পর্ব-১৮
ধারাবাহিক আঘাতের চূড়ান্ত পর্যায়
১৯৬৬ সাল এবং তৎপরবর্তী সময়ে ৬ দফার সাবল্য কতটা ছিল সেটা আজকের দিনে বসে আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, এই রাষ্ট্রের অনেকগুলো সমস্যা ও জটিলতা ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে এবং এগুলো পাকিস্তানের কাঠামোকে আঘাত করছে। এই রাষ্ট্রের প্রধান বা মৌলিক যে দুর্বলতা সেটি হলো, এটা একটি একক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র নয়। এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতি এই চ্যালেঞ্জটা এসেছে তার নিজের ভেতর থেকেই। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান বলতে পশ্চিম পাকিস্তানকেই বোঝানো হয়েছে- কিন্তু সেটা তাদের সংকটের জায়গা ছিলো না। সংকটের জায়গা হয়ে গেছে সেটা- যাকে অনেকটা জোর করে তারা নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছে, সেই পূর্ব পাকিস্তান। এই জোর করে ভিন্ন ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক একটি দেশকে নিজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রে এর জন্ম থেকেই একটি কাঠামোগত দুর্বলতা বিরাজ করছে। এই কাঠামোগত দুর্বলতা বা ভুল-নির্মাণটা পাকিস্তানকে বারবার আঘাত করছে। আঘাতটা পঞ্চাশে হচ্ছে, বায়ান্নতে হচ্ছে, চুয়ান্নতে হচ্ছে, সাতান্নতে হচ্ছে, আটান্নতে হচ্ছে, বাষট্টিতে হচ্ছে, পঁয়ষট্টিতে হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত ছেষট্টিতে চূড়ান্তভাবে হচ্ছে ৬ দফার মাধ্যমে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই যে কাঠামোর দুর্বলতা- সেটার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সবল আঘাতটা হচ্ছে ৬ দফা। এটি এসেছে এই কাঠামোর ভেতর থেকেই। চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ এবং এর পর থেকে একের পর এক যে আন্দোলন-প্রতিবাদগুলো হয়েছিলো- সেই পূর্ব পাকিস্তান গঠন করবার আন্দোলন এবং একত্রিত পাকিস্তান গঠন করার পর আলাদা হওয়ার যে প্রচেষ্টা; সবগুলোই ছিল এই কাঠামোর দুর্বলতা থেকে।

পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়া
৬ দফা যখন এলো, এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, এই ৬ দফা ও পাকিস্তান একসঙ্গে টিকতে পারে না। এবং একসঙ্গে টিকতে পারে না বলেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটছে। রাজনীতিতে তখন ৬ দফার বাইরে আর কোনো রাজনীতি থাকছে না। অন্য টুকরো-টাকরা রাজনীতি হয়তো আছে কিন্তু মূল রাজনীতির ধারা তখন এই ৬ দফা। শুরু থেকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৬৬ সালে এসে এরকম চূড়ান্ত রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মোকাবিলা করা আর সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আইয়ুব খানের সময়ে যদিও এটা ঘটছে- কিন্তু আইয়ুব খান সেনাবাহিনীরই একটি সিভিলিয়ান অংশ। ৬ দফার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে গালি দেওয়া হচ্ছে, শেখ মুজিবকে গালি দেওয়া হচ্ছে- কিন্তু বিষয় সেটা নয়, বিষয়টা হচ্ছে কোন যুক্তিতে বা কোন ভিত্তিতে তারা এটা বলবে যে, এই ৬ দফা আমরা মানি না? যেখানে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এটা বাস্তবায়িত হওয়া মানে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই এটাকে যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে।
১৯৬৭ সালে ৬ দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজাচ্ছে। আমরা যদি স্বাধীনতার প্রচেষ্টাগুলো দেখি, যেগুলো সাতচল্লিশ থেকেই শুরু হয়েছে। ধারাবাহিকতার দিক থেকে নিরিখ করলে সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, সাতান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি এভাবে একের পর এক যতগুলো আন্দোলন প্রচেষ্টা হয়েছে- তার সবগুলোই ছিল স্বাধীনতার প্রচেষ্টা। