
জাদুঘরের ঠিক পাশেই বাক্স-পেটরা নিয়ে বসে বোধিচরণ। বোধিচরণ একজন জুতোমিস্ত্রি- এই শব্দটি একটু খটমট লাগতে পারে কানে। রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এসব শুনে শুনেই আমাদের কান রীতিমতো অভ্যস্ত। তাই সহজ ও পুরোনো ভাষায় বললে- এই বোধিচরণ মুচি। মানুষের জুতো নিয়ে যার কাজকারবার। রোজ কত কিসিমের লোক যে তার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাদের রং ক্ষয়ে যাওয়া- বোয়াল মাছের মতো বিশাল হা হয়ে যাওয়া সুকতলার মতো বিক্ষিপ্ত জুতো নিয়ে- তার ইয়ত্তা নেই! বোধিচরণ মানুষের মুখ দেখে না- দেখে তাদের জুতোর চেহারা। আর এইসব জুতোর একেক রকম অবস্থা দেখে সে জুতোর মানুষদের অতীত ও বর্তমান বলে দিতে পারে! মাঝে মাঝে এমন জুতোর মানুষও তার কাছে আসে- যে জুতোয় নতুন করে পট্টি লাগানোরও কোনো অবস্থা থাকে না! কিন্তু শুশ্রূষার জন্য তার কর্মিষ্ঠ হাত সদা তৎপর। ফোঁড় আর সেলাইয়ে যেন ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ জুতোয় সে একরকম প্রাণ সঞ্চার করবে। খুঁজে দেবে পায়ে চলার স্বাভাবিক আনন্দ।
২.
বোধিচরণ আর দশজন মুচির মতো পায়ে চলার স্বাভাবিক আনন্দকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে আনলেও- এই গল্পে আসত কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে সে যে আর দশজন মুচির মতো নয়, এটা হলফ করে বলতে পারি। বোধিচরণ চরিত্রটির বিশেষত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিকটি হলো- সে তার কাছে আসা মানুষকে পড়তে দেয় একটি বিশেষ ধরনের বই। আপনাদের আগ্রহ আমি বুঝতে পারছি- আপনাদের মনে নিশ্চয় একটা ব্যাপারই এখন ঘোরপাক খাচ্ছে- সে আবার কেমন! আর বিশেষ বইটই আবার কী জিনিস? গাঁজাখুরি হলে ব্যাপারটা ওই পর্যন্তই ঠিক থাকে! শুনে আবার উড়িয়েও দেওয়া যায় যখন খুশি। আর তাই তো! এত জ্ঞানবিমুখ লোক চারদিকে। পড়া-ধরা টিচারদের অত্যাচার সহ্য করে কোনোরকম পাসটাস দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে এখন জ্ঞানের কথা শুনলেই যাদের মাথা ঘোরায়, ঘোরায় বললে অবশ্য কম বলা হয়- একেবারে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত গরম হয়ে যায়- তাদের কাছে বড়জোর সলিউশনের কড়া গন্ধটাও ভালো লাগে- সেখানে এই বিদ্যেটা নতুন করে বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে থাকার কথাই মনে করিয়ে দেয়। মুচির চেহারার সাথে বছরের পর বছর ফেল করা লোকেরা তাদের জালিম শিক্ষকদের চেহারার মিল খুঁজতে গিয়ে হতাশই হয়। এমনকি শিক্ষকদের ভাই তো নয়ই- জ্ঞাতি-গোষ্ঠী কারও চেহারার সাথেই তার এতটুকু মিল খুঁজে পায় না।
কিন্তু বোধিচরণ 'জুতো সেলাই ও চণ্ডীপাঠ' এই দুয়ের ভেতর ধরে রাখে তার কাছে আসা লোকদের। এবার বোধিচরণের এই বিশেষ ধরনের বইটার ব্যাপারে একটু বলে রাখি- যারা তার কাছে আসে, সে আগে তাদের জুতো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নেয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর জুতোর অবস্থা বুঝে একেক জনকে বইয়ের একেক অংশ পড়তে দেয়। যেমন এখনও কঠিন পর্যায়ে যায়নি এ রকম মানুষকে পড়তে দেওয়া অংশটি হালকা হলুদ রঙে দাগানো। আর যেসব জুতো যুদ্ধের মাঠ থেকে কোনোভাবে ফেরত এসেছে- তাদের অংশটি গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো। কিন্তু শুধু পালিশের জন্য যে জুতোজোড়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়- যেখানে ফোড়ন বা সুতোর কোনো কারবার নেই, সেই জুতোর মানুষদের সে খুব ভালো করে চেনে। এরা ভ্রমণে সঙ্গে করে নিয়ে যায় কুকুর। শুধু রোজ একটু পালিশের দরকার হয় এদের। তাই এদের বেলায় বোধিচরণ বরাবর চুপ।
৩.
যে বইটির কথা বলা হলো- তা মানুষের মানসিক শক্তি জোগায়। নিছক বাণী-উপদেশের উদ্ধৃতিময় বই নয় এটি। তারচেয়েও বেশি কিছু! না আপনারা ভাববেন না যেন; এটা জাদুর কোনো বই! জাদু শেখার কলাকৌশল না শেখালেও- কিন্তু কোথায় যেন সম্মোহিত করতে পারে এই বইটি। যারা মুচির জুতো থেকে বইয়ের প্রতি নাক গলানোর ব্যাপারটাকে ভালোমতো মেনে নিতে পারেন না- তারাও বইটির দাগানো অংশে ডুবে যান, কী আশ্চর্য কাণ্ড! মুচি বোধিচরণ জুতোর ওপর ও নিচতলা থেকে সুতো টেনে বের করে- নির্মমভাবে সেলাই করতে থাকে- আর জুতো সারাই করতে আসা মানুষ পড়তে থাকেন ছেঁড়াখোঁড়া মানসিক সেলাইয়ের জন্য বইয়ের হালকা দাগানো অংশটি। প্রতিদিন কতজন পড়েন এই বই? মানুষের হাতের স্পর্শে স্পর্শে বইটি দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু না, দুমড়ে যায় না। বইটি বেশ শক্ত, যাকে বলে শিক বাইন্ডিং। আপনারা বিদেশি বড় প্রকাশনা সংস্থার কিছু বই যদি দেখে থাকেন তাহলে আমার সঙ্গে একমত হবেন। যারা প্রথম দিকে অবহেলাভরে মুচির হাত থেকে বইটি নেন- তারাও একসময় পড়তে থাকেন। আর মজার ব্যাপারটাও এখানেই! এই বইটি কে লিখেছেন জানা যায় না। কারণ বইটির মলাট থেকে প্রিন্টার্স লাইনের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া!
৪.
একবার বোধিচরণের কাছে খুবই হতাশাগ্রস্ত এক যুবক এল- হ্যাঁ তার জুতোজোড়া দেখলে যে কেউ ভাববেন যুদ্ধের মাঠেরই বেঁচে যাওয়া জুতোজোড়া! কী নির্মম ছেঁড়াখোঁড়া, সেলাই করার জায়গাও এতটুকু বেঁচে নেই। বোধিচরণ অনেকক্ষণ সেই জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে কথা বলে উঠল, আপনি ফেরারি? যুবক রীতিমতো কেঁপে উঠল! তার গা থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। সে কী করবে বুঝতে পারে না- থাকবে না দৌড়ে পালাবে? যুবক ভাবে এই লোক নিশ্চয়ই পুলিশের চর। মুচির ছদ্মবেশ নিয়েছে। নাহলে সে ফেরারি না কী, তা তার জানার কথা না! যুবক যখন জুতোজোড়া রেখেই চলে যেতে উদ্যত- বোধিচরণ তখন তাকে আশ্বস্ত করে বলে-
'ভয় নেই, আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই!'
