- কালের খেয়া
- বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষার রাজনীতি
বাংলাদেশের একাত্তর
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষার রাজনীতি
ধারাবাহিক

পর্ব-৯
[নতুন প্রসঙ্গ]
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষার রাজনীতি একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা সচরাচর একটা ধারণা করে থাকি যে, বায়ান্নর এই ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষের যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল- সেই রাজনৈতিক অবস্থান ক্রমে একটা পর্যায়ে গিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে পরিণত হয়। 'বায়ান্ন থেকে একাত্তর'- এ রকম শব্দবন্ধ প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এ ধারণা সঠিক নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আরও দীর্ঘদিনের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখতে গেলেও ১৯৪০ সালেই বাংলাদেশের স্বাধীন দেশ হওয়ার আনুষ্ঠানিক সূচনা। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে যদি মাপতে হয়, তাহলে ১৯৪০ থেকেই মাপতে হবে। ১৯৪৮ বা ১৯৫২ সালে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে ১৯৪০ সালের রাজনৈতিক অবস্থান সরাসরি জড়িত।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি তা হলো, মনে করা হয় এ উপমহাদেশে ভাষা আন্দোলন কেবল আমরাই করেছি। এ ধারণাও ঠিক নয়। গোটা ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এবং প্রায় সব আন্দোলনই হয়েছে হিন্দি না হয় উর্দুবিরোধী। অর্থাৎ উত্তর ভারতের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধেই এ আন্দোলনগুলো চলেছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে।
উপমহাদেশের কোনো অখণ্ডতা নেই, উপমহাদেশের চরিত্র হচ্ছে বিবিধ। যারা এটাকে এক দেশ বানাতে চায় কিংবা যারা এর কিছু অংশকে এক বলতে চায়- সেটা ভারত হোক বা পাকিস্তান, তারাই এ চরিত্রকে অস্বীকার করে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ভাষাকে শক্তি করে ক্ষমতাবান বহু গোষ্ঠী রাজনীতি করেছে। সেই রাজনীতিটা সর্বদাই মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগগুলো খর্ব করার জন্য করা হয়েছে। সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে মোটামুটিভাবে এমন পাঁচটি বড় ধরনের আন্দোলনকে চিহ্নিত করা যায়, যার প্রায় প্রতিটির সঙ্গে উত্তর ভারতের ক্ষমতাবান গোষ্ঠী জড়িত।
প্রথম যে আন্দোলনটির কথা আমরা জানি, যেটা খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও মৌলিকভাবে ভূমিকা পালন করেছিল- সেটা হচ্ছে হিন্দি ও উর্দু ভাষার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বটা এখনও প্রায় অনালোচিতই বলা যায়। এটা ছিল বেশ মৌলিক এবং বৃহৎ একটি সংঘাত। এটি ছিল পূর্বে প্রতিষ্ঠিত উর্দু ভাষাবাদীদের বিরুদ্ধে নব্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হিন্দি ভাষাবাদীদের আন্দোলন। সে আন্দোলনকে দমাতে ইংরেজরা এবং উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষাভাষী গোষ্ঠী একসঙ্গে ভাষা-রাজনীতিটা করেছিল আগেকার অবস্থাপন্ন ও ক্ষমতাবান তুর্ক-আফগান গোষ্ঠী বা মোগল গোষ্ঠীদের দুর্বল করার জন্য। হিন্দিভাষী এবং ইংরেজরা একত্র হয়েছে উর্দু ভাষাভাষীর বিরুদ্ধে- কারণ ১৮৫৭ সালের দিকে উর্দুভাষীরা বড় অংশে আন্দোলনে জড়িত হয়েছিল, অর্থাৎ মোগল বা মোগল ঘরানার প্রতি যারা অনুগত। ইংরেজরা এতে যুক্ত হয়েছিল নিজেদের স্বার্থেই, অন্যদিকে হিন্দিভাষীরা সুযোগটা নিয়েছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কারণ, উর্দু ভাষাভাষী মোগলদের হটিয়ে তারা নিজেদের ক্ষমতা ফেরত চাইছিল।
