
অলংকরণ ::বোরহান আজাদ
সনাতন নাপিতের বিশাল আয়নাখানা সাবেকী বড়ইগাছের সঙ্গে বেশ করে বাঁধা, ওপাশে মেছোবাজার এপাশে মুরগিপট্টি, ব্যবসা তার জমজমাট, সে কারণে বলা যায়, চুল-দাড়ি কাটানো লোকের অভাব নাই, মাছমারারা যেমন আছে, মুরগিপট্টির মানুষগুলোও তো কম নয়। শিবগঞ্জ বাজারের দিনচলতি মানুষ তো আছেই, নাপিতের দোকান আরো আছে অবশ্যই কিন্তু সনাতন নাপিতের কাঁচির একটা অন্যরকম দক্ষতা জেনেই মানুষ ভিড় করে সবসময়।
ফজরের আজানের পরপরই বাড়ি থেকে পেটপুরে বাসিভাত-ভর্তা যা হোক খেয়ে বাপের আমলের মাডগার্ড ছাড়া রঙ উঠে যাওয়া পেছনের সিট ভাঙা শত জায়গায় ঝালাই করা সাইকেলটা নিয়ে সাত মাইল দূর থেকে কর্মস্থলে আসে। বউ তার ভারী লক্ষ্মী, স্বামী সেবায় কোনো খামতি নেই, বাজারের আসতে আসতে সাড়ে ছয়টা-সাতটা বেজে যায়, আবার ঠিক ঠিক জোহরের আজানের পর বাজার একটু স্তিমিত হলেই বাপের সেই সাবেকী আমলের সাইকেল হাতে ধরে হাঁটতে থাকে, ফাঁক বুঝে ভিড়বাট্টা একটু কম দেখলেই চেপে বসে, বাড়ি পৌঁছে দুটো দানাপানি খেয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে তারপর তিনটে/সাড়ে তিনটের দিকে আবার সেই সাবেকী কড়ইগাছের নিচে ছুটে আসে, জীবন যেন বিশাল আয়নার সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেছে তার। বাপের সময়েই তো সনাতন একটু-একটু করে নাপিতের কাজ শিখে ফেলে, বাপ বলতো, এ-কাজে ভাতের অভাব নেই, জীবন বহমান নদীর মতো চলতে থাকবে, কেউই বাধা দিতে পারবে না। কথাগুলো সনাতনের বড় বেশি মনে পড়ে, তাই সে সৎভাবে জীবন অতিবাহিত করতে চায়, যে জীবন সে পেয়েছে, সে জীবনটাকে কর্মের মধ্যে রেখে সৎ জীবন কাটানো তার প্রধান উদ্দেশ্য, ছেলে- মেয়ে দুটো গ্রামের স্কুলে পড়ছে, বউটা এতদিক সামলাতে পারে সনাতন ভেবে কূল পায় না। মুখে কুলুপ এঁটে সেই কোন সাতসকালে কাকপক্ষী জাগার আগেই বউ তার বিছানা ছেড়ে ওঠে, বাড়িঘর উঠোন ঝাঁট দিয়ে পয়পরিস্কার করে, মুরগি-হাঁস খোপ থেকে ছেড়ে দেয় ছাগল-গরু-বাছুর গোয়াল থেকে বাইরে রেখে, তাদের খেতে দিয়ে, বাসি কাজ শেষে পাগলা নদী থেকে এক ডুব দিয়ে তারপর স্বামীর জন্য খাওয়া, তারপরও কত যে কাজ আছে সংসারে, কোনো রা নেই মানুষটার, ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো, স্কুলে পাঠানো থেকে সংসারের খুঁটিনাটি কাজ বউটা করলেও কোনো অভিযোগ নেই, সেও যেন সনাতনের মতো একটা জীবন পেয়েছে, যেখানে দুটো খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা মিলেছে, সে জীবনটাই শ্রেষ্ঠ বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চেয়ে কি আর চাওয়ার আছে, মানুষ তো দুনিয়ায় আসে বেঁচে থাকা আর স্বামী-সন্তান-সংসারের জন্য কিছু সেবা করতে, এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না সনাতনের বউ।
যুদ্ধের সময় সনাতনের বয়স ৯ ছিল, এখনও তবু তার চোখে ভাসে সে সমস্ত দিনের ছবি। বাপের হাতে হাত ধরে চলে গিয়েছিল সীমান্ত পার হয়ে আরেক দেশ, মা-কাকি-পিসি-বাবা-কাকা-জেঠা আরো কতসব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শি চেনা-অচেনা মানুষ ছিল তাদের সঙ্গে, জীবনের জন্য মানুষ কি না করতে পারে! গরুগাড়িতে চেপেছিল রাজ্যের জিনিসপত্র, সঙ্গে ছিল ঠাম্মা-দিদিমা আর বাড়ি ঠাকুর, হরিনাম জপতে-জপতে ভিন দেশে গিয়ে জীবন রক্ষা পেয়েছিল, বাবা বলত, মানুষের জীবনটাই আগে, জীবনই যদি না থাকল তো আর কি? বাপের কথা শুনে সনাতন সেভাবেই বড় হয়েছে, ওর বড়দা-ভাইবোন-দিদিরা সংখ্যায় অনেক, দশজন হলেও বাবা সবাইকে একচোখে দেখত, গরুর গাড়ির ভেতর থেকে ঠাম্মা বলেছিল, সনাকে আমার কোলে তুলে দে...
