সমুদ্র আমাকে কেন যে এত টানে আমি বুঝতে পারি না। প্রথমবার সমুদ্রের কথা শুনেছিলাম বাংলার ক্লাসে। 'সিন্ধু' কবিতা পড়াতে গিয়ে আক্কাস আলী স্যার বুঝিয়েছিলেন, নজরুল কুমিল্লা থেকে প্রায় পালিয়ে চট্টগ্রামের কাছে পতেঙ্গা সমুদ্রবন্দরে দাঁড়িয়ে সাগরের কাছে তার বিরহী আত্মার আকুতি প্রকাশ করতে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। সাগরকে এক বিরহী প্রাণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করে, 'ও সিন্ধু, বন্ধু মোরা' বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন।
সাগর কি নজরুলকে তার বিরহী প্রেমকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল?
নজরুলের কথা থাক।
সাগরের কথা বলি।
সাগরের গল্প শোনার অভ্যাস আমার সুদূর শৈশবের। এই সাগরের ওপর প্রায় পুরোটা জীবনের কর্মময় সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবা, আমার দাদা, আমার নানা। দাদার কোলে বসে বসে অশীতিপর নাবিক জীবনের গল্প শুনেছি অনেক। সে যতটা না সাগরের গল্প, তার চেয়ে জাহাজের, কাপ্তানের বয়-বাবুর্চির। ব্রিটিশ জাহাজে চাকরি করতেন আমার দাদা আর নানা, দুই বন্ধু। মাঝে মাঝেই একই জাহাজে তাদের ডিউটি পড়ে যেত। শেষবার যখন এই ডিউটি পড়ে তখন দুই বন্ধু জাহাজের ডেকে বসে সিদ্ধান্ত নেন- তাদের দুইজনের পুত্র-কন্যাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে তারা পরস্পরের বেয়াই হয়ে যাবেন। হলেনও তাই।
এর অল্প পরে দাদা জাহাজের চাকরি থেকে অবসর নেন। বাবার চাকরি হয় জাহাজে। এরপর বাবার কাছ থেকে জাহাজের গল্প শোনা, বিদেশের গল্প শোনা, সমুদ্রের গল্প শোনা।
সমুদ্রের বীভৎস রূপ শরৎচন্দ্র যেভাবে পেয়েছিলেন সেভাবে তেমন কেউ পাননি। আমি শরৎচন্দ্রের রেঙ্গুন যাত্রার যে কাহিনি 'সমুদ্র সাইক্লোন' নামক অধ্যায়ে পড়ে সমুদ্রকে যে পরিমাণ কঠিন ও ভয়ংকর বলে মনে করেছিলাম, সমুদ্র আসলে সে রকম কদাচিৎ হয় মাত্র। মাঝসমুদ্রে নাকি তেমন কোনো ঢেউই থাকে না। কিনারার কাছে এসে তার ঢেউ হয়। যে সমুদ্র যত গভীর তার নাচানাচি তত কম। আর সমুদ্রের ওপর কয়েক ঘণ্টা জাহাজ চলাচলের পর কোনটা সামনে কোনটা পেছনে, কিছু বোঝা যায় না। ডানে-বামে-সামনে-পেছনে, শুধু পানি আর পানি।
আমি প্রথম সমুদ্র দেখি ফৌজদারহাট গ্রামের পাশের এক সৈকতে। ক্যাডেট কলেজ থেকে একবার আমাদের দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিচ ভলিবল খেলার জন্য। তখন সমুদ্রের পানির ছোঁয়া পাইনি। পানি থেকে অনেক দূরে বালিয়াড়ির ওপর টাঙানো নেটে আমরা ভলিবল খেলেছিলাম এক বিকেলে।
সাগরকে বুকের ভেতর নিয়েছিলাম আমি আরও অনেক পরে। সে ১৯৮৩ সালে, দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় আবার সেই ক্যাডেট কলেজ থেকে যখন তথাকথিত 'শিক্ষাসফর'-এ আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কক্সবাজার। নানা বিষয়ে 'শিক্ষা গ্রহণ', এরপর বিকেল বেলা আমরা সমুদ্রের কাছে যাই। হাফপ্যান্ট পরে সমুদ্রের পানিতে নামি। সেই প্রথম আমার সমুদ্রের জল ছোঁয়া, সমুদ্রের জলের স্বাদ নাকি নোনা। আমি বইয়ে পড়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক গল্প আছে এ নিয়ে। যে মেয়েটি সমুদ্র দেখতে পারেনি, সে তার কপোল বেয়ে পড়া অশ্রুর ফোঁটা জিহ্বায় লাগিয়ে স্বাদ নিয়েছিল সমুদ্রের। আমি সমুদ্রে নেমে সম্ভবত এ কাজটিই প্রথমে করেছিলাম। হাতের তালুতে পলি-বালুমাখা সমুদ্রের জল নিয়ে জিবে চেটে দেখেছি-আসলেই। সমুদ্রের জল নোনা হয়। এই পানি কায়দা করে আটকিয়ে লবণ বানানো যায়।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গিয়ে আমি একটি কবিতার দু'লাইন লিখেছিলাম। আমি প্রায়ই এই দুই লাইন নানা জায়গায় উদ্ধৃত করি।
