ঢাকা বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

টুম্পা

টুম্পা

অলংকরণ :: নাজিব তারেক­

সালেহা চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:২৩ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:২৩

একজন-একজন করে প্রায় সকলেই চলে গেল। রিজিয়ার চারপাশে এবং জীবনে যারা ছিল। দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে স্বামীও। নানা অসুখ। রিজিয়া বুঝল আজিজ আহমেদের গোপনে সুরা পান, রাতবিরেতে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খাওয়া, এসব বন্ধ না হলে স্বয়ং ঈশ্বরেরও শক্তি নেই তাকে সুস্থ করে তোলে।
একদিন সে নিজে গেল ডাক্তারের কাছে, বলতে, এই দুই বাজে অভ্যাসের কথা। ডাক্তার তেমন গুরত্ব দিলেন না। –একটু আধটু ড্রিংক তেমন ক্ষতিকারক কিছু না। এই তাদের মত।
একটু আধটু নয়, আমি দেখেছি এক বোতল ‘টিচার্স’ও কখনও শেষ করে ফেলেন। কখনও ‘ডিম্পল’। উনি হুইস্কি ছাড়া আর কিছু পান করেন না। 
কেমন করে দেখলেন?
উনি কোকা-কোলার গ্লাসে কোকা-কোলার সঙ্গে হুইস্কি মিশিয়ে খান যেন আমরা টের না পাই। এর পরও যেখানে বোতল লুকিয়ে রাখেন, সেটা আমি জানি। সকাল থেকে রাত, বোতল দেখে পরিমাণ বুঝতে পারি। উনি জানেন না, আমি জানি বোতল কোথায় লুকানো থাকে। 
আপনি ওনার ওপর স্পাইং করেন? ডাক্তার বলেন। রিজিয়া উত্তর দেয় না।
ডাক্তার একটু গম্ভীর থেকে বলেন– হুইস্কি তেমন ক্ষতি করে না।
আর দুপুর রাতে খাওয়া?
খিদে পায় বলে খান।
না রিজিয়া তর্কে জিততে আসেনি। বুঝতে পারে তার পক্ষে ডাক্তারকে বোঝানো মুশকিল। কারণ, তিনি বুঝতে চান না। এসব শুনবার সময় নেই।
এই করতে করতে একদিন রাতে বুকের প্রচণ্ড ব্যথায় হাসপাতালে যান এবং তিন দিন পর মৃত্যু। আগে চারবার বাইপাস হয়েছে। তারা মানে সার্জনবৃন্দ তাকে আর অপারেশনের টেবিলে তুলবেন না। বয়স তখন তার উনআশি। আশি হতে কয়েক মাস বাকি। তার কথামতো লন্ডনেই কবর হলো। ডেডবডি টেনে এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া তার পছন্দ ছিল না। তিনি সে কথা উইলে লিখে দিয়েছেন। ‘আমার যেখানে মৃত্যু সেখানেই যেন কবর হয়।’ চিরকাল তো সকলে তার কথাই শুনেছেন। কাজেই প্লেনে করে তাকে আর দেশের বাড়িতে নেওয়া হলো না।
রিজিয়া তখন চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে। বয়স আটষট্টি। এক ছেলে বিদেশে থাকে। এক মেয়ে সঙ্গে থাকে। তবে মেয়ে একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট কিনে যে কোনো মুহূর্তে চলে যাবে বলে প্রস্তুত। 
একদিন ‘রোজিলা’ পেটশপে মায়ের পেটের তলায় তিনটি বিড়ালছানা দেখতে পেল রিজিয়া। তিনটেই তুলতুলি। একটার গা ছোপ ছোপ নীল। আর পেটের কাছটা একেবারে ধবধবে উজ্জ্বল সাদা। কেবল চোখ ফুটেছে। তেমন করে দাঁড়াতে পারে না। 