যুবক আরও অবাক হয়- আরে এ লোক দেখি মনের কথাও টের পেয়ে যায়! যুবক ঢোক গিলে মানে মানে করতে থাকে। বোধিচরণ যুবককে বসতে বলে- তার জুতোর সরঞ্জামে ভরা বাক্সের ওপর। যুবক বসবে কি বসবে না বুঝতে পারে না। কিন্তু তার পায়ে অসম্ভব ব্যথা। একটু বসতে পারলে পায়ের দু'দণ্ড বিশ্রাম হয়! যুবক বসেছে কি বসেনি যুবককে চমকে দিয়ে বোধিচরণ বলল-
'কোনো মেয়ে আপনার জীবনে আসছিল, কিন্তু এখন নাই। চাকরি ছেড়ে এখন নিজের কাছ থেকেই পালায়ে বেড়াচ্ছেন। এই পালায়া বেড়ানোটা হুলিয়া কান্ধে নিয়া পালানোর চাইতেও কঠিন।'
যুবক অবিশ্বাসের চোখে মুচির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে কোনো কথা ফুটছে না। কথা বলা মানুষ হঠাৎ বাকশক্তি হারিয়ে ফেললে যা হয়!
তবে বোধিচরণের জীবনে এই বয়স পর্যন্ত অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তাও জুতোসংক্রান্ত। একবার এক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল। এক ভদ্রলোকের জুতো পালিশ করার কয়েক মিনিটের ব্যবধানে লোকটির জুতোসহ পুরো পা-ই থেঁতলে গেল বিপজ্জনকভাবে আসা একটি গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে। বোধিচরণ কতদিন সেই চকচকে জুতোসহ এক পাকে স্বপ্নে দেখেছে! আর ঘুমের মধ্যে তাড়ানোর মতো করে হুশহাশ করেছে। কিন্তু জুতোসহ পা স্থির হয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। একটুও নড়েনি। তারপর কতদিন সে স্বপ্নে একপাটি জুতোর পায়ের সাথে কথা বলেছে। জিজ্ঞেস করেছে তার পালিশ লাগবে কিনা? কেন সে যেতে চায় না! একপাটি জুতো তখন বলেছে, হ্যাঁ পালিশ লাগবে। অন্য পায়ের সঙ্গে সে আসবে বোধিচরণের কাছে! তার মতো এত সুন্দর কালি নাকি কোনো মুচি করে না!
বোধিচরণ আরেকদিনের কথা কখনও ভুলবে না। সেদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সে বাক্স-পেটরা সাজিয়ে মাত্রই জাদুঘরের পাশে বসে ছাতা মেলতে যাবে, ঠিক তখনই একজন এল। বোধিচরণ লোকটিকে বলল-
দেরি হবে।
কিন্তু লোকটি কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়েই রইল। বোধিচরণ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল-
'বললাম না দেরি হবে, পরে আসেন!'
ছাতাটাতা মেলে বোধিচরণ আগরবাতি জ্বালাল। দোকান খুলেই আগরবাতি জ্বালানো তার রোজকার অভ্যেস। আগরবাতির ঘ্রাণ নাকে এলে সে স্বস্তি পায়। তারপর শুরু করে কাজ। বোধিচরণ দেখে লোকটি তার প্রতিটি কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। লোকটির চোখ অনেক গভীর, তল খুঁজে পাওয়া দুস্কর। লোকটি হঠাৎ বোধিচরণের কানের কাছে প্রায় ফিসফিস স্বরে বলল-
'তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। যদি না করে দাও, তাহলে জুতোর সঙ্গে তোমাকেও সেলাই করে দেব।'
বোধিচরণ তারপর যা শোনে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! ভয়ংকর ও বীভৎস। লোকটি নাকি কোনো মৃত মানুষের চামড়া শুকিয়ে রেখেছে। সে চামড়ায় বানাতে চায় জুতো! বোধিচরণ কী বলবে! অনেকক্ষণ তার মুখে কোনো কথা জোটে না। তার পরপরই লোকটি বলে-
'কেন বানাতে চাই জানিস না? জানিস না? ও, তুই জানবি কোথা থেকে।'
কিন্তু লোকটি পরে আর আসেনি। কিন্তু বোধিচরণ স্বপ্নে দেখেছে, ওই লোক মানুষের গায়ের চামড়া নিয়ে ফিরে এসেছে। হিংস্র হাসিতে ফেটে পড়ছে। চামড়া দুলিয়ে দুলিয়ে বলছে-
'এই চামড়া কার জানিস? জানিস? ও তুই কোথা থেকে জানবি?'
তারপর কতদিন ওই লোক স্বপ্নে হানা দিয়েছে! ওই লোকটির সামনে রাগ চাপতে চাপতে; বোধিচরণ ঘ্যাচাং করে বাটালিতে তার নিজের আঙুলের এক টুকরো কেটে ফেলেছে। টপটপ রক্ত গড়িয়ে পড়তেই তার ঘুম ভেঙে গেছে।
৫.
যুবক ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করে-
'আপনি কে? আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেন কী করে?'
বোধিচরণ স্মিত হেসে বলল-
'আমি একজন সামান্য মুচি। মানুষের জুতা নিয়াই আমার কাজকারবার। জুতা দেখে আমি মানুষের কিছু গোপন কথা কইতে পারি। সেটা সম্পূর্ণ আন্দাজ! কারও সাথে মিলে যায়, আবার কারও সাথে মিলে না!'
মুচি আবার কথার সূত্র ধরে বলল-
'আপনি খুব হাঁপায়ে গেছেন। বসেন।'
তারপর একটু চুপ থেকে সে আবার যোগ করে-
'কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু বিশেষ কিছু লাভ হয় নাই। জীবনের প্রতি খুব মায়া আপনার।' যুবক যেন চাক্ষুষ করছে তার ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত। তার রক্ত ছলকে ছলকে উঠছে। মুখ বারবার ঘামে ভিজে যাচ্ছে। একটু বমি বমিও লাগছে।
৬.
হ্যাঁ এ কথা ঠিক; যুবক একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। গ্রামের সহজ-সরল একটি মেয়ে। তাকে নিয়মিত ফোন দিত মেয়েটি। সারারাত জেগে তার সঙ্গে কথা বলতে হতো। কিন্তু পরদিন থাকত তার অফিস। যুবক মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করত- রাত জাগলে তার ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়। চোখ রক্তজবার মতো টকটকে লাল হয়ে যায়। অর্ধেক ঘুম আর অর্ধেক জাগনা থেকে তাকে অফিস করতে হয়। কখনও কাজে ভুল হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটি এতকিছু মানতে চাইত না। তার কথা বলা চাই। গভীর রাতের ঘুমজড়ানো গলায় যুবক কথা বলত। তখন এমন হলো, ব্যাপারটি 'রোজ রাতের গল্প' হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ও যুবকের বয়সের ব্যবধান দশ বছর। মানে মেয়েটি তার থেকে দশ বছরের ছোট। আর বয়স অনুসারে মেয়েটির মধ্যে চাপল্যও ছিল। মেয়েটি বলত-
'শোনো না আজ কী হয়েছে! রহিমুদ্দি চাচা (রহিমুদ্দি নামে জনৈক চাচা) একটা লাল রঙের ঘোড়া নিয়ে এসেছে গ্রামে। এই ঘোড়াটার গায়ে কেউ হাত রাখতে পারে না। সে নতুন পরিবেশে এসে কাউকে সহ্য করতে পারছিল না। কারও দেওয়া খাবার খাচ্ছিল না। কিন্তু আমি যখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে খেতে দিলাম, ওমা কী সুন্দর করে চিবিয়ে চিবিয়ে সবটা খেয়ে নিল!'
