ঘর কোনো গীতিময় শব্দ নয়, তবু 'ঘর' শুনলেই এক সাথে বেশ ক'টি গান কেবল আমার কেনো অনেকেরই কানে বাজতে থাকে। হাসন রাজাই আসেন সবার আগে: কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।

হাসন রাজা তো ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের কথা ভাবেননি, ভেবেছেন নশ্বর জীবনের কথা :
জানতো যদি হাসন রাজা বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা করিয়া রঙিন।
হাসন রাজা যেমন জানতেন না, কেউ জানেন না কতদিন বাঁচবেন, তাই বলে ঘর বানাবার প্রতিযোগিতা কিন্তু থেমে নেই।
রবীন্দ্রনাথের গান কানে বাজে :
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছে আমার মনের ভিতরে।
ঘর তো নজরুলও বেঁধেছেন, 'আলোটা নিষ্প্রভ :তবু হাসির আড়ালে প্রেম দেখা যায়।
আমার ঘরের মলিন দ্বীপালোকে
জল দেখেছি যেন তোমার চোখে।
আমাদের যৌবনের শুরুর দিকটাতে প্রেমবঞ্চিত কিংবা প্রেমসঞ্চারিত আমাদের বন্ধুদের প্রিয় গান ছিল :
কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে
নিয়তি আমার ভাগ্যলয়ে যে নিশিদিন খেলাঘরে।
আমাদের কারও কণ্ঠে ছিল :
এমন এক ঘর বেঁধেছি আহারে যার ঠিকানা নাই।
কেউই হাসন রাজার মতো নয়, ঘর বাঁধতেই হবে, সুতরাং কণ্ঠে তুলে নিয়েছে সেই গান :
তোমায় নিয়া ঘর বান্ধিমু গহিন বালুচর।
আবার 'তুমি' ফিরে এলেই ঘরের স্বপ্ন, কিন্তু সময় তো ফেরে না।
সেই শর্তযুক্ত ঘরের গান:তুমি এসো ফিরে এসো, যদি আগে ছেলেবেলা/দুজনাতে হবে দেখা ঘর বাঁধা, বাঁধা খেলা।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে 'ঘরে-বাইরে' এই-ই আছে, কবিতায় ঘর আছে :
সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।
দেশে দেশে ফের দেশ আছে, আমি
সেই দেশ লব বুঝিয়া।
...
তবু হায় ভুলে যাই বারে বারে
দুরে এসে ঘর চাই বাঁধিবারে
আপনার বাঁধা ঘরেতে কি পারে
ঘরের বাসনা মিটাতে
প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায়
চির-জনমের ভিটাতে।
আর নজরুল ঘর ভেঙেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন জীবনে যেমন, গানেও তেমনি-
ঘর ছাড়াকে বাঁধতে এলি কে মা অশ্রুমতী
লীলাময়ী মহামায়া দামায়নী সতী
নজরুল চাঁদকেও ভাবেন ঘর ছাড়া চাঁদকে ডাকেন :
ঘর-ছাড়া ছেলে আকাশের চাঁদ আয় রে
জাফরানী রঙের পরাব পিরান তোর গায়রে।
আধুনিক গানে চার দেয়াল আর ছাদের ঘর থেকে বেশি এসেছে খেলাঘর :
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে :
তুমি আর আমি যেন জীবনের খেলাঘর
হাসি আর গানে ভরে তুলবো
যত ব্যথা দু'জনের ভুলবো
গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লিরিকস আর মান্না দের কণ্ঠ যেন খেলাঘরের জন্যই :
তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়
তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর।
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন :
দুরাশার বালুচরে একা একা আজও গান গাই
প্লাবনের ঢেউ আসে তবু ঘর বেঁধে যাই।
কিংবা সুধীর লাল চক্রবর্তীর চল্লিশের দশকের সেই গান :
খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়
বাঁশী কেন তবু নাম ধরে ডাকে আজও মোর আঙ্গিনায়।
কাইন্দা ফিরি ঘরে ঘর
সৈয়দ শাহনুরের (১৭৩০-১৮৫৫) গানের ঘর বেদনার সাক্ষী। এ ঘর স্থিত হবার নয়, ছেড়ে যাবার। তার বেদনায় পাষাণও অশ্রুসিক্ত হয়-
বন্ধু তোর লাইগা রে আমার তনু জর জর
মনে হয় ছাড়িয়া যাইতাম খইয়া বাড়িঘর
অরণ্য জঙলার মাঝে আমার এখান ঘর
ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইব খবর
বটবৃক্ষের তলে গেলাম ছায়া পাইবার আশে
প ছেইদ্যা রোদ্র লাগে আপন কর্মদোষে
পরকে আপন করলাম আপন করলাম পর
তোর লাইগ্যা কাইন্দা কাইন্দা ফিরি ঘরে ঘর