বিড়ালছানাটিকে কিনে একটা খাঁচায় করে বাড়িতে আনে। খাঁচা খুলে হাতের তালুতে বসায়। নাম রাখে টুম্পা।
মেয়ে চলে গেছে। তবে মাঝে মাঝে আসে। মনে হয় এই অপরূপ ছোপ ছোপ বিড়ালছানাকে তারও পছন্দ। রিজিয়া বলে– ও আমার। তুমি চাইলে যাও, ওখানে আরও দুটো আছে। 
মেয়ে তার অ্যাপার্টমেন্টে বিড়ালছানা রাখা একটু মুশকিল বলে চলে যায়। বাড়িতে কেবল টুম্পা আর সে। বুকের ভেতর যে এত ভালোবাসা ছিল বুঝতে পারেনি। ড্রপারে করে বিড়ালের দুধ খাওয়াতে থাকে। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। একতাল মিষ্টিবলের মতো টুম্পা চুপচাপ গায়ে হাত বোলানো, গলায় একটা ঝুমঝুমি বেঁধে দেওয়া পছন্দ করে। পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। লাফ দিয়ে কোলে ওঠে। তারপর সারা শরীরে ঘুরেফিরে আবার সে চুপচাপ শুয়ে থাকে কোলে। 
কী আনন্দ! কী আনন্দ! কী অপরূপ! কী মিষ্টি। এত আনন্দময় তুলোর বল আগে কোনোদিন দেখেনি রিজিয়া। এত অপরূপ কী করে বেড়ালছানা হয়, ভাবতে থাকে।
টুকটাক লেখালেখি করে রিজিয়া। দেশে বই হয়। লন্ডনেও দুটো ইংরেজি কবিতার বই হয়েছে। একটা গল্পের আর একটা উপন্যাস। গল্প ও উপন্যাস আমাজন.কম থেকে বের হয়েছে। আর কবিতার বই দুটো এক ছোট পাবলিশারের সঙ্গে দামদর করে। এসব নিয়ে তো ভালোই ছিল। এখন এই মৌটুসির সঙ্গ তাকে বলে– শোন রিজিয়া ভালোবাসা বলে একটি ব্যাপার আছে পৃথিবীতে। তুমি প্রথম তার স্বাদ পেয়েছ। সবকিছু ভালোবাসার নির্যাসে এই বিড়ালছানা ও তোমার ভেতরে একটুখানি প্রদীপের মতো জ্বলছে। অস্বীকার করবে না। বিড়ালকে আবার এত ভালোবাসা যায় নাকি, এমন বলবে না। যায়। পৃথিবীতে কেবল ভালোবেসে বাঁচা যায়। সে বিড়াল হোক বা কুকুর হোক বা খরগোশ হোক বা মোরগ হোক। 
আমি তো আমার স্বামীর সেবা করেছি।
তা করেছ। তবে তুলতুলি বিড়ালের মতো এমন নিবিড় করে কি ভালোবেসেছ? বা তিনি কি তোমাকে? হুইস্কির পরে তুমি। সেজন্যই তো সাইকোলজিস্ট বলেন– পেট বা পোষ্যকে ভালোবাসা, তার শরীরে হাত বোলানো তোমার ব্লাডপ্রেশার কমিয়ে দেবে। তোমার মনের বন্ধ নানা কষ্ট ঝরিয়ে দেবে। 
রিজিয়ার মনে পড়ে ছোটবেলার ওর বাচ্চাদের কথা। ও তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। স্বামীর শখ ওকে এমএ করতেই হবে। না, ঋতু ও ঋষিকে এই বিড়ালের মতো ভালোবাসতে পারেনি। একজন গ্রামের মেয়ে আর একজন আয়ার যত্নে ওরা বড় হয়েছে। এখনও ভাবলে বুকে ব্যথা হয়। 
তাইকি বিড়ালটাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে একাকার করে ভালোবাসতে কী যে সুখ আর আনন্দ ওর। – আয়রে আমার তুলতুলি। আমার সোনার বল। আমার মানিক। এমন করে যে কাউকে ভালোবেসে ডাকতে পারে, সেটাও নতুন। ভালোবাসা প্রকাশে একটু সলজ্জ। আর এখন এমন চিৎকার করে ভালোবাসা!
