ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

আমার মা আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন

প্রচ্ছদ

আমার মা আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন

মূল: আবদুলরাজাক গুরনাহ অনুবাদ::মাহীন হক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০

'আমার মা আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন'- মুনাহ তার মেয়ে খাদিজাকে বলতে শুনলেন। খাদিজা অবশ্য 'কাদি' নামটাই বেশি পছন্দ করে, বিশেষ ক'রে ওর বান্ধবীদের উপস্থিতিতে; মুনাহ এ কথাটা মাথায় রাখার চেষ্টা করেন। সেদিন বিকেলে খাদিজা আর ওর দুই বন্ধু, ক্লেয়ার ও এমি ভিডিওতে 'আউট অফ আফ্রিকা' দেখছিল। রোববার বিকেলগুলো ওরা এভাবেই কাটায়- পালা ক'রে একে অন্যের বাসায় গিয়ে দলবেঁধে ভিডিও প্লেয়ারে মুভি দেখে। ওদের বাড়িতে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার আরকি, অন্যদের বাসায় ডিভিডি।
তারপর যখন মুভিটা শেষ হয়ে গেলো, একটা গল্প শেষ হ'লে যেমন সংক্ষিপ্ত নীরবতা নেমে আসে, সেই অবসরে খাদিজা কথাটা বললো। মুভিটার 'আই হ্যাড আ ফার্ম ইন আফ্রিকা' গানটারই প্রতিধ্বনি ক'রে। হারানো প্রেম, হারানো খামার, হারানো স্বর্গ, হেমন্তকাল। তখনই কাদি বলে বসলো :'আমার মা আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন'।
মুনাহ'র মনে হলো তিনি দৌড়ে গিয়ে বলেন, 'ব্যাপারটা ঠিক ওরকম ছিল না। একেবারেই ওরকম কিছু না।'
কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন কে যেন কাদি'র ওটা বলার পর চাপাহাসি হেসে উঠলো। তা শুনে থমকে গেলেন। ওটা ছিল এমি, তিনি ভাবলেন, বিস্ময় বা আনন্দে খিলখিল ক'রে হেসে উঠে বলেছিল, 'তোমার মা? আসলেই!' হয়তো কাদি ওটা বলেছিল স্রেফ ওর কিশোরী বান্ধবীদের কাছে একটু বাহবা নেওয়ার জন্য!
এটা মুনাহ'র ছোটবেলাকার গল্প। তারা যখন ছোট ছিল, তখন ওরা খুব গল্প শুনতে ভালোবাসতো। ওরা হয়তো তার কথার মধ্যে কোনো গল্পের লেজ খুঁজে পেয়ে জোরাজুরি করতো গল্পটা শোনাতে। তার বড় ছেলে জামাল গল্পগুলো পুরোপুরি মুখস্থ রাখত, আর সে সব গল্পের লোকজনদের ব্যাপারে সে এমনভাবে কথা বলতো যেন সে নিজে তাদের ভালোই চেনে-'ওহ্‌, আবদুল্লাহ আঙ্কল টাকা-পয়সা নিয়ে সবসময়ই এমনই করে, তাই না? খুব বাজে।'
এখন জামাল এত বড় হয়ে গেছে যে সে পিঠে-পিঠে কথা বলে, কখনো সারা রাত বাইরে কাটায়, বন্ধুদের বাসায় অথবা কে জানে কী করে। ওর জামা থেকে সবসময় কেমন ঘাম, ধোঁয়া আর সস্তা খাবারের গা-গুলানো গন্ধ আসে। এখন ওর জামাকাপড় ধোয়ার জন্য বাছতে গেলে ও চিৎকার ক'রে মানা করে। ওসব যেমন আছে তেমন পরতেই ওর ভালো লাগে। কেমন যেন পা লেঙচিয়ে হাঁটে, যেন ওর কোমরের নিচ থেকে পা আর নিতম্বটা ক্রমেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সে যাই হোক, এখন আর মায়ের ছোটবেলার ভূতগুলোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই ওর। এখন যদি ওর মা ওর এককালের পরিচিত কারো গল্প করতে শুরু ক'রে দেয়, আর ওর যদি আগ্রহ দেখানো ছাড়া উপায়ন্তর না থাকে, তখন ও ঘনঘন মাথা দোলাতে থাকে, যাতে মা দ্রুত গল্পটার ইতি টানেন, যেন আগেকার মতো গল্পের ডালপালা বেশি ছড়িয়ে না যায়!
