প্রিজনভ্যান থেকে আসামির হাত বৃষ্টি ছোঁয়ার জন্য খানিকটা বেরিয়ে আসে, তখন ভোরের আবহ। গানে পরাজিত স্মৃতিগুলো জেগে ওঠার সম্ভাব্যকাল। জেগে উঠলে সবার সকাল হয় না, জেগে ওঠার জন্য কেউ কেউ বেছে নেয় সকালের অন্য কোনো চত্বর, প্রান্তর। ততদিনে ফোন নম্বর পাল্টে যায় কারো কারো, গলার স্বর মোটা হয়ে আসে, সদ্য অপরিচিত হয়ে ওঠা দীর্ঘ পরিচিত চোখের ভাষা ভুল হয়। কিন্তু নগরে প্রকৃত বৃষ্টি নামে না বহুকাল। প্রিয় কাঠগোলাপ, তোমাকে একটি শাড়ির ওপর লেপ্টে থাকতে দেখেছি। মনে হচ্ছিল তুমি আংশিক অভিমান। বৃষ্টিবিধৌত আলো ছুঁয়ে ছিলো তোমার মুখ। শেষ হওয়া সম্পর্ক চিরকাল অনাবৃত, ফুলের মতো। আবার এক ফাগুন মাথার উপর থাকার পরেও খসে পড়ে আয়ু শেষ হওয়া শিমুল। জেন্টস পারলারের সামনে এলোমেলো ছড়ানো কয়েকজোড়া জুতা, একজন নারীকে সল্ফ্ভ্রান্ত ক্রেতা হওয়ার সুখ মনে করিয়ে দেয়। ক্রম বর্ধমান নারীপ্রধান গল্পে পুরুষের মুখের থেকে বুকের মাপ বেশি জরুরি হিসেবে দেখানো হচ্ছে জেনেও প্রতিটি 'ছুটির দিন' মানসিক ভারসাম্য হারানো গাছের মতো ডালপালা মেলে দেয়; মাছের মতো বুদ্বুদ ছাড়ে। আমরা পেয়ে যাই স্টে সার্টিফিকেট।
দুঃস্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসা দুটি চোখ দেখছে কয়েকজন মানুষের পায়চারি। ঠিক পায়চারিও না একটু ছটফটে- বলা যায় পাখিচারী। ঘুমন্ত মানুষের আত্মা বেলিফুলের মতো। ঘ্রাণে ভরা থাকে সবক'টি পাপড়ি। এ সমস্ত দৃশ্যে কেবল মায়া, এ সমস্ত দৃশ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লোভ। এখনো কোথাও কোনো দরোজার পাশে, জানালার পাশে, তারকাঁটার পাশে কিংবা কারো মনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বলছে 'ভেতরে আসতে পারি'। অনুমতি চেয়ে অপেক্ষা করা মানুষের সংখ্যা কম নয়, যেমন কম নয় পতাকাহীন মানুষের সংখ্যা। মানুষের পা কখনো কখনো গন্তব্য ভুলে যেতে বাধ্য হয়। সে কথা জানে ঘুমপাখি।
ধরুন আপনি ঘুমাচ্ছেন আর আপনার ঘুমপাখি উড়ে বেড়াচ্ছে সেসব মানুষের কাতারে, যারা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইছে এবং যারা পতাকাহীন, লোগোহীন, স্লোগানহীন। পাখিটি উড়ছে এবং উড়ছে। আপনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। সকাল ৯টায় আপনার অফিস, সাড়ে ৭টায় অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে চলছে। মস্তিস্ক আপনাকে সংকেত দিচ্ছে কিন্তু আপনি উঠতে পারছেন না। এ উঠতে না পারা মানুষ কখনো পায়চারি করে না। সে তখন সুযোগ পায় দৃশ্যস্মৃতি খুলে দেখার। আপনাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, মাথাপিছু জীবনের ওজন, প্রেমের গড় আয়ু কত? সম্পর্করা কোথায়, কোন তিথিতে খোলস পাল্টায়? প্রশ্ন করতে করতে মানুষকে, তার কাঠামোকে নামানুষের স্তরে নামিয়ে আনতে পারবেন। প্রশ্ন হলো সেই বুলেট, যেটা ছুড়ে দিয়ে বা যার আঘাতে ভেঙে ফেলা যায় সবকিছু। যারা মানুষের জন্য উন্মুক্ত, সীমানাহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে তারা একের পর এক প্রশ্নে ভেঙে ফেলে সীমানাপ্রাচীর। অথবা তারা পাখি হতে চায়।
