
ছবি ::রেজওয়ান রাজ্জাক
ঘরের স্বপ্নই মানুষের আদিম নেশা। আদিম মানুষ প্রতিকূল প্রকৃতির মাঝে অস্তিত্বের লড়াইয়ে প্রথমেই চেয়েছে একটি ঘর। গাছের ডালে, পাথরের গুহায় নির্মাণ করছে সে ঘর। খ্রিস্টপূর্ব বিশ হাজার বছর আগে, বরফযুগের মানুষেরা বরফের ওপর ম্যামথের চামড়া আর হাড় দিয়ে নির্মাণ করেছে ঘর। তারপর মানুষ শিখেছে ঘর বানানোর আরও নানা কৌশল। বনের গাছগাছালি বাঁশ লতা পাতা দিয়ে। কাদামাটি দিয়ে। মাটি পুড়িয়ে পাকা মাটির টুকরো জড়ো করে। ইট রড সিমেন্ট কাচ দিয়ে। তারপর মানুষ আবিস্কার করেছে ঘর নির্মাণের আরও আরও নানা কৌশল। মানুষ ঘর চায়। চার দেয়াল তৈরি তার ভেতর এক নিরাপত্তাবোধ, একান্ত জীবনযাপনের আনন্দ। দেয়ালের বন্ধনের ভেতর মুক্তির আনন্দ। সে আনন্দে একান্তে সে প্রেম ভালোবাসা, স্নেহ উপযাপন করতে চায়, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়। এমনকি যে মুনি ঘর ছেড়ে বনবাসে যান, তাকেও বনের ভেতর একটি পর্ণকুটির বানাতে হয়। গৌতম রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পূর্ণিমার রাতে মানুষের দুঃখ নিবারণের উপায় খুঁজতে ঘর ছেড়েছিলেন। কিন্তু তাঁকেও আখেরে জনপদের প্রান্তে আশ্রম বানাতে হয় যেখানে শ্রমণরা ভিক্ষের খুদটুকু ভাগ করে খেতে খেতে তাঁর বাণীটুকু শান্তমনে বসে শুনতে পারে।
মানুষ যতদূর যায়, বুকের ভেতর একটি ঘরের স্বপ্ন বয়ে নিয়ে যায়। একটি ঘর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে মানুষ কত কত দেশ-বৈদেশ তন্নতন্ন করে বেড়ায়। কিন্তু মানুষের সেই একান্ত স্বপ্ন সহজে পূরণ হওয়ার নয়। দিন দিন সে স্বপ্ন পূরণের মূল্য আরও বেড়েই চলেছে। তাই দশ ফুট বাই দশ ফুট সেই ঘরের স্বপ্ন পূরণ করতে মানুষকে ছুটতে হয় দশদিগন্ত, ধুলো, রক্তমাখা পায়।
'একটুখানি ঘরের জন্যই তো
আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়
ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়।
দিগন্ত বিস্তারী আকাশও আমাকে এতটা
খোলা স্থান দিতে পারে না, যা পারে ছাদের নিচের এতটুকু।
আমি দশ ফুট বাই দশ ফুট ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত।
বৃক্ষকে সকলে প্রশংসা করে ছায়ার জন্যই তো?
অথচ কতই তুচ্ছ সে তোমার আঁচলের কাছে
আমি তোমার একটুখানি আঁচলের ছায়ার জন্য
কত না দ্রুত ঘরে ফিরি ধুলো, রক্তমাখা পায়।
শান্তা।'
(ঘর, প্রাচীন পুঁথির পৃষ্ঠা হতে, শোয়াইব জিবরান, জংশন, ঢাকা, ২০২০)
২.
আমার ঘরগুলোর গল্প বিচিত্র। খুব শৈশবে যখনে ভোর নামত, মায়ের ইউসুফ নবীর ঘর হারানোর নাগরি পুঁথিপাঠের ভেতর সে ঘরটি কীসের তৈরি ছিল ঠিক মনে পড়ে না। হয়তো মাটির উপর রবি দাদার ছাওয়া খড়ের চাল ছিল। হয়তো তাই ছিল বা ছিল না। কিন্তু ঘরের সে স্বপ্নটির কথা মনে আছে। বাবাকে সে স্বপ্নের ঘরের কথা বলেছিলাম। যে ঘরের চাল হবে ঢেউটিনের। দিনে সে টিনের উপর হাঁটবে পোষা কবুতরগুলো। তাদের পায়ের রিনিঝিনি শব্দ শোনা যাবে। আর রাত হলে নামবে বৃষ্টি। আমি ঘুমের ভেতর সে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পাবো। পিতা সত্যিই সে ঘরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। মাটির দেয়ালের উপর টিনের একটি ঘর। সে ঘরের ভেতরই আমি অতিক্রম করেছি আমার শৈশব কৈশোর। কত সে সকাল, রাত, দুপুর। বিকেলের মিষ্টি আলো পড়ত ঘরের ভেতর আর চালে শোনা যেত পায়রা যুগলের পায়ের রিনিঝিনি শব্দ। প্রথম প্রেমে পড়ার পর এ ঘরটির ভেতরই রাতে দু'চোখে ঘুম আসত তাকে কল্পনা করে, আর বৃষ্টির শব্দ তাল দিত স্বপ্নের ভেতর। কিন্তু এসএসসি পাস করার পর এ ঘরে আমার আর থাকা হয়নি। চলে যেতে হয়েছে দূরের শহরের হোস্টেলে। ততদিনে এ ঘরটির টিন বদলে পড়েছে পাকা ঢালাই। কিন্তু টিনের শব্দ থেকে আমি বঞ্চিত হইনি। কেননা এম সি কলেজের পঞ্চম ব্লকটিও ছিল টিনের তৈরি। মাঝে মধ্যেই সে চালে অচেনা পাখি বসতো। ক্লাস পালানো দুপুর উদাস করে দিত সেসব পাখির পায়ের শব্দ। আমাকে ফেলে আসা