ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

শুভশক্তিই বিজয়ী হয়

শুভশক্তিই বিজয়ী হয়

আনোয়ারা সৈয়দ হক [জন্ম : ৫ নভেম্বর, ১৯৪০] ছবি :: জে. জে. পার্লিয়া

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিম কামাল 

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:০৪ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:০৪

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের ৮৪তম জন্মদিন ৫ নভেম্বর। সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বহুমাত্রিক সৃজনী ক্ষমতায় তিনি বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। লেখালেখিসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি কালের খেয়ার মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিম কামাল 

lকেমন আছেন, কেমন চলছে লেখার সঙ্গে জীবন যাপন?
llনানাবিধ কাজ করতে হয় দৈনন্দিন। সাধারণত ভোরে উঠে লিখতে বসি। দেড় বা দুই ঘণ্টা লিখি। রাতে আবার বসি। যেদিন ছুটি থাকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লিখি। নির্ভর করে লেখার চাপ কেমন আছে তার ওপর। যদি কাউকে লেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই, ঠিক সময়ে তাঁকে তা দেওয়ার চেষ্টা করি। এইটুকু করার চেষ্টা করি যত ব্যস্তই থাকি না কেন। লেখালেখি থেকে আমি পেয়েছি অঢেল, তবু মাঝেমাঝে মনে প্রশ্ন জাগে। হয়তো আমার যেভাবে লেখা উচিত ছিল, সেভাবে কি লিখতে পেরেছি? হয়তো দেশের যে সাংস্কৃতিক ধারা অনুযায়ী আমি লিখতে পারিনি। হয়ত আমার জীবনবোধে ঘাটতি আছে।
lঠিক কেন বা কখন এমন মনে হচ্ছে?
llআমি মানুষের কথা, নারীদের কথা, সমাজের অনাচার, অত্যাচার, দেশের স্বাধিকার নিয়ে লিখছি, মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে লিখছি। মানুষকে নিজের সম্পর্কে বলি, ‘আমি ভালো লেখক।’ বলার ভিত্তিটা হচ্ছে, আমি জানি আমি ভালো লেখক। তবে আমি কতটুকু ভালো সেটা জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার কোনো লেখা নিয়ে তেমন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা, সমালোচনা পেলাম না। যেটা আমাকে আমার অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেবে। প্রশ্ন জাগে, সৈয়দ হকের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আমার যে সম্পর্ক, তার কারণে কি আমি একটা বাড়তি ফ্যাক্টর হিসেব গণ্য হয়েছি? হতেও পারে। 
lযাঁদের জন্যে লিখছেন, তাঁদের প্রতি আপনি একটা তরঙ্গ পাঠাচ্ছেন। সেই তরঙ্গ গ্রহণের প্রস্তুতি কতটা, এ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে? মানুষের মন এখন কীভাবে কাজ করছে।   
llআমি একটা তরঙ্গ পাঠাচ্ছি। যাঁরা এটাকে গ্রহণ করছেন, তাঁরা কতটা গ্রহণ করতে পারছেন, এটা একটা আলোচনার বিষয় অবশ্য। এটা সত্যি, সবাই একভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। সম্ভব না। কিন্তু দু চারজন যারা গ্রহণ করতে পারছেন, তাঁদের কাছ থেকে সাড়াটা পাওয়া দরকার। এটা ঘটছে না। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, আমাদের সাহিত্য সমাজে লেখার আলোচনা পেতে, প্রশংসা পেতে কাউকে একটা জোটের ভেতর থাকতে হয়। আমি যদি তোমার জোটে থাকি, তুমি আমার প্রশংসা করবে। আমি কোনো জোটে নেই। থাকাটা আমার পছন্দনীয় নয়। 
lআবার লেখাও তো ভবিষ্যৎগামী। আজ যা আলোচিত হচ্ছে না, কাল তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকতে পারে। আর কখনো কোনো শুভ জোটও কি সময়ের নিয়মেই তৈরি হয় না? 