১৮৫৭ পর্যন্ত ইংরেজরা পুরোপুরিভাবেই হিন্দুদের সুবিধাটা দিচ্ছিল, কিন্তু ১৮৫৭ সালে যখন বিদ্রোহ হলো, তখন ইংরেজরা বুঝল যে শুধু হিন্দুদের সুবিধা দিয়ে টিকে থাকা যাবে না। কারণ, সংখ্যায় কম হলেও মুসলমান অন্য জনগোষ্ঠীটি যথেষ্ট ঝামেলার সৃষ্টি করবে। তখন তারা মুসলমানদের, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের আলীগড় আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করল। এবং সেই আলীগড় আন্দোলনের বিশেষত্ব হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আনুগত্য। ইংরেজরা মুসলমানদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার সুযোগটি বাড়িয়ে দিল। স্যার সৈয়দ আহমেদ খানও মুসলমানদের বললেন, যদি তোমরা চাকরি চাও, তাহলে ইংরেজি শেখো।
দ্বিতীয় বাস্তবতাটি হলো, হিন্দি ভাষাভাষীরা তো উত্তর প্রদেশের ইউনাইটেড প্রভিন্সে যেখানে মোগলদের কেন্দ্রস্থল, সেখানে উর্দু ভাষাভাষীদের অধীনে ছিল; এখনও যেটাকে ভারতের ক্ষমতার মূল কেন্দ্রস্থল বলা যায়, সেখানে তখন হিন্দি ভাষাভাষীরা বলছে, এরা সেই মোগল ধারাবাহিকতা, এরা বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি। মূলত তারা তো তখনও উর্দুভাষীদের কাছে নিপীড়িত। তাই তখন তারা বিদ্রোহটা করল।
ইংরেজরা তখন একই সঙ্গে দুটি কাজ করেছিল, এক. ইংরেজি চর্চার জন্য মুসলমানদের উৎসাহ দিল; দুই- উর্দুভাষী যারা ছিল মোগলপন্থি, তাদের দমানোর জন্য হিন্দি ভাষাকে সুযোগ দিতে লাগল। এর মাধ্যমে এই হিন্দি বলা হিন্দু এলিট শ্রেণি এবং উর্দু বলা মুসলমান এলিট শ্রেণির মধ্যে একটা দ্বন্দ্বরত অবস্থার সূত্রপাত হয়। ইংরেজরা একদিকে যেমন আলীগড় আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন করেছে, কারণ চাকরি-বাকরিতে এগিয়ে আসার জন্য মুসলমানদের ইংরেজি ভাষা শেখা উচিত। আবার উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছে, যাতে করে মোগল যে ধারাবহিকতা ছিল- যার কারণে ১৮৫৭ সালে এত আন্দোলন হয়েছিল ওই অঞ্চলে, সেটাকেও তারা দমন করতে পারে। এই উর্দু ভাষাভাষীদের বিরুদ্ধে দ্বৈত একটা চেষ্টা তারা করেছে।
তার পরে যে ঘটনাটির প্রতি লক্ষ্য করতে হবে তা হলো, ১৮৭১ সালে এই বাংলায় উর্দুকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এবং উত্তর প্রদেশে সরাসরি বলে দেওয়া হয়, উর্দু প্রদেশের প্রধান ভাষা হবে না, প্রদেশের প্রধান ভাষা হবে হিন্দি। হিন্দি ভাষার আন্দোলনটি তারাই করেছিল যারা পরে কংগ্রেসের নেতা হয়েছিলেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রথম দ্বন্দ্বটা শুরু হয় উর্দু আর হিন্দির মধ্যে। আসল বিষয়টি হচ্ছে এর মাধ্যমে উর্দু ভাষাভাষীদের সুযোগকে সীমিত করে দেওয়া। ঠিক যেমনিভাবে পাকিস্তানে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করা হয়, তেমনিভাবে হিন্দি ভাষাভাষীরা উর্দু ভাষাভাষীদের বিরোধিতা করেছিল। করেছিল সুযোগ-সুবিধাগুলো নিজেদের হাতে রাখার জন্য। এই সুযোগ-সুবিধার মধ্যে প্রধান হচ্ছে চাকরির সুযোগ-সুবিধা। পাকিস্তান আমলে এসে উর্দু ভাষাভাষীরা যা করেছিল, সেটা পূর্বে কমবেশি উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষাভাষীরা যা করেছিল, তারই একটা অনুকরণ বলা যায়।