মেয়েটির ঘোড়া-বিষয়ক, মাছ-বিষয়ক, গাছ-বিষয়ক কিংবা মাকড়সা-বিষয়ক গল্প আর ফুরোয় না! রাত করে বাড়ি ফেরার পর একদিন- বুড়ো দাদু তাকে চুলের মুঠি ধরে কীভাবে মেরেছিল তাও সবিস্তারে বলা চাই। সব অভাব-অভিযোগ, আনন্দ-বেদনার কথা যুবকের সঙ্গে ভাগ করতে করতে সে কখনও ফুঁপিয়ে উঠত, আবার কখনও সশব্দে হেসেও উঠত আনন্দে।
যুবক শহরেই থাকে। ছুটিছাটা পেলে গ্রামে যায়। তবে আগের সময়গুলোতে গ্রামে যাওয়া আর এখন গ্রামে যাওয়ার মধ্যে একটা মোটাদাগে পার্থক্য ঘটে গেছে। সে মা-বাবার জন্য পারফিউম, লুঙ্গি, সাবান, টুকিটাকি জিনিস যেমন ব্যাগে ভরে তেমনি মেয়েটির জন্য নিয়ে যায় দামি কোম্পানির সুগন্ধি শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, একগাছি সবুজ-নীল চুড়ি, চুলের লাল রিবন ইত্যাদি ইত্যাদি। গভীর রাতে মেয়েটি সেজেগুজে, যুবকের দেওয়া সবুজ-নীল চুড়ি হাত ভরে পরে ছাদে যুবকের জন্য অপেক্ষা করে। আর যুবক ঝুঁকি নিয়ে সেই নিশীথে মেয়েটির সঙ্গে মিলিত হতে ঢপঢপ করা বুকে হাজির হয়। যুবক যখন মেয়েটিকে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরে; তখন জোর বাতাস বয়ে যায়। কাছেই কোথাও কোনো অচেনা পাখি চিচিচি করে ডেকে ওঠে। মেয়েটি চোখের পাতা আর খোলে না।
আর যখন খোলে- সে যেন সেই কম বয়সী কিশোরীটি নেই তখন- একজন পূর্ণ বয়স্কা নারী হয়ে ওঠে। তার তীক্ষষ্ট দাঁতে কামড়ে দেওয়ার মতো ফুঁস করে ওঠে-
'তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে?'
যুবক বলে-
'তুমি বুঝতে পারছ না, আমার নতুন চাকরি- এখন আমি ভাবতে পারছি না। আর এ রকম সুন্দর একটি রাত বিয়ের কথা বলে তুমি নষ্ট করে দিতে চাও?'
মেয়েটি তখন আলিঙ্গনের জাল থেকে বেরিয়ে বলে-
'আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, যত শিগগির!'
তারপর তার ঠোঁট উল্টে হাসি নির্গত হয়।
যুবক অধৈর্য হয়ে বলে-
'কিন্তু তোমার পড়াশোনাই তো ঠিকমতো শেষ হলো না। সবকিছুতে এত তাড়াহুড়ো কেন? আমরা আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি।'
মেয়েটি হঠাৎ চোখের তারা ঘুরিয়ে বলল-
'পরে যদি তোমার মন ঘুরে যায়? তখন আমার কী হবে? আমি তোমাকে সবটুকু চাই। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।'
মেয়েটি যেভাবে আলিঙ্গনের জ্যা থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়েছিল আবার সেই একই কায়দায় সে যুবকের দু'হাত নিয়ে আলিঙ্গনের একটা জ্যামিতি তৈরি করে। সেই রাতেই আরও অনেক কিছু ঘটতে পারত, কিন্তু যুবক ঘটতে দেয়নি।
তবে যা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটেনি, তা ঘটার জন্য প্রকৃতির খেয়ালে আবার একইরকম একটি রাত আসে। সেদিনও ছিল আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। ছাদের ওপর কোমর রেখে যে দীর্ঘদেহী আম গাছটা আকাশের দিকে ওঠে গেছে- সে এত রাতে মানব-মানবীর এই গোপন অভিসারের সাক্ষী। আর তার উপস্থিতিকে সরব করতে স্নিগ্ধ, কচিপাতা নাড়িয়ে যাচ্ছিল ঘন ঘন। মেয়েটি রাতের এই নির্জনতা ভেঙে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই হাসি কোনো নারকেল গাছের চূড়া পর্যন্ত যেন পৌঁছে যায়। মেয়েটি হঠাৎ হাসি থামিয়ে চোখে রহস্য খেলিয়ে বলে-
'ভয় পাও?'
যুবকের গলা একটু কেঁপে ওঠে। কথা বলতে গিয়ে যুবক টের পায় কেমন একটা ভৌতিক স্বর বেরিয়ে আসছে গলা থেকে!
মেয়েটি আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে, যাদের উচ্চ রক্তচাপ তারা এই হাসি শুনলে নির্ঘাত ভয় পাবে! মেয়েটি বলে-
'ভীতুর ডিম তুমি একটা। আমাকে বিয়ে করো আর না করো- আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ছি না। এমনকি মরে গেলে পেতনি হয়ে জাপটে ধরে থাকব।' এই বলে মেয়েটি বিপজ্জনকভাবে তাকে জাপটে ধরে! যুবক আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ টের পায় নিজের ভেতর। মেয়েটি এক প্রস্ত আলোর মতো শুয়ে পড়ে। যুবক চুম্বন করে মেয়েটিকে। তার হাত শিল্পীর রংতুলি ধরা হাতের মতো ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। মেয়েটির ফর্সা বুক কাঁচা মাটির দেবীর স্তনের মতো উন্মুক্ত হয়ে যায় এক ঝটকায়! সে যেতে থাকে ক্রমশ গভীরের দিকে, ভেঙেচুরে ... তার ভেতর এক রাক্ষুুসে পুরুষ জেগে ওঠে। তারপর গভীর জল থেকে যেন সাঁতার কেটে উঠে আমগাছ বরাবর দাঁড়ায়। মেয়েটির ঠোঁটে এক টুকরো পরিতৃপ্তির হাসি লেপটে থাকে। যুবক ও মেয়েটি হঠাৎ নিয়তির মতো আলাদা হয়ে যায়। ঝরঝর করে ওইদিন বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির শাসনে সমস্ত এলাকা ...। যুবক পরদিন শহরমুখী হয়। শহরে এসে আবার আগের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসা-অফিস। অফিস-বাসা। কিন্তু শহরে ফেরার পর ওই মেয়ের কাছ থেকে আর কোনো কল আসে না। যুবক অপেক্ষা করে- কিন্তু সেই অপেক্ষাও ফুরিয়ে যায়। একদিন যুবক জানতে পারে- ওই মেয়েটি ওদের বাড়ির সেই অভিসার সাক্ষী আমগাছটিতেই গলায় দড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু যুবক জানতেও পারেনি, এই আত্মহত্যার কারণ! যুবক তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তারপর একদিন চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে। সেই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ দেখলে তার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। মাথায় বৈদ্যুতিন এক তরঙ্গের প্রবাহ টের পায়। কখনও তা দ্রুত প্রবাহিত হয় আবার কখনও ধীরে। যখন ধীরে বয়- তখনই যুবক বেঁচে ওঠার একরকম আগ্রহ ফিরে পায়। চাকরি ছেড়ে কিছুদিন জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়েছে যুবক। কিন্তু ওই নির্জন জঙ্গল আরও শত্রু হয়ে উঠেছে তার কাছে। নিস্তব্ধতা আর জঙ্গলের এই খাঁখাঁ শূন্যতা তার দুঃসহ ভারের ওপর আরও এক অমোঘ ভার চাপিয়ে দিয়েছে। যুবক ঠিক করে সে শহরেই ফিরে যাবে আবার। মিশে যাবে কোলাহলের ভেতর। ফিরেও আসে- তারপর কত রাস্তা পাগলের মতো বিড়বিড় করে হেঁটেছে। হাঁটতে হাঁটতে জুতোর অবস্থাও বেজায় কঠিন! অনেকবার সেলাই করার পর শেষ মুহূর্তে সে এল বোধিচরণ মুচির কাছে। আর বোধিচরণ তাকে এ কী বলছে? এই কোলাহলের ভেতর মুচির কয়েকটি কথা তাকে রীতিমতো ঠান্ডা ও স্থির করে দিয়েছে। এই অবস্থা কাটাতে যুবকের বেশ অনেক সময় লেগে যায়।
৭.
