পর্ব :২
পশ্চিম পাকিস্তানিদের দিক থেকে দেখলে, তাদের জন্য ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যুত্থানটা ব্যর্থ। এর পর থেকে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিভিন্ন আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং সেটিকে থামানোর ক্ষমতা কারও ছিল না। এখানে দেখতে হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই প্রস্তুতিটা কিন্তু পাকিস্তানিরাই তৈরি করে দিচ্ছে। একটার পর একটা পর্যায় পার হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত গিয়ে ১৯৬৯-এ পাকিস্তানে দ্বিতীয় মার্শাল ল- ইয়াহিয়া খানের শেষ চরম মার্শাল ল এলো। সেই সময়টাতে দেখা যায়, সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই সশস্ত্রভাবে সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এবং গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানের সাক্ষাৎকারটাতে এটা পরিস্কারভাবে রয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও যেটার উল্লেখ আছে যে, এই সময়ে সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী যে অদক্ষ- সেটার প্রমাণও রয়েছে সেখানে- তারা কোনো বিশ্নেষণ করেনি যে, সমস্যাটা কত বড় এবং সামলানোর ক্ষমতা পাকিস্তানের আছে কি না।
হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট বলছে যে, বাঙালিরা এই সময়ে হাজার হাজার বিহারি বা পাকিস্তানিদের হত্যা করেছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট, সত্যটা হলো ২৫ মার্চের আগে এখানে কোনোভাবেই হাজার হাজার মানুষ মারা যায়নি, কোনো পক্ষেই। রিপোর্টে তারা কয়েক লাখ হত্যার যে উল্লেখ করেছে- এসব বলে আসলে তারা বাঙালিদের ওপর তাদের নির্যাতনের কারণটা তৈরি করছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু অবাঙালি এবং পাকিস্তানিদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল, তাই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে এই প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে; যেটিকে পরবর্তীকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্ত হাতে দমন করেছে। এ হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিশেষ করে নিয়াজীর বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ নেই।


২৬ মার্চের পরে বিভিন্ন জায়গায় অবাঙালি পাকিস্তানিদের হত্যা করা হয়, যখন সংঘর্ষ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। ২৫ মার্চের পরে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখলে বোঝা যায়।
পাকিস্তানের মাত্র একটা বই কুতুবউদ্দিন আজিজের 'ব্লাড অ্যান্ড টিয়ার্স'-এর উল্লেখ করে হামুদুর রহমান কমিশন পুরো অসত্যটাকে হালাল করার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া অন্য আরেকটি বিষয় হলো, আমরা যেমন 'অপারেশন সার্চলাইট' বইটিকে অনেক বেশি তুলে ধরি- যেখানে পাকিস্তানিদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এ বইতে বলা হয় যে, হলগুলো থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, তাই তারা কামান ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই, কোনো জায়গায় উল্লেখ নেই যে এমন ঘটনা ঘটেছিল। এবং হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও কিন্তু এটার উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখানে কামান ব্যবহার করাটা প্রয়োজন ছিল না।