মুন্সি প্রেমচাঁদ- যিনি উত্তর ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন, তিনি উর্দুতে লিখতেন। কিন্তু স্বনামধন্য লেখক হওয়ার পরও তিনি প্রকাশক পেতেন না। তাই হিন্দিতে লেখা শুরু করেন। হিন্দুস্তানি বলে যে ব্যাপারটা ছিল- সেটা অনেক বেশি হিন্দিনির্ভর হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯০০ সালে এসে আবার উর্দুকে জাগানোর কাজ শুরু হয়। হিন্দি-উর্দু দুই ভাষাকেই উত্তর প্রদেশের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তাহলে আগে কেন দ্বন্দ্বটা হয়েছিল? দ্বন্দ্বটা সুযোগের দখল।
দক্ষিণ ভারতে আবার ঘটনা ঘটল উল্টোভাবে- সেখানে আন্দোলন দানা বাঁধল হিন্দির বিরুদ্ধে। তামিলনাড়ূর মানুষদের হিন্দিবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। সেখানে সে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে; বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে তামিল ও হিন্দি ভাষার এই দ্বন্দ্ব। এবং এ আন্দোলন এতই প্রভাবশালী হয়েছিল যে এই সংকট সংবিধান পর্যন্ত গড়িয়েছে। যখন ভারতীয় সংবিধান লেখা হচ্ছিল- তখন ভাষার এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আরও বেশি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মনে রাখা দরকার, এই দ্বন্দ্বের জের ধরে ১৯৬৫ সালে দাঙ্গা হয় এবং সংঘর্ষে কমপক্ষে ৭০ জন মানুষ মারা যান।
আমাদের দেশে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ানো হলে কেবল ১৯৫২ সালের কথাই বলা হয়। আমরা ভাবি যে, আমরাই কেবল ভাষা আন্দোলন করেছি। কিন্তু তামিলরা আমাদের চেয়ে আরও ব্যাপকভাবে ভাষা আন্দোলন করেছে; অনেক বেশি রক্ত দিয়েছে। কারণটা খুব সোজা- হিন্দি ভাষাভাষীরা নিজেদের চারদিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। সেটা ছিল ভারতের সংকট। অর্থাৎ উত্তর ভারতের সর্বভারতীয় আধিপত্যের প্রচেষ্টা।
আরেকটি আন্দোলন হচ্ছে বিশাল অল্প্রব্দ বা বৃহৎ অল্প্রব্দ আন্দোলন। ১৯৫৩ সালের এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল অল্প্রব্দ ও তেলেঙ্গানা প্রদেশকে একত্র করে আলাদা করে দেওয়া। তেলেগুভাষী সমগ্র অঞ্চলকে এক করার জন্য এ আন্দোলন সংগঠিত করা হয়ে থাকলেও দিল্লির বা কেন্দ্রের রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল ভাষাকে ব্যবহার করার মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ করা, বিচ্ছিন্ন রাখা। এর সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক থাকলেও মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা। আরেকটি আন্দোলন হলো কানাড়া আন্দোলন- যেটা সংগঠিত হয়েছে ১৯৮০ সালের দিকে এবং এ আন্দোলন এখনও চলছে। এ আন্দোলনও যথারীতি হিন্দিবিরোধী। পঞ্চম আন্দোলনটি হচ্ছে বাংলাদেশের ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
দেখা যাচ্ছে, ভাষা আন্দোলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে দক্ষিণে। রক্তও বেশি গেছে সেখানেই। মোটামুটি এই হচ্ছে এ অঞ্চলের ভাষাকেন্দ্রিক রাজনীতির ইতিহাস।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন কবে থেকে শুরু হলো?