গ্রামের ঘরের তৃষ্ণা পেয়ে বসতো। মায়ের মুখ মনে পড়তো, ফেলে আসা প্রেমিকার মুখ মনে পড়ত। সরকারি হোস্টেলের সেই অর্ধাহার- অনাহারের দিন-রাতগুলো করুণ হয়ে উঠত বিকেলে। বন্ধুরা সব খেলতে মাঠে চলে যেত। আমি ছিলাম ঘরকুনো। হোস্টেলেই মন খারাপ করে শুয়ে থাকতাম। কাচের জানালা দিয়ে বিকেলের একচিলতে মিষ্টি রোদ এসে পড়ত বিছানায়। শুয়ে শুয়ে জগতের কত কল্পনাই না করতাম। কখনও হয়তো বের হয়ে বসতাম সামনে লম্বা বারান্দা থেকে মাঠের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়িতে। সূর্য বিকেলের আলো ছড়াতো দক্ষিণের নীল পাহাড়ের উপরে। মনে হতো ওই পাহাড় পার হলেই তো আমার ফেলে আসা ঘর। মা। মায়ের ঘর। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরপুরের সে ঘরে আর স্থায়ীভাবে কখনই আমার ফেরা হয়নি। এইচএসসি পাস করার পর চলে আসি ঢাকা শহরে। এসে উঠি পুরাতন ঢাকার সিদ্দিক বাজারের এক অন্ধকার খুপরি ঘরে। সেখান থেকে পরে ফকিরাপুলের গু কালারের এক ভবনের ততোধিক নোংরা ঘরে। এগুলো ছিল নামেই হোটেল। আদতে গ্রাম থেকে চিকিৎসা বা শ্রমিক হিসেবে বিদেশ যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হওয়া মানুষদের ভাড়া ঘর। এক একটি ঘর বা কক্ষে গাদাগাদি করে চার থেকে আটজন থাকার ব্যবস্থা। বারান্দার কোনায় নোংরা টয়লেট আর বাথরুম। ফকিরাপুলের ওই অস্থায়ী ঘর বা রুম ছেড়ে এক সময় উঠি ১৮৪, ফকিরাপুল মেসবাড়িতে। একটি ছয় ফুট বাই দশ ফুট ছোট্ট ঘরে তিনজন। আমি, মুজিব ইরম আর আতিক রহমান। আমাদের ঘরটির ছাদের ঠিক নিচেই খাবার হোটেলের রান্নার চুলা। সারা দিন টগবগিয়ে ফোটে ভাত আর পুড়াপুড়া নানা তরকারি। উপরে আমরাও রান্না হই ৬ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে। মতিঝিলপাড়ার করুণ কেরানিকুল, নটর ডেম কলেজে পড়া বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া অনাহারী, অর্ধাহারী শ্রমণ দল আর ফকিরাপুলের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর চতুর আদম পাচারকারী মানুষের দঙ্গল চারপাশে। আর সারদিন ঘট ঘট ঘটা ঘট ঘষ ঘষ প্রেসের শব্দ ও নকল টোকা কালির গন্ধ। সে ছোট্ট ঘরটিতে আমাকে থাকতে হয় অনেক দিন। তারপর একসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে জলাশয়ের পাশে বরাদ্দ পাই টিনশেডের আরেকটি ঘর। কক্ষ নম্বর ১০০৫ আমার ঘর। কেতাবি নাম আল বেরুনি এক্সটেনশন হলেও লোকে ডাকে জিল্লুর রহমান টেক্সটাইল বলে। পোশাক কারখানার মতোই তার গড়ন। লম্বা লম্বা টিনশেডের ভবন। আর রুমগুলো একটু বড় হলেও প্রতিটি রুমে চারজন করে থাকতে হয়। যথারীতি কমন বাথরুম টয়লেট। টয়লেটের গায়ে হয়তো লেখা আছে- 'হে জ্ঞানী, কাম করিয়া ঢালুন পানি।' জ্ঞানীরা আর পানি ঢালে না। ফলে 'সুগন্ধ' ওই এলাকায় ভুরভুর করে। ঘরটির জানালার সামনে মাঠ আর বাগান থাকলেও সাপ আর তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সংগঠনের ছেঁচড়া পাতি ছাত্রনেতাদের উৎপাত লেগেই থাকে। একদিন গোসল করছি উদোম হয়ে। আর ঠিক তখনই উপরের পানির পাইপ থেকে লাফ দিয়ে একটি সবুজ সাপ বদ্ধ বাথরুমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তো ভয় পাই-ই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ভয় পায় বেচারাও। ফলে তখনই আমাদের মধ্যে ছোট্ট দরজা-বন্ধ ঘরটিতে চক্রাকারে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কয়েক চক্কর দেওয়ার পরই আমি নিজেকে উদোম বাইরে আবিস্কার করি। সবুজ সাপটি পালিয়ে বাঁচে। এই টিনশেডের ঘর থেকে বছরখানেক পর প্রমোশন পাই লাল ইটের দুর্গের আল বেরুনি হলের মূল ভবনে। এবার কক্ষ ১১০ আমার ঘর। এ ঘরটি ছিল পরিত্যক্ত। সে সময়ের ছাত্রনেতারা এ ঘরে অস্ত্র আর নেশার জিনিসপত্র রাখত। গাঁজার কল্ক্কে আর কাটা বন্দুক সরিয়ে এ ঘরটিকে যখন বাসযোগ্য করে তুলি- তখন জানালার সামনের জলাশয় আর মাঠ; জানালার সামনের আতাগাছটির ফাঁক দিয়ে অদূরের মেয়েদের হলটির বারান্দা