বিশ ক্রোশ দূরের গ্রাম বাকুড়া থেকে সেলিনা বেগম সন্তান লাভের আশায় মজির ফকিরের কাছে আসেন। পুকুর পাড়ের গাছপালায় বেষ্টিত মাটির ঘরের মেঝেতে পাতানো বিছানার ওপর মুখোমুখি বসে মজির ফকির গুরুগম্ভীর কিন্তু নিচু স্বরে সেলিনা বেগমকে বলেন, তোমার সন্তান কি খুব প্রয়োজন?
'জে হুজুর, আপনেই আমার শ্যাষ ভরসা হুজুর। এবার সন্তান জন্ম দিবার না পারলে, স্বামী আমাক তালাক দিবে হুজুর। বিয়া হইছে দশ বছর হইলো। এখনও আমি আমার স্বামীকে ছলপলের মুখ দেখাবার পারিনি। ছলপল না হওয়ার কারণে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সারাদিন গালি-গালাজ সহ্য করা লাগে। স্বামী তো হু বলতেই মারে, ঠুঁ বলতেই মারে। এবার ছলপল না হলে স্বামী আমাক তালাক দিয়ে বাড়িত থাকে বার করে দিবে। মা-বাপ গরিব হুজুর। ওরকরেই খাওয়াপরা জোটে না। আমাক খাওয়াবে কী। আপনে যদি দয়া না করেন, আমার আর এই দুনিয়ায় বাঁচে থাকা হবে না।' সেলিনা বেগম মজির ফকিরের পা দুটি ধরে আকুল হয়ে কাঁদে।
'আমি যা করবার কব তুমি কি তা করবার পারবিন?'
'জে হুজুর। আপনে যা করতে কবেন, আমি তাই করতে পারব। যতই কঠিন হোক আমি পারব। আমাক যে পারতেই হবে হুজুর! আপনি শুধু বলেন কী করতে হবে আমাক।'
মজির ফকির সেলিনা বেগমকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে।
'কি পারবিন?'
সেলিনা বেগম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। এরপর চোখ জোড়া তুলে মজির ফকিরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, 'পারব হুজুর।'
২.
শুকনা খুনখুনা লোহার লাকান দুটা সুপারি দ্যাখ্যায়ে ফকির বাবাজি যখন কলো, তোমার মাথাত এই বদনা ভর্তি পানি ঢালা শুরু করব আমি। বদনার পানি শ্যাষ হওয়ার আগেই তোমাক কিন্তুক এই শুপারি দাঁত দিয়া ভাঙ্গে গুঁড়া গুঁড়া করা লাগবে। কি পারবিন? বদনার পানি শ্যাষ হওয়ার পর কিন্তু ভাঙ্গলে হবে না।
সেলিনা বেগম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়া মাটির দিকিন তাকায়ে থাকে ভাবলেন, আমি কি পারব? কোথ থাকে যে আমাক আল্লায় শক্তি দিল, ফকিরের দেয়া তাবিজখান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আমি কলাম, হয় পারব। আমাক পারায় লাগবে হুজুর।
স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পাড়ার সব লোক সেলিনা বেগমকে ঘিরে ধরে শুনছে।
যখন হুজুর বদনা (তাও আবার ছোট বদনা, বড় বদনা লয় কিন্তুক) দিয়ে পানি ঢালবার শুরু করল, আমি চোখ কিটকিটা করে বন্ধ করে মনে মনে আল্লাক ডাকতে ডাকতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সুপারি দুডা কামড়াবা শুরু করলাম। ওমা বদনার পানি শ্যাষ হওয়ার আগেই আমার মুখের সুপারি দুডা ভাঙ্গে গুঁড়া গুঁড়া! সেলিনা বেগম গলায় ঝোলানো মজির ফকিরের দেওয়া তাবিজটিতে চুমু খায় বার বার।
সেলিনা বেগমের হাতে ধরা কাগজে মোড়ানো সুপারির গুড়ার দিকে তাকিয়ে তাকে ঘিরে থাকা সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, আল্লাহ তোর কপালত ছল লেকে থুছে বলেই আল্লার দয়ায় আর মজির ফকিরের তাবিজের জোরেই শুপারি ভাঙ্গার এংকা শক্তি পাছু তুই। না হলে ছোট একখান বদনার পানি শ্যাষ হওয়ার আগেই এই লোহার লাকান শক্ত সুপারি গুঁড়া গুঁড়া করার কেরামতি কারও বাপের নাই।