১৯০৬ সালে এখানে মুসলিম লীগ যখন গঠিত হয়, তখন কিন্তু প্রস্তাব হয়েছিল যে, উর্দুকে মুসলিম লীগের ভাষা করতে হবে এবং মুসলমানদের জাতীয় ভাষাও হবে উর্দু। এর কারণ হচ্ছে, মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল উত্তর ভারতের উর্দু ভাষাভাষীদের হাতে। যা হোক, তখনই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়। অতএব, ১৯৪৮ সালেই যে প্রথম বিরোধিতা হয়েছিল, তা নয়। প্রথম বিরোধিতা হয় ১৯০৬ সালে। মুসলিম লীগের কর্ণধাররা জানত এখানে বাংলাই সবচেয়ে সবল অবস্থানে- তাই সব সময় তারা উর্দুকে নিয়ে আসতে চাইত। তারা উর্দুকে নিয়ে আসতে চাইছিল এ জন্য যে, যেহেতু তখনকার সময়ে মুসলিম লীগ ছিল উত্তর প্রদেশকেন্দ্রিক, তারা নিজেদের ক্ষমতাকে শক্ত করার জন্য ভাষার রাজনীতিটাকে সামনে আনতে চেষ্টা করেছে। তারা জানত যে, এই মুসলিম লীগের রাজনীতির অংশ তাদের চেয়েও বৃহত্তম জনগোষ্ঠী যারা, তারা হচ্ছে এই বাঙালিরা। সে কারণে নিজেদের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য তারা বারবার ভাষাটাকে নিয়ে এসেছে। বাংলার মুসলিম লীগের লোকেরা বলেছে- যদিও তারা হিন্দু অবস্থাপন্নদের হাতে অনেক বেশি নির্যাতিত, তবু বাংলা ভাষার ব্যাপারে তারা নড়বে না। কারণ, তারাও তো বাংলাকেই রক্ষা করতে চায়। তাই বাংলাই যদি না থাকে কৃষকের সঙ্গে কথা বলবে কী করে, মধ্যবিত্তের সঙ্গেই বা কথা বলবে কীভাবে? কাজেই তখনই প্রতিবাদ করা হয়।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটা হয় ১৯৩৭ সালে। তখন মুসলিম লীগে আবার আরেকবার উর্দুর আওয়াজ তোলা হয়। সেবারও পুরোপুরি হেরে যায়। কারণ, তখনও দলের সবচেয়ে সবল অংশ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ। সেই বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালে বলে যে- না, আমরা মানব না। আমরা উর্দুকে কোনোদিনই বাংলা ভাষার জায়গায় মেনে নেব না। তৎকালীন মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ এ ঘটনাগুলো বেশ ভালোভাবে এসেছে অধ্যাপক হারুনর রশীদের 'ফর শ্যাডোইং অব বাংলাদেশ' বইতে। আরও কিছু বই আছে এ ব্যাপারে। এ বিষয়গুলো জানা থাকলে যে কারও কাছে পটভূমিটা খুব পরিস্কার হয়ে যায় যে, হঠাৎ করে এক দিন আমরা বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করিনি, এর একটা দীর্ঘ ধারাবাহিকতা আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা যেমন সাতচল্লিশের আগে থেকে শুরু হয়েছে- তেমনি ভাষা আন্দোলনও শুরু হয়েছে সাতচল্লিশের আগে থেকে।
সাতচল্লিশে ঘটনাটা কী ঘটল? মূলত পূর্বে যারা উর্দুর ভাষার রাজনীতিটা করতে চেয়েছিল, তারাই প্রথমে এসে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসল। তারা নিজেরাও যেহেতু ভাষার কারণে ভুক্তভোগী- সে জন্য প্রথমেই যে বিষয়টা করার চেষ্টা করল, তা হলো যে, চাকরি করতে হলে উর্দুতেই করতে হবে। বস্তুতপক্ষে তারা উত্তর প্রদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানে আমদানি করার চেষ্টা করল। এবং যেহেতু পাকিস্তান একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র ছিল, সে কারণে তারা যখন এটা করছে, তারা পাকিস্তান বলতে পশ্চিম পাকিস্তানকেই বুঝেছে। কিন্তু তাদের মনে একটা ভয় ছিল- কারণ তারা জানত বাঙালিরা লেখাপড়া করে, যেখানেই যায় চাকরি দখল করে নেয়। সে কারণে তাদের আটকানোর জন্য শুরুতেই পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে একটি ভাষা হিসেবে বাদ দেওয়ার কথা বলল। রাজনীতিবিদরা বললেন, উর্দুই হবে প্রধান ভাষা- গণমাধ্যম, শিক্ষা, সিভিল সার্ভিস ইত্যাদিতে। তাহলে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির তো আর কোনো জায়গাই থাকল না। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর আগে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করেছে চাকরির জন্য। এখন যদি ভাষার জন্য চাকরিতেই না ঢুকতে পারে, তাদের তো আর কোনো পথই থাকল না। আজকের দিনেও মধ্যবিত্ত চাকরির জন্যই সব করে। সে কারণে তখন প্রতিবাদ অবধারিতই ছিল। আর সাংস্কৃতিকভাবে ভাষাকে রক্ষা করার বিষয়টা তো ছিলই।