লাইন দুটো ছিল এমন-
'কতদূর যেতে পারি, কতদূরে যাব আমি আর
সমুখে সমুদ্র দেখি, পেছনে পাহাড়।
কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম তখন। কিন্তু এই দুই লাইন লেখার পর এই কবিতার আর কোনো লাইন আমার আসেনি। মনে হয়েছে কবিতা লেখা শেষ হয়ে গেছে। হিমছড়ির কাছে পেছনে পাহাড় আর সামনের সমুদ্র দেখে এমন মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, অতি ক্ষুদ্র এই মানুষ, আমি আসলে এই সমুদ্র আর পাহাড়ের দৌরাত্ম্যের মাঝে আটকানো সামান্য এক জীব মাত্র। জাগতিক উপকরণ হিসেবে যেখানে পাহাড় আছে, যেখানে সমুদ্র আছে, সেখানে আমি মানুষ কেন, এক অতি নগণ্য কোনো জীব।
সাগর আর পাহাড় এ দুটোকেই আমার প্রায়ই একের পরিপূরক বলে মনে হয়েছে। পাহাড়কে নানা জায়গায় গিয়ে চিনেছি। আন্দিজ দেখেছি, আল্‌পস দেখেছি, দেখেছি হিমালয় আর অন্নপূর্ণার সারি। সেখানে সাগর থেকে দূরে স্বতন্ত্র অবয়ব নিয়ে পাহাড়েরা পিঠ উঁচিয়ে শুয়ে থাকে। তবে বড় পর্বত নয়, এমন সব পাহাড়ের পাশে সাগরকে সম্প্রীত হতে দেখেছি অনেক জায়গায়। যেখানেই সাগর শেষ হয়েছে, সেখান থেকে পাহাড়েরা সাগরকে আগলে রাখে। সাগর আর পাহাড়ের মধ্যে এক ধরনের মিলমিশ থাকে। মনে হয় বিরহী সাগরের ঢেউ এসে শেষ আশ্রয়টুকু পাহাড়ের তলায় সমর্পিত হয়।
১৯৯১ সালে এক ভোরে কক্সবাজারের কলাতলীর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার দুই ক্লাসের বড় ভাই খন্দকার তাজউদ্দিন শীতের সকালে। বলেছিলেন, ভোরবেলায় সমুদ্র না দেখলে সমুদ্রের আসল চেহারা বোঝা যাবে না। আমি গিয়ে দেখি, অনেক শান্ত এই সাগর। আসলে কি শান্ত ছিল? কলাতলীর সামনে কুয়াশা ভেজা সাগর এক পাড়ে। যেখান থেকে পাহাড় শুরু হবে এক চিলতে অবয়বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু। আমি সমুদ্র দেখা বাদ দিয়ে এই শিশুর ছবি তুলতে শুরু করি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই ছোট্ট শিশুটিই আসলে আমাদের এই ক্ষুদ্র মানব জাতির প্রতিনিধি। সাগরের কাছে এলে নিজেকে এর চেয়েও ছোট কিছু যদি থাকে, তা-ই মনে হয় আমার।
সাগরকে একেবারে বুকের ভেতর নেবার আকাঙ্ক্ষায় একবার আমার এক কাপ্তান বন্ধুকে বলেছিলাম জাহাজে একটা চাকরি আমাকে দিতে। সে পারেনি। সাগরের ওপরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত থাকার কোনো অভিজ্ঞতা আমার হলো না। আর সদরঘাট থেকে জাহাজে করে সুন্দরবন যেতে ৪-৫ রাত জাহাজের কামরায় থেকে আসল সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া যায় না। খানিকটা একবার পেয়েছিলাম ভিয়েতনামের মুই'নিতে। সমুদ্রের পাড়ে জেলেপাড়ার এক ট্রলারে জেলেদের পটিয়ে মাইল দশেক দূরের এক ট্রলারে গিয়েছিলাম আরেক ট্রলার থেকে মাছ নিয়ে আসার জন্য। সে আমার তখন পর্যন্ত তীর থেকে সমুদ্রের সবচেয়ে ভেতরে যাওয়া। সে ভেতরটুকু আবার সে রকম ভেতর ছিল যেখান থেকে তার তীরকে আর চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। মজাই পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, ফেরার পথে ট্রলারের চালক যদি পথ ভুল করে আরেকদিকে চলে যায় আমি হয়তো বার্মা, না হয় থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর চলে যেতে পারি। কিন্তু হয়নি।