জেগে ওঠে। ঘরের সামনের মাঠের ওপারে শীতের কুয়াশা, বর্ষার বৃষ্টি আর শরতের আকাশ অপরূপ হয়ে ধরা দেয়। এ ঘরটিতে আমি অনেকগুলো বছর থাকি। এর মধ্যে সংবাদপত্রে চাকরি হয়ে গেলে আমাকে ঢাকায় আবার আরেকটি ঘরের সন্ধান করতে হয়। এজিবি কলোনির এক কর্মচারীর ঘরে সাবলেট ভাড়া করি। আমি আর আমার আরেক সহকর্মী মাসুম থাকি। একটিই বাথরুম, একটিই রান্নাঘর। ছোট ছোট রুম। ঘরের মালিক মহিলার স্বামী পক্ষাঘাতের রোগী। বিছানায়ই বাহ্য ত্যাগ করেন। সকাল থেকে তাকে ঘর থেকে বেরোনোর মুখে বসিয়ে রাখা হয়। তিনি ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকেন আর তার শরীর থেকে উৎকট গন্ধ সারাঘর ছড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে পরে আরেকটি সাবলেট ঘর ভাড়া করি। দুই রুমের বাসা। মহিলা অফিস কেরানি আর স্বামী কী জানি ফটকা ব্যবসা করেন। তাদের পরস্পরের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দেখা হওয়া মাত্র যুদ্ধ শুরু হয়। সারারাত যুদ্ধ চলে। মাঝে মাঝে ঝগড়া শেষে খানিক মিল মহব্বত হলে মিথুনও চলে। আমরা দুই সহকর্মী পাশের ঘর থেকে সব শব্দ শুনতে পাই। আর মুচকি মুচকি হাসি। অবশ্য আমাদেরও শান্তি লাগে। ভালো লাগে। পরস্পরের ঘৃণার গুলির অশ্নীল শব্দ থেকে ভালোবাসার চুমুর পবিত্র শব্দ কার না ভালো লাগে?
এক সময় নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুটির সাথে ঘর বাঁধি। সেই এজিবি কলোনিরই এক ঘরে। ঘরের মালিক সরকারি অফিসের গাড়িচালক। বউটিও বেশ ভালো। সহমর্মী। তাদের দুটো ফুটফুটে মেয়ে। আট ফুট বাই দশ ফুট ঘরটি আমার বন্ধু নিজের মতো সাজাতে চেষ্টা করে। একটি বাথরুম একটি রান্নাঘর যথারীতি। এই ছোট্ট ঘরটিতেও চাঁদের আলো আসে। আমরা লাভ মেকিং করি। দেখাদেখি সাথের পরিবারটিও। কবি বন্ধুরা হঠাৎ হঠাৎ দল বেঁধে আসে। আমাদের খাবারের বাড়তি থালা নেই, প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল নেই। বউটি আমাদের এসব দিয়ে সাহায্য করে। তারপর আমরা ডেরা বাঁধি ৭ রাজচন্দ্র মুন্সী লেনের আড়াইতলা ঘরের ছাদে। একটি মাত্র ঘর। ছাদের ওপর পাশে রান্নাঘর আর বাথরুম। রাতে এ ঘর থেকে সে ঘরে গেলেও ছাদের ওপারে মুক্ত আকাশ চোখে পড়ে। এক যুগ এই ছাদের ঘরে কাটিয়ে এক সময় এই লেনেরই পাশের একটি নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করি। সেখানেও থাকি অনেকগুলো দিন। তারপর আমার সহপাঠী বন্ধুটির সরকারি চাকরির পোস্টিং হয়ে যায় টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে। আমি তখন তিন বছরের ইউজিসি স্কলারশিপে শিক্ষাছুটিতে। ফলে ঢাকায় আলাদা থাকার মানে নেই। তল্পিতল্পা গুটিয়ে টাঙ্গাইলে রওনা হই। টাঙ্গাইলের রেজিস্ট্রিপাড়ার মাঠের কোনায় একটি দ্বিতল ভবনে তিন রুমের ঘর ভাড়া করি। ঘরটি ছিল গুদামঘরের মতো। হাওয়া-বাতাসের চলাচল কম। সারক্ষণ গরম গুমোট হয়ে থাকত। তার মধ্যে আমার বন্ধুটির প্রশিক্ষণের ডাক পড়ে নায়েমে। আমাদের আবার ঘর বদলাতে হয়। এবার এক বছরের শিশুপুত্রের কথা চিন্তা করে বাসা নিই সাভারের আত্মীয়ের বাড়ির দোতলায়, ব্যাংক কলোনিতে। ব্যাংক কলোনি ততদিনে অনেক ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে শীতের দিনের ধুলো। ততদিনে আমার শিক্ষাছুটি শেষ হয়ে আসে। আমাকে অফিসে যোগ দিতে হয়। সাভার থেকে গাজীপুর আসা-যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঘরের জন্য আবেদন করি। পেয়েও যাই। দারুণ ছিল সে ঘরগুলো। গাছগাছালির সবুজ প্রকৃতির জঙ্গলের ভেতর লাল ইটের ঘর। কিন্তু সে ঘরের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কন্যা ততদিনে নবম শ্রেণিতে ওঠে। তারপর পড়াশোনার অসুবিধা তৈরি হয়। ফলে আমরা উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে একটি দুই রুমের ঘর ভাড়া করি। ঘরটি সুন্দর। কিন্তু পাশে আবাসিক হোটেল আর দোকানপাট থাকায় সারাদিন মানুষের চেঁচামেচি আর চিৎকার লেগে থাকে। আমরা