পাড়ার মাইকে মাগরিবের আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনা বেগমের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আর সেলিনা বেগম নিজেও জায়নামাজে দাঁড়ান এবং নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে শোকর গুজরান করেন, সেলিনা বেগমকে সুপারি ভাঙ্গার এই অসীম শক্তি দেয়ার জন্য।
দুই মাস যেতে না যেতেই সেলিনা বেগম গলা ফাটিয়ে বমি করতে শুরু করেন। তা দেখে সেলিনার স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ি মিটিমিটি হাসেন আর আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করেন। ৯ মাস দশ দিন পর সেলিনা বেগম ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিলেন।
আশপাশের দশ গ্রাম শুধু নয়, মফস্বল শহরের লোকদের মাঝেও মজির ফকিরের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। মজির ফকির শুধু ঝাড়ফুক আর তাবিজ-কবজ দেন না। নিঃসন্তান মহিলা যারা বছরের পর বছর ধরে সন্তানের আশায় ডাক্তার, কবিরাজ আর মওলানার কাছে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়ে সন্তান লাভে ব্যর্থ হয়েছেন তারা মজির ফকিরের কাছে আসার দু-তিন মাসের মাথায় গর্ভে অন্যরকম এক স্পন্দন টের পান। মজির ফকিরের কাছে আসার পর প্রত্যেক মহিলা লোহার মতো শক্ত সুপারি দাঁত দিয়ে ভাঙ্গার শক্তি অর্জন করেন এবং গর্ভধারণ করেন।
৩.
মজির ফকির লম্বা-চওড়া, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। বয়স পঞ্চাশ। গায়ের রং শ্যামলা। মাথাভর্তি মিশমিশে কালো চুল। মুখভর্তি চাপদাড়ি। চোয়াল শক্ত। বুকের ছাতি বেশ চওড়া। লুঙ্গির সঙ্গে পাঞ্জাবি পরেন। কথা খুব কম বলেন।
মজির ফকিরের পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েদের সবার বিয়ে হয়েছে। ছেলে বরকত সবার ছোট। বরকত লম্বা-চওড়া তাগড়া জোয়ান। কিন্তু কুচকুচে কালো। এক ছেলে হওয়ায় সে বেশ একরোখা আর জেদি স্বভাবের।
সকাল হলে মজির ফকির তার পুকুরের পশ্চিম পাড়ের মাটির ঘরে এসে ঠাঁই নেন। দুপুরে বাড়ি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করেন, বিকাল বিকাল আবার চলে আসেন মাটির ঘরে। রাত গভীর হলে বাড়ি ফেরেন তিনি।
ফকির সাহেব রাত-বিরাতে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের এই মাটির ঘরে যাওয়া-আসা করলেও গ্রামের অন্য মানুষেরা দিনের বেলাও পুকুরের পশ্চিম পাড়ে যাওয়ার সাহস করে না। কদাচিত গরু বা ছাগল খুঁজতে কেউ গেলে অশরীরী আত্মার চাপাকান্না শুনতে পায় সবাই। এই অশরীরী আত্মাটা নাকি মন্ডল বাড়ির যুবতী মেয়ে জোহুরা খাতুনের।
মন্ডলরা একসময় এই গ্রামে বেশ সম্পদশালী ছিল। কিন্তু তাদের বংশধররা তাদের সেই সহায় সম্পদ ধরে রাখতে পারেনি। মজির ফকির মন্ডলদের শেষ সম্বল বিশ শতক জমির ওপরের পারিবারিক কবরস্থানটা তাদের বংশধরদের কাছ থেকে কিনে নেন। কবরস্থান লাগোয়া আরও কিছু জায়গা কিনে তিনি প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর বেশ বড়সড় এই পুকুরটি খনন করেন। পশ্চিম পাশে পুকুরের মধ্যে কবরস্থানের কিছু অংশ পড়েছে আর বাকিটা উঁচু পাড় হিসেবে বিদ্যমান আছে।
