
[ডোডো পাখিকে (Raphus Cuculatus) প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করে আমি একটা ছোটগল্প লিখেছিলাম। সেই পাখি এখন আর নেই, বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কেন সেই পাখি নেই- এই জিজ্ঞাসার উত্তরও সেখানে ছিল। ডোডো পাখি কেবল মরিশাসেরই পাখি (Endemic)। পাখিটাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৫৯৮ সালে, শেষবার দেখা গেছে ১৬৬২ সালে। ওলন্দাজ নাবিকরা যখন মরিশাসে ঘাঁটি গাড়েন, তখন থেকে সহজলভ্য খাদ্য হিসেবে তারা ডোডো পাখি খেতে আরম্ভ করেন। পাখিটাকে ধরা খুবই সহজ ছিল। কেননা তার ডানা ছিল, কিন্তু উড়তে পারত না; পা ছিল, কিন্তু ভারী ওজনের (১৩ থেকে ২৩ কেজি) শরীরের কারণে সেভাবে দৌড়াতেও পারত না। অতএব 'নেই কেন সেই পাখি' বলতে যদি ডোডোকে বোঝানো হতো, তাহলে সহজে উত্তর দেওয়া যেত। কিন্তু প্রচ্ছদের পাখিটা যে রবীন্দ্রনাথের পাখি- ওখানেই যত রহস্য। তাই যার যার নিজের পাখির গল্প বলাই ভালো]।
১.
কী জানি, কিছু কিছু পাখি হয়তো মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে আসে, আবার উড়ে যায়। তাদের সত্তার গভীরে থাকে ডানার তীব্র আকুলতা আর নীলিমার নেশা। সে রকম একটা পাখি, আমি যার নাম দিয়েছি শ্যামলী।
শ্যামলী যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই তাকে দেখতাম, চিনতাম। সে ঘরের চেয়ে বেশি ভালোবাসত বারান্দাকে। বারান্দার চেয়ে বেশি ভালোবাসত রেলিংকে। রেলিংয়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসত বাড়ির ছাদটাকে। ছাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসত আকাশের ডানাঅলা মেঘ। মানুষের দিকে তাকাবার ফুরসত কোথায়!
তবু একবার সে তাকিয়েছিল। বারান্দা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়, কৌণিকভাবে, একবার, শুধু একবার। একই সময়ে, সামনের চুলগুলোকে এক ঝটকায় পিঠের পেছনে-। অকারণ অহংকার-যে এত মোহনীয় হতে পারে, আগে কখনও বুঝিনি।
সেই থেকে ভাবতে শুরু করি, আমি কেন পাখির মতো হলাম না।
'বুকের ভিতর একটি পাখি
দিবসরাত্রি, নড়নচড়ন
দানাপানি খায় না কিছু
কেবল তোমার পিছু পিছু।'
এইটুকু কথা কোনোদিন ওকে বলতে পারিনি। অথচ নিজেকে হাজারবার বলেছি- অন্যকেও। অন্যরা জানে, আমি খুব মুখর, কিন্তু আমি তো জানি আমি কী।
এইভাবে, দিন গেল, রাত গেল, ঘুম গেল। মনে মনে ওকে চাইতে থাকলাম, একতরফাভাবে। যতই মনে হয়েছে ওকে পাব না, আমার ভালোবাসা ততই তীব্র হয়েছে।
হঠাৎ একদিন, রূপকথার গল্পের মতো, আমার জীবনে এলো তিনটা দিন। যার যার বাড়ি থেকে দূরে, অন্য কোথাও। নির্জন পুকুর পাড়ে দুপুরের ঝলমল আলোয়। পরদিন ছাদে, সন্ধ্যার ঘোলাটে আলোতে, শ্যামল মহিমা ভরা লেবুগাছ- তার পাশে। একটা লেবুপাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করল সে। হাতের তালুতে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল- 'গন্ধটা কী রকম দেখেন।' গন্ধ শুঁকতে গিয়ে ওর হাতের তালুতে আমার ঠোঁট লেগে গিয়েছিল। সারা জীবনে এই স্পর্শের স্মৃতি আমি ভুলব না। আর সেই গন্ধ, মাঝে মধ্যে আমার ঘুমের ভেতরেও হানা দেয়। আর শেষ দিন, ড্রেসিংরুমের শেষ বাতিটার আলোয়। ওর হাতে একটা উপন্যাস, আমার হাতে শূন্যতা। ফাঁকে ফাঁকে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা; কী কথা- সত্যি মনে নেই। আমি কেবল ওর দিকে তাকিয়েই ছিলাম। ব্যস, এটুকুই; এর বেশি একটুকুও না।
'একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি/তাই নিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্কগ্দুনী'- গানটি যে আমার জীবনের কত বড় সত্য, তা আমিই জানি।
যা বলছিলাম- আমার জীবনের পূর্বাপর ধারাবাহিকতায় ওই তিনটা দিনকে আমি আজও খাপ খাওয়াতে পারিনি। একেবারে বিচ্ছিন্ন, অবিশ্বাস্য, কিংবা আমি স্বপ্নঘোরে ছিলাম। তারপর সবকিছুই আগের মতো। ওই তিনদিন শ্যামলী যেন শ্যামলী ছিল না, অন্য কেউ ছিল- পরাবাস্তব কেউ।
২.
