সিরাজী ভাইকে আর দেখব না। তাঁর হাসিমুখ, ভরাটগলা- তাঁর অসাধারণ সান্নিধ্য সবই এখন স্মৃতির অংশ। আমাদের প্রার্থনা, শুভকামনা কিছুই কাজে আসেনি। তিনি যাত্রা করেছেন অনন্তলোকে। কী করে বিদায় জানাব প্রিয় এই কবিকে, প্রিয় এই মানুষটিকে! আমার এই তাৎক্ষণিক লেখায় শোক প্রকাশের ভাষা নেই।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তরের দশকে বাংলা একাডেমিতে কোনো এক অনুষ্ঠানে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা তরুণ কবিবন্ধুরা বাংলা একাডেমিতে নিয়মিত যাতায়াত করি। কারণ আমাদের কাছে বাংলা একাডেমি তখন কবিতার ভুবন। ষাটের কবি-লেখকরা রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা, সুব্রত বডুয়া, ফরহাদ খান- এঁরা বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে আড্ডার কোনো এক ফাঁকে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তবে আমি তাঁকে কবিতার মাধ্যমে চিনতাম আগে থেকেই। বাবার চাকরি সূত্রে আমরা সপরিবারে তৎকালীন আদমজী জুট মিলে থাকতাম। ১৯৭৩ সালে আমি এসএসসি পাস করি। তখন কবিতা আমাকে পেয়ে বসেছিল প্রবলভাবে। দৈনিক পত্রিকা ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা পড়ে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর নাম জানতে পারি। সে সময়ে আদমজী থেকে কয়েকজন বন্ধু মিলে 'লোকালয়' নামে একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করি। লেখার জন্য ঢাকায় সিরাজী ভাইসহ কয়েকজন কবিকে চিঠি লিখি। নির্মলেন্দু গুণ ও হাবীবুল্লাহ সিরাজী লেখা পাঠিয়েছিলেন। সিরাজী ভাই হলুদ খামে একটি কবিতা পাঠিয়ে দেন। চমৎকার লিরিকধর্মী কবিতা। কবিতাটার নাম এখন মনে নেই। তাঁর সঙ্গে সেই আমার প্রথম সংযোগ। তারপর বাংলা একাডেমিতে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়। পেশায় তিনি ইঞ্জিনিয়ার। দেশে-বিদেশে চাকরি করেছেন, কিন্তু ছিলেন কবিতা অন্তঃপ্রাণ। সব পরিচয় ছাপিয়ে দিনে দিনে তাঁর কবি পরিচয় উজ্জ্বল হয়েছে। কবিতাই পরবর্তী সময়ে আমাদের কাছে টেনেছে। জীবনযাপনের কোলাহলের ভেতর তৈরি হয়েছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একটা গভীর সম্পর্ক যা কখনও মলিন হয়নি। আমার কাছে বিরল সান্নিধ্যের স্মৃতিতে ভাস্বর সেই দিনগুলো। কবি লেখকদের কাছে সিরাজী ভাই খুব প্রিয় ছিলেন। আন্তরিক ব্যবহার, সান্নিধ্য ও সহমর্মিতায় তিনি কাছে টানতে পারতেন সবাইকে। মানুষ হিসেবে ছিলেন রুচিবান, আড্ডায় ছিলেন দিলখোলা ও প্রাণবন্ত। একইভাবে বাংলা একাডেমির সহকর্মীদের কাছেও ছিলেন প্রিয়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিদের হাতে আমাদের সাহিত্যের তাৎপর্যপূর্ণ পালাবদল ঘটে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ-উত্তর সাহিত্যের দ্বিধা ও দোলাচলকে অতিক্রম করে কবিতা নতুন প্রাণের উদ্বোধনে উজ্জীবিত হয়। ষাটে এসে আমরা একঝাঁক উজ্জ্বল কবির আবির্ভাব দেখি। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তাদের অন্যতম। সময়ের অভিঘাতে কবিতা কখনও কখনও সমষ্টির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেও কবিকে সংগোপন সাধনায় নিজের ভাষা খুঁজে নিতে হয়। শব্দ, ধ্বনি, চিত্রকল্প ও প্রতীকের নানা রূপ ব্যবহারে নিজের আলাদা কাব্যসত্তা আবিস্কার করতে হয়। কাব্যযাত্রায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী নিজের একটা কবিতা ভুবন তৈরি করেছেন। তা সমকালের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে সৃজন ও মননের আলাদা রসায়নের বহুবিধ দৃষ্টান্তে দীপ্ত। কবিতায় তিনি সময়ের অভিজ্ঞতাকে যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি প্রমিত বাক্যবন্ধের পাশাপাশি মুখের ভাষাকেও উপজীব্য কবেছেন। বাংলা কবিতার প্রধান তিনটি ছন্দে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে তিনি যেমন ছিলেন স্বচ্ছন্দ, তেমনি মুক্তছন্দ ও গদ্যছন্দেও ছিলেন অনায়াস ও সপ্রতিভ। বিষয় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি কবিতা গ্রন্থের নামেও তিনি ছিলেন ভিন্নতার সন্ধানী। তাঁর 'মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি' কবিতাগ্রন্থ বের হলে এর অভিনব নামকরণে অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কিংবা 'আমি জেনারেল' বইটি দেখে কেউ সামরিক বাহিনীর কোনো কর্মকর্তার বই বলে ভেবে বসতে পারেন।
বাহাত্তর বছরের জীবনে ৩৩টি কাব্যগ্রন্থ; সেইসঙ্গে উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, স্মৃতিকথা- সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। এটি নিঃসন্দেহ তাঁর সৃজন সক্ষমতার উদাহরণ। পাঠকের প্রত্যাশাকে তিনি তাঁর সচল কলমে সব সময় সজাগ রেখেছেন। আমি দেখেছি যেখানেই গেছেন, একটা ছোট খাতায় রোজনামচার মতো লিখে গেছেন নানা ঘটনা। বছর দুয়েক আগে ২০১৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা হয়ে আমরা বার্লিন গিয়েছিলাম। কয়েকদিন জার্মানিতে থাকাকালে দেখেছি তাঁর হাতে ছোট্ট একটা নোটবই। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা প্রাত্যহিক অবলোকন ও অনুভব। একজন সংগঠক হিসেবেও আমরা দেখেছি তাঁকে। জাতীয় কবিতা পরিষদ সংগঠন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতাকে শানিত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে লিখেছেন অনেকগুলো কবিতা। তন্মধ্যে বছরখানেক আগে দৈনিক সমকালের 'কালের খেয়া'য় প্রকাশিত 'আমি অপেক্ষা করছি' কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 'আমি জেনারেল' কবিতায় লিখেছেন, 'আমি জেনারেল হাবীবুল্লাহ সিরাজী।/বুঝতে পারি রঙের বর্ণনা/গদ্য ও পদ্যের সবখানে বসিয়ে দিতে পারি একাত্তর/কেন্দ্রীয় কোষাগার খুলে বিতরণ করি/পিতা, প্রগতি ও পিস্তল'- এভাবে পারেন বলেই তাঁর কবিতার বহুমাত্রিক স্রোতে জড়িয়ে থাকে দেশ, সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু।
গত দুই বছর সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়ে উঠেছিল প্রায় প্রাত্যহিক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন। এছাড়া এ কমিটির 'প্রকাশনা ও সাহিত্য অনুষ্ঠান উপকমিটি'র তিনি সদস্য সচিব। সভাপতি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগে এই উপকমিটির অনেকগুলো সভা হয় এবং বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে জুম মাধ্যমে কমিটির সভায় তিনি নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সহায়তা দিয়েছেন। মুজিববর্ষে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ১০০টি গ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তন্মধ্যে অনেকগুলো প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে তিনি প্রশাসনিক ও সৃজনশীল কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে, নতুন অভিযাত্রার মাধ্যমে উত্তরাধিকার পত্রিকার নান্দনিক নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। এছাড়া ধানশালিকের দেশ, বাংলা একাডেমি গবেষণা পত্রিকা, বাংলা একাডেমির ইংরেজি জার্নাল চমৎকারভাবে প্রকাশ শুরু হয়েছিল। এ কাজে বাংলা একাডেমির মেধাবী ও তরুণ লেখকরা তাঁকে সহায়তা করেছে। একটি অনুবাদ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও শুরু করেছে বাংলা একাডেমি- তিনি এর প্রকাশিত রূপ দেখে যেতে পারেননি। করোনা মহামারির প্রতিকূল সময়েও বইমেলা আয়োজন করে তিনি সাধুবাদ পেয়েছেন। বাংলা একাডেমির সার্বিক উন্নয়নে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে আমাকেও তাঁর পরিকল্পনার কথা বলতেন, পরামর্শ নিতেন। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। তাঁর এই মৃত্যু বাংলা একাডেমির স্বপ্নযাত্রায় বড় আকারের ধাক্কা দিয়ে গেল।
করোনা মহামারিতে আমরা সবাই এখন বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য জগতের অনেককে আমরা হারিয়েছি। এ এক সময়, যার ক্ষতচিহ্ন ও শোক আমাদের চিরকাল বহন করতে হবে। বাংলা একাডেমির জন্য বড় দুঃসময় এটি। বাঙালি মনীষার অন্যতম দুই প্রধান কারুকৃৎ বাংলা একাডেমির প্রাক্তন দুই সভাপতি- জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান তাঁদের আমরা করোনায় হারিয়েছি। আনিসুজ্জামান স্যারের মৃত্যু ছিল আমাদের জন্য প্রথম আঘাত। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত পহেলা বৈশাখে আমরা হারালাম শামসুজ্জামান খানকে। একটা বড় শূন্যতার মধ্যে এ তালিকায় যুক্ত হলেন সিরাজী ভাই। তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। সিরাজী ভাই অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অবহেলা করেছেন শারীরিক অসুস্থতাকে। মরণব্যাধি অনেক আগেই বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে। কিন্তু কখনোই তিনি অসুস্থতার কথা সেভাবে বলতেন না। যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন তা ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত 'জমিনে ফারাক নেই' কাব্যগ্রন্থটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এজন্য আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই গ্রন্থে তাঁর নিরীক্ষা আছে। ব্যক্তি ও সমষ্টির অভেদ ভাবনাকে তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন এই গ্রন্থের কবিতায়। সেইসঙ্গে বৈশ্বিক উপলব্ধির কণ্ঠও ধারণ করে আছে কবিতাগুলো। কিন্তু একটা গভীর মৃত্যুচিন্তাও জুড়ে আছে এ গ্রন্থের কবিতায়। 'কেউ না কেউ তো বসে থাকে'- এই কবিতায় তাঁর দুটি পঙ্‌ক্তি- 'কেউ না কেউ তো বসে থাকে/মৃত্যু আসবে বলে অপেক্ষা করে আয়ু'- এই কেউ কে? এর মাধ্যমে কি তিনি ভবিতব্য দেখতে পেয়েছিলেন? তিনি কি তাঁর অনন্তযাত্রার অপেক্ষাকে রূপায়িত করেছেন স্বগতোক্তির মতো এই দুটি পঙ্‌ক্তিতে? কিংবা 'অনন্তধাম' কবিতায়, কবরকে তিনি বলেছেন অনন্তধাম। এখন মাটি ও তাঁর ভেতরে কোনো ফারাক নেই। জমিন ও তাঁর ভেতরে কোনো ফারাক নেই। তিনি লিখেছেন-
এখন বাইরে জাগরণ বিধি
হারানো স্বপ্নে হাওয়ার পরিধি
এপাশে ওপাশে অদ্ভুত স্বর
হারানো প্রহর?
তখন দেয়াল কবরের নাম
অনন্তধাম!

সিরাজী ভাই আজ অনন্তধামে চলে গেছেন। তাঁর জন্য আমাদের শোক, বাংলা কবিতার অন্তিম কুর্নিশ ও অশ্রু।