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রকাশে। সেই দিক থেকে দেখলে- ১৯৫৪ সালে যখন ফজলুল হককে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখনও বলা হচ্ছে যে, এরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যেতে চায় যদি না পাকিস্তান এদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না দেয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী বলছে, আমরা পাকিস্তানকে আসসালামালাইকুম দেব, যদি আমাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো না দেওয়া হয়। ঠিক একইভাবে কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও সেই একই কথা বলছে। তারাও বলছে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যথাযোগ্য সুবিধাদি না পেলে দেশ স্বাধীন করা হবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাবনায় পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এটা জন্ম থেকেই ছিল। কিন্তু ১৯৬৮ সালে এসে পাকিস্তান এমনই এক স্বাধীনতা প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অতিশয় তৎপর হয়ে ওঠে এবং এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' নামের এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত; কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার ও সিপাহি অতি গোপনে সংগঠিত হচ্ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা কখনও সম্ভব নয়, এটা বুঝতে পেরে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে যায়। শুরু হয় সরকারের গ্রেপ্তারি তৎপরতা। আইয়ুব সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেপ্তার করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে ঘোষণা করে যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় ২ জন সিএসপি অফিসারসহ আটজনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ পায়। এতে অভিযোগ করা হয় যে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র দপ্তর ১৮ জানুয়ারিতে আবার অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে। শেখ মুজিবুর রহমান, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউল্লাহ, প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরীসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু শেখ মুজিবকে এই মামলায় যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান সরকারের যে উদ্দেশ্য- সেটা তখন পরিস্কার হয়ে যায়।

জনগণের অনাস্থা এবং পাল্টা আঘাত
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়িত করার বিষয়টিকে কেউই বিশ্বাস করেনি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি ছিল- সেটি সংশ্নিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেই বোঝা যায়। কিন্তু এর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়ানো কেন? তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা হলে সেই '৬২-৬৩ সালেই তো হতে পারত; যখন তিনি মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীদের সঙ্গে ভারতে গিয়েছিলেন! কিন্তু তখন তো মামলা হয়নি।
'৬৬ সালের এই সেনা কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার কথা শেখ মুজিব জানতেন- কিন্তু তিনি তার অংশ ছিলেন না। মূলত বাংলাদেশের খুব কম স্বাধীনতা প্রচেষ্টাই আছে, যেটা শেখ মুজিব জানতেন না। বাষট্টি-তেষট্টির পরে তিনিই প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অতএব তিনি যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানবেন এবং তিনি যে স্বাধীনতাপন্থি- এটা সবারই জানা। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারটা শুরু হলো। কিন্তু সেই বিচারটা করতে গিয়ে, পাকিস্তান যে রাষ্ট্র হিসেবে দুর্বল সেটা আরেকবার উন্মোচিত হয়ে গেল; যখন জনগণ সম্পূর্ণরূপে তাদের বিপক্ষে চলে গেল। বাংলাদেশে তখন আন্দোলনটা শুরু হয়ে যায়। রাজনীতি যখন এরকম একটা পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন তার কলাকুশলীদের আর দোষী করার সুযোগ থাকে না। আমরা বলি যে, কোনো মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে না, কোনো মানুষই দোষ-গুণের বাইরে না। কিন্তু ১৯৬৬-৬৭ সালে পরিস্থিতিটা সেরকম ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানিদের সব আইনের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তিনি তখন রাজনীতিতে সব দোষের বাইরে চলে গেছেন। কেউ তাই বিশ্বাস করেনি- পাকিস্তানিদের করা এই ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের জড়িত থাকার ব্যাপারটি। সবাই এক বাক্যে ভেবেছে যে, এটা পাকিস্তানিদের বানানো।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে ছাত্ররা রাস্তায় নামছে, অন্যান্য মানুষেরাও নেমেছে রাস্তায়। জনগণের ভাবনার বিষয়টিই হচ্ছে যে, এই বিচার আমরা মানি না। জনগণের রায়ই তখন বড় রায়। অর্থাৎ, এরকমভাবে জনগণই যখন রাষ্ট্রে পরিণত হতে থাকে- যে কোনো উপায়েই তারা সংগঠিত হয়। সেদিনের সেই সংগঠনের প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে '৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলন।