কাদি'র অবশ্য অতশত মনে থাকতো না। প্রায়ই ওকে মনে করিয়ে দিতে হতো- 'হ্যাঁ, তুমি তাকে চেনো তো, ওই যে আমার খালু ওমর, আমার বয়স যখন চৌদ্দ তখন আমি কয়েক সপ্তাহের জন্যে উনার খামারবাড়িটাতেই ছিলাম।' আবার হঠাৎ আচানকভাবে কখনো কাদি'র মনে পড়ে যেত পুরোনো কোনো কথা। যেমন এখন, একরাশ স্মৃতি আর আবেগের মধ্য দিয়ে গিয়ে, তার ওই খামারবাড়ির কথা আচমকা মনে পড়ে গেলো, আর বন্ধুদের উদ্দেশে বলে বসলো, 'আমার মা আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন'।
সমস্যাটা হলো, সেটা আসলে আহামরি কিছুই ছিল না। না ছিল ঘোড়ায় উঠে এক চক্কর ঘুরে আসা, না ছিল ক্রিস্টালের গ্লাসে ভাগ্য দেখা, না কোনো চাকরবাকর, না কোনো প্রজাট্রজা। তিনি নিজেই ছিলেন প্রজা। জীবনের অধীনস্থ, অন্যের বশংবদ। এসব বুঝেই হয়তো কাদি'র বান্ধবী হেসে ফেলেছিল। কারণ ও হয়তো ঠিকই জানে টিভিতে যে সুন্দর জীবন তারা দেখেছে, কাদিদের একদমই কিছু হতে পারে না। ও হয়তো বুঝেছিল কাদি'র মায়ের খামারবাড়িতে আফ্রিকার খোলা আকাশ আর গহীন ছায়া, বাবলাগাছে ঘেরা গলিপথ আর প্রদীপালোকিত বারান্দার মতো কিছু ছিল না। বরং কাদি'র মায়ের আফ্রিকা যেমন ছিল সেটাও প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়- অসংখ্য মানুষে গিজগিজ করা রাস্তা, ধূলিধূসরিত মাঠভর্তি মায়েদের আঁকড়ে ধ'রে থাকা অগণিত শিশু।
বস্তুত কাদি'র বান্ধবী হয়তো এত কিছু ভাবাভাবির মধ্যে যায়নি। হয়তো ও হাসেওনি। মুনাহ'র এখন নিজেকে বোকা লাগছিল এই মনে ক'রে যে তিনি ওখানে ছুটে গিয়ে পার্থক্যটা ধরিয়ে দেওয়ার কথাও মাথায় এনেছিলেন। মুখের ভেতর একটা তিতকুটে স্বাদ অনুভব ক'রে তিনি অবাক হলেন। এটা কি তার বয়সের কারণে? কাদি'র কথায় কি একটা সুপ্ত আকুতি ধ্বনিত হয়েছিল যে, ''দয়া ক'রে তোমরা ভান করো যে আমার মা যখন আফ্রিকায় ছিলেন তখন তাকে অমনই লাগতো, আর আমিও তোমাদেরই মতো দেখতে।'' অথবা হয়তো কোনো আকুতি ছিল না আদৌ। হয়তো কাদি একটি আফ্রিকাকেই চেনে যেরকম সে মুভিতে দেখেছে, আর বিশ্বাস করে তার মা ওরকম একটা চৌকস খামারবাড়িতেই ছিলেন।
ওদের বয়স কেবল চৌদ্দ, ওরা বিব্রতই হতো, বিশেষ ক'রে কাদি, যদি তিনি ওখানে গিয়ে বলতে শুরু করতেন তিনি যে খামারবাড়িতে থেকেছেন তা একদমই টিভিতে প্রদর্শিত চাকচিক্যে সাজানো আফ্রিকার মতো নয়, বরং খুবই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ আর মানবিক। তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে সবকিছুর একটা নাম ছিল, ঘাস ও পত্রপল্লবের সুবাস থেকে শুরু করে এমনকী আবহাওয়ার নূ্যনতম পরিবর্তনেরও।
২.