অথচ কাঙ্ক্ষিত ঘর পায় না উভলিঙ্গের মানুষ। কূটনীতিক পাড়ায়ও তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাঁদা তুলতে দেখা যায়। এরপর লেকের অপরূপ সৌন্দর্যের মতো আলো-আঁধার তাদের চোখের কাজলে আর অন্ধকারে ছড়িয়ে যায়। এ মানুষেরা এ পাড়ার বিল্ডিংগুলোর ঠিক উল্টোপাশে, দেয়ালের সামান্যা জায়গাজুড়ে তৈরি করে কাপড়ের ঘর। ঘরের ভেতর যারা ঢোকে তারা হাতের ব্যাগটা সাবধানী নজরে রেখে কিছু সময় কাটিয়ে আসে। গভীর রাতে কাপড়ের ঘর গুটিয়ে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে ঘরহীনতার বোধে কাঁদে। কাঠামো, স্বীকৃত কাঠামো যে কত জরুরি তাদের থেকে ভালো আর কে জানে! কান্না তাদের হাতের তালিতে তালিতে ছড়িয়ে যায়। মানুষের কোলাজে বাসা বাঁধে হওয়া না হওয়া গান।
কেন্দ্রীয় না হওয়ায় কারণে করুণ মৃত্যুতেও ভালোবাসা পায় না কতশত শিল্পী চরিত্র। আবার সেই হয়তো একদিন আসামি হয়ে যায়। কারণ তার পাড়ায় প্রার্থনাস্থলে হামলার ঘটনা ঘটে। যদিও সে কিছু জানত না, তার পরেও তাকে ভোর হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে আসতে বলা হয়। আর বলা হয় একটি নতুন পোশাক পরে আসতে, এরপর হাতকড়া লাগাতে লাগাতে জানানো হয় আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে। লোকটি আমতা আমতা করে বলতে থাকে আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। তখন সে জানতে পারে, তার নামে ওয়ারেন্ট আছে, অনেকে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। লোকটি বলে যায়, তার নামে নাম- এ নামে গ্রামে আরও অন্তত তিনজন আছে। হামলাকারী তাদের মধ্যে কেউ হবে হয়তো। সে জানে খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে, কারণ দোষ সে করেনি। ফেরার ইচ্ছে তার ডানায় ভর করে, হঠাৎ নিজের যাপিত জীবন একটু দূর থেকে দেখার সুযোগ পায় যেন। কত প্রিয় মুখ, ঘরের জানালায় এত মায়ার বুননকে ছড়িয়ে রাখে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে সে এসব সুন্দরের কাছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে টিকে