মাঠপর্যায়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা জানেন যে, এটি ছিল একটি বড় আক্রমণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২৫ মার্চ রাতের পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিরোধ শুরু হয়। ঢাকার বাইরে গোটা দেশটাই তখন স্বাধীন ছিল। সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের এই যে প্রতিরোধ মানসিকতা তৈরি হয় এবং পাকিস্তান তখন দখলদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
এই প্রতিরোধটা কিন্তু পাকিস্তান আর্মি আশা করেনি। তাদের চিন্তাতেই ছিল না বাঙালি এভাবে প্রতিরোধ করতে পারে। এবং তা এমন একটি পর্যায়ে চলে যায় যা পাকিস্তান সামলাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধই বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করল। কিন্তু আমাদের ইতিহাসে প্রতিরোধের যে চিত্রটা আমরা পাই, তা হলো আমরা বলি, সেনাবাহিনী প্রতিরোধ করেছিল, বিডিআর প্রতিরোধ করেছিল, পুলিশ প্রতিরোধ করেছিল। এরপর আমরা থেমে যাই। মাঝে মাঝে হয়তো আওয়ামী লীগের সদস্যদের কথা বলি। কিন্তু সারাদেশে যে সংগ্রাম কমিটিগুলো গঠিত হয়েছিল, প্রতিটি সংগ্রাম কমিটিই ছিল সবল, সক্রিয়। এর মূল কারণ হচ্ছে এর পেছনের প্রধান শক্তিটা ছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ আকাঙ্ক্ষা। এই প্রতিরোধ কিন্তু একটি স্বাভাবিক বিষয়, এটি প্রকৃতিগত, একে থামানো যায় না। কারণ, যে কোনো বিপদে পড়লে বা বাধার সম্মুখীন হলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরোধী হয়ে ওঠি। আর সেই প্রতিরোধের কারণেই পাকিস্তান আর্মি অত্যন্ত অনভ্যস্থভাবে এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের আর্মি তো এর আগে কেবল সীমান্তে যুদ্ধ করেছে। দেশের ভেতরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তার নাই। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তো তারা কখনও যুদ্ধ করেনি। অতএব সেই যুদ্ধ কেমন হয় সেটা তারা জানত না। জনগণের সঙ্গে যুদ্ধ করা, কোনো সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। আর তারা যে প্রস্তুত ছিল না এটা বোঝার নানারকম সূত্র আছে। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট থেকেও বোঝা যায়।


আরেকটি বড় বিষয় হলো লুট। আমরা সাধারণত মনে করি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরে বাংলাদেশে টাকা-পয়সা লুট করেছে, ধনীদের বাড়ি লুট করেছে, প্রতিষ্ঠান লুট করেছে ইত্যাদি; আর সাধারণ মানুষের বাসা-বাড়ি লুট করেছে রাজাকাররা। কিন্তু বাস্তবতাটা তো শুধু তাই নয়। পাকিস্তান আর্মি যখন যুদ্ধ করতে গেছে, সেটা বাংলাদেশের যে জায়গাতেই হোক- তাদের খাবার ছিল না। কারণ তারা তো এ জন্য প্রস্তুত ছিল না। সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে গিয়ে তারা খাবার-দাবার লুট করেছে। ইতিহাসে এ বিষয়টার উল্লেখ দেখা যায় না। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষকে কেবল হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতনই ক্ষুব্ধ করেছে তা নয়, তাদের বাড়ি থেকে যে খাবার লুট করে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়ে যাওয়া হতো, সে কারণেও তারা ক্ষুব্ধ ছিল সেনাবাহিনীর ওপর। এ বিষয়টা পরে বোঝা যায় যে, মানুষ বাড়িতে গরু রাখত না বেশি। হয়তো জবাই করে বিক্রি করে দিত, কারণ কখন আবার পাকিস্তান আর্মি বা রাজাকার এসে উঠিয়ে নিয়ে যায়!