জোহুরা খাতুন ছিল মন্ডল বাড়ির মেয়ে। অনেককাল আগে যুবতী বয়সে সে নাকি গলায় ফাঁস নিয়ে মরেছে। মন্ডলদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে কবর দেওয়ার পর থেকেই নাকি তার অশরীরী আত্মার কান্না শুনতে শুরু করে গ্রামের মানুষজন।
পুকুরের পশ্চিম পাড়টা বেশ প্রশস্ত। একদিকে বাঁশের ঘন ঝাড়। অন্য দিকটা বড় বড় কদম, নিম, জাম, বট, পাকুড়, আকাশ ঢাকা কড়ইসহ আরও নানাবিধ গাছে ছাওয়া। জাম গাছে টসটসে জাম ধরলেও কেউ কখনও জাম গাছের ছায়া মাড়ায় না। দিনের তীব্র আলোয়ও চারপাশটা আবছা অন্ধকারে ছাওয়া থাকে। বাঁশ ঝাড়ের নিচেই মজির ফকির মাটি দিয়ে এই ঘরটি তৈরি করেছেন। পুকুর থেকে বেশ দূরে গ্রামের উত্তর পাড়ায় মজির ফকিরের মাটির বিশাল দোতলা বাড়ি।
৪.
কয়েক বছর হলো মজির ফকির ছেলে বরকতকে বিয়ে দিয়েছেন। বউয়ের গায়ের রং টকটকে ফর্শা। দেখতেও সুন্দর। কারণ, বরকতের এক জেদ- আব্বা, আমি কালো, বউ কিন্তুক আমার দুধের মতো ফকফকা সাদা হওয়া লাগবে। দুজন কালো হলে কিন্তুক ছলপল কালো হবে।
মজির ফকিরের ছেলে হওয়ায় দুধের মতো ফকফকে সাদা আর সুন্দর বউ পেতে অসুবিধা হয়নি বরকতের। বউকে বরকত খুব ভালোবাসে। বউকে নিয়ে সে আল্লাদে আটখানা। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে বউকে একদণ্ড কাছ থেকে সরতে দেয় না। ছেলের বউ কুলসুমকে মজির ফকির মেয়ের মতোই আদর স্নেহ করেন। বিয়ে হওয়ায় একে একে পাঁচ-পাঁচটা মেয়ে চলে যাওয়ার পর কুলসুমই তার মেয়েদের শূন্যতা পূরণ করেছে।
বরকতের বিয়ের পাঁচ বছর পার হতে চলল, এখনও তার ঘরে কোনো ছেলেমেয়ে জন্মায়নি। বিয়ের দু'তিন বছর পর্যন্ত ছেলে মাঝে মাঝে বাপকে বলেছে, আব্বা, আমার ছলপল তো হচ্ছে না।
বাপ বলে, মাত্র তো বিয়া করলু বাপ। সবুর কর। কিছুদিন পর এমনি এমনিই হবে।
পাঁচ বছর পার হওয়ার পর মজির ফকিরের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। এদিকে ছেলেও এখন প্রায় প্রায় বাপকে বলে, আব্বা আর তো দেরি করা উচিত লয়। কুলসুমক তুমি মাটির ঘরত লিয়ে যায়া সুপারি ভাঙ্গার ব্যবস্থা করো।
মজির ফকির কৌশলে ছেলেকে বলে, বাপ এখনও তো সময় যায়নি। মাত্র তো পাঁচ বৎসর হলো। আরও সময় যাক। সময় থাকতে আমার বিদ্যা খাটালে কিন্তুক ক্ষতি হবে তোর, ক্ষতি হবে আমাগরে সক্কলের। তুই এক কাজ কর, কুলসুমক লিয়ে তুই রাজশাহীত যা, ডাক্তার দেখা। ডাক্তারের ওষুধ খায়ে যদি ছলপল হয় তো ভালয়, আর না হলে তো আমি আছিই।
মজির ফকিরের শেষ আশার প্রদীপটিও নিভে গেল। রাজশাহীর ডাক্তার বরকতের বীর্য পরীক্ষা করে জানায় তার কোনোদিন সন্তান হবে না। তবে কুলসুমের কোনো সমস্যা নাই।
মজির ফকিরের কপালে চিন্তার রেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকেন। তার বউ বিছানায় পড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘোঁ-ঘোঁ করে নাক ডেকে ঘুমায়। একমাত্র ছেলের যে পাঁচ বছর ধরে সন্তান নাই সেটা তাকে ভাবায় না। আর ভাবাবেইবা কেন। দশ গ্রাম কি, পঞ্চাশ গ্রামের পুরুষদের আঁটকুড়ে নাম ঘুচিয়েছে তার স্বামী। নিজের ছেলেকে নিয়ে কিসের চিন্তা। সময় হলে বাপ ঠিকই ছেলের ঘরে সন্তান আনার ব্যবস্থা করবে।
৫.