বোধিচরণ যুবককে তার কাছে থাকা বই থেকে গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো একটি অংশ পড়তে দেয়। যুবক পড়তে থাকে। ওই অংশের প্রতিটি অক্ষর তাকে সম্মোহিত করতে থাকে। সে একই জিনিস বারবার করে পড়ে। বোধিচরণ তার এই অবস্থা দেখে বলে-
'আপনার মতো হতাশাগ্রস্ত যুবক আমি খুব বেশি দেখি নাই। তবে আপনার ভেতর শক্তি আছে, ওই শক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে- আপনি কামিয়াব হবেন। আর এই গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো অংশটা অনেকদিন পর কাউরে পড়তে দিলাম। শেষ কে পড়ছিল মনে নাই। এমনিতে যারা আমার কাছে আসে- তাদেরকে হালকা হলুদ রঙের অংশটাই পড়াই। কিন্তু আপনার কেস অন্য। তাই আপনাকে এটা পড়তে দিলাম।'
যুবকের জুতোর সেলাইকর্ম হয়ে গেলে সে জুতো গলিয়ে চলে যায়। কিন্তু জুতো পায়ে নিয়ে আসে এক অন্যরকম শক্তি! ভাবে তাকে আর হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। জীবনযুদ্ধে তাকে ব্যাঘ্রের মতো বাঁচতে হবে। থাকবে গর্জন, ঘণ্টায় ৪৬ মাইল বেগে তাকে দৌড়াতে হবে। পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হবে তাকে। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। মৃত ডারউইন বারবার ঘুরেফিরে আসতে লাগল যুবকের মস্তিস্কের কোষে।
৮.
যুবক তারপর থেকে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অহর্নিশ কাজের ভেতরই ডুবে থাকে। যেন আলস্যের এক ফোঁটা ছিদ্র না থাকে কোথাও। কাজের ভেতর দিয়ে মূলত সে তার অতীত ভুলে থাকতে চায়। অতীতের ছলনা অনেক কঠিন। ঘুমোতে দেয় না, খেতে দেয় না, কেবল সবকিছুতে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর সে বাধার দৈর্ঘ্য এতই যে- গজ ফিতেতেও ধরে না। যুবক অতঃপর তার সমস্ত মেধা ও শক্তি কাজের মধ্যে তিল তিল করে বিলিয়ে দেয়। আর হ্যাঁ; বছর ঘুরতেই তার অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবে আগের বছরের থেকে পরের বছর এই পরিবর্তন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। যুবক সুসজ্জিত রাজমহলের মতো কোনো বাড়ি থেকে একরাশ সুগন্ধের ভেতর বের হয়। তার চেহারায় স্বাস্থ্য ও সম্পদের রোশনাই চিকচিক করে। চেহারায় ফেয়ার হ্যান্ডসাম ক্রিমের মডেলের মতো আত্মবিশ্বাস। পায়ের প্রতি স্টেপে দৃঢ়তা। ডানহাতে পরা ঘড়ির সুন্দর নীল রঙের ডায়ালের দিকে তার চোখ সব সময়! তারপর হঠাৎ কবে যেন যুবক জাদুঘরের সামনে দিয়ে তার বিশাল গাড়ি করে যাচ্ছিল। রাস্তায় ছিল অনেক জ্যাম। হঠাৎ কী মনে করে গাড়ির জানালার কাচ খুলে দিতেই যুবকের চোখ গেল জাদুঘরের সামনে বসা এক মুচির দিকে। বয়সে তরুণ এক মুচি। একমনে সে সেলাই করে যাচ্ছে জুতো। কে যেন ধমকে উঠল-
'ঠিকমতো সেলাই করতে পারো না ?'
যুবক তার চকচকে পালিশ করা জুতোজোড়া নিয়ে মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তরুণ মুচি বুঝতে পারে না- এই সাহেব তার কাছে কেন? তরুণ মুচি যুবকের দিকে তাকায়। কিন্তু তাকিয়ে সে আগন্তুকের আসার হেতুটা ধরতে পারে না। তার কাছে সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হয়। যুবক বলতে চেষ্টা করে-
'আচ্ছা অনেকদিন আগে এখানে একজন বসতেন, বয়স্কমতো একটা লোক। তুমি জানো তার সম্পর্কে কিছু? আমার উনাকে একটু দরকার ছিল। নাম হলো বোধি ...'
তরুণ বলল-
'ও আপনি বাবুজির কথা বলছেন? বাবুজি তো এখন আর বসে না। আমিই বসি এখানে। কী দরকার আমারে বলেন।'
যুবক বলল-
'না, উনাকেই বলতে চাই, তুমি আমাকে উনার কাছে একটু নিয়ে চলো। এখনই। আর আজ তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না।'
এই বলে যুবক তরুণ মুচিকে একটা বড় নোট বের করে দিল। তরুণ মুচি ঠিক কিছু বুঝতে না পেরে সাহেবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। টাকাটা ফেরত দিতে যাবে। তার আগে যুবক তার হাত চেপে সরিয়ে দিল।
তরুণ মুচি বলল-
'বাবুজির কাছে আপনারে আমি এমনিই নিয়ে যেতাম।' যুবকের চোখে-মুখে বোধিচরণের সন্ধান পাওয়ার আনন্দ। তার কণ্ঠে যেন বহু শতাব্দীর তাড়া।
'এখন চলো, ইয়াংম্যান'
তরুণ মুচি সাহেবকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। অনেক গলি-ঘুপচি পেরিয়ে বোধিচরণের ছেলে সাহেবকে নিয়ে যেখানে পৌঁছে, সেটা অনেক মানুষের প্রকাশ্য সংসার না বলে সংসারের বাজার বললেই এর আক্ষরিক অর্থ উদ্ধার হয়। চারদিকে হাঁড়ি-পাতিলের শব্দ, চিৎকার-চেঁচামেচিতে কানে ঝিঁঝি লাগে। দেশি মদের ভুরভুর করা গন্ধে বাতাস ভারী। একটু অসাবধান হলেই সাহেববেশী যুবকের স্যুট-টাই গরম ভাতের মাড়ে নষ্ট হয়ে যেত। ভাগ্যিস মাড় ফেলতে আসা জীর্ণশীর্ণ তরুণীর চোখ সাহেব চিনতে ভুল করেনি! ঘাড় ঘুরিয়ে সে অপস্রিয়মাণ হরিণীর মতো হারিয়ে যায়। কয়েক বাড়ি পরেই তরুণ মুচি একটা জীর্ণ বাড়ির সামনে এসে ডাক পাড়ে।
'বাবুজি, বাইরে আসো। তোমাকে এক সাহেব খোঁজ করতেছে।'
তরুণ তারপর কোনদিকে যেন মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। আধখোলা দরজায় হঠাৎ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাপরা একটি মুখ উঁকি দিল। হ্যাঁ বোধিচরণেরই মুখ। সারামুখে ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ। মনে হলো ঘুমের ভেতরই ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ এই ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে চেহারায় কিছুটা বিরক্তির ছাপ। বোধিচরণ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়। চশমার ফাঁক গলিয়ে আগন্তুককে চেনার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বোধিচরণ সাহেবের দিকে আবার তাকিয়ে বলে-
'কে?' যুবক বোধিচরণের স্মৃতির সলতের মুখে আগুন ধরিয়ে দেয়। বলে-
'দেখুন আমি, বেশ অনেক বছর আগে- হ্যাঁ অনেক বছর আগে, আপনার কাছে আমার বাতিল প্রায় একজোড়া জুতো নিয়ে এসেছিলাম- আর আপনি তখন আমাকে একটি বই ...।'
যুবক কথা শেষ করতে পারে না। সে বাক্স-পেটরার ভেতর এই অদ্ভুত জুতোর মানুষকে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, সারামুখে দাড়ি-গোঁফ। কপালের চুল উঠে গিয়ে তালু পর্যন্ত ফাঁকা। যুবক ভাবে এই কি সেই মুচি? যে একদা তাকে কয়েকটি গোপন কথা বলে রীতিমতো ভড়কে দিয়েছিল! হ্যাঁ, এ যে ওই লোকই এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যুবক তার স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতে তারপরও জিজ্ঞেস করে-
আপনার নাম বোধিচরণ না?
বোধিচরণ ঠিক বুঝতে পারে না আগন্তুকের তার নাম জিজ্ঞেস করার হেতু।
সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
যুবক আবার জিজ্ঞেস করে-
'আমাকে চিনতে পেরেছেন?'
বোধিচরণ কাশতে কাশতে বলে-
'আমার কাছে কত মানুষ আসত প্রতিদিন, সবার চেহারা কি আর মনে থাকে! আর আমি তো মুখ নয়, মানুষের জুতোর দিকেই তাকাইছি সব সময়! জুতাই যে আমার অন্ন-রিজিক! আর এখন তো চোখেই দেখি না, জুতার কাজও করতে পারি না!'