llলেখা ভবিষ্যতে আলোচিত হতে পারে। আর শুভ জোটও সময়ে তৈরি হয়। মূলত জোট বলতে আমি তাদেরই বোঝাচ্ছি যাদের চিন্তা গণ্ডিবদ্ধ, যারা শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক সচেতন নয়। আমি শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন একটি জোট চাই। আমি লক্ষ্য করেছি বহু তরুণ লেখক আছেন, আমার চেয়ে ত্রিশ বছরের ছোট, যাঁদের লেখা পড়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি, এতটা ভালো। সবার বন্ধনে একটি সচেতন জোটে আমরা যদি আবদ্ধ না হতে পারি সবকিছু হারিয়ে যাবে। তেমন জোটের অভাব দেখছি। 
lহারিয়ে যেতে না দেওয়ার প্রশ্নে রাজনীতিকদের ভূমিকার প্রশ্ন চলে আসছে। তাঁদের দায়িত্ব কি ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে?
llআমি মনে করি, আমাদের দেশ-কাল-প্রেক্ষিতের কারণে কিছুটা কমতি তৈরি হয়েছে। 
lপ্রেক্ষিতটা কেমন?
llআমরা কখনও সুখে ঘরসংসার করতে পারিনি। সবসময় একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা, শিক্ষাগত অচলাবস্থার ভেতর দিয়ে আমাদের জীবন কেটেছে। আমরা আমাদের তরুণ বয়স যাপনকালে তীব্রভাবে এটা অনুভব করেছি। আমরা ছোট্টবেলায় ভাষা আন্দোলন দেখেছি, সেই শুরু। তারপর থেকে আন্দোলনই আমাদের জীবন। এখন পর্যন্ত আন্দোলনের মধ্যে আন্দোলনের মাঝেই আমরা আবর্তিত হচ্ছি। একটি দেশে শিল্প-সাহিত্য হতে গেলে সেই দেশে স্থিতাবস্থা থাকা দরকার। তুমি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবে। তোমার তো সেই স্থিরতাটুকু দরকার। ক্লাসের একজন ভালো শিক্ষার্থী বাসায় গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করে; কেউ তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় না; ও পড়ছে, ওকে পড়তে দাও। মানে হলো, এক ধরনের ট্রাংকুইলিটি লাগে। এটা একটা দেশে লাগে। আমরা যে পড়াশোনা, লেখালেখির এত চেষ্টা করছি, এটা একটা অস্থিতাবস্থার ভেতর করছি। এ জন্য আমাদের চিন্তার ভেতর নানা ধরনের ব্যাঘাত উপস্থিত। 
lরবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক সময়ে আদর্শ নিয়ে লড়ছেন, তাঁকে এর ভেতর অজস্র নিন্দামন্দ শুনতে হচ্ছে; দেখি তলস্তয়কে লেখার জন্য চার্চের কাছে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে, বিষয়গুলো নানান পথে তাঁদের রাজনীতিসম্পৃক্তও করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সৃষ্টিসম্ভারের কথা বলতে পারি। অস্থিতাবস্থা বিশেষ কোনো পথে আমাদের সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিতও করে না?
llঅবশ্যই উজ্জীবিত করে। আবার একজন ভালো পাঠক গ্রন্থ থেকেও সময় যাপন করতে পারে। আমরা ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম না, মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রে সরাসরি ছিলাম না, কিন্তু আমরা তা নিয়ে লিখতে পারছি। আমি মনে করি, লেখকের জীবন যদি নিষ্ক্রিয় হয়, তাহলে শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। কেউ শান্ত স্থিতাবস্থার ভেতরে থেকে কেবল বই পড়ছে, তাহলে সাহিত্য আসবে না। তাকে নেমে আসতে হবে। পাশাপাশি এও সত্য, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় সারাক্ষণ যখন কী হয় কী হয় ভাব, তখন তুমি একটা বইও বা পড়বে কী করে। একটা সিনেমা কী করে দেখবে। আমি স্থিতাবস্থা বলতে যা বোঝাচ্ছি, একটা দেশ যখন কোনো লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায়, তখন তার এগিয়ে চলার শর্তে তোমার যে নিবেদনটা তোমাকে দিতে হবে, তা যেন তুমি করতে পারো। অভাব, অসাম্য, কষ্ট চিরকাল থাকবে। কিন্তু রাস্তায় গেলে প্রাণ হারানোর ভয় থাকলে কিছু দাঁড়াবে না। তোমার পরিবার, শিশুদের নিয়ে যদি তীব্র নিরাপত্তাহীনতা কাজ করতে থাকে, তাহলে হবে না। তোমাকে কাগজ-কলম, কম্পিউটার নিয়ে তো একটা জায়গায় বসতে হবে, যেখানে বসে তুমি মানুষের কথাই লিখবে। কিন্তু তুমি নিজেই যখন অস্থিরতায় থাকবে, তখন তুমি অপরের কথা কী লিখবে? জীবনে অভিজ্ঞতা না থাকলে কিছুই পূর্ণাঙ্গতা পায় না। আমরা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি বলে জানি একাত্তর কাকে বলে। আমি ‘অবরুদ্ধ’ লিখেছি এবং সময়টা প্রত্যক্ষ যাপন করেছি বলেই লিখতে পেরেছি। আমি মনে করি সেটা ভালো একটা লেখা হয়েছে। এই লেখার মতো স্থিতাবস্থাটা আমরা চাই। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে আমরা যে একটা টালমাটাল অবস্থায় আছি, এটা কিন্তু আমাদের চেতনার ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। 