যুদ্ধ শুরুর আগেই সনাতনের ভাইবোনদের ভিনদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল গনাধন নাপিত, কিন্তু সনাতন যেতে চায়নি, তার যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না, গনাধনেরও যাওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না, নিজ দেশে থেকে অন্যদেশে জীবন বাঁচাতে যাবো কেন? কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক দেখে যেতেই হয় শেষাবধি। সে স্মৃতি সনাতনের চোখে আজও জ্বলজ্বল করে ভাসে।
যুদ্ধ শেষ হলে সনাতনেরা ফিরে আসে নিজ দেশে, পোড়া দেশে তখন অঙ্গার বৈ তো কিছুই অবশিষ্ট নেই, সবারই বাড়িঘর সব ভস্ম, হিন্দুর বাড়ি আস্ত থাকবে কি করে? বাপের কথা শুনে সনাতন বোঝে জাতি-ধম্ম ভেদাভেদ। তারপরও কতদিন যেন বাপটা বেঁচে ছিল, বোনেদের একে একে বিয়ে দিলো, ভাইয়েরা বড় হলো, কাজ-কম্ম করতে শিখল, তারপর দূরে-দূরে কোথায় সব চলে গেল, মা একদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাল, বছর না ঘুরতেই বাপটাও ওই পথ ধরল, ততদিনে সনাতন সংসারের হাল-হকিয়ত বুঝে গেছে, বোনেরা কেউ কেউ আসে-টাসে কদাচিৎ, সম্পর্কটা আছে যেভাবেই হোক, কিন্তু ভাইয়েরা তো অনেক দূরে-দূরে, সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখতে পারে না। চোখের আড়াল মানেই তো মনের আড়াল, এভাবেই মানুষ যুদ্ধ করতে করতে একটু একটু করে বুঝে যায় জীবনের সারকথা।
সন্ধ্যোর দিকে মানুষজন ভদ্র হওয়ার জন্য সনাতনের কাছে আসে, দাড়ি কামায়, চুল কাটে, গোঁফ সাইজ করে, কেউ-বা বগলের পশম কাটতে বলে,পায়ের নখ-নাকের পশম, সনাতন আনন্দমনে সবই করে দেয়, তারপর যে যা দেয় হাত পেতে নেয়, বাড়তি কোনো চাহিদা নেই তার, পিটালীতলার নরেশ মৈত্রীর বাড়ি, রানীহাটির তালুকদার বাড়ি বা চাঁপাবাজারের মনিরুদ্দীর বাড়ি সনাতন সপ্তাহে দু- তিনবার যায়, বাঁধা কাস্টমার তারা, হাত উপুড় করে পয়সাও দেয়, সনাতনের সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে সেই বাপের আমল থেকে, দীর্ঘদিন ভালোবাসা বলা যায়।
সনাতন নাপিতের বড় আরেকটি গুণ হলো মানুষজনকে আপন করে নেওয়া, রসিকতাও করতে জানে, রাজ্যের গল্প তার ঝুড়িতে রক্ষিত, গোলাপ বাজারের নয়নকে একদিন বলে, বিয়ে-শাদি করছো না কেন হে...
নয়ন জানায়, বিয়ে তো করতে চাই কিন্তু ভালো মেয়ে তো!
মুহূর্তে সনাতন বলে ওঠে, ভালো-খারাপ কী আবার, রানী হতে হবে বা উড়ালপঙ্খি হতে হবে, এমন তো নয়?
নয়ন কণ্ঠ নামিয়ে বলে, না তা নয় রে ভায়া, তবে দেখতে শুনতে একটু...
-খাসা হতে হবে, এই তো ব্যাপার...
-হ্যাঁ অমনই চায় আর কি!
-তাহলে আর ভালো-মন্দ কী হবে, শুধু দেখবে মেয়ে মোতে কি না...
নয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে খানিক, তারপর আবার সনাতন বলে ওঠে, আমার বউ মানে তোমার বউদি কেমন জানো?
-নিশ্চয় খুব সুন্দরী!
-ধ্যাৎ মিয়া, সুন্দরী কি, মাটির প্রতিমা বুঝলে মাটির...