বিকেলে উত্তরা সেক্টর ৯ আর ১১ এর মাঝখানের লেকটির পাড়ে হাঁটতে যাই। আর তখনই একদম লেকের পাড়ের একটি ঘর আমাদের চোখে পড়ে। বাড়ি ১, সড়ক ৫ সেক্টর ১১। লেকের উপর সবুজ গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি। একদিন আমরা গিয়ে খোঁজ নিই। আপাতত খালি নেই। পরে খালি হলে খোঁজ নিয়েন। কিন্তু যে ভাড়া বলে তা আমাদের সাধ্যর বাইরে মনে হতে থাকে। আমরা মন খারাপ করে প্রায় দিন বিকেলে লেকের এপারে হাঁটতে থাকি আর সে ঘরটিকে দেখতে থাকি। এক সময় আমাদের সে ঘরটিতে বাস করার সাধ স্বপ্ন হয়ে উঠতে থাকে। আর জলের পাশে থাকা আমার বন্ধুটির আজীবনের সাধ। একদিন সত্যিই সে বাড়িতে ঘর খালি হয়। আমরা সাধ্যের বাইরেও ভাড়া দিয়ে সাহস করে উঠে পড়ি। তারপর এক দশক সে ঘরটিতেই বাস করি। লেকের উপর গাছে গাছে পাখি ডাকা ঘর। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি এ ঘরটির মালিক আমরা নই। যে কোনো দিন মালিক উঠিয়ে দিতে পারে। এই দীর্ঘদিন এখানে থাকার ফলে বিভিন্ন যোগাযোগে এ ঘরটির ঠিকানা ব্যবহার করতে হয়েছে। মালিক তাড়িয়ে দেওয়া মাত্র ঠিকানাটি মিথ্যে হয়ে যাবে। একটি নিজ নামের ঠিকানার ঘরের তৃষ্ণা আমাদের তৈরি হয়। কিন্তু জলের পাশে পাখি ডাকা একটি ঘর কেনা কি এই শহরে সহজ? চাকরিজীবীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভবও বটে। এর মধ্যেই একদিন সরকারি একটি নতুন আবাসনের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় আসে। উত্তরার নতুন সেক্টর। কাশবন আর জলের মাঝখানে। তখন সঞ্চয়মাত্র আছে কয়েকটি টাকা। এটা দিয়ে বড়জোর আবেদন আর নিরাপত্তার জামানত হতে পারে। তবুও কিছু না ভেবেই আবেদন করে বসি। কিছুদিন পর স্বায়ত্তশাসিত চাকরি কোটায় একটি ঘর বরাদ্দ পেয়েও যাই। কিন্তু সরকারি যে কোনো কামে যেমন ঢিলে তাল আর নানা নখরামি থাকে, এ ঘরটি নিয়েও তা চলতে থাকে। আমি আর আমার আরেক কবিবন্ধু মিলে প্রায় দিনই নির্মাণাধীন সে ঘরটিকে দেখতে যাই। গিয়ে আমরা কোথায় বই রাখব সে পরিকল্পনা করতে থাকি। কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে? বহু বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিংয়ে কিস্তি দিয়ে দিয়ে এক খণ্ড জমি কিনেছিলাম। সেটি বিক্রি করি। তাতে দুই কিস্তি চলে। তারপর বাকি ছয় কিস্তি। এর মধ্যে ইউনিসেফে পরামর্শকের কাজ পেয়ে যাই। উচ্চ ডলারে। টাকার চিন্তা হাওয়া হয়ে যায়। চূড়ান্ত বেহিসাবি হয়ে উঠি। আর বছরখানেক পর ইউনিসেফের সে প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে যায়। এবার ঘরটির বাকি কিস্তির জোগান? এবার বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসে। গৃহঋণ পাই। ঋণের বোঝা তৈরি হলেও নিজের একটি ঘর হয়। জলের উপরে একটি ঘর। এ ঘরটিতে বাসের কয়েক মাসের মাথায়ই বন্ধুরা ফেসবুকে দুষ্টুমি করে একটি ঘোষণা দেয়। কবি শোয়াইব জিবরানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি গঠন। এই দুষ্টুমির ভেতর আমি গুনে দেখি বেলা তো সত্যিই কম হলো না। করোনায় মানুষ চারদিকে মরছে। আর আয়না আমাকে পাকা চুলও দেখাচ্ছে। বুঝতে না বুঝতেই খেলার প্রথমার্ধ শেষ হয়ে গেছে। শূন্যের উপর দশ ফুট বাই দশ ফুটের পাকা ঘর ছেড়ে দশ হাত মাটির স্থায়ী ঘরে যাওয়ার দিন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে।
ঘাসের ছাউনি দেওয়া এমনি একটি মাটির ঘরে শুয়ে আছেন আমার বাবা মা সাং সিদ্ধেশ্বরপুরে। আমাকেও সেখানে যেতে হবে। শৈশবের সে টিনের ঘরটি আর নেই। আর সে ঘরটি আর ফিরে পাবার উপায়ও নেই। আর সময় নেই টিনের চালে পাখির পায়ের নূপুর বা বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শোনার স্বপ্ন দেখার। তবে পৃথিবীতে বৃষ্টি পড়া তো থেমে যাবে না। সিদ্ধেশ্বরপুরেও অমনি বৃষ্টি হবে।
বৃষ্টি পড়বে টুপটাপ ঘাসের উপর। কিন্তু আমি হয়তো শুনতে পাবো না। শুয়ে রবো। ঘরের স্বপ্নে জাগিব না আর চিরনিদ্রার ভেতর। া