তার মেয়ে ওটা বলার পর থেকে একটুও নড়েননি তিনি, প্রচ উত্তেজনা তাকে চলৎশক্তিহীন করে ফেলেছিল। ধীরে ধীরে উত্তেজনা প্রশমিত হলো, তার বদলে অনুতাপ আর অপরাধবোধ এসে ভর করলো।
এত ক্ষু্বব্ধ হওয়ারই বা কী ছিল?
ওরা আলাদা দুনিয়ার বাসিন্দা। তার কোমল-হৃদয় কন্যা ও তার বান্ধবীরা একটা আহত কচ্ছপ কিংবা সমুদ্রতটে আটকা পড়া একটা দলছুট সিলমাছের দুঃখেও অশ্রুপাত করবে, কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ওপর দৃষ্টি পড়লে ওরা নির্বিকারে মুখ ফিরিয়ে নেবে, কারণ ওরা ভাবতে শিখেছে এমন দুর্দশাই যেন ওদের ন্যায্য পাওনা।
স্মৃতি তাকে খুব জ্বালাতন করে। তিনি ভুলতে পারেন না। তিনি জানেনও না কেন কিছু জিনিস কখনোই পিছু ছাড়ে না। নিজেদের ঘর থেকে বহুদূরে রাস্তার মানুষগুলো কি ওরকমই? তিনি ভাবতে লাগলেন দূরত্ব কীভাবে স্মৃতিকে বদলে দেয়।
তাকে নিয়ে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল তখন তিনি খুব কাছেই ছিল। কিন্তু সবার ভাবটা ছিল এরকম যে সে শুনলে শুনুক, যেন বিষয়টাতে তার সম্পৃক্ততা নেই কোনো। তখন তার বাবা বহু মাস ধ'রে নিরুদ্দেশ, অদূর ভবিষ্যতে ফেরার কোনো সম্ভাবনাও আর নেই।
তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন তিনি তার বাবার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে কখনো ভাবেননি। তিনি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে খেয়ালও করতেন না, বা কেবল তখনই খেয়াল করতেন যখন বাবা ফিরে এসে ঘরে থাকতেন। কারণ তাদের বাবা ফিরলে বাড়িতে অনেক কিছু ঘটতো, যেন তাদের মা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বা বড় কিছু করার আগে বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে থাকতেন। কিংবা হয়তো কিছু কাজ বাবা তার দীর্ঘ প্রবাস থেকে যে টাকাটা নিয়ে আসতেন তার জন্য আটকে থাকতো। অনেক বছর পরে মুনাহ'র একদিন মনে হয়েছিল তাদের বাবা না-থাকার সময়টায় তাদের মা ঝিমিয়ে যেতেন; আর মুনাহ ও তার বোনের জীবনটা স্তিমিত হয়ে পড়তো।
এরকম একবার সবকিছুর দুর্ভার তার জন্য এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়ে যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায়ই লম্বা সময় ধ'রে তিনি বসে থাকতেন হাতে মাথা ধ'রে। বিরতিহীন মাথাব্যথায় ভুগতেন; এমনকি সবচেয়ে সহজ কাজগুলোও করতে পারতেন না।
নিজেদের ঠোকাঠুকি স্থগিত রেখে মুনাহ আর তার বড় বোন হাওয়া পা টিপেটিপে মায়ের পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়তো। মায়ের প্রলম্বিত শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিল না। মা কান্না শুরু করলে তাদের কিছুই করার থাকতো না। একবার শুরু হলে কোনো কিছুই ওদের মায়ের কান্না থামাতে পারতো না যতক্ষণ না, এ রকম মনে হতো, তিনি তার চোখের সব পানি ঝরিয়ে ফেলেছেন। মাঝে মাঝে তিনি একটা ছোট্ট বিচ্যুতি বা তুচ্ছ আঘাতের জন্য সারাটা দিন কাঁদতে থাকতেন, যতক্ষণ না মুনাহ'রা তিনজনই ওদের দুর্বোধ্য বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে নিথর হয়ে যেতো।
৩.
