
ছবি ::সাইদুর রহমান
এবার ঈদে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। একটি দড়িতে ঝুলে আছে কয়েকজন মানুষ। দড়িটি ঝুলে আছে একটি ফেরিতে। দৃশ্যটি হৃদয়বিদারক। দড়িতে ঝুলে তারা বাড়ির পথে। ক'ঘণ্টা তারা ঝুলে থাকতে পারবে? কিন্তু ঘরের টান তাদের সবকিছু বিস্মৃত করেছে। ছবিটি দেখে আমার প্রথমেই মনে হয়েছে কোথায় ছুটে চলেছে তারা? ঘরে?
ঘর কি? দু'টুকরো টিনের একটি শেড? কিংবা অপেক্ষমাণ কোনো মুখ? নাড়ির ভেতর থেকে ডেকে ওঠা কোনো সম্পর্ক? নদীর ওপর দিয়ে ভেসে আসা পরিচিত হাওয়া? এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটি?
সেবার দেশে ফেরার মুখে ঈদ ছিল। দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রানজিটে বসে আছি। রিয়াদ থেকে কলকল করতে করতে একদল দেশি ভাইবোন মুহূর্তে নীরব-নির্জন কর্নারটি মুখর করে তুললেন। সবাই ঘরে ফিরছেন। ঘর। তাদের আনন্দ দিগন্ত ছুঁয়েছে। একে অপরকে চিনুক বা চিনুক যার যার কাজ, 'মালিক', ছুটি, কতদিন থাকবেন, কত টাকা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন সব হড়হড় করে নিজেদের ভেতর শেয়ার করে যাচ্ছেন। কেউ ছেলের বিয়ে দেবেন। হবু বউয়ের বয়স, পরিবার, গায়ের রং সব একনাগাড়ে বলে চলেছেন। অদূরে এক বোন কান থেকে টেলিফোন নামাচ্ছেনই না। তার কথা সশব্দে। কাউকে টাকা-পয়সার বিষয়ে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন। মুহূর্তে আমি যেন একটি হট্টগোলের ভেতর পড়ে গেলাম। মজার বিষয়, আমার একদম খারাপ লাগছে না। আমি অপূর্ব এক অনুভবে স্নাত হয়ে ওদের ভেতর বসে বসে ভাবছি, আমার কি ওদের মতো কোনো ঘর আছে?
দূরে কোনো এক উঠোনের গরু দেখতে পাচ্ছি। তাদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। গোয়ালে গোবর ভুসি জল মিশে কেমন একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির খুব আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য অপেক্ষায় বাড়ির মানুষরা। সে বাড়ি বুঝি ঘর!
'ঘর' কি দৃশ্যমান কোনো আবাস নাকি ভেতরে বাস করা কোনো স্বপ্ন? কোনো কল্পনা এবং মোহ? যা আমাদের কল্পনায় কেবল তৈরি হয়? মনের গভীরে থিতু হওয়ার এক কল্পনার মানসিক অবস্থান। এক নিরাপত্তাবোধ?
একদিন আমার একটি ঘর হবে। আমার ঘর। আমার আপন কেউ আমাকে দেখে চিনে ফেলবে। এবং ঘরটিও। সেখানে বসে আমি কারও সঙ্গে বসে পাজল মেলানো খেলা খেলব।
তবু কেন মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকেনি কোনোদিন? ঘর নয়, বেরিয়ে পড়াই মানুষের প্রকৃতি। চার দেয়াল মানুষকে বন্দি রাখতে পারেনি। পথই হয় তার গন্তব্য। সে ঘুরে বেড়ায় বনবাদাড়। সমুদ্রে নাও ভাসায়। বিপদে শ্বাপদে নিজেকে সমর্পণ করে।
অজানাকে জানার নেশায় নেশাতুর ঘোরে। একদিন ক্লান্ত হয়। জলের পরে মাথা রেখে ঘর ঘর বলে কাঁদে। এ মানুষের এক গভীর টানাপোড়েন।
পৃথিবীর বড় বড় রিফিউজি ক্যাম্প ঘর হারানো মানুষগুলো তাঁবু থেকে তাঁবুতে ঘুরে ফেরে। কি অর্থ তাদের কাছে ঘর?