-ওই তাই একই হলো।
-কিসের এক বলো, দেখতে সুন্দরী হলে কি সুন্দরী বলে, কাজে-কামে সংসার-ধম্মেই মানুষকে চেনা যায়, বুঝলে ভায়া, শুধু উড়তে জানলে সুন্দরী বলে না, ডানা থাকা চাই।
সনাতন নাপিত এমনই এক মানুষ যে, তাকে সবাই ভালোবাসে। একদিন অসুখে পড়ে যদি শিবগঞ্জ বাজারে না আসে তো লোকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, পরের দিন এসে হাসতে হাসতে বলে ওঠে, না ভাই তোমাদের ছেড়ে আমি ভারতে পালিয়ে যাইনি।
ভারত সে যাবে না, কারণ বাপের আদেশ যতদিন বেঁচে থাকবি এদেশেই থাকবি, সনাতন জানায়, একবার পলিয়ে গিয়ে নাজেহাল যা হয়েছি আর কোনোদিন ও-মুখো যাবো না ভাই, নিজের রক্তের আত্মীয়-স্বজনও দূর-দূর করেছে, আমরা উদ্বাস্তু হয়ে সে-বার গিয়েছিলাম বলে নিজের লোকের কম হেনস্থ সয়েছি... তাই সনাতনের কথা- দেশ আমার, মাটি আমার আর নাপিতের কাজ এদেশ-ওদেশ বলে তো কথা নেই, সবখানেই মূল্য, ভদ্র হও টাকা ফেলো, এভাবেই সনাতন নিজের মূল্যায়ন নিজে করে। শিবগঞ্জ বাজারের মানুষজন ওর কাছে চুল-দাড়ি কামায় আর কাঁচির শব্দের তালে তালে সনাতনের গল্প শোনে, ওর গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়।
খাসেরহাটের মাছমারা কার্তিক সেদিন চুল-দাড়ি কাটতে এসে জানায়, মানুষজন আর আগের মতো নেই সনাতনদা, বড় আকাল পড়ে গেছে ভালো মানুষের...
সনাতন বলে, কেন ভাই, ভালো মানুষের খোঁজ করছো কেন ভায়া!
-খোঁজ করছি না, ভাবছি, দেশ যে মন্দ লোকে ভরে গেল গো...
-ভালো-মন্দ তো নিজের কাছে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।
-তাও ঠিক কথা, কিন্তু আমি ব্যবসা করতে এসে বড় ফেঁসে যাচ্ছি যে!
কাহপাড়ার মোখলেস গাইন হাটের দিনে শিবগঞ্জ বাজারে গান শোনায়, নিমায়ের চায়ের দোকানের বাঁশের টানা বেঞ্চে বসে গল্প করছিল, কার্তিকের কথা শুনে একটা গান গেয়ে ওঠে... সুজন দেইখে কইরো পিরিত/ভোলা-ম-ন.../নয়লে ও' মন দিয়ো না/ও' প্রেমে সুখ তো পাবি না...
কথার তার কেটে যায়, কার্তিক অমনি হেঁকে জানায়, গায়েন তুমি পারো বটে, সব কিছুতেই তোমার গান...
-গান...হ্যাঁ রে ক্ষেপা গা...ন... নিজের দোতারাখানা বেঞ্চে নামিয়ে একটু হেসে আড়চোখে তাকিয়ে আবার বলে, গানই তো প্রাণ রে,গান হলো জগতের আনন্দ, সব মন্দকে ভালো করে ওই গান, সব খারাপকে ঝেড়ে ফেলে ওই গান...
সনাতন নাপিতের এভাবেই দিন যায় রাত আসে, আবার রাত যায় দিন আসে, কোনো কোনো রাতে তার চোখে ঘুম আসে না, মাঝরাতে ঘর থেকে বের হয়ে পাগলানদীর কাছাকাছি এসে খানিক দাঁড়ায়, বুক ভরে শ্বাস নেয়, রাতের বাতাস বড় বেশি মায়াবী, আকাশের চাঁদের মতো মধুর পরশ বুলিয়ে দেয়; তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মন কোথায় হারিয়ে যায়। দিন দিন মানুষ কেমন সভ্য হয়ে উঠল, চারদিকের মানুষ আজ আর কেউ অসভ্য নেই, সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়ছে সবার জীবনে। অথচ একটা সময় এসব অঞ্চলে কি ছিল, মানুষের দু'বেলা অন্ন জুটত না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, বাপের হাত ধরে স্কুলের পরিবর্তে সনাতন তাই শিবগঞ্জ বাজারে নাপিতের কাজ শিখতে আসত, সে এক আনন্দের জীবন ছিল; অথচ আজ কেমন সব পাল্টে যাচ্ছে, সব কেমন কালো-শাদা লাল-সবুজ- সেই দুনিয়ার মানুষ আর আজকের মানুষের মধ্যে এত অমিল কেন সনাতন বুঝে পায় না। মুহূর্তে বাবা-মায়ের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে, মা ছিল সরস্বতীর মতো, এখনও মা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শাদা-শুভ্র শাড়ি পরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে এভাবে চোখের মধ্যে আসবে ভাবেনি সনাতন। মা যেন মা নয় একটা মোমের পুতুল, জীবনভর খেয়ে না খেয়ে বাপের সংসার করেছে, কোনো অভিযোগ নেই, প্রতিবাদ নেই; কিন্তু ছেলেমেয়েদের কখনো অবহেলা করেনি, বুক ভরে ভালোবেসেছে, এমন মা যেন পৃথিবীতে আর হয় না, সেই মায়ের ভালোবাসা যার জীবনে, সে কি অসৎ হতে পারে, তাই তো সনাতন মায়ের স্মৃতি নিয়ে সুখে আছে, মা যে তাকে দেখা দেয় আর বলে, সনা বাবা আমার, জীবনে কাউকে কষ্ট দেবে না মানুষকে ভালোবাসবে, তবেই তুমি ভালোবাসা পাবে। আর বাপের কথাগুলো কানে বাজে, বেঁচে থাকতে হলে সৎ ভাবে বাঁচবে, অন্যায় করে কেউ মাথা উচু করে বাঁচতে পারে না। সনাতনের বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে বাবা-মায়ের আশীর্বাদে।