একদিন আমিনা খালা বেড়াতে এলেন, আর তখনই মুনাহ শুনতে পেলো যে তাকে গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমিনা খালা ছিলেন ওদের মায়ের বড় বোন। তিনি বললেন যে এই দু'জনকে একসঙ্গে সামলানো অনেক ঝামেলার কাজ, আর তাই তিনি মুনাহ'কে তার কাছে নিয়ে রাখবেন, যতদিন না ওদের মায়ের শরীর একটু ভালো হয়। তিনি মুনাহ'কে বললেন, ''হাওয়া ওর মায়ের সেবাযত্ন ক'রে ওকে খানিকটা বিশ্রাম করতে দিয়ে সুস্থ ক'রে তুলতে পারবে। তুই আমার সাথে গ্রামে চল- তোকে কাজ জুটিয়ে দেবো।''
মুনাহ'র মনে পড়ে না কেউ স্কুল কামাইয়ের বিষয়ে কিছু বলেছিল কিনা, কিন্তু ওর নিজের মাথায় সবার আগে এ বিষয়টাই গোত্তা মেরে গিয়েছিল। কয়েকটা দিন স্কুলে যাওয়া হবে না।
এক ঘণ্টার মধ্যে মুনাহ কেবল কিছুদিন বাইরে থাকার মতো করে তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে খালার সাথে সাথে বাসস্টপ পর্যন্ত হেঁটে গেলো। শেষ যেবার তার বাবাবাড়ি ফিরেছিলেন তখন তিনি যে সিল্ক্কের শালটা নিয়ে এসেছিলেন সেটা গায়ে চড়িয়েছিল। ওর এটা মনে ছিল, কারণ এই প্রথমবার ও ওই শালটা গায়ে দিয়েছিল।
খামারবাড়িটা শহর থেকে মাত্র মাইল পনেরো দূরে, আর সে ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার ওখানটায় গেছে। তাছাড়া ওমর খালুর সাথে ওদের বছরে চার-পাঁচবার দেখা হতো, কারণ তিনি শহরে এলেই ওদের দেখতে আসতেন। মুনাহ একবারও ভাবেনি এখানে তাকে অনেক কয়টা সপ্তাহ কাটাতে হবে।
ওমর খালু খুব বেশি হাসতেন না, কিন্তু জানেন তো, তা এইজন্য না যে তিনি বিরক্ত বা অখুশি। তিনি এমনিতেই হাসতেন না। কিন্তু মুনাহ'কে ফুটপাথ পেরিয়ে তাদের ঘরে আসতে দেখে তিনি হেসেছিলেন। তিনি ছাউনি-দেওয়া বারান্দায় বসেছিলেন; একটা ঝুড়ি বুনছিলেন তালগাছের পাতা দিয়ে। তারপর ওদের পদশব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালেন, আর মুনাহকে দেখে তার মুখাবয়ব একটা নির্বাক হাসিতে ছেয়ে গেল।
তাদের ঘরটা ছিল একটা ঢালের ওপর, ঢালের শেষ প্রান্তে বয়ে চলছিল ছোট্ট মতো একটা খাল। বাড়ির পেছনভাগে খালের উভয়দিকেই ছয় একর জায়গাজুড়ে ছিল খামারটা।
খামারবাড়িতে কাটানো প্রথম রাতটা সে কখনো ভোলেনি। ভোলেনি গ্রামাঞ্চলের সেই গহীন নীরবতার কথা। আসলে তা নীরবতাও ঠিক ছিল না, কারণ বিভিন্ন আঁচড়ের শব্দ, নানা কিছুর খড়খড় আওয়াজ ও রাত্রির সকল শ্রবণাতীত ধ্বনি-প্রতিধ্বনির এক অবর্ণনীয় মিশেল সবসময়ই শোনা যেতো। সে যখন ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের ঘরের দিকে যেতো, তখন এই নীরবতা নিঃশব্দ গর্জনে তার ওপর হামলে পড়তো। ঘুমের মধ্যে সে শুনতে পেতো কর্কশ চিৎকার, যা চোখ খুললেই মিলিয়ে যেতো। কেবল খালপাড়ের ব্যাঙগুলোর ক্রমাগত শ্বাস-প্রশ্বাস শব্দময় হয়ে উঠতো।
