রাত্রি যথেষ্ট গভীর হয়েছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদও ঢলে পড়েছে। জনশূন্য সমুদ্রতীরে দু'জন মানুষ বসে আছে। বেশ দূরত্বে। তবে দৃষ্টিসীমার মধ্যে। এদের দেখে মনে হয়- এরা পূর্ণিমায় সমুদ্র বেশ উপভোগ করছে। একজন বিশ বছরের তরুণী। অন্যজন ৬৬ বছরের প্রৌঢ়। বহুক্ষণ ধরে দু'জন দু'জনকে দেখছে। তা তিন ঘণ্টা তো হবে। হাবভাবে মনে হচ্ছে সমুদ্রতীরে এরা দু'জনই বুঝি নিশিযাপন করতে এসেছে। চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। মানুষ দু'জন পরস্পরের প্রতি খুব বিরক্ত।
বয়স্ক জনের নাম ডোনাল্ড। সে ভাবছে মেয়েটির মতলব কী? এত রাত পর্যন্ত নির্জন সমুদ্রসৈকতে একাকী থাকা একজন তরুণীর জন্য নিরাপদ নয়। এ কথা জানার বয়স কি মেয়েটির হয়নি? মেয়েটি কি স্ট্রিটগার্ল? কাস্টমারের অপেক্ষায় আছে? স্ট্রিটগার্ল হলে সে জনসমাগম স্থানে, হোটেল, বার, লোকালয়ে থাকবে। নির্জন সমুদ্রসৈকতে কেন?
অধৈর্য হয়ে ডোনাল্ড উঠে দাঁড়াল।
মেয়েটি জেনি। সে খুশি হয়ে নড়েচড়ে বসল। অবশেষে ধৈর্যের জয় হয়েছে। আপদ বিদায় হচ্ছে। তার ইচ্ছে পূর্ণ হতে চলেছে। এ কী, লোকটি দেখছি তার দিকে এগিয়ে আসছে! মতলব তাহলে এই! দেখে তো নেহাতই নিরীহ ভদ্র্রলোক মনে হয়েছে। এখন নির্জনতার সুযোগ নিতে চাইছে। জেনি চারদিকে তাকাল। তারা দু'জন ছাড়া সিবিচে আর কেউ নেই। প্রধান সড়ক প্রায় হাফ কিলোমিটার। দৌড়ে পালানো সম্ভব নয়। চিৎকার করলে শোনার মতো জনমানুষ নেই। সে পালাবে কেন? প্রতিশোধ নেওয়ার এই তো সুযোগ। নারী হওয়ার কারণে এ পর্যন্ত পুরুষের কাছে সে যত অপমানিত হয়েছে। আজ তার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা।
লোকটাকে সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে জেনি। তরুণ নয় যে শারীরিক শক্তিতে পারবে না। বয়স্ক মানুষ। এই ভেবে জেনি খুশি হয়ে ওঠে। এই পৃথিবীতে একটি প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ সে পাচ্ছে। তার আত্মা শান্তি পাবে। তার মৃত্যু হবে প্রশান্তির।
ব্যাগের ভেতর থেকে ছুরিটি বের করে সে ওভারকোটের পকেটে রাখল। শক্ত হাতে ছুরির বাঁট ধরে রাখল। লোকটি কিছু করার আগেই যেন মুহূর্তে লোকটিকে সে আঘাত করতে পারে।
ডোনাল্ড কাছে এসে একটু দূরত্ব বজায় রেখে ভদ্র্রনম্র কণ্ঠে বলল-
হ্যালো।
জেনি সন্দেহের তীক্ষষ্ট দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল-
হ্যালো।
মৃদু হেসে ডোনাল্ড বলল-
আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি?
জেনি ওভারকোটের পকেটে ছুরির বাঁট আরও শক্ত করে চেপে ধরল। কঠোর কণ্ঠে বলল-
সরি। এখানে বসার আরও অনেক বেঞ্চ আছে। তুমি ওই বেঞ্চটায় বসেছিলে। উঠে এলে কেন?
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি।
কেন?
তুমি অনেকক্ষণ ধরে বসে আছ। সমুদসৈকতে একাকী এত রাত পর্যন্ত থাকা নিরাপদ নয়। তুমি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছ?
জেনি রুষ্ট হয়ে বলল-
তুমিও অনেকক্ষণ একাকী বসে ছিলে। তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করতে যাইনি। বিপদ হলে আমার হবে। তোমার কী?