লেবুপাতার গন্ধের কথা মনে পড়লে আমি গাছগাছালির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেখানে পাখিরা বাসা বাঁধে। নিজের ইচ্ছায়। তাই খাঁচা আমার ভালো লাগত না।
শ্যামলীকে ভালো লাগত, এখনও লাগে। ওর জন্য খাঁচা নয়, বৃক্ষই মানানসই। তাই আমি বৃক্ষের মতো হতে চেয়েছি। সেই স্থিরতা, সেই ধৈর্য আমি কিন্তু আমার ভেতরে টের পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে- পায়ের তালুতে শিকড় গজিয়েছে, আকুল বাহুর মতো পল্লবিত শাখা-প্রশাখায় পাতার সবুজ হাতছানি।
৩.
শ্যামলী আসলে মানুষ ছিল না, পাখিই ছিল। প্রমাণ পেতেও দেরি হলো না। নিজেকে আরও যোগ্য করে তোলার জন্য আমি যখন বাইরে, ঠিক তখনই একটা খাঁচার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। তবুও বেহায়া বৃক্ষের মতো আমি দাঁড়িয়ে থেকেছি। তখন (২৮.৬.১৯৭৯) লিখলাম-
'আজও যদি ফিরে আসো দেখতে পাবে আগের মতন,
মানুষের গোত্রে নয়, বৃক্ষদের মাঝে খোঁজ নিও।'
সে আমার খোঁজ নিয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু আমি নিয়েছি। জেনেছি- সে ডিম পেড়েছে। তবুও লিখলাম (২৬.৭.১৯৮০)-
'তোমাকে পাইনি বলে আমি আজও রয়েছি তোমার,
কেবলই গভীর হবো, কেবলই ছড়াবো ডালপালা।
এই জনমে তো শুধু দেখাদেখি, দহনের জ্বালা।'
কয়েক যুগ পরে, তাকে শেষবার দেখলাম একটি মৃতদেহের সামনে, কালো পোশাকে আবৃত। মাঝখানে মৃতদেহ, সে আমার সামনে, কিন্তু সে আমার নয়। এরপর আর তাকে কোনোদিন দেখিনি, আর দেখবও না। কেননা, সে আর বেঁচে নেই। তবু আমি অপেক্ষায় থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
'তার অপেক্ষায় আছি, তাকে যেন কখনও না পাই,
বৃক্ষের ভিতরে আমি আমরণ বেঁচে থাকতে চাই।'
৪.
সেই তিনদিনের মতো করে আর কখনও আসেনি সে। কিন্তু নিজেকে আড়ালে রেখে একটার পর একটা বিকল্প পাখি পাঠাতে শুরু করেছিল। মৃত্যুর পরেও সে তা অব্যাহত রেখেছে। বিকল্প পাখিদের কোনোটা বারান্দার, কোনোটা রেলিংয়ের, কোনোটা ছাদের, কোনোটা বাসার, কোনোটা খাঁচার। কোনোটা ডিম পেড়েছে, কোনোটা পাড়েনি, শেষবার যে পাখিটা পাঠাল, তার মেঘাচ্ছন্ন চোখের মধ্যে শ্যামলী খাঁচার বেদনা। আমি তাকে অগ্রিম লিখে রাখা একটা কবিতা শোনালাম।
তুমিও যখন যাবে তারপর বলা হবে শুরু- সেই সব পাখি...
সেই সব পাখি যার অধিবাস ভেতর বাড়িতে
সেই সব পাখি যারা শিউলি ফোটায় শাদা ভাতের হাঁড়িতে।
পাতার আড়ালে আলো নিভে গেলে উড়ে যেতে পারো,
বৃক্ষই তোমাকে খুঁজে নেবে।
তুমিও যখন যাবে তারপর বলা হবে শুরু-
সেই সব পাখি যারা লাল কাঠবাদাম ঠোকরায়
শব্দ গাঁথা বুকের পাড়ায়,
সেই সব পাখি যারা অন্য বিছানার ঘুম খায়,
সেই সব পাখি যারা ডানাহীন, তবু উড়ে যায়;
সেই সব পাখি যারা মানচিত্রে নদীর মতন
জলের আভাস দেয়,
পিপাসার প্রশ্নে দেয় ফাঁকি।
সেই সব পাখি...
মন্তব্য করুন