- কালের খেয়া
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা: ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি ১৯৫৮
বাংলাদেশের একাত্তর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা: ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি ১৯৫৮

পর্ব-১২
[নতুন প্রসঙ্গ]
কিছুদিন আগে আমি আমার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম যে, 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টির নাম কেউ শুনেছেন কিনা?' দেখলাম যে, একজন যার বাবা এই পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে; এবং আরেকজন প্রবীণ সাংবাদিক- এই দু'জন ছাড়া আর কেউ জানেন না বা কোনোদিন এই পার্টিও কথা শোনেনওনি। তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, এটা সম্পর্কে আমরা কেউ খুব একটা জানি না- আমি নিজেও এর নাম শুনিনি অন্তত ১৯৮০ সালের আগে। '৮০ সালে আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করি, তখন কলিমদাদ খান নামে এক ভদ্রলোক একবার বললেন, সরকারি এক অফিসে কিছু দলিলপত্র পড়ে আছে, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে। তারপর নানা রকম কাঠখড় পুড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের জন্য সেই দলিলগুলো আমি সংগ্রহ করেছিলাম। সেই দলিলগুলো সংগ্রহ এবং পড়তে গিয়েই প্রথম আমি ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টির কথা জানতে পারি। এর আগে কিছুই জানতাম না এই পার্টির সম্পর্কে। তখন আমি ধীরে ধীরে অন্যদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করি। আমার ভাগ্য ভালো ছিল- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে ইমামুর রশীদ নামে একজন ভদ্রলোক কাজ করতেন, যিনি জামালপুরেরই মানুষ। জামালপুরের মানুষ হিসেবে তিনি এই পার্টি এবং পার্টিও সদস্যদের কথা কিছু জানতেন, এবং তিনি আমাকে তখন কিছু নাম বললেন। এই নামগুলো ধরে খুঁজতে খুঁজতে জীবিত কয়েকজন সদস্যের খোঁজ পেয়ে যাই। আমি তাদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করি। সেই সময়েই তৎকালীন 'বিচিত্রা' পত্রিকায় এ নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তারা নিজেরাও কিছু লেখার চেষ্টা করেছিলেন, আমি সেসব লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছি।
১৯৪৭ সালের দিকের ইনার গ্রুপের কথা আমরা জানি, যার প্রতিষ্ঠা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও আগে। মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠিত এ গ্রুপটির সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানও জড়িত ছিলেন। কিন্তু সাতচল্লিশের পরে 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি'ই হচ্ছে প্রথম একটি সংগঠন যার জন্মই হয় বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য। ঐতিহাসিক দিক থেকে এ সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝতে হলে দেখা দরকার যে, এর ঘটনাগুলো কখন ঘটছে। ১৯৫৪ থেকে '৫৮ সালের যে রাজনীতি তার পরিসমাপ্তি ঘটে পাকিস্তান সরকার '৫৮-র ৭ই অক্টোবর যখন মার্শাল ল জারি করে। সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে দেখেছি যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা দু'জন ব্যক্তিকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। একজন হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান, আরেকজন মওলানা ভাসানী। অর্থাৎ, তাদেরকে নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল পাকিস্তানিদের। এই দুর্ভাবনায় তৃতীয় ব্যক্তিটি হবার কথা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু নথিপত্রে তা প্রকাশ পায় না। তৎকালীন পাকিস্তানি গোপন নথিতে যা প্রকাশ পায় তা হলো, পাকিস্তানিদের সাথে মার্কিন যোগাযোগ। নথিপত্র থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানি সামরিক সরকার কর্তৃক জারিকৃত মার্শাল ল'টিও ছিল অনেক বেশি মার্কিন তাড়িত। দলিলপত্র দেখলে বোঝা যায় যে, মার্কিনি পাকিস্তানিদের সকলভাবে নিয়ন্ত্রণ বা অনুপ্রাণিতই শুধু করত না, তারা প্রায় পরিচালনাই করত। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাজই ছিল সকল ব্যাপারে মার্কিনিরা কী বলছে, তাদের কী মতামত- এসব পর্যালোচনা করা। মার্কিনিদের একটা দুর্ভাবনা ছিল যে, এখানে বামরা হয়তো সবল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিক থেকে সোহরাওয়ার্দী তো বাম ছিলেন না। পাকিস্তানপন্থি মানুষ হলেও তিনি তো কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী ছিলেন। তাই তাকে নানাভাবে মামলা-মোকদ্দমা করে একরকম শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আর কোনোদিন সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি। তবে সেই পাকিস্তান পাকিস্তানিদের কাছেও ১৯৫৮ সালে শেষ হয়ে যায়। ধারাবাহিকতার দিক থেকে মার্শাল ল'ই ছিল পাকিস্তানের নতুন বাস্তবতা। সেই নতুন বাস্তবতার বিরুদ্ধে তখন অনেকেই আন্দোলন শুরু করে। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতায় যে অন্যতম ব্যক্তিটি আর গুরুত্বপূর্ণ থাকলেন না, তিনি হলেন এ কে ফজলুল হক। যিনি চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের প্রধান হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে নতুন ধারাবাহিকতার সূচনা করে। তবে এটাই সেনাবাহিনীর প্রথম ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা নয়।