মানুষ যতদূর যায়, বুকের ভেতর একটি ঘরের স্বপ্ন বয়ে নিয়ে যায়। একটি ঘর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে মানুষ কত কত দেশ-বৈদেশ তন্নতন্ন করে বেড়ায়। কিন্তু মানুষের সেই একান্ত স্বপ্ন সহজে পূরণ হওয়ার নয়। দিন দিন সে স্বপ্ন পূরণের মূল্য আরও বেড়েই চলেছে। তাই দশ ফুট বাই দশ ফুট সেই ঘরের স্বপ্ন পূরণ করতে মানুষকে ছুটতে হয় দশদিগন্ত, ধুলো, রক্তমাখা পায়।
'একটুখানি ঘরের জন্যই তো
আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়
ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়।
দিগন্ত বিস্তারী আকাশও আমাকে এতটা
খোলা স্থান দিতে পারে না, যা পারে ছাদের নিচের এতটুকু।
আমি দশ ফুট বাই দশ ফুট ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত।
বৃক্ষকে সকলে প্রশংসা করে ছায়ার জন্যই তো?
অথচ কতই তুচ্ছ সে তোমার আঁচলের কাছে
আমি তোমার একটুখানি আঁচলের ছায়ার জন্য
কত না দ্রুত ঘরে ফিরি ধুলো, রক্তমাখা পায়।
শান্তা।'
(ঘর, প্রাচীন পুঁথির পৃষ্ঠা হতে, শোয়াইব জিবরান, জংশন, ঢাকা, ২০২০)
২.
আমার ঘরগুলোর গল্প বিচিত্র। খুব শৈশবে যখনে ভোর নামত, মায়ের ইউসুফ নবীর ঘর হারানোর নাগরি পুঁথিপাঠের ভেতর সে ঘরটি কীসের তৈরি ছিল ঠিক মনে পড়ে না। হয়তো মাটির উপর রবি দাদার ছাওয়া খড়ের চাল ছিল। হয়তো তাই ছিল বা ছিল না। কিন্তু ঘরের সে স্বপ্নটির কথা মনে আছে। বাবাকে সে স্বপ্নের ঘরের কথা বলেছিলাম। যে ঘরের চাল হবে ঢেউটিনের। দিনে সে টিনের উপর হাঁটবে পোষা কবুতরগুলো। তাদের পায়ের রিনিঝিনি শব্দ শোনা যাবে। আর রাত হলে নামবে বৃষ্টি। আমি ঘুমের ভেতর সে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পাবো। পিতা সত্যিই সে ঘরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। মাটির দেয়ালের উপর টিনের একটি ঘর। সে ঘরের ভেতরই আমি অতিক্রম করেছি আমার শৈশব কৈশোর। কত সে সকাল, রাত, দুপুর। বিকেলের মিষ্টি আলো পড়ত ঘরের ভেতর আর চালে শোনা যেত পায়রা যুগলের পায়ের রিনিঝিনি শব্দ। প্রথম প্রেমে পড়ার পর এ ঘরটির ভেতরই রাতে দু'চোখে ঘুম আসত তাকে কল্পনা করে, আর বৃষ্টির শব্দ তাল দিত স্বপ্নের ভেতর। কিন্তু এসএসসি পাস করার পর এ ঘরে আমার আর থাকা হয়নি। চলে যেতে হয়েছে দূরের শহরের হোস্টেলে। ততদিনে এ ঘরটির টিন বদলে পড়েছে পাকা ঢালাই। কিন্তু টিনের শব্দ থেকে আমি বঞ্চিত হইনি। কেননা এম সি কলেজের পঞ্চম ব্লকটিও ছিল টিনের তৈরি। মাঝে মধ্যেই সে চালে অচেনা পাখি বসতো। ক্লাস পালানো দুপুর উদাস করে দিত সেসব পাখির পায়ের শব্দ। আমাকে ফেলে আসা গ্রামের ঘরের তৃষ্ণা পেয়ে বসতো। মায়ের মুখ মনে পড়তো, ফেলে আসা প্রেমিকার মুখ মনে পড়ত। সরকারি হোস্টেলের সেই অর্ধাহার- অনাহারের দিন-রাতগুলো করুণ হয়ে উঠত বিকেলে। বন্ধুরা সব খেলতে মাঠে চলে যেত। আমি ছিলাম ঘরকুনো। হোস্টেলেই মন খারাপ করে শুয়ে থাকতাম। কাচের জানালা দিয়ে বিকেলের একচিলতে মিষ্টি রোদ এসে পড়ত বিছানায়। শুয়ে শুয়ে জগতের কত কল্পনাই না করতাম। কখনও হয়তো বের হয়ে বসতাম সামনে লম্বা বারান্দা থেকে মাঠের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়িতে। সূর্য বিকেলের আলো ছড়াতো দক্ষিণের নীল পাহাড়ের উপরে। মনে হতো ওই পাহাড় পার হলেই তো আমার ফেলে আসা ঘর। মা। মায়ের ঘর। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরপুরের সে ঘরে আর স্থায়ীভাবে কখনই আমার ফেরা হয়নি। এইচএসসি পাস করার পর চলে আসি ঢাকা শহরে। এসে উঠি পুরাতন ঢাকার সিদ্দিক বাজারের এক অন্ধকার খুপরি ঘরে। সেখান থেকে পরে ফকিরাপুলের গু কালারের এক ভবনের ততোধিক নোংরা ঘরে। এগুলো ছিল নামেই হোটেল। আদতে গ্রাম থেকে চিকিৎসা বা শ্রমিক হিসেবে বিদেশ যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হওয়া মানুষদের ভাড়া ঘর। এক একটি ঘর বা কক্ষে গাদাগাদি করে চার থেকে আটজন থাকার ব্যবস্থা। বারান্দার কোনায় নোংরা টয়লেট