রাজধানী শহরের রোড ডিভাইডারের ওপর বসে শ্রমিক নারীকে রাতের রান্না বসাতে দেখেছি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত হাতে রান্না সেরে নিচ্ছে সে কেরোসিনের চুলোয়। চুলো ঘিরে ঘর ঘর একটা দৃশ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে।
কোনো এক রসুইঘর। গনগনে আগুনে ভাত ফুটছে। চুলোর চারপাশে নানা ধরনের কৌটাকৌটি। আনাজ কুটা বঁটি। তেলের শিশি। ইলিশ ভাজার চনমনে গন্ধ চারপাশ ছড়িয়ে পড়েছে। উঠোন থেকে হাঁক আসছে, বউ সালুন হইতে কতক্ষণ?
ঘর। সে ঘর ছেড়ে গৃহহীন এক নারী নগরের যানবাহনের ভিড়ে খোলা আকাশের নিচে বসেছে দুটো ভাত ফুটোতে। তার কাছে ঘরের অর্থ জানতে মন চায়।
পৃথিবীর রিফিউজি গল্পগুলো এক রকম। জীবনসায়াহ্নে হাতড়ে ফিরছে শৈশবের ঘর। এই যে টানাপোড়েন কিসের? আমি নিজেও অনেকবার আমার শৈশবের বাড়িতে ছুটে গেছি 'ঘর' ভেবে। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেবেছি, না আসলেই ভালো হতো। থাকত আমার কল্পনায় সে ঘরখানি, যে ঘরকে আমি আপন ঘর মনে করেছি। মূলত 'আপন ঘর' বলে কিছু এক্সিস্ট করে বলেও আমার মনে হয় না। ঘর সে নিজে। তার আপন আলয়। আপন অর্জন। আপন নিরাপত্তা।
চৌকাঠ পার হয়ে পৃথিবীতে বেরিয়ে, পেছন ফিরে দেখা। যেখানে ফেরার জায়গাটুকুন হাত বাড়িয়ে থাকে সেটাই কি তবে ঘর?
ঘর কি? দু'টুকরো টিনের একটি শেড? কিংবা অপেক্ষমাণ কোনো মুখ? নাড়ির ভেতর থেকে ডেকে ওঠা কোনো সম্পর্ক? নদীর ওপর দিয়ে ভেসে আসা পরিচিত হাওয়া? এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটি?
সেবার দেশে ফেরার মুখে ঈদ ছিল। দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রানজিটে বসে আছি। রিয়াদ থেকে কলকল করতে করতে একদল দেশি ভাইবোন মুহূর্তে নীরব-নির্জন কর্নারটি মুখর করে তুললেন। সবাই ঘরে ফিরছেন। ঘর। তাদের আনন্দ দিগন্ত ছুঁয়েছে। একে অপরকে চিনুক বা চিনুক যার যার কাজ, 'মালিক', ছুটি, কতদিন থাকবেন, কত টাকা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন সব হড়হড় করে নিজেদের ভেতর শেয়ার করে যাচ্ছেন। কেউ ছেলের বিয়ে দেবেন। হবু বউয়ের বয়স, পরিবার, গায়ের রং সব একনাগাড়ে বলে চলেছেন। অদূরে এক বোন কান থেকে টেলিফোন নামাচ্ছেনই না। তার কথা সশব্দে। কাউকে টাকা-পয়সার বিষয়ে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন। মুহূর্তে আমি যেন একটি হট্টগোলের ভেতর পড়ে গেলাম। মজার বিষয়, আমার একদম খারাপ লাগছে না। আমি অপূর্ব এক অনুভবে স্নাত হয়ে ওদের ভেতর বসে বসে ভাবছি, আমার কি ওদের মতো কোনো ঘর আছে?