আট বছর পার হয়ে গেল বরকতের ঘরে এখনও কোনো ছেলেমেয়ে জন্মায়নি। বাপকে মাঝে মাঝে তাড়া দেয় সে। কিন্তু বাপের সেই এক কথা, এখনও তো সময় যায়নি। আরও সময় যাক। সময় থাকতে আমার বিদ্যা খাটালে কিন্তুক ক্ষতি হবে সক্কলের। সময় যাবার দে।
বরকত বেশ বুঝতে পারে সময় নাই। বাপের কথাও তো ফেলতে পারে না। ফকির মানুষ। অনেক কিছুই বোঝে। তাড়াহুড়া করলে যদি আবার কোনো ক্ষতি হয়। বাপ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সময় হলে বাপ নিশ্চয় ব্যবস্থা করবে। তার বাপের এই বিদ্যার কারণে শয়ে শয়ে মেয়ে মানুষ গর্ভধারণ করে। কুলসুমের গর্ভধারণ না করার কোনো কারণ নাই।
বরকতের বন্ধু-বান্ধবরা এবং গ্রামের অন্যান্য লোকজন বরকতকে আড়ালে আবডালে এতদিন আঁটকুড়ে বলেছে। এখন একদম মুখের ওপর বলতে শুরু করেছে। একদিন তার এক বন্ধু বলল, ক্যারে, তোর বাপ সারা দুনিয়ার মানুষের হাঁটকুড়া নাম ঘোচাওচে আর লিজের ব্যাটাক হাঁটকুড়া করে থুছে ক্যা! আর এক বন্ধু ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে বলে, ক্যারে বাপ তোক ইংক্যা হাঁটকুড়া করেই থুবে সারাজীবন। ছলপলের মুখ কি কুনদিন দেখপার পাবু না।
কথাগুলো শুনে বরকতের মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল, চোখে রক্ত উঠে গেল। এতদিন আড়ালে-আবডালে তাকে আঁটকুড়ে বললেও মুখের ওপর কেউ বলার সাহস করেনি। মজির ফকিরের ছেলে বলে সবাই তাকে যথেষ্ট সম্মান করে, সমঝে চলে। এখন মুখের ওপর এমন অপমান! বন্ধুদের দিকে পাকামরিচের মতো টকটকে লাল চোখ জোড়া নিক্ষেপ করে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
৬.
মজির ফকির আজকাল পুকুর পাড়ের মাটির ঘরে খুব বেশি যায় না। লোকজন যারা আসে তাদের বেশিরভাগই ফিরে যায়। যারা খুব হাত-পা ধরে আকুতি মিনতি করে, কান্নাকাটি করে। আসা-যাওয়া করতে করতে বাড়ির উঠানের মাটি গভীর করে ফেলার দশা করে তাদের জন্য মাঝে মাঝে যায়। সারাক্ষণ বাড়িতে বসে ঝিম মেরে চিন্তা করে। সারারাত দুই চোখের পাতা একত্র করতে পারে না। চিন্তায় তার দিশেহারা অবস্থা!