এর আগে, সমুদ্রপথে পাড়ি দিতে গিয়ে ঝানু ঝানু কাপ্তানেরা পথ ভুল করে অপর দেশে পৌঁছেছেন, এমন খবর জানি। আগের দিনে, যখন দেশের সীমানা নির্ধারণ হতো তার সমুদ্রসীমা দিয়ে তখন মানুষ এই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরেক ভূখণ্ডে গিয়ে ডাকাতি করত। ডাকাতের ভয়ে অনেক নিরীহ লোক এলাকা ছেড়ে চলে গেল ডাকাতেরা রাজ্য জয় বা আবিস্কার করেছে ঘোষণা দিয়ে তার দেশের প্রতিভূূ গড়ে তুলত নতুন দেশে। এ কাজে পারঙ্গম ছিল ইউরোপীয় নাবিকেরা। যন্ত্র আবিস্কারের আগে শুধু পাল তোলা নাও দিয়ে কী করে এসব সমুদ্র তারা পাড়ি দিত, সেসবের কাহিনি নানা জায়গায় মজা করে লেখা হয়েছে। পড়তে পড়তে শিহরিত হয়েছি বারবার।
ক্যাপ্টেন স্কট উত্তর মেরুতে যাবার জন্য যে জাহাজ বানিয়েছিলেন সেটি আমি দেখে এসেছি স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরে। এই জাহাজের ভেতরের কামরাগুলো, ইঞ্জিন, মাস্তুল সবকিছুর সাথে সাগর ও তার অথৈ জলরাশির নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। ছোট ছোট সাগর দেখা হয়ে গেছে আমার। বড় সাগর বা মহাসাগরও দেখা হয়েছে দুটো। আটলান্টিক আর প্রশান্ত। প্রশান্ত মহাসাগরকে দেখেছি অন্তত তিন জায়গা থেকে। একটি চিলির ভেলপারাইসো থেকে, এরপর অস্ট্রেলিয়া আর পাপুয়া নিউগিনি থেকে। প্রশান্ত মহাসাগরের জল ছুঁয়েছি। ওপর দিকে নৌকায় ভেসেছি। এই সাগরটি দেখে আমার মনে হয়েছে, যে যত গভীর সে তত স্থিত। যত কম গভীর হয় তত বেশি নাচানাচি সে করে।
তবে কোনাকুনি আস্ত এক সাগরের দুটি ছোট দূরত্বের প্রান্ত পার হবার এক অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম একবার ২০১১ সালে। সুইডেন থেকে পোল্যান্ড যাওয়ার জন্য শর্টকাট কম খরচের যে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছিলাম সেটা ছিল ২৭ ঘণ্টায় পুরো বাল্টিক সাগর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার ফেরিতে উঠে পড়া। এই ছিল আস্ত সাগরের বুকে টানা এক দিনের বেশি সময় সাগরের ওপর থাকার সুযোগ।
ফেরিটাতে উঠে দেখি খুব অল্পসংখ্যক দরিদ্র যাত্রী এখানে উঠেছেন, যাদের বেশিরভাগই ট্রাক বা লরির চালক। আস্ত লরি ঢুকে গেছে জাহাজের পেটের মধ্যে। আর দুইজনি খুপরিগুলোতে যাত্রীদের বাস। সে বিকেলটা ছিল অবিস্মরণীয় সুন্দর এক বিকেল। ডিমের কুসুমের মতো লাল সূর্যটা কালচে হয়ে যাওয়া ঘন নীল পানির ভেতর টুপ করে ডুবে যাওয়ার এমন মনোরম দৃশ্য এর আগে আমি কোথাও দেখেছি। ছবিতে দেখেছি অনেক, বাস্তবে নয়। খুব ভালো করে সমুদ্রে সূর্য ডোবার দৃশ্য কক্সবাজারের সৈকত কূল থেকে আমার কখনোই দেখা হয়নি, কিন্তু সুন্দরবনের কাছে এই বঙ্গোপসাগরের ওপর এক রাতে চন্দ্র উদয় হবার দৃশ্য আমি দেখে পুলকিত হয়েছিলাম। আমি এই ছবিটাকেও আমার তোলা অন্যতম প্রিয় ছবি হিসেবে মার্ক করে থাকি।
সমুদ্রে সূর্যোদয় আমি একবারই দেখেছিলাম। সেটা সেই বাল্টিক সাগরের ওপর, সেই জাহাজের ফেরিতেই। সেই জাহাজের দুই বেডের খুপরিতে আমার সহযাত্রী লাভলু ভাই কামরার সাথে লাগানো বৃত্তাকার জানালার শাটার খুলে ঘুমিয়েছিলেন। বলেছেন, আমাদের পায়ের দিকে পূর্ব। সূর্য উঠবে সকালে। সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়লে ঘুম ভাঙবে। দেখবি, সমুদ্রে সূর্যোদয়।