আসামি হোক, সেও তো কারো না কারো সন্তান। সন্তানের সামান্য দুঃখ যে সইতে পারতো না, তার হাতে হাতকড়া দেখে পঞ্চাশ পেরোনো মা হাসে। মায়ের কাছে সন্তানের তখন দুটি রূপ। একটি রূপ শান্ত, আরেকটি রূপ ক্লান্ত। মা তার সন্তানের ক্লান্তরূপ দেখে হাসে, জানে যে শান্তরূপের সন্তানটি তার ঘরেই আছে। যেমন, বৌমা যখন সকালের নোংরা পোশাকটি বদলে দিচ্ছিল, তখনো সে বলছিল, একটা বৌমা আরেকটা টৌমা। টৌমাটা বেশি কথা বলে। বেশি বকে। এ মেয়ে কোন ভালো ঘরের মেয়ে না। ভালো ঘরের মেয়ে হলো তার বৌমা। ছেলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে ভাবে ফিরে এসে দেখবে মা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। মা তার জন্য কাঁদছে, ছেলে ফিরে আসার আনন্দে মা অস্থির হয়ে উঠবে, আদর করার জন্য এগিয়ে আসবে। যদিও মায়ের ঘোর কাটে না।
প্রিজন ভ্যানটি এগিয়ে যায়, এক সময় শিল্পকলার রোড ধরে যেতে থাকে। শিল্পকলার দেয়ালে লেখা 'পোস্টার লাগাবেন না'। একজন মুচি সম্ভবত কারও পিতা অথবা পিতামহ। সে লেখাটা আংশিক ঢেকে হেলান দিয়ে বসে। দেয়ালের সঙ্গে বিজোড় জুতা ঝুলিয়ে রাখে উল্টো কায়দায়। শরীরের জামা খুলে রেখে দেয় ছোট্ট বক্সের উপর। বক্সের উপর দারুণ চিত্রশিল্প। যুগল মুখ চেয়ে থাকে।
কার যেন সাধ হয়, যে বার বার ভালোবাসা চেয়ে ফিরে গেছে তাকে একবার ভালোবাসবার। ততদিনে দেরি হয়ে যায়। ততদিনে যে শহরের মানুষ একসময় মেশিনে ভাঙানো চাল খাওয়ার গৌরব করতো সে শহরে ঢেঁকিছাঁটা চালের দাম বাড়ে। দাম বাড়ে কচুশাকের। গ্রামের মানুষ লুফে নেওয়ায় শহুরে আভিজাত্যের তালিকা থেকে নেমে যায় পোলট্রি আর সয়াবিন তেলের নাম।
বাজার থেকে উঠে গেছে যে মুদ্রা সেসবে লেপ্টে আছে অতীত স্মৃতি। স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নদের আলাদা করা যায় না। আঙুলে লেগে যায় দুপুরের রোদ। চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে জীবন। অথচ বাড়ি থেকে বের হয়ে আরেকটু সামনে গেলে মানুষের দমের দোকান। এখানে আগে সাইকেল ও রিকশার চাকায় দম দেওয়া হতো। এখন বড় হসপিটাল হয়েছে। প্রাণের চার্বি কমিয়ে আনা মানুষের ভিড় লেগে থাকে। ফ্রেশ অক্সিজেন চেম্বার থেকে শুরু করে কান্নার জন্য ঘর, হাসির জন্য ঘর সব পাওয়া যায়।
সিনেমা হলের আদলে গড়ে উঠেছে অন্য থিয়েটার। যেখানে প্রত্যেকে তাদের নিজের জীবনের গল্প, স্বল্প কিংবা দীর্ঘ দৈর্ঘের মঞ্চে মঞ্চস্থ করে। এ মঞ্চে ক্রিমিনাল সাইকোলজির শিক্ষক গবেষণাপত্র পাঠ করার সময় কবিতার মতো মনে হতে পারে। তিনি বলছেন, গত রাতে আপনাদের বাসায় একটি শিশু সদৃশ্য কেক পৌঁছেছিল। আপনারা এ কেকের ডিজাইনারকে গালাগাল দিয়েছেন। সে ডিজাইনার মূলত একজন পিতা। যার শিশু কন্যা সন্তান ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মুমূর্ষু কন্যাকে জীবনের সঙ্গে লড়তে দেখে যে বেদনা তৈরি হয়েছে মনে, সে বেদনার আদল এ কেক। আপনারা এবার ঠিক করুন এ কেক খাবেন কি খাবেন না। দ্বিতীয় গল্পে ক্রিমিনাল সাইকোলজির শিক্ষক