
পর্ব :১
বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় সাধারণত আমরা পাকিস্তানকে দেখি একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে তাদের কর্মকাণ্ডের আলোকে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিধিটাকে ধারাবাহিকভাবে যদি পর্যালোচনা না করা হয় তাহলে পাকিস্তান কেন বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর মতো পরিস্থিতিতে গেল- সেটা বোঝা যাবে না।
ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে এটা পরিস্কার হয় যে, পাকিস্তান কোনোদিন রাষ্ট্র হিসেবেই গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র হলে রাষ্ট্রের এক অংশ আরেকটি অংশের ওপর জন্মলগ্ন থেকেই নির্যাতন শুরু করে না। ১৯৪৭ সালের পরপরই পাকিস্তানের যাত্রা পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নির্যাতন দিয়ে শুরু হয়। যে কারণে প্রতিবাদও শুরু হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে প্রথম থেকেই সম্পর্কটা ছিল বৈরী। কিন্তু রাষ্ট্রের মধ্যে এক অংশের সাথে আরেক অংশের সম্পর্ক তো এত বৈরী হয় না কখনও। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা, তাদের সঙ্গেই বৈরী সম্পর্ক। অর্থাৎ, ক্ষমতায় রয়েছে সংখ্যালঘিষ্ঠরা, কিন্তু নির্যাতন হচ্ছে সংখ্যাগুরুর ওপরে। এই ধরনের সমীকরণে কোনোদিন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় না এবং সৃষ্টি হলেও তা টিকতে পারে না। আমি বলব যে, রাষ্ট্র হিসেবে যেসব সূচক থাকা দরকার, পাকিস্তানে সে সূচকগুলো ছিল না। পাকিস্তান বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্রই ছিল না। আর যে রাষ্ট্র নয়, তাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল ঔপনিবেশিক। আর এই কথাটা দু'জন মানুষ বারবার বলেছেন। যাদের সেই কথা আমরা স্মরণ করি না। এক হচ্ছে, যখন যৌথ বাংলা আন্দোলন ব্যর্থ হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার সিদ্ধান্ত হচ্ছে- শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়ই মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীকে বলেছিলেন যে, 'এটা টিকবে না; এটা একটা কলোনি হতে যাচ্ছে।' অন্য যে মানুষ এই কথাই বলেছিলেন, সেটা হচ্ছে মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানীর গোটা রাজনৈতিক ইতিহাসই হচ্ছে কলোনির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সুতরাং, পাকিস্তানের সঙ্গে এ দু'জনের সম্পর্ক শুরুতেই আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। শেখ মুজিবুর রহমান তো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শক্তি, আর তার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর রাজনীতির পার্থক্য হচ্ছে, মওলানা ভাসানী সামাজিক সংগ্রামের শক্তি। দু'জনের সংগ্রামের বিভিন্নতার কারণে আমাদের মধ্যে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তবে মূলত এ দু'জনের কেউই পাকিস্তানি ছিলেন না। পাকিস্তানকে বুঝলে এ বিষয়টা আমাদের কাছে অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়।
পাকিস্তান ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছে। পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে মানে পশ্চিম পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান জেতেনি- জিতেছে বাংলাদেশ আর পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই দিকটাতে যখন দেখেছে- তখন কোন চোখ দিয়ে দেখেছে? পাকিস্তানিদের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হচ্ছে 'হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট'। উল্লেখ্য, পরাজিত হবার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি যুদ্ধতদন্ত কমিশন গঠন করে। তিন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রধান ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান। এ রিপোর্টের সম্পূর্ণটা উন্মোচিত না হলেও যতটুকু পাওয়া যায় তা বারবার পড়ে আমি দেখেছি, আমাদের ইতিহাসবিদরা যে কথাটা বলেন না, পাকিস্তানিরা সে কথাটা প্রথম থেকেই বলে যে, ১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু হলো তখন থেকেই পাকিস্তানের পরাজয়ের সূত্রটা শুরু। অর্থাৎ, পাকিস্তানিরা নিজেরাই বলছে যে, ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানের পতন শুরু হলো।