পাকিস্তান হওয়ার পরপরই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে আন্দোলন হয়েছে, মিছিল হয়েছে- তার মানে তাহলে কী দাঁড়ায়? পাকিস্তান জন্ম থেকেই একটা ভিত্তিহীন রাষ্ট্র। পাকিস্তান তার জন্মের পরে পূর্ব বাংলায় [পূর্ব পাকিস্তানে] কখনোই পা রাখতে পারেনি। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কোনোভাবেই পাকিস্তান এখানে ছিল না।
ঐতিহাসিকভাবে সাতচল্লিশেই আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এবং তার ভিত্তি ছিল ভাষা। এ আন্দোলন করেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহর ভাষণে বোঝা যায় যে, ততদিনে ভাষাকে ভিত্তি করে প্রতিবাদটা কত ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। ওখানেই জিন্নাহ মেনে নিয়েছে যে, প্রদেশে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা যাবে। তবে রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু।
মধ্যবিত্তের প্রতিবাদের প্রধান বিষয়ই হয়ে উঠল ভাষা। তারা ভাষার জন্য প্রতিবাদ করছে- বলছে, আমাদের চাকরির সুযোগ দিতে হবে, শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ দিতে হবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতাগুলোতে দেখা যায় যে, সে তখন এ বিষয়টাকে অন্য খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জিন্নাহ বলার চেষ্টা করেছে যে, এসব ভারতের কারসাজি।
পাকিস্তান মূলত ছিল একটি ঔপনিবেশিক কেন্দ্র। শেখ মুজিব যেটাকে বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান তার একটা কলোনি। এটা আসলে কলোনিই ছিল। কলোনির মালিক কলোনির লোকদের সুযোগ দেবে? ইংরেজরা যেভাবে ধীরে ধীরে তাদের অনুগতদের সুযোগ দিয়েছে, ঠিক একইভাবে পাকিস্তানও তাই করবে।
এর মধ্যে পাকিস্তানের সংবিধান তৈরির কাজ শুরু হলো এবং সংবিধানে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার কথা উঠল। সংবিধান অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর বিরোধিতা করলেন। ঢাকায় ফিরলে ধীরেন দত্তকে সে কারণে অভ্যর্থনাও জানানো হয়। অর্থাৎ, ততদিনে ভাষার ব্যাপারটা ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
তৎকালীন রাজনীতির বিষয়টা দেখলে বোঝা যায় যে, ভাষা সেখানে একটি উপাদান ছিল। বড় সংকট ছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। সে দ্বন্দ্বটা হচ্ছে, এখানকার মানুষ যেহেতু আলাদা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত- তারা নিজেদের কাঠামোটা তৈরি করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান সে চেষ্টায় বাধা দিচ্ছে। এই যে একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র আরেকটি উঠতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে দমন করছে- সেই দমন-নিপীড়নের বিভিন্ন প্রকাশ ছিল সেখানে। যে কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ সংবিধানের প্রতিবাদ শুরু করল। সংবিধান লেখার যে মূল ভিত্তিগুলো ছিল, সেগুলোর প্রতিবাদ করতে লাগল। এবং তা যথেষ্ট সাংঘর্ষিক ছিল। একই সঙ্গে এখানে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক দুরবস্থা। বিশেষ করে গ্রামের দিকে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে চল্লিশের মন্বন্তরের ছায়াও পড়েছিল। তাই এই রাজনীতি করতে গিয়ে যদি অর্থনৈতিক উন্নতি না হয়, বাংলায় কোনো রাজনীতিবিদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। এবং বাংলার যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হতে আসা রাজনীতিবিদ- তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে যদি একত্র করতে না পারে, তাহলে তারা রাষ্ট্র গঠনের এ আন্দোলনকে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? সে জন্য একদিক থেকে ভাষার রাজনীতিটা যেমন ছিল অর্গানিক, একই সঙ্গে ভাষার রাজনীতিটা ছিল ঐতিহাসিকভাবে অপরচুনিস্ট। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সামগ্রিকভাবে একত্র করার ক্ষেত্রে ভাষা একটা বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। পরে ১৯৫৪ সালের দিকে গিয়ে মধ্যবিত্তরা যখন অর্থনৈতিক আন্দোলনের দিকে অনেক বেশি মনোনিবেশ করল, তখন রাজনীতিবিদরা এটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকল।
বাংলাদেশের গ্রামে ভাষার আন্দোলন খুব একটা দেখা যায় না। দু-একটা ছিটেফোঁটা ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামে ভাষা আন্দোলন হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই। যেহেতু ভাষা তাদের রুজি দেয় না। মানুষ রুজির জন্য আন্দোলন করে। বাংলাদেশের কৃষক অশিক্ষিত; সে ভাষা দিয়ে কী করবে! ভাষা তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। এমনকি বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, তারা ইংরেজি ভাষাটাই শেখার চেষ্টা করেছে; দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে আরম্ভ করে এখনকার সময় পর্যন্ত। কিন্তু কেন? চাকরি, ব্যবসা যে সুবিধাই তারা পেয়েছে, ভাষা থেকেই তো তারা সুবিধাটা নিয়েছে। অতএব, ভাষাটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় ছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে, টিকে থাকার স্বার্থে। তারা যত ব্যবসা করেছে, ভাষা দিয়ে করেছে। সেটা রাজা রামমোহন হোক বা প্রিন্স দ্বারকানাথ হোক। এমনকি ১৮৫৭ সালের পরে কলকাতার মুসলমান বাঙালি সংগঠনগুলো 'বেঙ্গল মোহামেডান সোসাইটি', 'আঞ্জুমান' ইত্যাদি ইংরেজদের দালালি করেছে একই কারণে। কারণ, ইংরেজি শিখলে চাকরি পাবে। অর্থাৎ ভাষা এবং চাকরি একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির গোলাগুলিটা ছিল রাজনৈতিক ঘটনা। মিছিলে গুলি করা- এই গুলি করে তাদের আন্দোলন থামানোর ঐতিহ্য সব সময়ই আছে। এ ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের আমরা ভাষাশহীদ বলি; কিন্তু সেখান থেকে আমাদের ইতিহাস শুরুর যে বিষয়টি- সেটি ঠিক নয়। আমাদের ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। একাধিক শ্রেণি এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। বায়ান্নর পরে যা হলো- মধ্যবিত্ত বা চাকরিনির্ভর শ্রেণি যেটা, সেই শ্রেণি বুঝতে পারল যে, তাদের পক্ষে পাকিস্তানের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করাটা খুব সহজ হবে না। যার কারণে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠল। বায়ান্ন সালে মিছিলে গুলি করে পাকিস্তান মূলত বিশাল একটা পলিটিক্যাল ইমাজিনেশন তৈরি করে দিল। এই যে জনকল্পনা- এই জনকল্পনা তৈরিতে বায়ান্নর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই জনকল্পনা হচ্ছে, এদের সঙ্গে আমাদের হবে না, নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র চাই।
কিন্তু আন্দোলনের শক্তি হিসেবে বা যেখান থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে বায়ান্নকে সেভাবে ধরা যায় না। বস্তুত ভাষার রাজনীতি সব সময়ই হয়েছে। বায়ান্নর পরে যখন পরবর্তীকালের রাজনীতিটা এগোচ্ছে, তখন ১৯৪০ সালের রাজনীতির ধারাবাহিকতাটা আছে কিনা। ১৯৫৫ সালে এসে যখন সংবিধানটা হলো, পাকিস্তানিরা বাংলাকে যতই অপছন্দ করুক, তখন কিন্তু উর্দু আর বাংলাকে এক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। কেন মেনে নিয়েছে? তার কারণটা হলো, তারা রাজনীতিটা সামলাতে পারছে না। একটা পর্যায়ে এসে ১৯৫৮ সালে তারা মার্শাল ল দিল। মার্শাল ল-টা তারা দিয়েছে মূলত