মুনাহকে আলাদা একটা ঘর দেওয়া হয়েছিল। আমিনা খালা বলছিলেন, 'এখানে তুই কয়েক সপ্তাহ থাকবি। তো একে নিজের ঘরের মতোই ভেবে নে।'
বাড়িটা ছিল খুব ছোট, কেবল দু'টো ঘর আর একটা গোলাঘর। তবে একদম খুপড়িও না, একজন ছোট কৃষকের আবাস যেরকম হয় সে রকম আর কী! বছরের নানান সময়ে যে ঘরে মুনাহ ঘুমাতো সেটাকেও নানা ভান্ডার হিসেবে ব্যবহার করা হতো; তাই সেখানটার সাদা দেয়ালে ছিটা দাগ ও গাছের রস লেগে গিয়েছিল, যার দাগ এখন আর মুছে উঠানো সম্ভব নয়। ছোট্ট জানালাটা ছিল বন্ধ আর খালের অন্যদিকে মুখ করা, ঢালের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ কলাগাছের দিকে।
দিনের বেলা তাকে আমিনা খালার আশপাশে থাকতে হতো, ফাইফরমাশ খাটার জন্য। কিন্তু মুনাহ বুঝেছিল এর আসল উদ্দেশ্য ছিল তার ওপর সবসময় নজর রাখা, কারণ তার বয়স ছিল চৌদ্দ আর সে ছিল একটা মেয়ে। উঠান ঝাড়ু দেওয়া, রান্নাবান্না, জামাকাপড় ধোয়া, ফলমূল ধুয়ে ঝুড়িতে ভ'রে শহরের বাজারে নিয়ে যাওয়া- এসবে সে সাহায্য করতো। প্রথম প্রথম কাজগুলো মনে হতো ক্লান্তিকর, কিন্তু তারপর সে একটা একঘেয়ে নিয়মের মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। সব মিলিয়ে খামারের জীবনটা অদ্ভুতরকমের স্বস্তিদায়ক বোধ হয়েছিল। বিকেলবেলা, যদি সে খুব ক্লান্ত না থাকতো আর যদি ওমর খালুর মর্জি হতো, তাহলে তিনি মুনাহকে খামারের কাজ দেখিয়ে দিতেন। এছাড়া মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বেরোতেন।
হাঁটতে হাঁটতে তারা কখনো কখনো রাস্তার ধারে ওই বিশালাকায় আমগাছটা পর্যন্তও চলে যেতো, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে গ্রামের লোকেরা শহরের বাসের জন্য অপেক্ষা করে। ওখানে ছোট একটা দোকানও ছিল; দোকানদার তাদের জন্য কফি বানাতো আর ওমর খালু বেঞ্চে বসে থাকা লোকজনের সাথে টুকটাক আলাপ করতেন।
'যাও ভিতরের লোকজনদের সাথে আলাপ করে এসো'- তিনি প্রথমদিন বলেছিলেন। এরপর থেকে সবসময় সে ওই ঘরের মহিলার কাছে গিয়ে বসে থাকতো, যতক্ষণ না গাছের নিচে বসে থাকা সবার সাথে ওমর খালুর আলাপ শেষ হয়।
একদিন এক লোক গালগল্পের পর উঠে এসে ওদের সাথে হাঁটতে শুরু করলেন। ওমর খালুর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তিনি- হয়তো তিরিশের গোড়ায়, হাসি-হাসি মুখ আর বড়-বড় কৌতূহলী চোখ তার। ওমর খালু বলেছিলেন, 'উনার নাম ইসসা'। আর তিনিই ছিলেন ওদের আশপাশে নিকটতম প্রতিবেশী। মুনাহ তাদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার ভাবভঙ্গি শুনেই বুঝে ফেলেছিল যে এই দু'জন দু'জনকে খুবই পছন্দ করেন।
ইসসা এমনিতে প্রায়ই ওদের খোঁজখবর নিতে আসতেন। মুনাহ পরে জানতে পেরেছিল, তিনি কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের নিয়ে পেম্বায় এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।