যুবক কৌতূহল জড়ানো গলায় বলে-
'আচ্ছা আপনার কাছে ওই যে একটা বই ছিল- সেটা আমি চাই। ওই বই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমি বোঝাতে পারব না, সেদিন আমি কী নিয়ে ফিরেছিলাম! আপনি যা চান আমি দেব, বিনিময়ে আমার ওই বইটাই চাই।'
বোধিচরণ কাশির দমক সামলাতে সামলাতে বলল-
'বই! ওহ!! ছিল তো ... কিন্তু সে তো অনেককাল আগের কথা! ওই বই কবে যে কে নিয়া গেল, ভুলেই তো গেছি!'
২.
বোধিচরণ আর দশজন মুচির মতো পায়ে চলার স্বাভাবিক আনন্দকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে আনলেও- এই গল্পে আসত কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে সে যে আর দশজন মুচির মতো নয়, এটা হলফ করে বলতে পারি। বোধিচরণ চরিত্রটির বিশেষত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিকটি হলো- সে তার কাছে আসা মানুষকে পড়তে দেয় একটি বিশেষ ধরনের বই। আপনাদের আগ্রহ আমি বুঝতে পারছি- আপনাদের মনে নিশ্চয় একটা ব্যাপারই এখন ঘোরপাক খাচ্ছে- সে আবার কেমন! আর বিশেষ বইটই আবার কী জিনিস? গাঁজাখুরি হলে ব্যাপারটা ওই পর্যন্তই ঠিক থাকে! শুনে আবার উড়িয়েও দেওয়া যায় যখন খুশি। আর তাই তো! এত জ্ঞানবিমুখ লোক চারদিকে। পড়া-ধরা টিচারদের অত্যাচার সহ্য করে কোনোরকম পাসটাস দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে এখন জ্ঞানের কথা শুনলেই যাদের মাথা ঘোরায়, ঘোরায় বললে অবশ্য কম বলা হয়- একেবারে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত গরম হয়ে যায়- তাদের কাছে বড়জোর সলিউশনের কড়া গন্ধটাও ভালো লাগে- সেখানে এই বিদ্যেটা নতুন করে বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে থাকার কথাই মনে করিয়ে দেয়। মুচির চেহারার সাথে বছরের পর বছর ফেল করা লোকেরা তাদের জালিম শিক্ষকদের চেহারার মিল খুঁজতে গিয়ে হতাশই হয়। এমনকি শিক্ষকদের ভাই তো নয়ই- জ্ঞাতি-গোষ্ঠী কারও চেহারার সাথেই তার এতটুকু মিল খুঁজে পায় না।
কিন্তু বোধিচরণ 'জুতো সেলাই ও চণ্ডীপাঠ' এই দুয়ের ভেতর ধরে রাখে তার কাছে আসা লোকদের। এবার বোধিচরণের এই বিশেষ ধরনের বইটার ব্যাপারে একটু বলে রাখি- যারা তার কাছে আসে, সে আগে তাদের জুতো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নেয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর জুতোর অবস্থা বুঝে একেক জনকে বইয়ের একেক অংশ পড়তে দেয়। যেমন এখনও কঠিন পর্যায়ে যায়নি এ রকম মানুষকে পড়তে দেওয়া অংশটি হালকা হলুদ রঙে দাগানো। আর যেসব জুতো যুদ্ধের মাঠ থেকে কোনোভাবে ফেরত এসেছে- তাদের অংশটি গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো। কিন্তু শুধু পালিশের জন্য যে জুতোজোড়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়- যেখানে ফোড়ন বা সুতোর কোনো কারবার নেই, সেই জুতোর মানুষদের সে খুব ভালো করে চেনে। এরা ভ্রমণে সঙ্গে করে নিয়ে যায় কুকুর। শুধু রোজ একটু পালিশের দরকার হয় এদের। তাই এদের বেলায় বোধিচরণ বরাবর চুপ।
৩.
যে বইটির কথা বলা হলো- তা মানুষের মানসিক শক্তি জোগায়। নিছক বাণী-উপদেশের উদ্ধৃতিময় বই নয় এটি। তারচেয়েও বেশি কিছু! না আপনারা ভাববেন না যেন; এটা জাদুর কোনো বই! জাদু শেখার কলাকৌশল না শেখালেও- কিন্তু কোথায় যেন সম্মোহিত করতে পারে এই বইটি। যারা মুচির জুতো থেকে বইয়ের প্রতি নাক গলানোর ব্যাপারটাকে ভালোমতো মেনে নিতে পারেন না- তারাও বইটির দাগানো অংশে ডুবে যান, কী আশ্চর্য কাণ্ড! মুচি বোধিচরণ জুতোর ওপর ও নিচতলা থেকে সুতো টেনে বের করে- নির্মমভাবে সেলাই করতে থাকে- আর জুতো সারাই করতে আসা মানুষ পড়তে থাকেন ছেঁড়াখোঁড়া মানসিক সেলাইয়ের জন্য বইয়ের হালকা দাগানো অংশটি। প্রতিদিন কতজন পড়েন এই বই? মানুষের হাতের স্পর্শে স্পর্শে বইটি দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু না, দুমড়ে যায় না। বইটি বেশ শক্ত, যাকে বলে শিক বাইন্ডিং। আপনারা বিদেশি বড় প্রকাশনা সংস্থার কিছু বই যদি দেখে থাকেন তাহলে আমার সঙ্গে একমত হবেন। যারা প্রথম দিকে অবহেলাভরে মুচির হাত থেকে বইটি নেন- তারাও একসময় পড়তে থাকেন। আর মজার ব্যাপারটাও এখানেই! এই বইটি কে লিখেছেন জানা যায় না। কারণ বইটির মলাট থেকে প্রিন্টার্স লাইনের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া!
৪.
একবার বোধিচরণের কাছে খুবই হতাশাগ্রস্ত এক যুবক এল- হ্যাঁ তার জুতোজোড়া দেখলে যে কেউ ভাববেন যুদ্ধের মাঠেরই বেঁচে যাওয়া জুতোজোড়া! কী নির্মম ছেঁড়াখোঁড়া, সেলাই করার জায়গাও এতটুকু বেঁচে নেই। বোধিচরণ অনেকক্ষণ সেই জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে কথা বলে উঠল, আপনি ফেরারি? যুবক রীতিমতো কেঁপে উঠল! তার গা থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। সে কী করবে বুঝতে পারে না- থাকবে না দৌড়ে পালাবে? যুবক ভাবে এই লোক নিশ্চয়ই পুলিশের চর। মুচির ছদ্মবেশ নিয়েছে। নাহলে সে ফেরারি না কী, তা তার জানার কথা না! যুবক যখন জুতোজোড়া রেখেই চলে যেতে উদ্যত- বোধিচরণ তখন তাকে আশ্বস্ত করে বলে-
'ভয় নেই, আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই!'
যুবক আরও অবাক হয়- আরে এ লোক দেখি মনের কথাও টের পেয়ে যায়! যুবক ঢোক গিলে মানে মানে করতে থাকে। বোধিচরণ যুবককে বসতে বলে- তার জুতোর সরঞ্জামে ভরা বাক্সের ওপর। যুবক বসবে কি বসবে না বুঝতে পারে না। কিন্তু তার পায়ে অসম্ভব ব্যথা। একটু বসতে পারলে পায়ের দু'দণ্ড বিশ্রাম হয়! যুবক বসেছে কি বসেনি যুবককে চমকে দিয়ে বোধিচরণ বলল-
'কোনো মেয়ে আপনার জীবনে আসছিল, কিন্তু এখন নাই। চাকরি ছেড়ে এখন নিজের কাছ থেকেই পালায়ে বেড়াচ্ছেন। এই পালায়া বেড়ানোটা হুলিয়া কান্ধে নিয়া পালানোর চাইতেও কঠিন।'
যুবক অবিশ্বাসের চোখে মুচির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে কোনো কথা ফুটছে না। কথা বলা মানুষ হঠাৎ বাকশক্তি হারিয়ে ফেললে যা হয়!