দূরে কোনো এক উঠোনের গরু দেখতে পাচ্ছি। তাদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। গোয়ালে গোবর ভুসি জল মিশে কেমন একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির খুব আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য অপেক্ষায় বাড়ির মানুষরা। সে বাড়ি বুঝি ঘর!
'ঘর' কি দৃশ্যমান কোনো আবাস নাকি ভেতরে বাস করা কোনো স্বপ্ন? কোনো কল্পনা এবং মোহ? যা আমাদের কল্পনায় কেবল তৈরি হয়? মনের গভীরে থিতু হওয়ার এক কল্পনার মানসিক অবস্থান। এক নিরাপত্তাবোধ?
একদিন আমার একটি ঘর হবে। আমার ঘর। আমার আপন কেউ আমাকে দেখে চিনে ফেলবে। এবং ঘরটিও। সেখানে বসে আমি কারও সঙ্গে বসে পাজল মেলানো খেলা খেলব।
তবু কেন মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকেনি কোনোদিন? ঘর নয়, বেরিয়ে পড়াই মানুষের প্রকৃতি। চার দেয়াল মানুষকে বন্দি রাখতে পারেনি। পথই হয় তার গন্তব্য। সে ঘুরে বেড়ায় বনবাদাড়। সমুদ্রে নাও ভাসায়। বিপদে শ্বাপদে নিজেকে সমর্পণ করে।
অজানাকে জানার নেশায় নেশাতুর ঘোরে। একদিন ক্লান্ত হয়। জলের পরে মাথা রেখে ঘর ঘর বলে কাঁদে। এ মানুষের এক গভীর টানাপোড়েন।
পৃথিবীর বড় বড় রিফিউজি ক্যাম্প ঘর হারানো মানুষগুলো তাঁবু থেকে তাঁবুতে ঘুরে ফেরে। কি অর্থ তাদের কাছে ঘর?
রাজধানী শহরের রোড ডিভাইডারের ওপর বসে শ্রমিক নারীকে রাতের রান্না বসাতে দেখেছি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত হাতে রান্না সেরে নিচ্ছে সে কেরোসিনের চুলোয়। চুলো ঘিরে ঘর ঘর একটা দৃশ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে।
কোনো এক রসুইঘর। গনগনে আগুনে ভাত ফুটছে। চুলোর চারপাশে নানা ধরনের কৌটাকৌটি। আনাজ কুটা বঁটি। তেলের শিশি। ইলিশ ভাজার চনমনে গন্ধ চারপাশ ছড়িয়ে পড়েছে। উঠোন থেকে হাঁক আসছে, বউ সালুন হইতে কতক্ষণ?
ঘর। সে ঘর ছেড়ে গৃহহীন এক নারী নগরের যানবাহনের ভিড়ে খোলা আকাশের নিচে বসেছে দুটো ভাত ফুটোতে। তার কাছে ঘরের অর্থ জানতে মন চায়।
পৃথিবীর রিফিউজি গল্পগুলো এক রকম। জীবনসায়াহ্নে হাতড়ে ফিরছে শৈশবের ঘর। এই যে টানাপোড়েন কিসের? আমি নিজেও অনেকবার আমার শৈশবের বাড়িতে ছুটে গেছি 'ঘর' ভেবে। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেবেছি, না আসলেই ভালো হতো। থাকত আমার কল্পনায় সে ঘরখানি, যে ঘরকে আমি আপন ঘর মনে করেছি। মূলত 'আপন ঘর' বলে কিছু এক্সিস্ট করে বলেও আমার মনে হয় না। ঘর সে নিজে। তার আপন আলয়। আপন অর্জন। আপন নিরাপত্তা।
চৌকাঠ পার হয়ে পৃথিবীতে বেরিয়ে, পেছন ফিরে দেখা। যেখানে ফেরার জায়গাটুকুন হাত বাড়িয়ে থাকে সেটাই কি তবে ঘর?
বিষয় : প্রচ্ছদ শেখ তাসলিমা মুন আহারে ঘর
মন্তব্য করুন