রাতে রিজিয়ার লেপের ওপর ঘুমিয়ে থাকে টুম্পা। রিজিয়া যতবার এপাশ থেকে ওপাশ করে, টুম্পাও পজিশন বদলে ফেলে। চলে যায় পায়ের কাছে। টুম্পা কাছে না থাকলে মন ভালো লাগে না। যখন বাইরে থেকে বাড়িতে আসে গুটিশুটি মারা টুম্পাকে বুকে তুলে নেয়। তার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। টুম্পাও বিড়ালি উত্তরে বলতে চায় সেও রিজিয়াকে ভালোবাসে। বিড়ালি ভাষায় এটা-সেটা বলে। ও জানে বিড়াল কেবল মানুষকে দেখলেই কথা বলে। ও আর একটা বিড়াল দেখলে কথা বলে না। আর একটা বিশেষ বয়সের পর বিড়াল কোনো কথা বলে না। 
ছলছল স্রোতের মতো বিড়াল ভালোবাসায় চমৎকার জীবন বয়ে চলে। কখনও  টুম্পি আবার কখনও আবার কখনও টুম্পা। একটা ডাকের অপেক্ষায় ও। ও রিজিয়ার ভাষা বোঝে। ডাক মানেই ছুটে আসা। 
গলস্টোন বোধ হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর রিজিয়া। বিছানা থেকে নেমে গেছে মেঝেতে। আর সেখানে উপুড় হয়ে– মাগো! মাগো! করছে। কখন যে টুম্পিও পিঠের ওপরে বসেছে ঠিক বুঝতে পারেনি। একসময় বুঝতে পারে টুম্পি ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেবল একবার এখানে আর একবার ওখানে করছে। বলতে চায়– কী হয়েছে তোমার? রিজিয়া অবাক। একসময় ব্যথাটা একটু কমলে রিজিয়া ঘুমিয়ে যায় আচ্ছন্নের মতো। আর টুম্পি পিঠের ওপরে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে। আহারে টুম্পা! আহারে এত মায়া তোর আমার জন্য! রিজিয়া কাঁদতে থাকে। সত্যিই কান্না ওকে ভাসায়। 
ওর মনে পড়ে জীবনে ও যত বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল কোনোটাই তেমন করে বন্ধু হয়নি। একজন তো ভেবে নিল ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব মানে ‘সেক্স’। কাজেই সেটা চলে গেল। 
একজন মেয়ের বন্ধুত্ব চলে যাবার পর জানতে পারল ওর যত গোপন কথা সব সে একে-ওকে বলেছে। সেটা চলে গেল।
এমনি দু-একটা বন্ধুত্ব! হাওয়ায় উড়ে গেল। 
এভাবে রিজিয়া বুঝতে পেরেছিল সত্যিকারের বন্ধুত্ব একেবারেই কঠিন ব্যাপার। আহা টুম্পা? হৃদয়ের ভেতরে কেমন করে জায়গা করে নিল। টুম্পা কি বন্ধু! না হৃদয়ের সেই আকৃতি, যা হঠাৎ করে জানায় দেয় আমি আছি।  
মেয়ে ঋতুর বাড়িতে নাকি ইঁদুর দেখা গেছে। ও ইঁদুরকে ভীষণ ভয় পায়। কে যেন ওকে বুদ্ধি দিয়েছে তুমি তোমার মায়ের বিড়াল এনে কয়দিন রাখো। তাহলে ইঁদুর আর বিরক্ত করবে না। এ কথা সে রিজিয়াকে বলেনি। 
একদিন কি একটা কাজে বাইরে থেকে এসে দেখে জানালায় বসে নেই টুম্পি। কোথাও নেই। খাবারের বাক্স বাজিয়ে ডাকতে ডাকতে গলা ব্যথা হয়ে গেল। টুম্পা এলো না। সারারাত কেটে গেল। সারারাত ঘুমাতে পারল না। মেয়ে বলল ও কিছু জানে না। 