তবে বোধিচরণের জীবনে এই বয়স পর্যন্ত অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তাও জুতোসংক্রান্ত। একবার এক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল। এক ভদ্রলোকের জুতো পালিশ করার কয়েক মিনিটের ব্যবধানে লোকটির জুতোসহ পুরো পা-ই থেঁতলে গেল বিপজ্জনকভাবে আসা একটি গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে। বোধিচরণ কতদিন সেই চকচকে জুতোসহ এক পাকে স্বপ্নে দেখেছে! আর ঘুমের মধ্যে তাড়ানোর মতো করে হুশহাশ করেছে। কিন্তু জুতোসহ পা স্থির হয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। একটুও নড়েনি। তারপর কতদিন সে স্বপ্নে একপাটি জুতোর পায়ের সাথে কথা বলেছে। জিজ্ঞেস করেছে তার পালিশ লাগবে কিনা? কেন সে যেতে চায় না! একপাটি জুতো তখন বলেছে, হ্যাঁ পালিশ লাগবে। অন্য পায়ের সঙ্গে সে আসবে বোধিচরণের কাছে! তার মতো এত সুন্দর কালি নাকি কোনো মুচি করে না!
বোধিচরণ আরেকদিনের কথা কখনও ভুলবে না। সেদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সে বাক্স-পেটরা সাজিয়ে মাত্রই জাদুঘরের পাশে বসে ছাতা মেলতে যাবে, ঠিক তখনই একজন এল। বোধিচরণ লোকটিকে বলল-
দেরি হবে।
কিন্তু লোকটি কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়েই রইল। বোধিচরণ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল-
'বললাম না দেরি হবে, পরে আসেন!'
ছাতাটাতা মেলে বোধিচরণ আগরবাতি জ্বালাল। দোকান খুলেই আগরবাতি জ্বালানো তার রোজকার অভ্যেস। আগরবাতির ঘ্রাণ নাকে এলে সে স্বস্তি পায়। তারপর শুরু করে কাজ। বোধিচরণ দেখে লোকটি তার প্রতিটি কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। লোকটির চোখ অনেক গভীর, তল খুঁজে পাওয়া দুস্কর। লোকটি হঠাৎ বোধিচরণের কানের কাছে প্রায় ফিসফিস স্বরে বলল-
'তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। যদি না করে দাও, তাহলে জুতোর সঙ্গে তোমাকেও সেলাই করে দেব।'
বোধিচরণ তারপর যা শোনে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! ভয়ংকর ও বীভৎস। লোকটি নাকি কোনো মৃত মানুষের চামড়া শুকিয়ে রেখেছে। সে চামড়ায় বানাতে চায় জুতো! বোধিচরণ কী বলবে! অনেকক্ষণ তার মুখে কোনো কথা জোটে না। তার পরপরই লোকটি বলে-
'কেন বানাতে চাই জানিস না? জানিস না? ও, তুই জানবি কোথা থেকে।'
কিন্তু লোকটি পরে আর আসেনি। কিন্তু বোধিচরণ স্বপ্নে দেখেছে, ওই লোক মানুষের গায়ের চামড়া নিয়ে ফিরে এসেছে। হিংস্র হাসিতে ফেটে পড়ছে। চামড়া দুলিয়ে দুলিয়ে বলছে-
'এই চামড়া কার জানিস? জানিস? ও তুই কোথা থেকে জানবি?'
তারপর কতদিন ওই লোক স্বপ্নে হানা দিয়েছে! ওই লোকটির সামনে রাগ চাপতে চাপতে; বোধিচরণ ঘ্যাচাং করে বাটালিতে তার নিজের আঙুলের এক টুকরো কেটে ফেলেছে। টপটপ রক্ত গড়িয়ে পড়তেই তার ঘুম ভেঙে গেছে।
৫.
যুবক ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করে-
'আপনি কে? আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেন কী করে?'
বোধিচরণ স্মিত হেসে বলল-
'আমি একজন সামান্য মুচি। মানুষের জুতা নিয়াই আমার কাজকারবার। জুতা দেখে আমি মানুষের কিছু গোপন কথা কইতে পারি। সেটা সম্পূর্ণ আন্দাজ! কারও সাথে মিলে যায়, আবার কারও সাথে মিলে না!'
মুচি আবার কথার সূত্র ধরে বলল-
'আপনি খুব হাঁপায়ে গেছেন। বসেন।'
তারপর একটু চুপ থেকে সে আবার যোগ করে-
'কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু বিশেষ কিছু লাভ হয় নাই। জীবনের প্রতি খুব মায়া আপনার।' যুবক যেন চাক্ষুষ করছে তার ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত। তার রক্ত ছলকে ছলকে উঠছে। মুখ বারবার ঘামে ভিজে যাচ্ছে। একটু বমি বমিও লাগছে।
৬.
হ্যাঁ এ কথা ঠিক; যুবক একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। গ্রামের সহজ-সরল একটি মেয়ে। তাকে নিয়মিত ফোন দিত মেয়েটি। সারারাত জেগে তার সঙ্গে কথা বলতে হতো। কিন্তু পরদিন থাকত তার অফিস। যুবক মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করত- রাত জাগলে তার ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়। চোখ রক্তজবার মতো টকটকে লাল হয়ে যায়। অর্ধেক ঘুম আর অর্ধেক জাগনা থেকে তাকে অফিস করতে হয়। কখনও কাজে ভুল হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটি এতকিছু মানতে চাইত না। তার কথা বলা চাই। গভীর রাতের ঘুমজড়ানো গলায় যুবক কথা বলত। তখন এমন হলো, ব্যাপারটি 'রোজ রাতের গল্প' হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ও যুবকের বয়সের ব্যবধান দশ বছর। মানে মেয়েটি তার থেকে দশ বছরের ছোট। আর বয়স অনুসারে মেয়েটির মধ্যে চাপল্যও ছিল। মেয়েটি বলত-
'শোনো না আজ কী হয়েছে! রহিমুদ্দি চাচা (রহিমুদ্দি নামে জনৈক চাচা) একটা লাল রঙের ঘোড়া নিয়ে এসেছে গ্রামে। এই ঘোড়াটার গায়ে কেউ হাত রাখতে পারে না। সে নতুন পরিবেশে এসে কাউকে সহ্য করতে পারছিল না। কারও দেওয়া খাবার খাচ্ছিল না। কিন্তু আমি যখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে খেতে দিলাম, ওমা কী সুন্দর করে চিবিয়ে চিবিয়ে সবটা খেয়ে নিল!'
মেয়েটির ঘোড়া-বিষয়ক, মাছ-বিষয়ক, গাছ-বিষয়ক কিংবা মাকড়সা-বিষয়ক গল্প আর ফুরোয় না! রাত করে বাড়ি ফেরার পর একদিন- বুড়ো দাদু তাকে চুলের মুঠি ধরে কীভাবে মেরেছিল তাও সবিস্তারে বলা চাই। সব অভাব-অভিযোগ, আনন্দ-বেদনার কথা যুবকের সঙ্গে ভাগ করতে করতে সে কখনও ফুঁপিয়ে উঠত, আবার কখনও সশব্দে হেসেও উঠত আনন্দে।
যুবক শহরেই থাকে। ছুটিছাটা পেলে গ্রামে যায়। তবে আগের সময়গুলোতে গ্রামে যাওয়া আর এখন গ্রামে যাওয়ার মধ্যে একটা মোটাদাগে পার্থক্য ঘটে গেছে। সে মা-বাবার জন্য পারফিউম, লুঙ্গি, সাবান, টুকিটাকি জিনিস যেমন ব্যাগে ভরে তেমনি মেয়েটির জন্য নিয়ে যায় দামি কোম্পানির সুগন্ধি শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, একগাছি সবুজ-নীল চুড়ি, চুলের লাল রিবন ইত্যাদি ইত্যাদি। গভীর রাতে মেয়েটি সেজেগুজে, যুবকের দেওয়া সবুজ-নীল চুড়ি হাত ভরে পরে ছাদে যুবকের জন্য অপেক্ষা করে। আর যুবক ঝুঁকি নিয়ে সেই নিশীথে মেয়েটির সঙ্গে মিলিত হতে ঢপঢপ করা বুকে হাজির হয়। যুবক যখন মেয়েটিকে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরে; তখন জোর বাতাস বয়ে যায়। কাছেই কোথাও কোনো অচেনা পাখি চিচিচি করে ডেকে ওঠে। মেয়েটি চোখের পাতা আর খোলে না।
আর যখন খোলে- সে যেন সেই কম বয়সী কিশোরীটি নেই তখন- একজন পূর্ণ বয়স্কা নারী হয়ে ওঠে। তার তীক্ষষ্ট দাঁতে কামড়ে দেওয়ার মতো ফুঁস করে ওঠে-
'তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে?'