লাভলু ভাইর কথা ফলেছিল। বিছানায় শুয়ে শূন্য ডিগ্রিতে পানির ওপর থেকে যেন কমলা রঙের একটি পিতলের বাটি ধীরে ধীরে উঠে আসছে। যতক্ষণ ধরে এই সূর্যের কিরণ এসে চোখের পাতার ওপর অত্যাচার করা শুরু না করল, ততক্ষণ পর্যন্ত চেয়ে চেয়ে এই সূর্যোদয়ের যে ছবি তুলেছিলাম, এমন ইমেজ আমার করোটিতে আটকে আছে।
বাল্টিক সাগরের বুকে এই সাতাশ ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রার ভেতর আমি বারবার আমার বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করি। এই জাহাজে লিফট আছে, সিঁড়ি আছে। ছোট্ট সিঁড়ি। আমি এক-দুইটা সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে যাই, উপরে উঠি। ডাইনিং হলে যাই। খাবার খাই। জাহাজ যখন চলে, ঠিক মনে হয় না যে পানির ওপর ভাসমান কিছু চলছে। নৌকা চড়ে বা লঞ্চে চড়ে যেমন মনে হয় তার কিছুই না। টেবিলের ওপর পানির গ্লাস ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মনে হলো একটা মার্বেলকেও রেখে দিলে মনে হয় এর নড়চড় হবে না।
জাহাজের ক্রুরা যেখানে থাকে, যেখানে ঘুমায়, তার কিছুই আমার দেখা হলো না। দেখলাম নিজের কামরা, আর একটা গরিব প্যাসেঞ্জারের লাউঞ্জ। যারা চেয়ারে বসে বসে আর হাতব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে যাত্রা শেষ করেছে। আমিও আমার বাবা-মার সাথে একবার জাহাজে চড়েছিলাম, আমার যখন পাঁচ বছর বয়স। চট্টগ্রামের কোনো এক বন্দরে কোনো এক জাহাজের ভেতর গিয়েছিলাম। আমার তেমন কিছুই মনে নেই। শুধু ঝাপসা মনে আছে খুব ঠান্ডা এক ঘরের ভেতর গিয়ে দেখেছিলাম অনেকগুলো মাংসের বড় বড় অংশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার খুব শীত লেগেছিল। আমি নাকি ভয়ও পেয়েছিলাম। কান্নাকাটি করে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন।
এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমার মা, ছোট বোন আর তার স্বামী ও বাচ্চাদের নিয়ে একবার গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজেই আমাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানের পরদিন মাকে নিয়ে আমরা সমুদ্র দেখতে যাই। আমারই এক বন্ধু, নেভির বড় কর্মকর্তা- আয়োজন করে দিয়েছিল সবচেয়ে ভালো জায়গা থেকে সমুদ্র দেখার। আমার বোন শবনম আর তার বাচ্চাদের এই প্রথম সমুদ্র দেখা। সেই ঘটনার পর প্রথম দেখা আমার মায়েরও। সূর্যাস্তের আগে আগে আমরা ওখানে গিয়ে নানা ঢঙে ছবি তোলার আয়োজনে ব্যস্ত থাকি। লক্ষ্য করি, দূরে একটা বেঞ্চিতে প্রায় একা মা বসে থাকেন।
সূর্য ডুবে যায়। সমুদ্র থেকে খানিক দূরে নোঙর করে রাখা জাহাজগুলো থেকে বাতি জ্বলে ওঠে।
আমার মায়ের বেঞ্চির কাছে আসি। তিনি বলেন, ওইগুলো বড় জাহাজ। ওই জাহাজ থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে তীরে আসতে হয়।
তুমি জানো কেমনে? শবনম প্রশ্ন করে মাকে।
মা বলেন- তোর বাবা বলতেন।
আমরা চুপচাপ বসে থাকি। মা কোনো কথা বলেন না। হঠাৎ করে বলে ওঠেন- আমার কেন যেন মনে হলো ওই জাহাজে তোদের বাপ হয়তো আছেন। একটা ছোট নৌকা দিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন, এই দেখ, আমি তো আছি, এতদিন জাহাজেই ছিলাম।
তিরিশ বছর আগে গত হওয়া স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে এই সাগর!
সাগর তো সবকিছু নিয়েই যায় না, কত কিছুই তো দেয়।