এখানকার যে মানুষগুলো সাতচল্লিশ থেকে আটান্ন পর্যন্ত ছিল- সেই মানুষগুলো কিন্তু নতুন রাজনীতি করছে। নতুন রাজনীতি বলতে যা বোঝায় তা হলো, তখন আর রাখঢাক বা কোনো দ্বিধা না করে যতটুকু সম্ভব তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে চলে গেছে। তখন তারা চরম-চূড়ান্ত বা র্যাডিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই র্যাডিক্যাল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা লক্ষ্য করি, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলে স্বাধীনতার বিষয়টা তখন স্পষ্ট বা সরাসরিভাবে, মুক্তভাবে আলোচিত হয়ে ওঠে।
এই ধারাবহিকতায় ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনের পর থেকে বামপন্থিরাও নতুনভাবে সক্রিয় হতে চেষ্টা করছে; আর আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতায় রয়েছেই। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে আমরা লক্ষ্য করি যে, যদিও দুটো আলাদা দল হয়ে গেছে, তবু আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীদের মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট সদ্ভাব ও মিল রয়েছে। তারা তখন অনেকেই একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এই একসঙ্গে কাজ করার অন্যতম অবয়ব হচ্ছে 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি'। কেউ কেউ আবার একে বলেন ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট, কেউ বলেন, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি ইত্যাদি। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম সক্রিয় প্রতিষ্ঠা। প্রথম সক্রিয় প্রতিষ্ঠা এ কারণে যে, এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আমলে সৃষ্ট। সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এটি একটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ছোট একটা সংগঠন, কিন্তু তার পরেও পাকিস্তানিদের তা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। সেই কারণেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এ সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ দলটির কেন্দ্র ঢাকায় ছিল না, ছিল জামালপুরে। হয়তো গোপনীয়তার জন্য ঢাকা শহর বা কেন্দ্র থেকে দূরে এর সূত্রপাত করা হয়েছিল; মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অর্থাৎ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব :বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি- এই নামে তারা শুরু করে। আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে সব রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই সময়ে ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের নিকটবর্তী ১৫ নম্বর মোহাম্মদ আলী রোডের বাসায় 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের' একটি মিটিং হয়েছিল। এ পার্টিটি যারা গঠন করেছিলেন তাদের দু-তিনজনের নাম আমি বলতে পারি। এর মূল যিনি ছিলেন তার নাম আলী আসাদ, যাকে সবাই কালা খোকা বলে ডাকত। আলী আসাদের পরেই যিনি ছিলেন তার নাম আব্দুর রহমান সিদ্দিকী। এছাড়া ছিলেন এ আর এম সাঈদ, খন্দকার ফজলুর রহমান। এরা প্রায় সবাই ছিলেন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রধানত আওয়ামী লীগের কর্মী। তখন তো আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ নেই। কেউ কেউ বাম ও ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে জামালপুরে আলী আসাদের নেতৃত্বে শাখা কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে জামালপুরের আওয়ামী লীগের নেতা আখতারুজ্জামান, রেজাউল করিম, সৈয়দ আবদুস শরীফসহ আরও অনেকেই ছিলেন। তারা একটা নৌকার মধ্যে বসে মিটিং করেন। সেটিই ছিল ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টির প্রথম মিটিং। সিদ্ধান্ত হয় তারা স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। সে জন্য পূর্বাপর যে ধারাবাহিকতাটা চলে আসছিল- সেটি হলো তারা ভারতের কাছে গিয়ে সহায়তা চাইবে। তারপর আলী আসাদ এবং আব্দুর রহমান সিদ্দিকীরা ঢাকার দিকে চলে আসেন। অন্যরা সেখানেই থেকে কাজ করছিলেন। তারপরে টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণায়ও কমিটি গঠন করা হয়।
এ সংগঠনটির রাজনৈতিকভাবে তেমন প্রভাব হয়তো ছিল না, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটিই ছিল স্বাধীনতার প্রথম প্রচেষ্টা। মূলত ১৯৫৮ সালে এসে সবার মধ্যেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে জাগ্রত হয়ে যায়। ময়মনসিংহ-জামালপুরের মতো জায়গায় একটা দল তৈরি হচ্ছে- তারা স্বাধীনতার জন্যই তৈরি হচ্ছিল। সবার আকাঙ্ক্ষার সেই ধারাবাহিকতায়ই ১১ বছর পর স্বাধীনতার জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, 'অকস্মাৎবাদ'মুক্ত ইতিহাসের চর্চা না করলে আমরা বুঝতে পারব না যে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার চেষ্টা করছে স্বাধীন পাকিস্তান হওয়ারও আগে থেকে। সেটা ধারাবাহিকভাবে চলেছে বিভিন্ন সময়ে। এবং ১৯৫৮ সালে এসে সেটা আর দ্বিধান্বিত রইল না। [ক্রমশ]
মন্তব্য করুন