পাগলার হাওয়ার চেয়েও শীতল হয়ে যায় তার বুক, রাতের আকাশ তখনও জ্যোৎস্না ঢেলে যায়, সেই জ্যোৎস্নার ভেতর ভালোবাসার পরাগ ছড়িয়ে দেয় মনের নিভৃত কোণে, শরীর-মন কেমন চাঙ্গা হয়ে ওঠে, রাত যে কত হলো বোঝা না গেলেও আন্দাজ করে শেষপ্রহর চলছে, আরেকটু পরে গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠবে, মসজিদের আজানের সাথে সাথে মানুষের পৃথিবী কোলাহলে মগ্ন হবে, সনাতন তখন কাঁচি-ক্ষুর-চিরুনি-ব্রাশ প্রভৃতির বাক্সটা ঝুলিয়ে দেখে সাইকেলের হ্যান্ডেলে, তারপর সাইকেল ঠেলে হাঁটতে থাকবে, শিবগঞ্জ বাজারের সড়ক ধরে যেসব মানুষ যাবে, তাদের সনাতন চেনে, সবাই তাকে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে বলেই সনাতন একজন মানুষ হতে পেরেছে, তারপরও সে ভাবে মানুষ হওয়া কি এতই সহজ, ছেষষ্টি লক্ষ যোনি ভেদে যে মানবজন্ম পেয়েছে তা কি সোজা কথা, সাপ-ব্যাঙ-কেঁচো-ইদুর বা কুকুর-শিয়াল-শুয়োর করে যদি সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠাত, তাহলে কার কী করার ছিল, কিন্তু সে মানবজন্ম পেয়েছে, বাবা বলত, মানব জন্ম মানে মানুষের উপকার করা, আর যদি মানবকুলের উপকার নাই-বা করতে পারলি তো ক্ষতি করবি না, মানুষের ক্ষতি করা মানে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করার শামিল।
সনাতন হাঁটছে মাটি ফেলা সরু সড়ক ধরে, আজ তার তালুকদার বাড়ি যেতে হবে, সাইকেলটা বড় বিগড়েছে, আর কতদিন বহন করে নিয়ে যাবে, তারও তো আয়ু বলে একটা কথা আছে। সনাতন হেঁটে যায় সামনে, তার থামার কোনো সময় নেই। আজকের সকালটা মনে হচ্ছে অন্যদিনের থেকে ভিন্ন, সনাতন জানে সকাল ভিন্ন হলেও মানুষগুলো কখনও ভিন্ন হয় না, বড় আপন বড় আত্মীয় তার কাছে। রঙচঙের পৃথিবীতে বদলে যাচ্ছে সবই, বাড়ি-ঘর হাট-বাজার পরিচিত পরিবেশ সব কেমন মুহূর্তে-মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে, টাকা-ক্ষমতা আর অস্ত্রের কাছে মানুষ মাথা বিকিয়ে দিচ্ছে, কেউ কারও দিকে তাকানোর আর ফুরসত পায় না। সনাতন সবই দেখে, তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয় না, হাসি-খুশি ভরা সনাতন ঢোলা শার্ট আর কালো ঢোলা সেই কোনকালের প্যান্ট পরে হেঁটে যায় আর আসে, এই আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে পাগলা নদীর বাতাসে ভেসে বেড়ানো মানুষের মুখচ্ছবি দেখে আর দেখতে থাকে। গাছের মাথা রোদের প্রথম আলোত ভেসে যায়, ভাঙা মন্দিরটার সামনে এলে মাথা নামিয়ে বিনম্র প্রণাম ঠুকে খোয়া বিছানো সড়কে উঠে যায়। বিগড়ানো সাইকেলের ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে কেমন একটা মমতা ছড়িয়ে গেলেও সনাতন বিরক্ত হয়েই হাঁটতে থাকে। মনে মনে ভাবে আজ শিবগঞ্জে যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন, রাস্তা কি বড় হয়ে গেল, এ রাস্তা দিয়েই তো জীবনভর হাঁটছে, কিন্তু আজ কী হলো বুঝে উঠতে না পারলেও একটা গাছের কাছাকাছি এসে মাথাটা ঘুরে যায়। টাল সামলাতে পারে না, নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, চোখে কেমন অন্ধকার দেখে, এত অন্ধকার কোথা থেকে এলো, বুকের ভেতর একটু ভারী বোধ হলো, সনাতন অনেক দূরে দেখতে পেলো একটা শ্মশান, যেখানে তার মা-বাবার শেষকৃত্য করা