কেমনে যাইবাম ঘরে
নদের চাঁদের সাথে হুমরা বাইদ্যার কন্যা মহুয়ার জলের ঘাটে তিন সন্ধ্যায় দেখা আর তাতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বহু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে প্রেমের জয় হতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘর টানছে না কাউকেই। নদের চাঁদ বলল :
কি কইবাম বাপ মায়ে কেমনে যাইবাম ঘরে।
জাতি নাশ করলাম কন্যা তোমারে পাইবার তরে
তোমায় যদি না পাই কন্যা আর না যাইবাম বাড়ি।
এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি
শৈশবের সেই ঘর মহুয়ারও প্রয়োজন নেই। সুতরাং তারও অটুট সিদ্ধান্ত:
পইড়া থাকুক বাবা মাও পইড়া থাকুক ঘর।
তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর
দুই আঁখি যেদিগে যায় যাইবাম সেইখানে।
আমার সঙ্গে চল বন্ধু যাইবাম গহীন বনে।
রাধারমণের গানে শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে যখন অঙ্গ জ্বলে যায় বাসরঘরের কী-ই বা প্রয়োজন?
ভ্রমর রে সারা নিশি পুরাইলাম
ফুলের শয্যা লইয়া
সেই শয্যা হইল বাসি দেও জ্বলে ভাসাইয়া রে

অন্য ঘরের খোয়াবে
শেখ ভানু (১৮৪৯-১৯১৯) নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, নতুন ঘরের সন্ধান ও পেয়েছেন কিন্তু সে ঘরে পৌঁছার 'তওফিক' যে তার হয়নি। কিন্তু সেখানেই যে তার গন্তব্য।
শেখ ভানু লিখছেন:
কাবা শরীফ আল্লার ঘর, মক্কা শরীফ ঠিকানা
তোয়াফ করিবার তফিক মুই গরীবরে দিলায় না
...
অধীনে শেখ ভানু কয় জন্মি কেন মইলাম না
বাঁচলাম যদি হজ্জ্বের তফিক আমায় কেন দিলায় না।

গিয়াস পাগলের অন্ধার বাসরঘর
হুমায়ূন আহমদের একটি উদ্যোগ পুনর্জন্ম দিয়েছে- 'মরিলে কান্দিস না আমার দায়' গানটির। এই গানের গীতিকার সুরকার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ তার জীবনের সাধ মেটাতে বেছে নিয়েছেন অন্ধকার বাসরঘর। কেমন করে সে ঘরে যাবেন স্বজনদের জন্য রেখে গেছেন তারও ফরমায়েশ:
গরম জলে সাবান গুলে গোসল করাইও
কর্পূর গুলিয়া সারা অঙ্গে মাখাইও
আতর গোলাপ ছিটাইও অঙ্গের বসনে
বাঁশের পাল্ক্কি সাজাইয়া কান্ধে উঠাইয়া
শবমিছিল করিও ঘরে কলিমা পড়িয়া
বাসরঘরে রাইখ নিয়া পরম যতনে।
আন্ধারঘরের বাসরে গিয়াস পাগলের আশা পূরণ হবে, পাবেন তিনি তার পরম বন্ধুর দরশন।