আতাউস সামাদ ভাই আমাদেরকে বলেছিলেন এবং এটা তার অনেক লেখাতেও পাওয়া যায় যে, বিচার যখন চলছে শেখ মুজিব সামাদ ভাইকে ডাকলেন। ডেকে বললেন যে, 'সামাদ, তুই যা, গিয়ে হুজুরকে (মওলানা ভাসানী) বল যে, সময় হয়েছে'। সামাদ ভাই সেদিন আশ্চর্য হয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিবকে প্রতিউত্তরে জিজ্ঞেস করছেন- 'এইটুকু বললেই বুঝবে!'; শেখ মুজিব জবাবে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ বুঝবে, তুই যা।' শেখ মুজিব এই মামলা এবং বিচার নিয়ে একেবারেই ভীত ছিলেন না। বেশ সবলভাবেই তিনি সামাদ ভাইকে কথাগুলো বলেছিলেন। সামাদ ভাই গেলেন ন্যাপের সাইদুল হাসানের বাসায়। সেখানে তিনি মওলানা ভাসানীর দেখা পেলেন। ন্যাপের সিরাজুল হোসেন খানসহ আরও কয়েকজন ছিলেন ওখানে। ভাসানী সামাদ ভাইকে কীসব ব্যাপার নিয়ে বকাবাদ্য করেছিলেন- কিন্তু তারপর যখন সামাদ ভাই উনাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন যে, আমি কোর্ট থেকে এসেছি- আপনাকে একটি বার্তা দিয়েছেন শেখ মুজিব। তিনি বললেন কী বলেছে মুজিবর? সামাদ ভাই বললেন, 'সময় হয়েছে'। মওলানা ভাসানী অনেকটা উচ্চস্বরে কথাটা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, 'কী বলেছে- সময় হয়েছে?'। সামাদ ভাইয়ের পুনরায় হ্যাঁসূচক উত্তরে ভাসানী বললেন, 'আচ্ছা, ঠিক আছে'। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা বোঝাপড়া ছিল। যে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই তারা সেদিন চূড়ান্ত সময়ের বার্তা আদান-প্রদান করেছেন। এবং তারপর থেকেই গায়েবানা জানাজা থেকে আরম্ভ করে অন্য সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সক্রিয়তা শুরু হয়ে গেল।

দাবানল জ্বলে উঠল
শেখ মুজিব এবং মওলানা ভাসানীর মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ছিল। আমরা যে রাজনীতিতে দু'জনকে আলাদা করে দেখি সেটা আমাদের দুর্বলতা। আমাদের রাজনীতির যে বিভিন্ন রকম সংঘর্ষ, সহিংসতা ও বিদ্বেষ- আজকের দিনে যা এত বড় আকার ধারণ করেছে, সেসব আমাদের ইতিহাস চর্চায় প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমি একাধিকভাবে বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা ভাসানীর রাজনীতি ঘনিষ্ঠ রাজনীতি। তারা আলাদা হোক, আলাদা দল করুক কিংবা মওলানা ভাসানীর সংগঠন দুর্বল, শেখ মুজিবের সংগঠন অনেক সবল- কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে দু'জনের মধ্যে যে সন্ধিটা ছিল, সেটা আমাদের রাজনৈতিক বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের জায়গা থেকে আমরা ধরতে পারি না।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে যখন ব্যাপকভাবে আন্দোলনটা শুরু হলো- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একবার আসামিদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আইয়ুব খান বলেছে, না, আমি ছেড়ে দিতে পারি না; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জড়িত। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে এসব কোনো যুক্তিই আর টিকল না। একটা পর্যায়ে গিয়ে মামলার বিচার যেখানে চলছিল, সেখানে গিয়ে বিচারকদের বসার জায়গাশুদ্ধ আগুন ধরিয়ে দিল জনতা। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে যে, জনগণের পক্ষ থেকে এ বিচারকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হচ্ছে। এমনই একটা সময়ে মামলার একজন অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তাকে পালাতে দিয়ে গুলি করে মারে। যে কোনো কারণেই হোক তাদের কাছে হয়তো মনে হয়েছে, সার্জেন্ট জহুরুল হককে মারা দরকার, তাই মেরে ফেলেছে। অতএব এমন তেতে ওঠা অগ্নিকুণ্ডময় সময়ে যে মামলা নিয়ে মানুষের এত অসন্তোষ- সেই মামলারই একজন আসামিকে যদি খুন করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়ায়, সেটা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। পাকিস্তানিরা নিজেরাই নিজেদের আত্মহত্যার আয়োজন সম্পন্ন করল আর কী। আর তাতে কী হলো? তাতে আইয়ুব খান শেষ, ওই মামলাও শেষ আর পাকিস্তান তো শেষই। শেখ মুজিবুর রহমান বের হয়ে এলেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, এই মামলার বিরুদ্ধে জনগণের যে আন্দোলন-বিক্ষোভ- তার সবই কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আঘাত। সেনাবাহিনীর সরকার অর্থাৎ যারা মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতায় এসেছিল- তারাই এবার বলছে নির্বাচন দেবে। আর নির্বাচন দেওয়ার পরে কী হয়েছিল তা আমরা জানি। [ক্রমশ]