১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে মূলত কী ঘটেছিল? তখন পাকিস্তান বা কেন্দ্রবিরোধী প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছিল। সেই তীব্রতাকে ঠেকানোর ক্ষমতা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিল না। ছিল না আমলাতান্ত্রিকভাবেও। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা' সিরিজে আমি বেশ কয়েকবার এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। তখন তার বিকল্প হিসেবে সেনাবাহিনী এলো। মূল বিষয়টি হচ্ছে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতেও সে সময়টাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে সামরিক শাসন বলেই। তার মানে হচ্ছে, যেই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল- সেই রাষ্ট্রকাঠামো দিয়ে পাকিস্তান সামলানো সম্ভব না। তাই তাকে সামলাতে সামরিক শাসনেরই দরকার হলো। কিন্তু পাকিস্তান সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা রোমান্টিক ধারণা হয়ে গেছে যে, পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র ছিল- বাংলাদেশকে বুঝতে হলে এটাকে আমাদের বাতিল করা দরকার। পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিলো না। অন্য যে বিষয়টি রয়েছে, আমাদের ইতিহাসবিদদের ভাবনার ক্ষেত্রে পাকিস্তান বিরোধিতা থেকে এক ধরনের ভারতীয় অবস্থান সংলগ্নতার জন্ম হতে দেখা যায়। তারা মনে করেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বলে একটা একক দেশ ছিল, সেই দেশটা ভেঙে দুটি দেশ হলো- ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু এটা ঠিক নয়। ১৯৪৭ সালে ভারতে বহু রাষ্ট্র ছিল। ইংরেজরা সরাসরিভাবে মাত্র অর্ধেক শাসন করত। বাকি অর্ধেকে যে দেশগুলো ছিল, সেগুলো স্বাধীন দেশ। সেগুলো ছিলো স্বাধীন রাজতন্ত্র। যেমন- কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ইত্যাদি। সেই স্বাধীন দেশগুলো কিন্তু ভারতের অংশ ছিল না। ভৌগোলিকভাবে হলেও রাজনৈতিক, আইনগত, আমলাতান্ত্রিক- কোনোভাবেই ছিল না। এ বিষয়টা আমরা হিসাব করি না। কারণ আমাদের দেশের ইতিহাসবিদরা সেই পটভূমি বাদ দিয়ে পড়ালেখাটা ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে থাকেন। যার ফলে ইতিহাস সৃষ্টির ধারাবাহিকতার বিষয়ে আমাদের ধারণাটা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা হলেও কম রয়ে গেছে।
জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান একটার পর একটা সংকট সামলাচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে যে প্রথম সংকটটা সামলেছে সেটা হচ্ছে ভারতের সাথে যুদ্ধ, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। ভারত কোনোদিন পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি। পাকিস্তানও ভারতকেই প্রধান শত্রু মনে করে। এবং ক্রমাগত একে অপরের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। এখনও লড়ছে, আজীবন লড়বে- যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো ধরনের সমঝোতা হয়। যদিও সমঝোতা হবার সম্ভাবনা কম। কারণ লড়াইটা চালু থাকলে অভ্যন্তরীণভাবে দুটো দেশেরই অনেক লাভ হয়। তারা একে অন্যের প্রতি যে ঘৃণা সৃষ্টি করে, তার মাধ্যমে ক্রমাগত একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হতে থাকে। যার দিকে চোখটা সবসময় ব্যস্ত থাকে। এটি পাকিস্তানের জন্য লাভ, ভারতের জন্যও লাভ। এবং এটা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশ- যাকে একসময় পূর্ব পাকিস্তান বলা হতো; লাহোর প্রস্তাব অনুসারে যেটি একটি স্বাধীন দেশ হবার কথা ছিল- সেই দেশের মানুষ তো কোনোদিনই মেনে নেয়নি পাকিস্তানকে। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারত কোনোদিনই বড় বিষয় ছিল না। ঐতিহাসিকভাবেও ভারতের কিছু কিছু অংশের মানুষের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের রাগ-দুঃখ ছিল, যারা বাংলা দখল করেছে তাদের সবাই ছিলো উত্তর ভারতীয়। সেটা আর্যরাই হোক অথবা মোঘলরা। এছাড়া ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলটি নির্যাতিত ছিলো গুজরাটি ও মাড়োয়ারিদের দ্বারাও। জগৎশেঠ, রায়বল্লভরা এ অঞ্চলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতো। তারাই ইংরেজদের ডেকে এনেছে এবং সাহায্য করেছে বাংলা দখল করতে। ইতিহাসের দিক থেকে আমরা যদি পর্তুগিজদের আগমনের সময়েও দেখি- তখনও দেখা যাবে যে, বাংলার মানুষ খুব বেশি ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থসম্পদের সুযোগ পায় নি, বেশিরভাগই পেয়েছে পশ্চিম ভারতের মানুষরা। যারা বাংলায় ব্যবসা করেছে। একাধিক পর্তুগিজ বইতে এ তথ্য পাওয়া যাবে। অর্থাৎ আমাদের ওপর কেন্দ্রীয় ভারতের যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণ- সেটার ইতিহাস কয়েকশ বছরের। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিকভাবেই ভারতের মানুষের প্রতি অতটা প্রীতি থাকার কথা না। ভারত প্রীতিটা মূলত তৈরি হয়েছে ঔপনিবেশিক যুগে, যখন এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইংরেজদের অধীনে চাকরি পাওয়া শুরু করেছে, যাদের একটা সর্বভারতীয় চরিত্র ছিলো। অতএব এই দ্বন্দ্বগুলো ঐতিহাসিক। এগুলো হঠাৎ করে হয়নি। অকস্মাৎবাদের চর্চার কারণে যেমন আমরা ভাবি যে, ওরা একটা খারাপ কাজ করেছিল বলে আমাদের খারাপ লাগছে, আসলে তো আমরা ভাই ভাই। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে আমরা কারও ভাই না। কেউ কারও ভাই-ভাই নয়। আমরা মনে করি- যেহেতু আমরা বাঙালি, তাই সব বাঙালি আমাদের ভাই আর সব অবাঙালি আমাদের শত্রু। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি অবাঙালি সবাই আমাদের শত্রু। যে কেউ যে কারও শত্রু হতে পারে। আমরাও হয়তো কারও কারও শত্রু।
ইতিহাসের এই দ্বন্দ্ব ১৯৪৭ সালে মেটেনি। এই দ্বন্দ্ব তখন বরং আরও প্রকট হয়েছে। যে কারণে দেখা যাচ্ছে এই দেশে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যে রাজনীতি ছিল, সেটা একেবারেই বিলীন হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। বাংলাতে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজনীতি ছিলো, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের রাজনীতি ছিলো না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ তৈরি হলো। আওয়ামী মুসলিম লীগ কেন? কারণ তখন তো পৃথক নির্বাচনী পদ্ধতি ছিল। মানে মুসলমানরাই কেবল মুসলমানদের ভোট দিতে পারবে। ১৯৭১ সালের আগে কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে এই পৃথক নির্বাচনী পদ্ধতি বাদ দিয়ে কোনো ভোটই হয়নি। যদিও এটা বিলুপ্ত হয়েছিলো ১৯৫৫ সালে। একাত্তর সালেই প্রথম পৃথক নির্বাচনের বাইরে ভোট হলো, যেখানে সবাই ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখন বিষয় হলো এই পরিবেশে বাংলাদেশের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আলাদা। কারণ বাংলাদেশের প্রধান শত্রু হচ্ছে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের প্রধান শত্রু হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভারত। এটা সম্পূর্ণ আলাদা ঐতিহাসিক নিরিখ। কয়েকশ বছরের ইতিহাসে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবার কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের সঙ্গে কেন্দ্র দিল্লি অর্থাৎ উত্তর ভারতেরও সম্পর্ক হবার কোনো ভিত্তি নাই। আমরা নির্যাতিত, আমাদের দখল করেছে সবাই। এই দখলকৃত মানুষের ইতিহাস আর দখলদারদের ইতিহাস কোনোদিন এক হয় না। আমাদের ইতিহাসবিদদের অনেকেই জাতীয়তাবাদের যুক্তি দেখিয়ে আমরা বাঙালি, আমরা মুসলমান, আমরা বাঙালি মুসলমান এ জাতীয় বিভিন্ন সীমাবদ্ধ পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে দেখানোর চেষ্টা করেন। যার মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব পরিচিতি সম্পর্কে ভাবনায় অনেক দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। মানুষের পরিচিতি তৈরি হয় ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে। সেটা জাতীয়তাবাদ কোনোদিন বিশ্নেষণ করে বোঝাতে পারে না। মানুষের প্রধান পরিচিতি তার ইতিহাস ও ইতিহাসের অভিজ্ঞতা- তার ধর্ম বা ভাষার পরিচিতি না।
১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন হচ্ছে, তার আগেই আমরা কতগুলো পর্যায় পার হয়ে গেছি। চুয়ান্নর নির্বাচন হয়ে গেছে- যাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে একটা ঐক্য তৈরিই হয়ে গেছে। সূচক হিসেবেও এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সবাই এক হয়ে নির্বাচন করতে পারি। ১৯৫২ সালের কথা বাদ দিয়েই বলছি- কারণ চুয়ান্নতে গ্রামের মানুষও ভোট দিয়েছে; বায়ান্ন সালে গ্রামে কোনো আন্দোলন হয়নি। ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর সাতান্নতে গিয়ে যখন আওয়ামী লীগ ভাগ হচ্ছে- সেই ভাগের অনেক কারণের মধ্যে একটি ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর ক্ষোভ; কারণ সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, আমরা তো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পেয়েই গেছি। অথচ বাস্তবে যার কোনো ভিত্তি ছিল না। তিনি এসব কথা বলেছেন ক্ষমতায় থাকার জন্য। তিনি নিজে ছিলেন পাকিস্তানপন্থি, তিনি পাকিস্তানের পক্ষেই কথা বলেছেন। কিন্তু এটা অনেকেই মানেনি। এবং এই ক্ষোভটা খুব প্রচণ্ড ছিল। আর এই ক্ষোভটাকে যেই মানুষ সামলাতে বা নিজের পক্ষে নিতে পেরেছিলেন তার নাম হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান। সংগঠনকে ঠিক রেখেই তিনি সেটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তো তখন রাজনীতিতে প্রান্তিক হয়ে গেলেন। রাজনীতিতে তার আর কোনো ভিত্তি থাকল না। বস্তুত রাজনীতিতে তার ভিত্তি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব তাকে ব্যবহার করে রাজনীতিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থাকলেও কিছু এসে যায় না, না থাকলেও কিছু এসে যায় না। রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকীকরণের যে ক্ষমতা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের, সেটি তিনি সফলভাবেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এবং সংগঠনও রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, রাজনীতিতে এটি তার অন্যতম বড় অর্জন।
১৯৬৩ সালে যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মারা গেলেন, তখন দেখা গেল শেখ মুজিবের হাতে যে সংগঠনটা আসছে সেটি একটি বিশাল সবল সংগঠন। যার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত। এই সংগঠনটা কিন্তু মওলানা ভাসানী পাননি। তিনি সামাজিক রাজনীতির মানুষ ছিলেন, তিনি তার আবেগ-অনুভূতি দিয়ে আলাদা সংগঠন করেছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। যেটা সফল হয়নি। দ্বিতীয়ত, এর বড় দুর্বলতা হলো এটি ছিল পাকিস্তানভিত্তিক দল। আর পাকিস্তানকেন্দ্রিক দল কীভাবে টিকতে পারে, যেখানে আমাদের মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গেই? ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কোনোদিন সবল হতে না পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে এটি ছিল একটি বড় কারণ। যদিও এ সংগঠনের নেতারা অত্যন্ত নৈতিক ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে যতজন মানুষকে আমরা দেখতে পাই যে, তারা গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন- সেই স্বল্প কিছু মানুষের মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অনেক মানুষ ছিলেন। অর্থাৎ তারা ছিলেন নৈতিক কিন্তু ক্ষমতাহীন মানুষ। এই ছিল তখনকার বাস্তবতা। যেখানে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাজনীতি সবলতা পেয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী দিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতাকে বা রাষ্ট্র হিসেবে তার ভিত্তিহীনতাকে যে সামলানোর চেষ্টা করা হলো- সেটা ব্যর্থ হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬ দফাকে ঠেকানোর জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে যে মামলা হলো, মানুষ সেটা বিশ্বাস করেনি। মানুষ আন্দোলনে নেমেছে। সে আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি নিশ্চয়ই অত বোকা ছিলেন না যে, তিনি জানতেন না আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তখন এটা প্রধান দলের হাতেই যাবে। তিনি অবশ্যই জানতেন। মওলানা ভাসানীর এই ভূমিকাটা নিয়ে আমরা আলোচনা করি না।
স্বেচ্ছায় মওলানা ভাসানী যে জিনিসটা করতে পেরেছিলেন, তা হলো এই আন্দোলনের জন্য সমাজটাকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে তিনি বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেটা তিনি করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে যৌথভাবে। সেটা আজকালকার দিনের এক টেবিলে বসে চুক্তি-স্বাক্ষর করে যৌথ আন্দোলন করার মতো নয়। দু'জনের ভাবনা তো একই রকম ছিল। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যে সমঝোতা ছিলো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আতাউস সামাদের বক্তব্য থেকে। যিনি বলছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলাকালীন আদালত থেকেই শেখ মুজিবের আন্দোলন শুরু করার বাণী মওলানা ভাসানীকে তিনি নিজে পৌঁছে দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে আন্দোলনটা শুরু হয়। তাছাড়া আমরা যদি মওলানা ভাসানীর ইতিহাসটা দেখি- যখন তিনি রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে আসামে গিয়ে রাজনীতি করছেন, সেটা কাদের রাজনীতি? পূর্ববঙ্গের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনীতিই তো। যারাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনীতি দিয়ে শুরু করেছে, তারা কোনোদিন সেখান থেকে সরে আসেনি। শেখ মুজিব সরে আসেননি, মওলানা ভাসানীও সরে আসেননি।
[ক্রমশ]
মন্তব্য করুন