সিভিলিয়ানদের দমিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু তাদের মতে যত রকম সুযোগ দেওয়া যায়, তত সুযোগ দেওয়ার পরও এখানকার মানুষ শান্ত হচ্ছে না। মানুষ প্রতিবাদ করছে তার রুটি-রুজি নিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাসবিদরা ভাষা আন্দোলনকে অনেক বেশি সংস্কৃতায়িত করেন। রাজনীতিকে তারা কালচারালাইজেশন করেন। পলিটিকস তো আসলে লাইভলিহুড, মানে রুটি-রুজি সংক্রান্ত। রাজনীতি হচ্ছে আর্থসামাজিক সমতার প্রয়োজনে, রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে। যেহেতু বাংলাদেশের আন্দোলনটা সব সময়ই রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা থেকে উঠে এসেছে- সে কারণে অন্য যত আন্দোলন, সেটা ভাষা আন্দোলন হোক বা অন্য যে কোনো আন্দোলন হোক, তা সেই রাষ্ট্র গঠন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আসে। তাই ভাষা আন্দোলনকে বড় মাপে দেখতে হলে আমাদের রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখাটা দরকার।
আসলে আমাদের ভাষা আন্দোলনটা হয়েছে একটা রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে। এটা আলাদাভাবে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়নি। পাকিস্তানিরা তো বলেনি যে, বাঙালিরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারবে না। এমনকি জিন্নাহর বক্তৃতাতেও ছিল যে, প্রদেশে যে বাংলা থাকবে এটা জিন্নাহ তার বক্তৃতাতেও বলেছে। বলা হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহার করতে হলে ব্যবহার করতে হবে উর্দু, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মনে রাখা দরকার- এটা মাতৃভাষার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। অতএব, এটা রাজনৈতিক। এটা রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র হয়েছিল, সেখানে পূর্ববঙ্গের মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। মূলত ভাষার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পাকিস্তানিরাও জানিয়ে দিচ্ছিল যে, তোমরা রাষ্ট্রের লোক না। সেটারই বাঙালিরা প্রতিবাদ করছিল। প্রতিবাদ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রত্যাশা ছিল চাকরি-বাকরির নিশ্চয়তা। না হলে তারা টিকবে কী করে? রাষ্ট্রে তারা বাঁচবে কী করে? অর্থাৎ প্রতিবাদটা রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গেল। এবং রাষ্ট্রকে তারা চ্যালেঞ্জ করল। এই চ্যালেঞ্জে অন্তর্ভুক্ত নানা দিকের মধ্যে ভাষাও একটা দিক। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মূল বিষয়টি ছিল অর্থনৈতিক আন্দোলন। আর উর্দু ভাষাভাষীরা এটা করছিল, উর্দু ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, তারা চাইছিল যে, বাঙালিদের ঢুকতে দেব না রাষ্ট্রের ভেতরে। আর বাংলাদেশের মানুষ বলছিল, না আমরা ঢুকব। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল হওয়ার পর তো সেই ঢোকার পথটা একেবারেই বন্ধ করে দিল। তখন বাংলাদেশের বাকি যে মানুষ ছিল, তারাও স্বাধীনতার পক্ষে গেল। ১৯৫৮ সালের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, তখন নতুন নতুন বহু দল গঠিত হচ্ছে, যারা স্বাধীনতা চায়। বাংলাদেশ নামক একটি অপরিস্ম্ফুটিত রাষ্ট্র কীভাবে তার জন্ম থেকে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেছে- সেই দ্বন্দ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এসবই হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আর ভাষার জন্য আন্দোলন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরই অংশ। সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ভাষার জন্য নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা অর্জনের জন্য। া
[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত]
মন্তব্য করুন