lচেতনার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কী কী লক্ষণ দেখা দিয়েছে আমাদের?
llধীরে ধীরে আমরা বিকৃত মনোভাবের হয়ে যাচ্ছি। ধর্মান্ধ হতে যাচ্ছি। আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ছি। গভীরে প্রবেশ করতে পারছি না। হতাশ হয়ে পড়ছি, উৎপীড়ক-সমালোচক হয়ে উঠছি। আমাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটছে। আমরা তখন কোনো কিছুতে আস্থা রাখতে পারছি না। এসব আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষতি। 
lআমাদের সামনে আশাবাদী হওয়ার কোনো পথ খোলা নেই?
llআমার একটা গল্প আছে, হাত। সেখানে কেরামত আলী নামে এক চরিত্র আছে, যে ভাঙা যে কোনো কিছু জুড়ে দিতে পারে। একটা টানা একতলা ঘরে সে থাকে, সেখানেই তার নাওয়া-খাওয়া, সেখানেই ঘুম আর কাজ। একজনের রেডিও ভেঙে গেছে, জুড়ে দিয়েছে। এক লোকের দ্বিতীয় স্ত্রীর আয়না ভেঙে গেছে, মেয়েটা কাঁদছে। সেই আয়নাও কেরামত আলী জুড়ে দিল। এই জুড়ে দেওয়াতে তার এতটাই দক্ষতা যে নাম হয়ে গেল মেরামত আলী। কেরামত আলী কিন্তু খিটখিটে স্বভাবের মানুষ। কিন্তু তার মনটা খুব ভালো। একদিন এক ছোট্ট মেয়ে এলো। নাম ফুলি। ফুলির পুতুলটা ভেঙে গেছে। কেরামত আলীর দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল ফুলি। কেরামত বলল, কী চাই? ফুলি বলল, আমার পুতুলটা...। কেরামত আলী ধমকে উঠল, যাও যাও! যত ঝামেলা। বলে তাকিয়ে দেখে, ফুলির চোখ দুটো টলটল করছে। কেরামত আলী বলল, রেখে যাও! দু’দিন পর এসো। দু’দিন পর এসে ফুলি একবার পুতুলের দিকে তাকায়, আরেকবার কেরামত আলীর দিকে তাকায়। পুতুলটা এমনভাবে জুড়ে গেছে যেন কোনো দিন ভাঙেনি। এই ফুলি একদিন হারিয়ে গেল। বাজারে মাইকিং হচ্ছে, সবাই বলছে ফুলির কথা। ফুলির বাবা কাঁদতে কাঁদতে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেরামত আলীরও কানে গেল, ফুলিকে পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর রাতে ফুলির বাবা এসে কেরামতের দরজায় কড়া নাড়ল। তার হাতে একটা বস্তা। বলল, ‘আমার মেয়েটাকে জোড়া দিতে পারবেন ভাই?’ অপহরণকারীরা ফুলির টুকরো লাশ রেখে গেছে ওদের দরজায়। কেরামত আলী ভাঙা জিনিস জোড়া দেয়। এই মেয়েটার পুতুলটাকে জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ তো কখনও জোড়া দেয়নি। গম্ভীর মুখে সে বস্তাটা ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কী হচ্ছে বন্ধ ঘরের ভেতরে? ফুলির বাবা বাইরে অপেক্ষমাণ। সারারাত পার হলো। একসময় কেরামত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ভেতরে যাও। বাবা গিয়ে দেখে, তার ছোট্ট ফুলি ক্লান্ত বসে আছে একটা চেয়ারে। পরনে রক্তাক্ত শাড়ি। চোখ মেলে দুর্বল গলায় বলল, আমাকে এখানে আনছেন কেন বাবা? বাবা যখন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, কেরামত আলী তখন বাইরে একটা পাথরের ওপর বসে বিড়ি ধরিয়েছে। আর বলছে, জায়গাটা আর আগের মতো নাই। এখান থেকে চলে যেতে হবে।] 
এ গল্প আমি এই বোঝাতে লিখেছি মানুষের ওপর অপশক্তির উৎপাত, অত্যাচার যত বাড়ে, শুভশক্তির ক্ষমতাও তত বাড়ে। এবং ক্রমে আরও বেড়ে সেই অপশক্তিকে, উৎপাতকে সে দমন করে। যদি মানুষকে কেটেও ফেলো, সেই শুভশক্তিকে মানুষ জোড়া দিতে পারে, এতই বাড়বে তার ক্ষমতা। শেষ দৃশ্যে অশুভ কখনোই শুভর সঙ্গে পারবে না। অতীতেও পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। 
 

আরও পড়ুন