এ থেকে বোঝা যায়- একটা সেনাবাহিনী যদি আক্রমণ করতে প্রস্তুত থাকত তাহলে অবশ্যই রসদ নিয়ে নামত। সে হিসেবে পাকিস্তান আর্মির কোনো রসদই ছিল না। রসদ ছিল না মানে কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। অর্থাৎ সারা বাংলাদেশ যে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে, এটা তাদের চিন্তাতেই ছিল না। সে কারণে যুদ্ধটা যখন শুরু হয়ে গেল, খাবার-দাবারের মতো আরও অনেক কিছুরই ঘাটতি দেখা দিল। তখন বিশেষভাবে তাদের অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে খাবারের জন্য। তদুপরি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খাবার লুট করতে হয়েছে। এই লুটের বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ এটা বুঝতে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন পরাজিত হয়ে গেছে। ২৫ মার্চের আক্রমণের পর পাকিস্তান আক্ষরিক অর্থেই পরাজিত।
এপ্রিলের পর থেকে মানুষ ভারতে যাওয়া শুরু করেছে ট্রেনিং নিতে। দু-তিন মাস পর তারা ফেরত এসে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তান যে ওসিলাটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন সময় যে, বাঙালিরা ৫ লাখ বিহারি পাকিস্তানিকে মেরেছে- সে কারণে সেনাবাহিনী বাঙালিদের আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো ঘটনারই আসলে উল্লেখ পাওয়া যায় না। তারচেয়ে বড় কথা ২৫ মার্চের আগে কোনো বড় হত্যাকাণ্ডই ঘটেনি, কোনো পক্ষেই। দু'একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যা ঘটার ঘটেছে ২৫ মার্চের আক্রমণের পরে। অতএব নিজেদের কৃতকর্মের ইতিহাসটাকে তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব বলেই তারা হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টের মতো দলিল তৈরি করে, বা তাদের ইতিহাসবিদদের এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়।
তবে বাংলাদেশে আক্রমণ যে চালাবে, সে সিদ্ধান্তটা তারা নিয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু সেখানে দেশব্যাপী যুদ্ধের কোনো সিদ্ধান্ত বা ধারণা ছিল না। তাদের চিন্তা ছিল ঢাকা আক্রমণ করলে বা দখল করলে এক রাতেই বাঙালিরা ঠান্ডা হয়ে যাবে। যে কথাটা ইয়াহিয়া খান পরবর্তী সময়ে বললো যে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ভুট্টোও যেটা বলেছে যে, একটু ঝামেলা ছিল, সেটা ঠিক হয়ে গেছে। পাকিস্তান আর্মিও সেই একই কথা বলেছে। অর্থাৎ তাদের ধারণা ছিল যে, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে পারবে না। কিন্তু তাদের তো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা নেই। তাদের ইতিহাস সম্পর্কেও ধারণা নেই যে, এই মানুষগুলো যুদ্ধ করছে ২০০ বছর ধরে। পাকিস্তানে তো কোনো কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস নেই। বঙ্গ হচ্ছে কৃষক বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল। বঙ্গের মানুষতো লড়াই করতে সারাজীবনই প্রস্তুত। সে যেকোনো পরিস্থিতিতেই লড়াই করবে। বাংলাদেশের এই মানুষ কেন টিকে গেছে? কারণ ও লড়াই করে। ও হারতে পারে না। ওর ইচ্ছা হলেও ও পারবে না। কারণ এটা ওর ডিএনএতেও ঢুকে গেছে, কারণ সে তো লড়াই করেই টিকে থেকেছে তার গোটা ইতিহাসে। ডেল্টা বা ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষের এটাই চরিত্র। একাধিকবার তার ওপর দখল হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিদেশিদের হাতে দখল হয়ে যাওয়াটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এবং প্রতিরোধ করাটাও নতুন বিষয় নয়। একাত্তরে বাংলাদেশি শরণার্থীরা চরমতম কষ্টের মাঝেও টিকে ছিল।