বলছেন, আপনারা যাদের নিরহংকারী বলে জানেন, চেনেন তাদের কেউ কেউ সত্যিকার অর্থে নিরহংকারী হওয়ার অহংকার তাদের ছেড়ে যায়নি। এর পরেও আপনারা কি নিজের পিতা, মাতা, জীবনসঙ্গী কিংবা সন্তানকে শুধু ভালো মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো অপরাধ করবেন কিনা তা সিদ্ধান্ত নিন। আপনি যে কী তা যাচাইয়ের জন্য প্রেরকের নাম ছাড়া চিঠি আহ্বান করতে পারেন।
চলো, চলো তৈরি হয়ে নাও। চিড়িয়াখানার আদলে কে যেন গড়ে তুলছে মানুষের আবাসন। চলো দেখতে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে কারা থাকে, একটি ছেলেকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তার নাম জানি না। চেহারা মনে আছে। কিন্তু তখন ওর বয়স ছিল সাত থেকে আট বছর। এতদিনে দশ পেরিয়েছে। তার মানে বদলে যাওয়া চেহারা নিয়ে যদি সামনে দাঁড়ায় ওকে চিনতে পারবো না। ছেলেটি লেগুনার হেলপার ছিলো। ওর শরীর থেকে কাঠগোলাপের মায়াবী ঘ্রাণ বের হতো। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে ওকে আরও বেশি সতেজ মনে হতো। ওর ডান হাতে একটি আঙুল কম ছিলো। বৃদ্ধাঙ্গুল না থাকায় টাকা নেওয়ার কৌশল ছিলো অন্যদের থেকে আলাদা। যেহেতু ওর নাম মনে নেই এবং ওর বয়সের আরও অনেকে লেগুনার হেলপার হিসেবে কাজ করে এবং তাদের শরীর থেকেও যেহেতু কাঠগোলাপের ঘ্রাণ বের হয় আমি বলতে পারি না 'সে ছেলেটি কোথায়'। প্রশ্নটি কোনোভাবেই তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে না কারণ অন্যদেরও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল নেই। হতে পারে পরিবারেই সেই সব থেকে বড় পুরুষ। তার বাবা হারিয়ে গেছে তার পিতামহ নেই অথবা পিতামহকে কোনোদিন দেখেনি। আর তারপরেই হয়তো বৃদ্ধাঙ্গুলের প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে গেছে। অথবা তারা একটি বৃদ্ধাঙ্গুল জমা দিয়ে এ কাজে নিয়োগ পায়। নগরের উচ্চশিক্ষিতরা শুধু মাথা জমা রাখলেই চাকরি হয়, ওদের বেলায় মাথা গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল গুরুত্বপূর্ণ কেন জানি না।
সন্তানের কাঠগড়ায় পিতা যাবজ্জীবনের আসামি। মা বাদী হয়ে তার বেকসুর খালাস আবেদন করে। সন্তান রাজি হয় না, মা তার সামনে ধর্ম উপস্থাপন করে। এরপর কোথাও কোনো প্রার্থনালয় ভেঙে পড়লে মা প্রথম সন্দেহ করে সন্তানকে। সন্তান সন্দেহ করে পিতাকে। মা এক সময় স্বামী আর সন্তান দুজনের মধ্যে নিজেকে সমানভাবে প্রতিস্থাপিত হতে দেখে। পিতা এবং সন্তান দুজনের যে কোনো একজন মুক্তি পেতে পারে। যে হেরে যায় তার কাছে পাখি একটি দুরারোগ্য ব্যাধির নাম। তবু সে পাখি হতে চায়। যে জিতে যায় জেতার পরিপূর্ণ স্বাদ সে পায় না।

বিষয় : ততদিনে দেরি হয়ে যায়

মন্তব্য করুন