হয়েছিল, শত মানুষের হরি ধ্বনিতে মুখরিত হলেও সনাতন স্তব্ধ হয়ে আছে, তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, শব্দগুলো ক্রমেই হারিয়ে গেলেও সনাতন নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়ায়, তাকে যেতে হবে আরো অনেকটা দূরে, কত মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে, ওদিকে চিতার দাউ-দাউ আগুনে ভস্ম হচ্ছে মানুষের মাটির প্রতিমা, শরীর যেন শরীর নয় একেকটা মূর্তি, সে মূর্তি কীভাবে প্রাণ ফিরে পাবে জানে না, কিন্তু সনাতন জানে ভালোবাসা থাকলে পাথরেও প্রাণ ফিরে পায়, মাটির মূর্তিও কথা বলে যদি সে মানুষের ভালোবাসা পায়। া
ফজরের আজানের পরপরই বাড়ি থেকে পেটপুরে বাসিভাত-ভর্তা যা হোক খেয়ে বাপের আমলের মাডগার্ড ছাড়া রঙ উঠে যাওয়া পেছনের সিট ভাঙা শত জায়গায় ঝালাই করা সাইকেলটা নিয়ে সাত মাইল দূর থেকে কর্মস্থলে আসে। বউ তার ভারী লক্ষ্মী, স্বামী সেবায় কোনো খামতি নেই, বাজারের আসতে আসতে সাড়ে ছয়টা-সাতটা বেজে যায়, আবার ঠিক ঠিক জোহরের আজানের পর বাজার একটু স্তিমিত হলেই বাপের সেই সাবেকী আমলের সাইকেল হাতে ধরে হাঁটতে থাকে, ফাঁক বুঝে ভিড়বাট্টা একটু কম দেখলেই চেপে বসে, বাড়ি পৌঁছে দুটো দানাপানি খেয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে তারপর তিনটে/সাড়ে তিনটের দিকে আবার সেই সাবেকী কড়ইগাছের নিচে ছুটে আসে, জীবন যেন বিশাল আয়নার সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেছে তার। বাপের সময়েই তো সনাতন একটু-একটু করে নাপিতের কাজ শিখে ফেলে, বাপ বলতো, এ-কাজে ভাতের অভাব নেই, জীবন বহমান নদীর মতো চলতে থাকবে, কেউই বাধা দিতে পারবে না। কথাগুলো সনাতনের বড় বেশি মনে পড়ে, তাই সে সৎভাবে জীবন অতিবাহিত করতে চায়, যে জীবন সে পেয়েছে, সে জীবনটাকে কর্মের মধ্যে রেখে সৎ জীবন কাটানো তার প্রধান উদ্দেশ্য, ছেলে- মেয়ে দুটো গ্রামের স্কুলে পড়ছে, বউটা এতদিক সামলাতে পারে সনাতন ভেবে কূল পায় না। মুখে কুলুপ এঁটে সেই কোন সাতসকালে কাকপক্ষী জাগার আগেই বউ তার বিছানা ছেড়ে ওঠে, বাড়িঘর উঠোন ঝাঁট দিয়ে পয়পরিস্কার করে, মুরগি-হাঁস খোপ থেকে ছেড়ে দেয় ছাগল-গরু-বাছুর গোয়াল থেকে বাইরে রেখে, তাদের খেতে দিয়ে, বাসি কাজ শেষে পাগলা নদী থেকে এক ডুব দিয়ে তারপর স্বামীর জন্য খাওয়া, তারপরও কত যে কাজ আছে সংসারে, কোনো রা নেই মানুষটার, ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো, স্কুলে পাঠানো থেকে সংসারের খুঁটিনাটি কাজ বউটা করলেও কোনো অভিযোগ নেই, সেও যেন সনাতনের মতো একটা জীবন পেয়েছে, যেখানে দুটো খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা মিলেছে, সে জীবনটাই শ্রেষ্ঠ বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চেয়ে কি আর চাওয়ার আছে, মানুষ তো দুনিয়ায় আসে বেঁচে থাকা আর স্বামী-সন্তান-সংসারের জন্য কিছু সেবা করতে, এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না সনাতনের বউ।
যুদ্ধের সময় সনাতনের বয়স ৯ ছিল, এখনও তবু তার চোখে ভাসে সে সমস্ত দিনের ছবি। বাপের হাতে হাত ধরে চলে গিয়েছিল সীমান্ত পার হয়ে আরেক দেশ, মা-কাকি-পিসি-বাবা-কাকা-জেঠা আরো কতসব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শি চেনা-অচেনা মানুষ ছিল তাদের সঙ্গে, জীবনের জন্য মানুষ কি না করতে পারে! গরুগাড়িতে চেপেছিল রাজ্যের জিনিসপত্র, সঙ্গে ছিল ঠাম্মা-দিদিমা আর বাড়ি ঠাকুর, হরিনাম জপতে-জপতে ভিন দেশে গিয়ে জীবন রক্ষা পেয়েছিল, বাবা বলত, মানুষের জীবনটাই আগে, জীবনই যদি না থাকল তো আর কি? বাপের কথা শুনে সনাতন সেভাবেই বড় হয়েছে, ওর বড়দা-ভাইবোন-দিদিরা সংখ্যায় অনেক, দশজন হলেও বাবা সবাইকে একচোখে দেখত, গরুর গাড়ির ভেতর থেকে ঠাম্মা বলেছিল, সনাকে আমার কোলে তুলে দে...