একাত্তরে পাকিস্তানিদের প্রথম পর্যায়টা হচ্ছে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত। তার পরের পর্যায়টি হলো ২৬ মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত যখন তারা কুষ্টিয়া দখল করে নিল। কিন্তু তার আগেই তো মুজিবনগর সরকার গঠন হয়ে গেছে। পাকিস্তানিদের নির্যাতনকে নিষ্ঠুরতা হিসেবে না দেখে যদি একে কাঠামোর মধ্যে ফেলে দেখি যে, তাদের নিষ্ঠুরতা করার প্রয়োজনটা কী ছিল? তাহলে দেখতে পাবো যে, এটি একটি অদক্ষ, অসহায় সেনাবাহিনী। যে পরিস্থিতিটা তারা তৈরি করেছে, সেটা সামলাবার ক্ষমতা তাদের নেই। এরকম সেনাবাহিনী একটা দেশকে দখল করে সেটাকে টিকিয়ে রাখার মতো ক্ষমতা ছিল কিনা, সেই প্রশ্নটা আমাদের করতে হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এটাই ছিল প্রথম পর্যায়ের চিত্র। এবং এই প্রথম পর্যায়টা তারা পার হতে পারেনি। একইসঙ্গে যখন মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, তখন সারা দুনিয়ার কাছে সেটি গ্রহণযোগ্যতাও পেয়ে গেল। আর মুজিবনগর সরকারের গ্রহণযোগ্যতা একটি মৌলিক বিষয়। এই সরকারের ক্ষমতা, রসদ, ব্যাপ্তি কোনোকিছুই সবল ছিল না। তারপরেও এটি প্রতীকীভাবে একটি সংগ্রামী মানুষের সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। এবং এ সরকারের সপক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আসা শুরু হলো। যার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দাঁড়াতে পারেনি।
আন্তর্জাতিকভাবে অন্য যে বিষয়টি এখানে বিবেচ্য, সেটি হলো- এক রাতের ভেতর ঢাকা দখল করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই আন্দোলনকে আমরা থামিয়ে দিতে পারব- পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্ত, বরং সুযোগ তৈরি করে দিল ভারতকে। কারণ পাকিস্তান তো ভারতের ঐতিহাসিক শত্রু; তারা সাতচল্লিশ সাল থেকেই চেষ্টা করছে পাকিস্তানকে ভাঙতে। পাকিস্তান মানে পশ্চিম পাকিস্তান। সে কারণে ভারত কোনোদিনই বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। তারা সব সময় চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে। কারণ, বাংলাদেশ ভারতের বিরোধী শক্তি না। ভারতের কেন্দ্র হচ্ছে দিল্লি, উত্তর ভারত। পাকিস্তানের কেন্দ্রও সেই উত্তর ভারত। আর পাকিস্তান-ভারত এই উত্তর ভারতের দ্বন্দ্বের কারণেই তৈরি দুটি রাষ্ট্র। তাদের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রগুলো ওইখানেই অর্থাৎ, দিল্লি, লাহোর, করাচি ইত্যাদি। বাংলাদেশ তৃতীয় রাষ্ট্র, তার আলাদা বাস্তবতা। বাংলাদেশ কৃষকের রাষ্ট্র। এই কৃষকের রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব ছিল না। আর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বন্দ্বটা, সেটা উপনিবেশের দ্বন্দ্ব। যেহেতু এ অঞ্চল ইংরেজদের উপনিবেশ ছিল এবং যেহেতু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বা ওয়ারিশ হিসেবে একে পাকিস্তান পেয়েছে, একে তারা উপনিবেশ হিসেবেই নিয়েছে। এর সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করেছে শুরু থেকে। তবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানিদের চেয়ে দক্ষ ছিল।
বাংলাদেশের মানুষ যে কৃষক বিদ্রোহ করেছে ১৭৬০ সালে- সেই একই কৃষক বিদ্রোহ করেছে একাত্তরে। ১৭৬০ সালেও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার সঙ্গে সহায়তা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৭১ সালেও কৃষকদের সঙ্গে সেই একই শ্রেণি এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকটি ছোট ছোট শ্রেণি একত্র হয়ে যুদ্ধটা করেছে। কিন্তু সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের। যে মানুষগুলো স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় যার কথা অনেকেই আনেননি, তবে এখন কিছুটা হলেও স্বীকার করেন- তা হচ্ছে বাংলার সাধারণ কৃষক সমাজ, গ্রামীণ সমাজ; যারা হারেনি। তারাই একাত্তরে দখলকৃত বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছে। অত্যন্ত বিপর্যস্ত, দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছে, তবু তারা বিরোধিতা করেছে, প্রতিরোধ করেছে, বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত পথ পরিস্কার করে দিয়েছে যৌথ বাহিনীকে দেশে প্রবেশ করার জন্য। 

[ক্রমশ]