যুবক বলে-
'তুমি বুঝতে পারছ না, আমার নতুন চাকরি- এখন আমি ভাবতে পারছি না। আর এ রকম সুন্দর একটি রাত বিয়ের কথা বলে তুমি নষ্ট করে দিতে চাও?'
মেয়েটি তখন আলিঙ্গনের জাল থেকে বেরিয়ে বলে-
'আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, যত শিগগির!'
তারপর তার ঠোঁট উল্টে হাসি নির্গত হয়।
যুবক অধৈর্য হয়ে বলে-
'কিন্তু তোমার পড়াশোনাই তো ঠিকমতো শেষ হলো না। সবকিছুতে এত তাড়াহুড়ো কেন? আমরা আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি।'
মেয়েটি হঠাৎ চোখের তারা ঘুরিয়ে বলল-
'পরে যদি তোমার মন ঘুরে যায়? তখন আমার কী হবে? আমি তোমাকে সবটুকু চাই। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।'
মেয়েটি যেভাবে আলিঙ্গনের জ্যা থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়েছিল আবার সেই একই কায়দায় সে যুবকের দু'হাত নিয়ে আলিঙ্গনের একটা জ্যামিতি তৈরি করে। সেই রাতেই আরও অনেক কিছু ঘটতে পারত, কিন্তু যুবক ঘটতে দেয়নি।
তবে যা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটেনি, তা ঘটার জন্য প্রকৃতির খেয়ালে আবার একইরকম একটি রাত আসে। সেদিনও ছিল আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। ছাদের ওপর কোমর রেখে যে দীর্ঘদেহী আম গাছটা আকাশের দিকে ওঠে গেছে- সে এত রাতে মানব-মানবীর এই গোপন অভিসারের সাক্ষী। আর তার উপস্থিতিকে সরব করতে স্নিগ্ধ, কচিপাতা নাড়িয়ে যাচ্ছিল ঘন ঘন। মেয়েটি রাতের এই নির্জনতা ভেঙে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই হাসি কোনো নারকেল গাছের চূড়া পর্যন্ত যেন পৌঁছে যায়। মেয়েটি হঠাৎ হাসি থামিয়ে চোখে রহস্য খেলিয়ে বলে-
'ভয় পাও?'
যুবকের গলা একটু কেঁপে ওঠে। কথা বলতে গিয়ে যুবক টের পায় কেমন একটা ভৌতিক স্বর বেরিয়ে আসছে গলা থেকে!
মেয়েটি আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে, যাদের উচ্চ রক্তচাপ তারা এই হাসি শুনলে নির্ঘাত ভয় পাবে! মেয়েটি বলে-
'ভীতুর ডিম তুমি একটা। আমাকে বিয়ে করো আর না করো- আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ছি না। এমনকি মরে গেলে পেতনি হয়ে জাপটে ধরে থাকব।' এই বলে মেয়েটি বিপজ্জনকভাবে তাকে জাপটে ধরে! যুবক আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ টের পায় নিজের ভেতর। মেয়েটি এক প্রস্ত আলোর মতো শুয়ে পড়ে। যুবক চুম্বন করে মেয়েটিকে। তার হাত শিল্পীর রংতুলি ধরা হাতের মতো ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। মেয়েটির ফর্সা বুক কাঁচা মাটির দেবীর স্তনের মতো উন্মুক্ত হয়ে যায় এক ঝটকায়! সে যেতে থাকে ক্রমশ গভীরের দিকে, ভেঙেচুরে ... তার ভেতর এক রাক্ষুুসে পুরুষ জেগে ওঠে। তারপর গভীর জল থেকে যেন সাঁতার কেটে উঠে আমগাছ বরাবর দাঁড়ায়। মেয়েটির ঠোঁটে এক টুকরো পরিতৃপ্তির হাসি লেপটে থাকে। যুবক ও মেয়েটি হঠাৎ নিয়তির মতো আলাদা হয়ে যায়। ঝরঝর করে ওইদিন বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির শাসনে সমস্ত এলাকা ...। যুবক পরদিন শহরমুখী হয়। শহরে এসে আবার আগের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসা-অফিস। অফিস-বাসা। কিন্তু শহরে ফেরার পর ওই মেয়ের কাছ থেকে আর কোনো কল আসে না। যুবক অপেক্ষা করে- কিন্তু সেই অপেক্ষাও ফুরিয়ে যায়। একদিন যুবক জানতে পারে- ওই মেয়েটি ওদের বাড়ির সেই অভিসার সাক্ষী আমগাছটিতেই গলায় দড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু যুবক জানতেও পারেনি, এই আত্মহত্যার কারণ! যুবক তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তারপর একদিন চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে। সেই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ দেখলে তার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। মাথায় বৈদ্যুতিন এক তরঙ্গের প্রবাহ টের পায়। কখনও তা দ্রুত প্রবাহিত হয় আবার কখনও ধীরে। যখন ধীরে বয়- তখনই যুবক বেঁচে ওঠার একরকম আগ্রহ ফিরে পায়। চাকরি ছেড়ে কিছুদিন জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়েছে যুবক। কিন্তু ওই নির্জন জঙ্গল আরও শত্রু হয়ে উঠেছে তার কাছে। নিস্তব্ধতা আর জঙ্গলের এই খাঁখাঁ শূন্যতা তার দুঃসহ ভারের ওপর আরও এক অমোঘ ভার চাপিয়ে দিয়েছে। যুবক ঠিক করে সে শহরেই ফিরে যাবে আবার। মিশে যাবে কোলাহলের ভেতর। ফিরেও আসে- তারপর কত রাস্তা পাগলের মতো বিড়বিড় করে হেঁটেছে। হাঁটতে হাঁটতে জুতোর অবস্থাও বেজায় কঠিন! অনেকবার সেলাই করার পর শেষ মুহূর্তে সে এল বোধিচরণ মুচির কাছে। আর বোধিচরণ তাকে এ কী বলছে? এই কোলাহলের ভেতর মুচির কয়েকটি কথা তাকে রীতিমতো ঠান্ডা ও স্থির করে দিয়েছে। এই অবস্থা কাটাতে যুবকের বেশ অনেক সময় লেগে যায়।
৭.
বোধিচরণ যুবককে তার কাছে থাকা বই থেকে গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো একটি অংশ পড়তে দেয়। যুবক পড়তে থাকে। ওই অংশের প্রতিটি অক্ষর তাকে সম্মোহিত করতে থাকে। সে একই জিনিস বারবার করে পড়ে। বোধিচরণ তার এই অবস্থা দেখে বলে-
'আপনার মতো হতাশাগ্রস্ত যুবক আমি খুব বেশি দেখি নাই। তবে আপনার ভেতর শক্তি আছে, ওই শক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে- আপনি কামিয়াব হবেন। আর এই গাঢ় হলুদ রঙে দাগানো অংশটা অনেকদিন পর কাউরে পড়তে দিলাম। শেষ কে পড়ছিল মনে নাই। এমনিতে যারা আমার কাছে আসে- তাদেরকে হালকা হলুদ রঙের অংশটাই পড়াই। কিন্তু আপনার কেস অন্য। তাই আপনাকে এটা পড়তে দিলাম।'
যুবকের জুতোর সেলাইকর্ম হয়ে গেলে সে জুতো গলিয়ে চলে যায়। কিন্তু জুতো পায়ে নিয়ে আসে এক অন্যরকম শক্তি! ভাবে তাকে আর হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। জীবনযুদ্ধে তাকে ব্যাঘ্রের মতো বাঁচতে হবে। থাকবে গর্জন, ঘণ্টায় ৪৬ মাইল বেগে তাকে দৌড়াতে হবে। পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হবে তাকে। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। মৃত ডারউইন বারবার ঘুরেফিরে আসতে লাগল যুবকের মস্তিস্কের কোষে।
৮.