যুদ্ধ শুরুর আগেই সনাতনের ভাইবোনদের ভিনদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল গনাধন নাপিত, কিন্তু সনাতন যেতে চায়নি, তার যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না, গনাধনেরও যাওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না, নিজ দেশে থেকে অন্যদেশে জীবন বাঁচাতে যাবো কেন? কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক দেখে যেতেই হয় শেষাবধি। সে স্মৃতি সনাতনের চোখে আজও জ্বলজ্বল করে ভাসে।
যুদ্ধ শেষ হলে সনাতনেরা ফিরে আসে নিজ দেশে, পোড়া দেশে তখন অঙ্গার বৈ তো কিছুই অবশিষ্ট নেই, সবারই বাড়িঘর সব ভস্ম, হিন্দুর বাড়ি আস্ত থাকবে কি করে? বাপের কথা শুনে সনাতন বোঝে জাতি-ধম্ম ভেদাভেদ। তারপরও কতদিন যেন বাপটা বেঁচে ছিল, বোনেদের একে একে বিয়ে দিলো, ভাইয়েরা বড় হলো, কাজ-কম্ম করতে শিখল, তারপর দূরে-দূরে কোথায় সব চলে গেল, মা একদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাল, বছর না ঘুরতেই বাপটাও ওই পথ ধরল, ততদিনে সনাতন সংসারের হাল-হকিয়ত বুঝে গেছে, বোনেরা কেউ কেউ আসে-টাসে কদাচিৎ, সম্পর্কটা আছে যেভাবেই হোক, কিন্তু ভাইয়েরা তো অনেক দূরে-দূরে, সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখতে পারে না। চোখের আড়াল মানেই তো মনের আড়াল, এভাবেই মানুষ যুদ্ধ করতে করতে একটু একটু করে বুঝে যায় জীবনের সারকথা।
সন্ধ্যোর দিকে মানুষজন ভদ্র হওয়ার জন্য সনাতনের কাছে আসে, দাড়ি কামায়, চুল কাটে, গোঁফ সাইজ করে, কেউ-বা বগলের পশম কাটতে বলে,পায়ের নখ-নাকের পশম, সনাতন আনন্দমনে সবই করে দেয়, তারপর যে যা দেয় হাত পেতে নেয়, বাড়তি কোনো চাহিদা নেই তার, পিটালীতলার নরেশ মৈত্রীর বাড়ি, রানীহাটির তালুকদার বাড়ি বা চাঁপাবাজারের মনিরুদ্দীর বাড়ি সনাতন সপ্তাহে দু- তিনবার যায়, বাঁধা কাস্টমার তারা, হাত উপুড় করে পয়সাও দেয়, সনাতনের সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে সেই বাপের আমল থেকে, দীর্ঘদিন ভালোবাসা বলা যায়।
সনাতন নাপিতের বড় আরেকটি গুণ হলো মানুষজনকে আপন করে নেওয়া, রসিকতাও করতে জানে, রাজ্যের গল্প তার ঝুড়িতে রক্ষিত, গোলাপ বাজারের নয়নকে একদিন বলে, বিয়ে-শাদি করছো না কেন হে...
নয়ন জানায়, বিয়ে তো করতে চাই কিন্তু ভালো মেয়ে তো!
মুহূর্তে সনাতন বলে ওঠে, ভালো-খারাপ কী আবার, রানী হতে হবে বা উড়ালপঙ্খি হতে হবে, এমন তো নয়?
নয়ন কণ্ঠ নামিয়ে বলে, না তা নয় রে ভায়া, তবে দেখতে শুনতে একটু...
-খাসা হতে হবে, এই তো ব্যাপার...
-হ্যাঁ অমনই চায় আর কি!
-তাহলে আর ভালো-মন্দ কী হবে, শুধু দেখবে মেয়ে মোতে কি না...
নয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে খানিক, তারপর আবার সনাতন বলে ওঠে, আমার বউ মানে তোমার বউদি কেমন জানো?
-নিশ্চয় খুব সুন্দরী!
-ধ্যাৎ মিয়া, সুন্দরী কি, মাটির প্রতিমা বুঝলে মাটির...
-ওই তাই একই হলো।
-কিসের এক বলো, দেখতে সুন্দরী হলে কি সুন্দরী বলে, কাজে-কামে সংসার-ধম্মেই মানুষকে চেনা যায়, বুঝলে ভায়া, শুধু উড়তে জানলে সুন্দরী বলে না, ডানা থাকা চাই।
সনাতন নাপিত এমনই এক মানুষ যে, তাকে সবাই ভালোবাসে। একদিন অসুখে পড়ে যদি শিবগঞ্জ বাজারে না আসে তো লোকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, পরের দিন এসে হাসতে হাসতে বলে ওঠে, না ভাই তোমাদের ছেড়ে আমি ভারতে পালিয়ে যাইনি।
ভারত সে যাবে না, কারণ বাপের আদেশ যতদিন বেঁচে থাকবি এদেশেই থাকবি, সনাতন জানায়, একবার পলিয়ে গিয়ে নাজেহাল যা হয়েছি আর কোনোদিন ও-মুখো যাবো না ভাই, নিজের রক্তের আত্মীয়-স্বজনও দূর-দূর করেছে, আমরা উদ্বাস্তু হয়ে সে-বার গিয়েছিলাম বলে নিজের লোকের কম হেনস্থ সয়েছি... তাই সনাতনের কথা- দেশ আমার, মাটি আমার আর নাপিতের কাজ এদেশ-ওদেশ বলে তো কথা নেই, সবখানেই মূল্য, ভদ্র হও টাকা ফেলো, এভাবেই সনাতন নিজের মূল্যায়ন নিজে করে। শিবগঞ্জ বাজারের মানুষজন ওর কাছে চুল-দাড়ি কামায় আর কাঁচির শব্দের তালে তালে সনাতনের গল্প শোনে, ওর গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়।
খাসেরহাটের মাছমারা কার্তিক সেদিন চুল-দাড়ি কাটতে এসে জানায়, মানুষজন আর আগের মতো নেই সনাতনদা, বড় আকাল পড়ে গেছে ভালো মানুষের...