বেশ কিছুদিন চলে গেল। টুম্পা আর ফিরে এলো না। তবে হঠাৎ করে মনে হতো লেপের ওপর ভারী কি যেন! লেপটা টানতে গিয়ে মনে হতো টুম্পা পায়ের দিকে চলে গেল। কোনো কোনোদিন স্বপ্নে দেখত হাত-পা মেলে দিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে টুম্পা। মনে হলো এটাই ঠিক। কোনোভাবে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েছে। 
আবার একার জীবন। না সে আর বিড়াল কিনবে না। টুম্পার জায়গায় কাউকে বসাবে না। দু-একজন খালি জীবনে আসতে চেয়েছিল। লিভটুগেদার নয়, বিয়ে করে। রিজিয়া বুঝতে পারল না বিয়ে আর নয়। বিয়ে তাকে এমন কিছু দেয়নি যা তাকে বারবার পেতে হবে। ওসব আর সে করবে না। 
মনে পড়ছে যখন সে কম্পিউটারে লেখে টুম্পা পাশের বিছানায় শুয়ে থাকে। যতক্ষণ সে লেখে ও নড়ে না। এটা ওর সবচাইতে প্রিয় সময়। রিজিয়া লিখছে, টুম্পা বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। 
–মা একটা কথা তোমাকে বলতে চাই। ম্যাসিভ হ্যার্ট অ্যাটাকে রিজিয়া হাসপাতালে। এখন একটু জ্ঞান ফিরেছে। মেয়ে বলছে।
মা আমি কিছুতেই তোমাকে বলতে পারিনি। ইঁদুরের উৎপাতের জন্য টুম্পিকে এক দিনের জন্য আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তবে ভুল করেছি খাঁচার ভেতর ওকে বসাইনি। তাই আমার বাড়িতে গিয়ে দরজা খুলতেই এক লাফে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়ে।
তারপর …
মা তুমি শুনছ? জ্ঞান থাকলে রিজিয়া বলত– টুম্পি আমাকে স্বপ্নে বলে গেছে। আমি জানি। এক দিন অনেক কান্নাকাটির পর টুম্পাকে বলেছিলাম তুই বল টুম্পি কী হয়েছিল তোর। ও বলেছে। 
নার্স এসে মায়ের শরীরটা ঢেকে দিল। কোনো কনফেশন শুনবার মতো সময় নেই আর।
‘রোজমেরি কবরস্থানে’ নতুন কবর থেকে একটু দূরে নাইটগার্ড হাঁটছিল। এটা তার অভ্যাস। প্রতি রাতেই সে হাঁটে। আকাশভরা জোছনা। গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মে মাস বলে নানান গোলাপ ফুটেছে। চমকে গেল গার্ড। ঝিমঝিম রিমঝিম তারাভরা রাত। একটা বিড়াল নতুন কবরটাকে দুই পায়ে আঁচড়ে চলেছে। অপরূপ এক বিড়াল। গার্ড কাছে গেল না। বিড়ালটা যেন ওই কবরের ভেতরে ঢুকবে। হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি দু’হাতে সেই বিড়ালটাকে বুকের কাছে তুলে নিল। হৃদয়ের কাছে। তারপর কী যে বলল– গার্ড বুঝতে পারল না।
এ ঘটনা খুব বেশি হলে পাঁচ সেকেন্ডের। এরপর বিড়ালও নেই। ছায়ামূর্তিও নেই। কেবল আকাশের তারার ভেতরে কোথায় হারাল বা স্থান করে নিল সেই  ভালোবাসা, তুলোর বল আর একজন পিপাসিত নারী। u

আরও পড়ুন