আর বাথরুম। ফকিরাপুলের ওই অস্থায়ী ঘর বা রুম ছেড়ে এক সময় উঠি ১৮৪, ফকিরাপুল মেসবাড়িতে। একটি ছয় ফুট বাই দশ ফুট ছোট্ট ঘরে তিনজন। আমি, মুজিব ইরম আর আতিক রহমান। আমাদের ঘরটির ছাদের ঠিক নিচেই খাবার হোটেলের রান্নার চুলা। সারা দিন টগবগিয়ে ফোটে ভাত আর পুড়াপুড়া নানা তরকারি। উপরে আমরাও রান্না হই ৬ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে। মতিঝিলপাড়ার করুণ কেরানিকুল, নটর ডেম কলেজে পড়া বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া অনাহারী, অর্ধাহারী শ্রমণ দল আর ফকিরাপুলের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর চতুর আদম পাচারকারী মানুষের দঙ্গল চারপাশে। আর সারদিন ঘট ঘট ঘটা ঘট ঘষ ঘষ প্রেসের শব্দ ও নকল টোকা কালির গন্ধ। সে ছোট্ট ঘরটিতে আমাকে থাকতে হয় অনেক দিন। তারপর একসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে জলাশয়ের পাশে বরাদ্দ পাই টিনশেডের আরেকটি ঘর। কক্ষ নম্বর ১০০৫ আমার ঘর। কেতাবি নাম আল বেরুনি এক্সটেনশন হলেও লোকে ডাকে জিল্লুর রহমান টেক্সটাইল বলে। পোশাক কারখানার মতোই তার গড়ন। লম্বা লম্বা টিনশেডের ভবন। আর রুমগুলো একটু বড় হলেও প্রতিটি রুমে চারজন করে থাকতে হয়। যথারীতি কমন বাথরুম টয়লেট। টয়লেটের গায়ে হয়তো লেখা আছে- 'হে জ্ঞানী, কাম করিয়া ঢালুন পানি।' জ্ঞানীরা আর পানি ঢালে না। ফলে 'সুগন্ধ' ওই এলাকায় ভুরভুর করে। ঘরটির জানালার সামনে মাঠ আর বাগান থাকলেও সাপ আর তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সংগঠনের ছেঁচড়া পাতি ছাত্রনেতাদের উৎপাত লেগেই থাকে। একদিন গোসল করছি উদোম হয়ে। আর ঠিক তখনই উপরের পানির পাইপ থেকে লাফ দিয়ে একটি সবুজ সাপ বদ্ধ বাথরুমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তো ভয় পাই-ই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ভয় পায় বেচারাও। ফলে তখনই আমাদের মধ্যে ছোট্ট দরজা-বন্ধ ঘরটিতে চক্রাকারে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কয়েক চক্কর দেওয়ার পরই আমি নিজেকে উদোম বাইরে আবিস্কার করি। সবুজ সাপটি পালিয়ে বাঁচে। এই টিনশেডের ঘর থেকে বছরখানেক পর প্রমোশন পাই লাল ইটের দুর্গের আল বেরুনি হলের মূল ভবনে। এবার কক্ষ ১১০ আমার ঘর। এ ঘরটি ছিল পরিত্যক্ত। সে সময়ের ছাত্রনেতারা এ ঘরে অস্ত্র আর নেশার জিনিসপত্র রাখত। গাঁজার কল্ক্কে আর কাটা বন্দুক সরিয়ে এ ঘরটিকে যখন বাসযোগ্য করে তুলি- তখন জানালার সামনের জলাশয় আর মাঠ; জানালার সামনের আতাগাছটির ফাঁক দিয়ে অদূরের মেয়েদের হলটির বারান্দা জেগে ওঠে। ঘরের সামনের মাঠের ওপারে শীতের কুয়াশা, বর্ষার বৃষ্টি আর শরতের আকাশ অপরূপ হয়ে ধরা দেয়। এ ঘরটিতে আমি অনেকগুলো বছর থাকি। এর মধ্যে সংবাদপত্রে চাকরি হয়ে গেলে আমাকে ঢাকায় আবার আরেকটি ঘরের সন্ধান করতে হয়। এজিবি কলোনির এক কর্মচারীর ঘরে সাবলেট ভাড়া করি। আমি আর আমার আরেক সহকর্মী মাসুম থাকি। একটিই বাথরুম, একটিই রান্নাঘর। ছোট ছোট রুম। ঘরের মালিক মহিলার স্বামী পক্ষাঘাতের রোগী। বিছানায়ই বাহ্য ত্যাগ করেন। সকাল থেকে তাকে ঘর থেকে বেরোনোর মুখে বসিয়ে রাখা হয়। তিনি ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকেন আর তার শরীর থেকে উৎকট গন্ধ সারাঘর ছড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে পরে আরেকটি সাবলেট ঘর ভাড়া করি। দুই রুমের বাসা। মহিলা অফিস কেরানি আর স্বামী কী জানি ফটকা ব্যবসা করেন। তাদের পরস্পরের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দেখা হওয়া মাত্র যুদ্ধ শুরু হয়। সারারাত যুদ্ধ চলে। মাঝে মাঝে ঝগড়া শেষে খানিক মিল মহব্বত হলে মিথুনও চলে। আমরা দুই সহকর্মী পাশের ঘর থেকে সব শব্দ শুনতে পাই। আর মুচকি মুচকি হাসি। অবশ্য আমাদেরও শান্তি লাগে। ভালো লাগে। পরস্পরের ঘৃণার গুলির অশ্নীল শব্দ থেকে ভালোবাসার চুমুর পবিত্র শব্দ কার না ভালো লাগে?