সনাতন বলে, কেন ভাই, ভালো মানুষের খোঁজ করছো কেন ভায়া!
-খোঁজ করছি না, ভাবছি, দেশ যে মন্দ লোকে ভরে গেল গো...
-ভালো-মন্দ তো নিজের কাছে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।
-তাও ঠিক কথা, কিন্তু আমি ব্যবসা করতে এসে বড় ফেঁসে যাচ্ছি যে!
কাহপাড়ার মোখলেস গাইন হাটের দিনে শিবগঞ্জ বাজারে গান শোনায়, নিমায়ের চায়ের দোকানের বাঁশের টানা বেঞ্চে বসে গল্প করছিল, কার্তিকের কথা শুনে একটা গান গেয়ে ওঠে... সুজন দেইখে কইরো পিরিত/ভোলা-ম-ন.../নয়লে ও' মন দিয়ো না/ও' প্রেমে সুখ তো পাবি না...
কথার তার কেটে যায়, কার্তিক অমনি হেঁকে জানায়, গায়েন তুমি পারো বটে, সব কিছুতেই তোমার গান...
-গান...হ্যাঁ রে ক্ষেপা গা...ন... নিজের দোতারাখানা বেঞ্চে নামিয়ে একটু হেসে আড়চোখে তাকিয়ে আবার বলে, গানই তো প্রাণ রে,গান হলো জগতের আনন্দ, সব মন্দকে ভালো করে ওই গান, সব খারাপকে ঝেড়ে ফেলে ওই গান...
সনাতন নাপিতের এভাবেই দিন যায় রাত আসে, আবার রাত যায় দিন আসে, কোনো কোনো রাতে তার চোখে ঘুম আসে না, মাঝরাতে ঘর থেকে বের হয়ে পাগলানদীর কাছাকাছি এসে খানিক দাঁড়ায়, বুক ভরে শ্বাস নেয়, রাতের বাতাস বড় বেশি মায়াবী, আকাশের চাঁদের মতো মধুর পরশ বুলিয়ে দেয়; তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মন কোথায় হারিয়ে যায়। দিন দিন মানুষ কেমন সভ্য হয়ে উঠল, চারদিকের মানুষ আজ আর কেউ অসভ্য নেই, সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়ছে সবার জীবনে। অথচ একটা সময় এসব অঞ্চলে কি ছিল, মানুষের দু'বেলা অন্ন জুটত না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, বাপের হাত ধরে স্কুলের পরিবর্তে সনাতন তাই শিবগঞ্জ বাজারে নাপিতের কাজ শিখতে আসত, সে এক আনন্দের জীবন ছিল; অথচ আজ কেমন সব পাল্টে যাচ্ছে, সব কেমন কালো-শাদা লাল-সবুজ- সেই দুনিয়ার মানুষ আর আজকের মানুষের মধ্যে এত অমিল কেন সনাতন বুঝে পায় না। মুহূর্তে বাবা-মায়ের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে, মা ছিল সরস্বতীর মতো, এখনও মা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শাদা-শুভ্র শাড়ি পরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে এভাবে চোখের মধ্যে আসবে ভাবেনি সনাতন। মা যেন মা নয় একটা মোমের পুতুল, জীবনভর খেয়ে না খেয়ে বাপের সংসার করেছে, কোনো অভিযোগ নেই, প্রতিবাদ নেই; কিন্তু ছেলেমেয়েদের কখনো অবহেলা করেনি, বুক ভরে ভালোবেসেছে, এমন মা যেন পৃথিবীতে আর হয় না, সেই মায়ের ভালোবাসা যার জীবনে, সে কি অসৎ হতে পারে, তাই তো সনাতন মায়ের স্মৃতি নিয়ে সুখে আছে, মা যে তাকে দেখা দেয় আর বলে, সনা বাবা আমার, জীবনে কাউকে কষ্ট দেবে না মানুষকে ভালোবাসবে, তবেই তুমি ভালোবাসা পাবে। আর বাপের কথাগুলো কানে বাজে, বেঁচে থাকতে হলে সৎ ভাবে বাঁচবে, অন্যায় করে কেউ মাথা উচু করে বাঁচতে পারে না। সনাতনের বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে বাবা-মায়ের আশীর্বাদে।