যুবক তারপর থেকে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অহর্নিশ কাজের ভেতরই ডুবে থাকে। যেন আলস্যের এক ফোঁটা ছিদ্র না থাকে কোথাও। কাজের ভেতর দিয়ে মূলত সে তার অতীত ভুলে থাকতে চায়। অতীতের ছলনা অনেক কঠিন। ঘুমোতে দেয় না, খেতে দেয় না, কেবল সবকিছুতে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর সে বাধার দৈর্ঘ্য এতই যে- গজ ফিতেতেও ধরে না। যুবক অতঃপর তার সমস্ত মেধা ও শক্তি কাজের মধ্যে তিল তিল করে বিলিয়ে দেয়। আর হ্যাঁ; বছর ঘুরতেই তার অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবে আগের বছরের থেকে পরের বছর এই পরিবর্তন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। যুবক সুসজ্জিত রাজমহলের মতো কোনো বাড়ি থেকে একরাশ সুগন্ধের ভেতর বের হয়। তার চেহারায় স্বাস্থ্য ও সম্পদের রোশনাই চিকচিক করে। চেহারায় ফেয়ার হ্যান্ডসাম ক্রিমের মডেলের মতো আত্মবিশ্বাস। পায়ের প্রতি স্টেপে দৃঢ়তা। ডানহাতে পরা ঘড়ির সুন্দর নীল রঙের ডায়ালের দিকে তার চোখ সব সময়! তারপর হঠাৎ কবে যেন যুবক জাদুঘরের সামনে দিয়ে তার বিশাল গাড়ি করে যাচ্ছিল। রাস্তায় ছিল অনেক জ্যাম। হঠাৎ কী মনে করে গাড়ির জানালার কাচ খুলে দিতেই যুবকের চোখ গেল জাদুঘরের সামনে বসা এক মুচির দিকে। বয়সে তরুণ এক মুচি। একমনে সে সেলাই করে যাচ্ছে জুতো। কে যেন ধমকে উঠল-
'ঠিকমতো সেলাই করতে পারো না ?'
যুবক তার চকচকে পালিশ করা জুতোজোড়া নিয়ে মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তরুণ মুচি বুঝতে পারে না- এই সাহেব তার কাছে কেন? তরুণ মুচি যুবকের দিকে তাকায়। কিন্তু তাকিয়ে সে আগন্তুকের আসার হেতুটা ধরতে পারে না। তার কাছে সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হয়। যুবক বলতে চেষ্টা করে-
'আচ্ছা অনেকদিন আগে এখানে একজন বসতেন, বয়স্কমতো একটা লোক। তুমি জানো তার সম্পর্কে কিছু? আমার উনাকে একটু দরকার ছিল। নাম হলো বোধি ...'
তরুণ বলল-
'ও আপনি বাবুজির কথা বলছেন? বাবুজি তো এখন আর বসে না। আমিই বসি এখানে। কী দরকার আমারে বলেন।'
যুবক বলল-
'না, উনাকেই বলতে চাই, তুমি আমাকে উনার কাছে একটু নিয়ে চলো। এখনই। আর আজ তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না।'
এই বলে যুবক তরুণ মুচিকে একটা বড় নোট বের করে দিল। তরুণ মুচি ঠিক কিছু বুঝতে না পেরে সাহেবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। টাকাটা ফেরত দিতে যাবে। তার আগে যুবক তার হাত চেপে সরিয়ে দিল।
তরুণ মুচি বলল-
'বাবুজির কাছে আপনারে আমি এমনিই নিয়ে যেতাম।' যুবকের চোখে-মুখে বোধিচরণের সন্ধান পাওয়ার আনন্দ। তার কণ্ঠে যেন বহু শতাব্দীর তাড়া।
'এখন চলো, ইয়াংম্যান'
তরুণ মুচি সাহেবকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। অনেক গলি-ঘুপচি পেরিয়ে বোধিচরণের ছেলে সাহেবকে নিয়ে যেখানে পৌঁছে, সেটা অনেক মানুষের প্রকাশ্য সংসার না বলে সংসারের বাজার বললেই এর আক্ষরিক অর্থ উদ্ধার হয়। চারদিকে হাঁড়ি-পাতিলের শব্দ, চিৎকার-চেঁচামেচিতে কানে ঝিঁঝি লাগে। দেশি মদের ভুরভুর করা গন্ধে বাতাস ভারী। একটু অসাবধান হলেই সাহেববেশী যুবকের স্যুট-টাই গরম ভাতের মাড়ে নষ্ট হয়ে যেত। ভাগ্যিস মাড় ফেলতে আসা জীর্ণশীর্ণ তরুণীর চোখ সাহেব চিনতে ভুল করেনি! ঘাড় ঘুরিয়ে সে অপস্রিয়মাণ হরিণীর মতো হারিয়ে যায়। কয়েক বাড়ি পরেই তরুণ মুচি একটা জীর্ণ বাড়ির সামনে এসে ডাক পাড়ে।
'বাবুজি, বাইরে আসো। তোমাকে এক সাহেব খোঁজ করতেছে।'
তরুণ তারপর কোনদিকে যেন মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। আধখোলা দরজায় হঠাৎ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাপরা একটি মুখ উঁকি দিল। হ্যাঁ বোধিচরণেরই মুখ। সারামুখে ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ। মনে হলো ঘুমের ভেতরই ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ এই ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে চেহারায় কিছুটা বিরক্তির ছাপ। বোধিচরণ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়। চশমার ফাঁক গলিয়ে আগন্তুককে চেনার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বোধিচরণ সাহেবের দিকে আবার তাকিয়ে বলে-
'কে?' যুবক বোধিচরণের স্মৃতির সলতের মুখে আগুন ধরিয়ে দেয়। বলে-
'দেখুন আমি, বেশ অনেক বছর আগে- হ্যাঁ অনেক বছর আগে, আপনার কাছে আমার বাতিল প্রায় একজোড়া জুতো নিয়ে এসেছিলাম- আর আপনি তখন আমাকে একটি বই ...।'
যুবক কথা শেষ করতে পারে না। সে বাক্স-পেটরার ভেতর এই অদ্ভুত জুতোর মানুষকে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, সারামুখে দাড়ি-গোঁফ। কপালের চুল উঠে গিয়ে তালু পর্যন্ত ফাঁকা। যুবক ভাবে এই কি সেই মুচি? যে একদা তাকে কয়েকটি গোপন কথা বলে রীতিমতো ভড়কে দিয়েছিল! হ্যাঁ, এ যে ওই লোকই এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যুবক তার স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতে তারপরও জিজ্ঞেস করে-
আপনার নাম বোধিচরণ না?
বোধিচরণ ঠিক বুঝতে পারে না আগন্তুকের তার নাম জিজ্ঞেস করার হেতু।
সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
যুবক আবার জিজ্ঞেস করে-
'আমাকে চিনতে পেরেছেন?'
বোধিচরণ কাশতে কাশতে বলে-
'আমার কাছে কত মানুষ আসত প্রতিদিন, সবার চেহারা কি আর মনে থাকে! আর আমি তো মুখ নয়, মানুষের জুতোর দিকেই তাকাইছি সব সময়! জুতাই যে আমার অন্ন-রিজিক! আর এখন তো চোখেই দেখি না, জুতার কাজও করতে পারি না!'
যুবক কৌতূহল জড়ানো গলায় বলে-
'আচ্ছা আপনার কাছে ওই যে একটা বই ছিল- সেটা আমি চাই। ওই বই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমি বোঝাতে পারব না, সেদিন আমি কী নিয়ে ফিরেছিলাম! আপনি যা চান আমি দেব, বিনিময়ে আমার ওই বইটাই চাই।'
বোধিচরণ কাশির দমক সামলাতে সামলাতে বলল-
'বই! ওহ!! ছিল তো ... কিন্তু সে তো অনেককাল আগের কথা! ওই বই কবে যে কে নিয়া গেল, ভুলেই তো গেছি!'
মন্তব্য করুন