আহত গলায় ডোনাল্ড বলল-
তা ঠিক। আমি তোমার জন্যই বসে ছিলাম। আমি চলে গেলে তুমি একাকী হয়ে পড়বে। যদি তোমার কোনো বিপদ হয়। এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? রাত অনেক হয়েছে। আমি চলে যাচ্ছি। তোমার একা থাকা নিরাপদ নয়। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।
জেনি ব্যঙ্গ করে বলল-
এই তো লাইনে এসেছ। তোমার ধৈর্য আছে বটে। অবশ্য পাকা খেলোয়াড়রা সবাই ধৈর্যশীল। এতক্ষণ শিকারের আশায় বসে ছিলে। কী বুড়ো কী তরুণ, পুরুষ মানুষ তো! শিকারের তৃপ্তিই আলাদা। বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে সোজা বেডরুমে নিয়ে তুলবে। সফল পুরুষ। বুড়ো হয়েছ, অভ্যাস যায়নি।
ডোনাল্ড বলল-
এ ক্ষেত্রে তোমার অনুমান অধিকাংশ সত্য। সাধারণত এমনটা হয়ে থাকে। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। আমি বিরক্ত হচ্ছি এই ভেবে, তুমি সমুদ্রসৈকত ছেড়ে যাচ্ছ না কেন? তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি আবার সমুদ্রসৈকতে ফিরে আসব। সমুদ্রসৈকতে আজ আমি একা থাকতে চাই।
জেনি বিস্মিত হয়ে বলল-
কেন, এই সমুদ্রসৈকত কি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি?
না। তবে আজকের রাত আমি নষ্ট করতে রাজি নই। অনেক দিনের পরিকল্পনার ফসল আজকের এই রাত।
জেনি কৌতূহল অনুভব করে ডোনাল্ডের সঙ্গে কোথায় যেন তার একটা মিল আছে। জেনি এই প্রথম শোভন আচরণ করল। সরে বসে অমায়িক হেসে বলল-
পিল্গজ, সিট ডাউন স্যার। আমরা বসে কথা বলতে পারি।
ডোনাল্ড বসে জেনিকে ধন্যবাদ জানাল।
জেনি হেসে বলল-
আজ রাতের জন্য সমুদ্রসৈকত আমারও একা চাই। তুমি চলে গেলে বরং ভালো হয়।
আমাদের দু'জনের চাহিদা এক। সমস্যাটাও কি এক?
আমার তো তাই মনে হচ্ছে।
কে যাবে?
তুমি যাও। আমার যন্ত্রণা অসীম। একমুহূর্ত বেঁচে থাকার ইচ্ছেও আমার নেই।
আমি সিনিয়র। জীবনের এত দুঃখ যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, আর পারছি না। তুমি তরুণ। বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা তোমার জীবনে আলোকবিন্দুর মতো জেগে উঠতে পারে।
ডোনাল্ড মিনতির সুরে বলল-
আমার ইচ্ছে পূরণের সুযোগ আগে আমাকে দাও।
জেনি বলল-
যার মৃত্যু অধিক জরুরি, সেই আগে সুযোগ পাবে।
সেটা নির্ধারণ করবে কীভাবে?
আমরা কেন মরতে চাই তার কারণগুলি নির্ধারণ করবে।
তাতে যদি নির্ধারণ না হয়, তাহলে?
টস হবে। টসে নির্ধারণ হবে আজকের সুযোগ কার ভাগ্যে আছে।
ডোনাল্ড বলল-
আমি রাজি। শুরু করো।
জেনি বলল-
আমার যখন নয় বছর বয়স, আমার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এ ঘটনার জন্য মা আমাকে দায়ী করত। তুচ্ছ কারণে আমাকে মারধর করত। মা দ্বিতীয় বিয়ে করে। এগারো বছর বয়সে সৎবাবার দ্বারা আমি প্রথম ধর্ষিত হই। মাকে জানালে মা আমাকে উল্টো নির্যাতন করে। আমি কেন সুন্দরী- এই অপরাধে মা আমাকে এক অনাথ আশ্রমে রেখে আসে। আশ্রমের মহিলা সুপার ছিল লেসবিয়ান। তাকে নিয়মিত সেবা দিতে আমাকে বাধ্য করা হতো। আমি সারাক্ষণ এই ভয়ে বড় হয়েছি। এ গোপনীয়তা জানাজানি হলে আমাকে অনাথ আশ্রম ও স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। আমার তেরো বছর বয়সে আমার স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য করে। কী যে অসহ্য শারীরিক মানসিক কষ্ট। সইতে পারি না। কাউকে বলতে পারি না।
ডোনাল্ড বলল-
তোমার মাকে বলোনি?