ঘরের গল্প
মানুষ বেঁচে থাকে গল্প নিয়ে, গল্প মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। হাজার এক রাত্রির গল্পে শেহেরজাদ জানতেন যদি গল্পটা শেষ হয়ে যায়, পরদিন প্রত্যুষে জল্লাদের খÿের নিচে মাথাটা রাখতে হবে। সুতরাং তাকে গল্প বুনতেই হবে। গল্পের শুরুটা হয় ঘরে। ঘর মানেই গল্পগৃহ।
টিএস এলিয়ট বলেছেন, মানুষ যেখান থেকে শুরু করে, সেটাই ঘর। নো প্লেস লাইক হোম- এ তো সর্বজনীন সর্বকালীন সত্য। ঘর নিয়ে সুবচনের শেষ নেই। ভালোবাসা প্রত্যাশা এবং স্বপ্নের শুরুটা ঘরেই।
ঘর বানাতে ইউরোপীয়দের ইট-কাঠ লাগে, আমাদের বাঁশ ও ছন; ইগলু বানাতে কেবল বরফ, বেদুইনের তাঁবু, বেদের নৌকা- সবই ঘর; কিন্তু সবগুলোই অসম্পূর্ণ; ঘর সম্পূর্ণ করতে চাই মানুষ, আশা এবং স্বপ্ন। গুহামানবের ঘর প্রকৃতিই তৈরি করে দিয়েছিল। তারপর পাথর কেটে ধারালো হাতিয়ার তৈরি করে গুহামানব তার গুহাগৃহের কসমেটিক সার্জারি করলো, সেই ঘর দিল ছায়া, সেই ঘর ঝড় ও বৃষ্টি প্রতিরোধ করল; একসময় সেই গুহাকে টেনে বের করে নিয়ে এলো অরণ্যে, তারপর মুক্তাঙ্গনে, তারপর নাল জমিতে, তারপর সেই জমির নাম রেজিস্টারে ছাপা হলো ভিটে। গুহামানবের উত্তরসূরিরা নগর সৃষ্টি করল, রাজধানী বানাল, বন্দরে জাহাজ ভিড়ালো, টাউন প্ল্যানার, আর্কিটেক্ট- সবাই তাদের সন্তান। মানুষ হাসন রাজার মতো জানতে চায় না ক'দিন বাঁচবে। সুতরাং ঘর বানায়, রঙিন ঘর, শীতল ঘর, ওম-সর্বস্ব ঘর। কদাচিৎ কেউ আবদুল আলীমের কণ্ঠে গেয়ে ওঠে- পরের জায়গা পরের জমি/ঘর বানাইয়া আমি রই/আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।
আমি যতই বলি ঘর আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমার অল্টার ইগো মুচকি হেসে বলে লখিন্দরের বাসরঘর তো আরও নিরাপদ ছিল।
ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ অন্ন ও বস্ত্রের সাথে মানুষকে ঘরের গ্যারান্টি দিয়েছিল- মাত্র ২৩ বছর পর ৯৯ লক্ষ বাঙালি ঘরছাড়া হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে নিয়েছে। ঘর নেই ফিলিস্তিনের গাজায় সাবরা-শাতিলায় ঘর নেই জনযুদ্ধ উপদ্রুত বিশ্বে, ঘর নেই কাশ্মীরে।
কী আশ্চর্য। যাদের ঘরই নেই করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাধিকালে তাদেরও লকডাউন- গৃহে থাকুন ঘরবন্দি থাকুন- কী আশ্চর্য, ঘর সেইসব মানুষের- ঘরের চার দেয়ালের একটিও নেই, মাথা ঠেকাতে পারে একমাত্র আকাশ।
হাজার বছর আগে কনফুসিয়াস বলেছেন, জাতি তার শক্তি আহরণ করে ঘরের সংগতির দৃঢ়তা থেকে।
আমি সত্তরের শেষে একটি বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছিলাম; এলম গাছের একটি পরিত্যক্ত গুঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে ধিকি ধিকি তারপর দাউ দাউ জ্বলতে থাকে আগুন। এই গুঁড়িটি ছিল পিঁপড়েদের ঘর। আগুনের শুরুতেই কিছু পিঁপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, নিরপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কিছু পিঁপড়ে আহত ও নিহত হয়। একসময় আগুন নিভে আসে। এলম গাছের গুঁড়ি অঙ্গারে পরিণত হয়। অথচ দেখা গেল সেই পিঁপড়েগুলো নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে লাইন ধরে তাদের পুরোনো ঘরে ফিরে আসছে। যেখানে ফিরে আসা যায় তার নামই তো ঘর।
অজ্ঞাত লেখক ভুল বলেননি:যেখানে ভালোবাসা বাস করে, যেখানে স্মৃতি সৃষ্টি হয়, যেখানে বন্ধু ও পরিবার বিরাজ করে, যেখানে কখনো অট্টহাসি শেষ হয় না তার নামই ঘর। া