বারান্দায় ঝিম মেরে বসে থাকা বাপের দিকে অগ্নিমূর্তি নিক্ষেপ করে বরকত ঘরের দরজা দরাম করে বন্ধ করে চিৎকার করে বলতে থাকে, কাল দিনের মধ্যে যদি আমার হাঁটকুড়া নাম ঘোঁচানোর ব্যবস্থা না করিন তাহলে আমি এই ঘরের ফ্যানের সাথে ঝুলে মরমু এই কয়া দিনু। বাড়ির লোকেরা চিৎকার দিয়ে পড়ি মরি করে ছুটে আসে। দরজা ধাক্কায়। অনুরোধ করে। বরকত দরজা খোলে না। পাড়ার অনেক লোকও ইতোমধ্যে জড়ো হয়েছে। বন্ধ ঘর থেকে বরকত চিৎকার করে শুধু এক কথায় বলে চলেছে। সবাই মজির ফকিরের কাছে এসে বলে, কুলসুমক তুমি এখনই মাটির ঘরত লিয়ে যাও। বরকতের মা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, সামিস্যা কি তোমার? সারা দুনিয়ার ম্যায়া মানুষ মাটির ঘরত আসার পর পোয়াতি হয়। আর তোমার ব্যাটার বউ আট আটটা বছর ধরে পোয়াতি হউচে না সেডা কি তোমার চোখত পরোছে না। ব্যাটাক তুমি হাঁটকুড়া বানে থুছিন। গায়ের ব্যাবাক মানুষ হামার ব্যাটাক হাঁটকুড়া কয়।
মায়ের মুখ থেকে হাঁটকুড়া শব্দটা কানে যেতেই বরকতের মাথায় আগুন ধরে যায়। সে দরাম করে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, ওই বুড়ি চুপ করবু। দরজায় লাগানোর মোটা লাঠিটা নিয়ে এসে মায়ের দিকে তাক করে বলে, এই লাঠির বাড়ি দিয়ে তোর মাথা কলে ফাটে ফেলামো। তোর ভাতারক ক, কুলসুমক এখনই মাটির ঘরত লিয়ে যাক।
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বরকত। এমনিতে সে রাগী আর একরোখা স্বভাবের তা ঠিক, কিন্তু মা-বাপকে কখনও সে এমন অপমান করে কথা বলেনি। আসলে বরকতেরইবা দোষ কি। আট-আটটি বছর ধরে সে তো ধৈর্য ধরেই ছিল। বাপের ওপর ভরসা করেই গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এখন তাকে মুখের ওপর আঁটকুড়ে বলতে শুরু করেছে। দেয়ালে একদম পিঠ ঠেকে গিয়েছে বরকতের।
দরাম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বরকত বলে, না হলে আমি কিন্তুক ঘরের ফ্যানত ঝুলে মরমু।
বাড়ির লোকেরা এখনই মানে এই সন্ধ্যাবেলায় কুলসুমকে মাটির ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করলে, মজির ফকির বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ছেলে বরকত যেন শুনতে পায় এমন উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, আজ লয় কাল সকালে লিয়ে যাব। এখন আমি মাটির ঘরত যায়া সারারাতে সব জোগাড়যন্তর করি। কাল সকালে আসে লিয়ে যাব কুলসুমক।মজির ফকির তার লম্বা লম্বা পা ফেলে মাটির ঘরের দিকে রওনা দেন। বাপের কথায় ভরসা পেয়ে বরকত ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
৭.
সকাল দশটা। এখনও মজির ফকির কুলসুমকে নিতে আসছে না দেখে বরকতসহ বাড়ির সবাই পুকুর পাড়ের মাটির ঘরের দিকে রওনা হয়। মাটির ঘর থেকে কয়েক হাত দূরে বিশাল কড়ই গাছটার মোটা একটা ডালে মজির ফকিরের মৃতদেহটি ঝুলতে দেখে সবাই নিশ্চিত হয় এটি মন্ডল বাড়ির যুবতী মেয়ে জোহুরা খাতুনের অশরীরী আত্মার কাজ!