পাগলার হাওয়ার চেয়েও শীতল হয়ে যায় তার বুক, রাতের আকাশ তখনও জ্যোৎস্না ঢেলে যায়, সেই জ্যোৎস্নার ভেতর ভালোবাসার পরাগ ছড়িয়ে দেয় মনের নিভৃত কোণে, শরীর-মন কেমন চাঙ্গা হয়ে ওঠে, রাত যে কত হলো বোঝা না গেলেও আন্দাজ করে শেষপ্রহর চলছে, আরেকটু পরে গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠবে, মসজিদের আজানের সাথে সাথে মানুষের পৃথিবী কোলাহলে মগ্ন হবে, সনাতন তখন কাঁচি-ক্ষুর-চিরুনি-ব্রাশ প্রভৃতির বাক্সটা ঝুলিয়ে দেখে সাইকেলের হ্যান্ডেলে, তারপর সাইকেল ঠেলে হাঁটতে থাকবে, শিবগঞ্জ বাজারের সড়ক ধরে যেসব মানুষ যাবে, তাদের সনাতন চেনে, সবাই তাকে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে বলেই সনাতন একজন মানুষ হতে পেরেছে, তারপরও সে ভাবে মানুষ হওয়া কি এতই সহজ, ছেষষ্টি লক্ষ যোনি ভেদে যে মানবজন্ম পেয়েছে তা কি সোজা কথা, সাপ-ব্যাঙ-কেঁচো-ইদুর বা কুকুর-শিয়াল-শুয়োর করে যদি সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠাত, তাহলে কার কী করার ছিল, কিন্তু সে মানবজন্ম পেয়েছে, বাবা বলত, মানব জন্ম মানে মানুষের উপকার করা, আর যদি মানবকুলের উপকার নাই-বা করতে পারলি তো ক্ষতি করবি না, মানুষের ক্ষতি করা মানে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করার শামিল।
সনাতন হাঁটছে মাটি ফেলা সরু সড়ক ধরে, আজ তার তালুকদার বাড়ি যেতে হবে, সাইকেলটা বড় বিগড়েছে, আর কতদিন বহন করে নিয়ে যাবে, তারও তো আয়ু বলে একটা কথা আছে। সনাতন হেঁটে যায় সামনে, তার থামার কোনো সময় নেই। আজকের সকালটা মনে হচ্ছে অন্যদিনের থেকে ভিন্ন, সনাতন জানে সকাল ভিন্ন হলেও মানুষগুলো কখনও ভিন্ন হয় না, বড় আপন বড় আত্মীয় তার কাছে। রঙচঙের পৃথিবীতে বদলে যাচ্ছে সবই, বাড়ি-ঘর হাট-বাজার পরিচিত পরিবেশ সব কেমন মুহূর্তে-মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে, টাকা-ক্ষমতা আর অস্ত্রের কাছে মানুষ মাথা বিকিয়ে দিচ্ছে, কেউ কারও দিকে তাকানোর আর ফুরসত পায় না। সনাতন সবই দেখে, তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয় না, হাসি-খুশি ভরা সনাতন ঢোলা শার্ট আর কালো ঢোলা সেই কোনকালের প্যান্ট পরে হেঁটে যায় আর আসে, এই আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে পাগলা নদীর বাতাসে ভেসে বেড়ানো মানুষের মুখচ্ছবি দেখে আর দেখতে থাকে। গাছের মাথা রোদের প্রথম আলোত ভেসে যায়, ভাঙা মন্দিরটার সামনে এলে মাথা নামিয়ে বিনম্র প্রণাম ঠুকে খোয়া বিছানো সড়কে উঠে যায়। বিগড়ানো সাইকেলের ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে কেমন একটা মমতা ছড়িয়ে গেলেও সনাতন বিরক্ত হয়েই হাঁটতে থাকে। মনে মনে ভাবে আজ শিবগঞ্জে যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন, রাস্তা কি বড় হয়ে গেল, এ রাস্তা দিয়েই তো জীবনভর হাঁটছে, কিন্তু আজ কী হলো বুঝে উঠতে না পারলেও একটা গাছের কাছাকাছি এসে মাথাটা ঘুরে যায়। টাল সামলাতে পারে না, নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, চোখে কেমন অন্ধকার দেখে, এত অন্ধকার কোথা থেকে এলো, বুকের ভেতর একটু ভারী বোধ হলো, সনাতন অনেক দূরে দেখতে পেলো একটা শ্মশান, যেখানে তার মা-বাবার শেষকৃত্য করা হয়েছিল, শত মানুষের হরি ধ্বনিতে মুখরিত হলেও সনাতন স্তব্ধ হয়ে আছে, তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, শব্দগুলো ক্রমেই হারিয়ে গেলেও সনাতন নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়ায়, তাকে যেতে হবে আরো অনেকটা দূরে, কত মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে, ওদিকে চিতার দাউ-দাউ আগুনে ভস্ম হচ্ছে মানুষের মাটির প্রতিমা, শরীর যেন শরীর নয় একেকটা মূর্তি, সে মূর্তি কীভাবে প্রাণ ফিরে পাবে জানে না, কিন্তু সনাতন জানে ভালোবাসা থাকলে পাথরেও প্রাণ ফিরে পায়, মাটির মূর্তিও কথা বলে যদি সে মানুষের ভালোবাসা পায়। া
বিষয় : গল্প আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ
মন্তব্য করুন