এক সময় নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুটির সাথে ঘর বাঁধি। সেই এজিবি কলোনিরই এক ঘরে। ঘরের মালিক সরকারি অফিসের গাড়িচালক। বউটিও বেশ ভালো। সহমর্মী। তাদের দুটো ফুটফুটে মেয়ে। আট ফুট বাই দশ ফুট ঘরটি আমার বন্ধু নিজের মতো সাজাতে চেষ্টা করে। একটি বাথরুম একটি রান্নাঘর যথারীতি। এই ছোট্ট ঘরটিতেও চাঁদের আলো আসে। আমরা লাভ মেকিং করি। দেখাদেখি সাথের পরিবারটিও। কবি বন্ধুরা হঠাৎ হঠাৎ দল বেঁধে আসে। আমাদের খাবারের বাড়তি থালা নেই, প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল নেই। বউটি আমাদের এসব দিয়ে সাহায্য করে। তারপর আমরা ডেরা বাঁধি ৭ রাজচন্দ্র মুন্সী লেনের আড়াইতলা ঘরের ছাদে। একটি মাত্র ঘর। ছাদের ওপর পাশে রান্নাঘর আর বাথরুম। রাতে এ ঘর থেকে সে ঘরে গেলেও ছাদের ওপারে মুক্ত আকাশ চোখে পড়ে। এক যুগ এই ছাদের ঘরে কাটিয়ে এক সময় এই লেনেরই পাশের একটি নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করি। সেখানেও থাকি অনেকগুলো দিন। তারপর আমার সহপাঠী বন্ধুটির সরকারি চাকরির পোস্টিং হয়ে যায় টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে। আমি তখন তিন বছরের ইউজিসি স্কলারশিপে শিক্ষাছুটিতে। ফলে ঢাকায় আলাদা থাকার মানে নেই। তল্পিতল্পা গুটিয়ে টাঙ্গাইলে রওনা হই। টাঙ্গাইলের রেজিস্ট্রিপাড়ার মাঠের কোনায় একটি দ্বিতল ভবনে তিন রুমের ঘর ভাড়া করি। ঘরটি ছিল গুদামঘরের মতো। হাওয়া-বাতাসের চলাচল কম। সারক্ষণ গরম গুমোট হয়ে থাকত। তার মধ্যে আমার বন্ধুটির প্রশিক্ষণের ডাক পড়ে নায়েমে। আমাদের আবার ঘর বদলাতে হয়। এবার এক বছরের শিশুপুত্রের কথা চিন্তা করে বাসা নিই সাভারের আত্মীয়ের বাড়ির দোতলায়, ব্যাংক কলোনিতে। ব্যাংক কলোনি ততদিনে অনেক ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে শীতের দিনের ধুলো। ততদিনে আমার শিক্ষাছুটি শেষ হয়ে আসে। আমাকে অফিসে যোগ দিতে হয়। সাভার থেকে গাজীপুর আসা-যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঘরের জন্য আবেদন করি। পেয়েও যাই। দারুণ ছিল সে ঘরগুলো। গাছগাছালির সবুজ প্রকৃতির জঙ্গলের ভেতর লাল ইটের ঘর। কিন্তু সে ঘরের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কন্যা ততদিনে নবম শ্রেণিতে ওঠে। তারপর পড়াশোনার অসুবিধা তৈরি হয়। ফলে আমরা উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে একটি দুই রুমের ঘর ভাড়া করি। ঘরটি সুন্দর। কিন্তু পাশে আবাসিক হোটেল আর দোকানপাট থাকায় সারাদিন মানুষের চেঁচামেচি আর চিৎকার লেগে থাকে। আমরা বিকেলে উত্তরা সেক্টর ৯ আর ১১ এর মাঝখানের লেকটির পাড়ে হাঁটতে যাই। আর তখনই একদম লেকের পাড়ের একটি ঘর আমাদের চোখে পড়ে। বাড়ি ১, সড়ক ৫ সেক্টর ১১। লেকের উপর সবুজ গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি। একদিন আমরা গিয়ে খোঁজ নিই। আপাতত খালি নেই। পরে খালি হলে খোঁজ নিয়েন। কিন্তু যে ভাড়া বলে তা আমাদের সাধ্যর বাইরে মনে হতে থাকে। আমরা মন খারাপ করে প্রায় দিন বিকেলে লেকের এপারে হাঁটতে থাকি আর সে ঘরটিকে দেখতে থাকি। এক সময় আমাদের সে ঘরটিতে বাস করার সাধ স্বপ্ন হয়ে উঠতে থাকে। আর জলের পাশে থাকা আমার বন্ধুটির আজীবনের সাধ। একদিন সত্যিই সে বাড়িতে ঘর খালি হয়। আমরা সাধ্যের বাইরেও ভাড়া দিয়ে সাহস করে উঠে পড়ি। তারপর এক দশক সে ঘরটিতেই বাস করি। লেকের উপর গাছে গাছে পাখি ডাকা ঘর। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি এ ঘরটির মালিক আমরা নই। যে কোনো দিন মালিক উঠিয়ে দিতে পারে। এই দীর্ঘদিন এখানে থাকার ফলে বিভিন্ন যোগাযোগে এ ঘরটির ঠিকানা ব্যবহার করতে হয়েছে। মালিক তাড়িয়ে দেওয়া মাত্র ঠিকানাটি মিথ্যে হয়ে যাবে। একটি নিজ নামের ঠিকানার ঘরের তৃষ্ণা আমাদের তৈরি হয়। কিন্তু জলের পাশে পাখি ডাকা একটি ঘর কেনা কি এই শহরে সহজ? চাকরিজীবীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভবও বটে। এর মধ্যেই একদিন সরকারি একটি নতুন আবাসনের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় আসে। উত্তরার নতুন সেক্টর। কাশবন আর জলের মাঝখানে। তখন সঞ্চয়মাত্র আছে কয়েকটি টাকা। এটা দিয়ে বড়জোর আবেদন আর নিরাপত্তার জামানত হতে পারে। তবুও কিছু না ভেবেই আবেদন করে বসি। কিছুদিন পর স্বায়ত্তশাসিত চাকরি কোটায় একটি ঘর বরাদ্দ পেয়েও যাই। কিন্তু সরকারি যে কোনো কামে যেমন ঢিলে তাল আর নানা নখরামি থাকে, এ ঘরটি নিয়েও তা চলতে থাকে। আমি আর আমার আরেক কবিবন্ধু মিলে প্রায় দিনই নির্মাণাধীন সে ঘরটিকে দেখতে যাই। গিয়ে আমরা কোথায় বই রাখব সে পরিকল্পনা করতে থাকি। কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে? বহু বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিংয়ে কিস্তি দিয়ে দিয়ে এক খণ্ড জমি কিনেছিলাম। সেটি বিক্রি করি। তাতে দুই কিস্তি চলে। তারপর বাকি ছয় কিস্তি। এর মধ্যে ইউনিসেফে পরামর্শকের কাজ পেয়ে যাই। উচ্চ ডলারে। টাকার চিন্তা হাওয়া হয়ে যায়। চূড়ান্ত বেহিসাবি হয়ে উঠি। আর বছরখানেক পর ইউনিসেফের সে প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে যায়। এবার ঘরটির বাকি কিস্তির জোগান? এবার বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসে। গৃহঋণ পাই। ঋণের বোঝা তৈরি হলেও নিজের একটি ঘর হয়। জলের উপরে একটি ঘর। এ ঘরটিতে বাসের কয়েক মাসের মাথায়ই বন্ধুরা ফেসবুকে দুষ্টুমি করে একটি ঘোষণা দেয়। কবি শোয়াইব জিবরানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি গঠন। এই দুষ্টুমির ভেতর আমি গুনে দেখি বেলা তো সত্যিই কম হলো না। করোনায় মানুষ চারদিকে মরছে। আর আয়না আমাকে পাকা চুলও দেখাচ্ছে। বুঝতে না বুঝতেই খেলার প্রথমার্ধ শেষ হয়ে গেছে। শূন্যের উপর দশ ফুট বাই দশ ফুটের পাকা ঘর ছেড়ে দশ হাত মাটির স্থায়ী ঘরে যাওয়ার দিন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে।
ঘাসের ছাউনি দেওয়া এমনি একটি মাটির ঘরে শুয়ে আছেন আমার বাবা মা সাং সিদ্ধেশ্বরপুরে। আমাকেও সেখানে যেতে হবে। শৈশবের সে টিনের ঘরটি আর নেই। আর সে ঘরটি আর ফিরে পাবার উপায়ও নেই। আর সময় নেই টিনের চালে পাখির পায়ের নূপুর বা বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শোনার স্বপ্ন দেখার। তবে পৃথিবীতে বৃষ্টি পড়া তো থেমে যাবে না। সিদ্ধেশ্বরপুরেও অমনি বৃষ্টি হবে।
বৃষ্টি পড়বে টুপটাপ ঘাসের উপর। কিন্তু আমি হয়তো শুনতে পাবো না। শুয়ে রবো। ঘরের স্বপ্নে জাগিব না আর চিরনিদ্রার ভেতর। া
বিষয় : প্রচ্ছদ শোয়াইব জিবরান একটুখানি ঘর
মন্তব্য করুন