বাসায়ে এলে তিনি ওমর খালুর সাথে ঢাকা-বারান্দায় বসতেন, কফি খেতে-খেতে গল্প আর হাসাহাসি করতেন। মাঝে মাঝে আমিনা খালাও ওদের সাথে বসতেন। তার বউ-বাচ্চাদের খবরা-খবর জিজ্ঞেস করতেন। আর কখনো কখনো তাকে নিজের ছেলে বলেও সম্বোধন করতেন।
ওমর খালু সবসময় মুনাহ'কে ডেকে পাঠাতেন। সবাইকে লুকিয়ে ইসসা মুনাহ'র দিকে দৃষ্টিপাত করা শুরু করলেন। তার এই আগ্রহ মুনাহ'র নজর এড়ালো না। প্রায় প্রতিদিনই তিনি আসতে শুরু করলেন। তার চোরা চাহনি আর অপাঙ্গে দৃষ্টিনিক্ষেপ মুনাহ'র শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিত। তার তাকানোর সময় দীর্ঘতর হতে লাগলো, আর একদিন তিনি মুনাহ'র দিকে তাকিয়ে একটা গোপন হাসি দিলেন। মুনাহ পাল্টা হেসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল, খুশিতে।
যা ঘটে চলেছিল তা ঢেকে রাখার উপায় ছিল না। ইসসা'র সামনে মুনাহ এলেই ওমর খালু অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। আমিনা খালা অবশ্য সবসময় ওকে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতেন। অবশ্য তাদের কেউ ওকে কিছু বলেননি। ইসসার হাসি আর চাউনি মুনাহ'র শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত, কিন্তু ওর ভয় করতো। যেহেতু তিনি ওকে মুখ ফুটে কিছু বলেননি আর খালা-খালুও সজাগ থাকতেন খুব; ও বস্তুত বেশ নিরাপদ বোধ করতো।
এক রাতে ইসসা মুনাহ'র ঘরের জানালায় এসে দাঁড়ালো। হয়তো এটাই প্রথমবার ছিল না, হয়তো তিনি আগেও এমনটা করেছেন। জানালাটা ছিল দেয়ালের বেশ উঁচুতে, দু'টো কাঠের খড়খড়ি ছিল ওতে। এখানে প্রথম আসার পর মুনাহ গ্রামের অন্ধকারটা এত ভয় পেতো যে দু'টো কপাটই রাতের বেলা বন্ধ ক'রে রাখতো। পরে আস্তে আস্তে সে একটা খোলা রেখে ঘুমাতে যেত। সেদিন ঘুম ভাঙতেই তার মনে হয়েছিল কিছু একটা ঘটেছে, আর তখুনি তার চোখ সরাসরি জানালার দিকে গেলো।
রাত্রির অন্ধকারেও সামান্য আলো ছিল যাতে সে জানালার বাইরে একটা মাথার ছায়া দেখতে পেলো। হাতচাপা দেওয়ার আগেই ভয়ে তার মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে গেল।
এক মুহূর্তেই তার বোঝা হয়ে গেল যে ওটা ইসসা ছাড়া অন্য কেউ নয়। সে নিজেকে স্থির ক'রে রাখলো, যেন তখনও সে ঘুমে ডুবে আছে, ঘুমিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করলেও সে ইসসার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। তার মনে হ'লো কসরৎপ্রসূত সজোর শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে তার ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকবে।

কিছুক্ষণ পর জানালা থেকে মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু সে আর উঠে গিয়ে জানালা আটকানোর সাহস করলো না। ভয় হলো যদি আটকাতে গেলে ইসসা তাকে হাত বাড়িয়ে ধ'রে ফেলেন। খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে সারারাত কাটলো নির্ঘুম, তন্দ্রা আর জাগরণের মধ্য দিয়ে।
