজাপতি ডানায় উড়ে উড়ে কেটে গেল অনেকটা সময়, ইতোমধ্যে সময়ের নিরিবিলি চরায় জেগে উঠল অবিনাশী সেই প্রেম, বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এই প্রণয় রূপকথা ১৯৬৫ সালে খুঁজে পেলো তার গৃহ। নিভৃত বন-মধ্যে যেন ছায়াচ্ছন্ন এক বহুবর্ণিল পুষ্প উদ্যান।
দুজনের অপার ভালোবাসায় এই ধরায় এসেছে দুজন সন্তান, কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক, পুত্র দ্বিতীয়-সৈয়দ হক। আরো জন্ম নিলো অমৃতের কতিপয় সন্তান। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'তৃষিতা' প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে। ১৯৬৮ সালে 'সচিত্র সন্ধানী' পাক্ষিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো উপন্যাস 'সেই প্রেম, সেই সময়'। অসাধারণ আধুনিক এই উপন্যাসে আপনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বর্ণনায়, চরিত্র চিত্রণে, কাহিনি নির্মানে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিলেন।
তরতর করে উজানে-ভাটিতে বয়ে চললো আপনার শিল্পতরী। বহু বাঁক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও আপনার স্পষ্ট লক্ষ ছিল সমুদ্রসঙ্গমে বয়ে যাওয়া। কর্মজীবন ও সংসার যাপনের বাইরে বেরিয়ে তাই নিজস্ব একান্ত বিশ্রাম ও ঘুমের সময়টুকু আপনি কেড়ে নিয়ে, তার ব্যয় বাড়ালেন শিল্প অন্বেষায়। কি দুর্মর আকুতি। এমন না হলে কী আর সৃষ্টিশীলভাবে বেঁচে থাকা হয়? চেতন-অবচেতনে এমন প্রেরণা, সৃষ্টির বীজ হৃদয়ে উপ্ত হলে, উন্মুক্ত হলেই বুঝি, অর্ধনারীশ্বরের মতো অবলীলায় বলা যায়-
'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সূর্যকরে পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।'
নিরন্তর এই শিল্প-যাত্রায় একজন প্রকৃত ভাষাশিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকে লিখেছেন আপনি ৩৩টি উপন্যাস। ভাবা যায় না, কত শ্রমসাধ্য এই কাজ। প্রান্তবাসী নারীর জীবন, জীবিকা, নারীর আদিম পেশার সংকট নিয়ে আপনার নিরীক্ষাধর্মী অসাধারণ এক উপন্যাস 'ব্যবহূতা' পাঠে আমি বিমুগ্ধ হয়েছি। আমাদের চোখের আড়ালে থাকা যৌন পেশা নিয়ে জানতে পেরেছি অনেক অজানা তথ্য। এ ছাড়া নরক ও ফুলের কাহিনী, নারী :বিদ্রোহী, ঘুমন্ত খেলোয়াড়, খাদ, নিঃশব্দতার ভাঙচুর, উদয় মিনাকে চায়, অস্থিরতার কাল, ভালোবাসার সময় ইত্যাদি।
ছোটগল্প, 'হেলাল যাচ্ছিলো রেশমার সাথে দেখা করতে'- এ রকম অনন্য কিছু গল্পসহ প্রায় ১১টি গল্প আছে।
শিশুতোষ রচনার অনেকটা জুড়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ, ঘটনা ও কাহিনির চমৎকার বয়ান। যে পাঠ থেকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বাহিত দেশপ্রেমের মন্দাকিনী। এ ছাড়া শিশুদের মনোভূমি বিনির্মাণে নীতিনৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ২৫টি রচনা রয়েছে আপনার। প্রবন্ধের ৭টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য, ক্ষুব্ধ সংলাপ, মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি, পিকাসোর নারীরা, নারীর কিছু কথা।
কাব্যগ্রন্থেও তিনি নারীর মুক্তি খুঁজেছেন নিজের মতো করে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'কিছু কি পুড়ে যাচ্ছে কোথাও'।
'তুমি আগে যাবে, না আমি,
স্বপ্নের ভেতর, তুমি এক অলৌকিক বাড়িঅলা,
কাল খুব কষ্টে ছিলাম' মিলে ৬টি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে আপনার, তাই না?
বিপুল বর্ণাঢ্য আপনার এই শিল্পসম্ভার এবং তার স্বীকৃতিও এসেছে দেশের অধিকাংশ পুরস্কার প্রাপ্তিযোগে। মহতী অপর এক শিল্পীর সঙ্গে শিল্পিত জীবন যাপন আপনার আরাধ্য ছিল। আপনি তাকে শেষ পর্যন্ত সেভাবেই নিয়ন্ত্রণে রেখে যাপন করেছেন।
মন্তব্য করুন