পরদিন সকালে সে বাইরে গিয়ে দেখলো জানালা বরাবর একটা মাটির চাঙ্গর পড়ে আছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে ইসসা জানালার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তবে স্থির থাকার জন্য তাকে জানালার শিক ধ'রে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।
সেদিন বিকেলে যখন ইসসা এলেন, উঠোনের ভেতরে থাকা মুনাহ তাকে দেখতে পেয়ে সম্ভাষণ জানালো। ওর কণ্ঠস্বরের কাঁপুনিটা লুকানো ছিল না।
সে রাতে সে জানালার দু'টো কপাটই বন্ধ ক'রে বিছানায় শুয়ে জেগে রইলো ইসসা আসেন কিনা দেখার জন্য।
ইসসা যখন এলেন মুনাহ শুনতে পেলো, কপাটে তার হাতের ধাক্কা টের পেলো।
'আমার থেকে লুকিয়ো না,' মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি, তার গলায় মিনতি।
মুনাহ অন্ধকারে স্থির শুয়ে থাকলো, সে ইসসার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর জানালার শিক্‌ ছেড়ে দিয়ে ধপ ক'রে নেমে গেলেন ইসসা।
মুনাহ এই ভয় আর নিতে পারছিল না। সকালে আমিনা খালার মুখোমুখি হতেই সে সব বলে দিল। আমিনা খালা তৎক্ষণাৎ কিছুই বললেন না; তাকে খুব বিষণ্ণ দেখালো, যেন মুনাহ তাকে বড় একটা দুঃসংবাদ দিয়েছে।
'ওমরকে কিছু বলিস না,' খালা বললেন।
খালা ওকে ওর জিনিসপত্রে গোছ-গাছ করতে বললেন।
এক ঘণ্টার মধ্যে তারা রাস্তার ধারে আমগাছের নিচের ওই বাসস্টপের পথে রওনা হয়ে গেলো।
ওমর খালু এই তাড়াহুড়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না।
'কী হয়েছে বলো তো?' তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমিনা খালা বললেন, 'কিছু হয়নি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা। ও এখানে আসার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, তাই না?'
৪.
মুনাহ শুনতে পেলেন কাদি তাকে খুঁজছে।
'মা তুমি কোথায়?' কাদি হাঁক পাড়লো।
ও এসে রান্নাঘরে ঢুকলো। হাসিখুশি চতুর্দশী মেয়ে, নিজের বাড়ির মতো নিরাপদ, এসে দাঁড়ালো টেবিলে যেখানে মুনাহ তার স্মৃতিসম্ভার নিয়ে বসে আছেন। পেছন থেকে মায়ের কাঁধে ঢলে পড়লো কাদি, মায়ের মুখ ঘিরে ছড়িয়ে গেলো ওর লম্বা চুল।
'কী করছো তুমি?' কাদি জিজ্ঞেস করলো। মায়ের কপালে একটা চুমো দিয়ে উঠে এলো কাদি।
কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো- "আমরা এমি'র বাসায় যাচ্ছি। আমি দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো।"
'একদমই অমন ছিল না, আফ্রিকার ওই খামারটা,' মুনাহ বলে উঠলেন।
'ওহ, তুমি শুনে ফেলেছো, ওদের এ-কথাটি শুনিয়ে আমি একটু ভাব নিচ্ছিলাম আর কী।' -হেসে বললো কাদি।

আরও পড়ুন

×