মা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাননি। স্কুলের বাধ্যবাধকতায় যখন আসতে হতো, মাকে জানিয়েছি। হাত-পা ধরে অনুরোধ করেছি এখান থেকে আমাকে নিয়ে যেতে।
মা রাগ করে বলেছে-
মানিয়ে চলতে শেখ। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে মানিয়ে নিতে হয়।
জেনি বলল-
আঠারো বছর যেদিন হলো, মনে হলো আজ আমার স্বাধীনতা। যৌনযন্ত্রণা থেকে আমার মুক্তির দিন। কাজ করব, নিজের ইচ্ছায় চলব। যেখানেই কাজ করি, বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে সেই যৌনযন্ত্রণা। পনেরো বছরের কিশোর থেকে সত্তর বছরের বৃদ্ধ সবাই এক। নারীর মাংস চাই। সেক্স। সেক্সের কত বর্ণ, কত ধরন, কত স্টাইল। পার্থক্য শুধু এটুকু যে- কে কীভাবে উপভোগ করবে। ভালোবাসা বলে কিছু নেই। হৃদয়ের স্পর্শ নেই। সবটাই পুরুষের আনন্দোৎসব। কিছু পুরুষের শিকার ধরার কলাকৌশল ও উত্তেজনা আর কাঁচা মাংস ভোজের আনন্দোৎসবের নাম লাভ। প্রেম।
ডোনাল্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বলল-
ভেরি স্যাড। তোমার সঙ্গে আলাপ না হলে আমার জানা হতো না নর-নারীর মানবিক সম্পর্কের এত কুৎসিত রূপ।
জেনি বলল-
এ পর্যন্ত আমি পঁচিশবার ধর্ষিত হয়েছি। আমার স্বাধীনতাকে আমার স্বপ্নকে পুরুষের দল ধর্ষণ করে দলেমুচড়ে ফেলে চলে গেছে। আমি পরম সৌভাগ্যবতী, এখনও বেঁচে আছি। আমাকে হত্যা করা হয়নি।
ডোনাল্ড অনুতপ্ত হয়ে বলল-
আমি লজ্জিত যে আমি একজন পুরুষ।
জেনি বলল-
শুধু একবার স্বেচ্ছায় আমার জীবন-যৌবন মার্কের কাছে আমি সমর্পণ করেছি। সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম ভালোবাসার সৌরভ। আমরা পরস্পরের স্বপ্নে, দুঃখে-আনন্দে বিভোর থাকতাম। আমার দুঃখী জীবনের সকল পরাধীনতা যৌন যাতনা মার্কের স্পর্শে আমি ভুলে গেলাম। কোথায় ছিল জীবনের এ আনন্দ, উত্তেজনা, স্বপ্ন!
আমার জন্মোৎসব পালন করার জন্য আজকের এই সমুদ্রসৈকত আমরা বেছে নিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সারারাত আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুধু কথা বলব। আমরা ছাড়া সমুদ্রসৈকতে আর কেউ নেই। রাত্রি গভীর হচ্ছে। আমরা কথা বলছি, আদর করছি, উতলা হচ্ছি, নেশায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। উন্মুক্ত সমুদ্রসৈকতে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আমরা পরস্পরের প্রেম গ্রহণ করলাম। চাঁদ হয়তো মৃদু হেসে ছিল এ যুগের আদম হাওয়াকে দেখে।
আমি মার্কের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম-
যদি বাচ্চা হয়?
মার্ক আমাকে আদর দিয়ে বলল-
ছেলে হলে আদম, মেয়ে হলে ইভ- এই নাম রাখব। কিছুক্ষণ পর মার্কের তিনজন বন্ধু এলো। আমার জানা ছিল না। মার্ক ওদের আসার কথা আমাকে বলেনি। আমি অপ্রস্তুত হয়ে মার্কের মুখের দিকে তাকালাম। মার্ক বলল-
আমি ওদের ইনভাইট করেছি। তোমার জন্মদিন উপলক্ষে এনজয় করব।
মার্ক তার বন্ধুদের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে গেল। আমাকে এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। যাকে প্রেম মনে করেছি, মুক্তি খুঁজেছি, সে-ও পুরুষের নারীর মাংস ভোজের উৎসব। এই শরীরের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। আমার দেহ, আমার সৌন্দর্য আমার সবচেয়ে বড় শত্রু! পুরুষ দেখলে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি! আমি চাই না আর একটি পুরুষও আমার শরীর ছিন্নভিন্ন করুক।
জেনি ডোনাল্ডের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সমুদ্রে তাকাল। এখন পূর্ণ জোয়ার। সগর্জনে সমুদ্রের ঢেউ যখন তীরের দিকে সবেগে ছুটে আসে, মনে হয় ঢেউয়ের মাথায় যেন আলো জ্বলছে।
ডোনাল্ড বলল-
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই সমুদ্রসৈকতে এমনি এক রাতে আমি ও ডোনা একটি বেঞ্চে বসে ছিলাম। ডোনা কাঁদছিল। আমি শোকার্ত হৃদয়ে খুব অসহায় ভঙ্গিতে তাই দেখছিলাম। আমি বেকার। শূন্য পকেটের মানুষ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরকে ভালোবাসি। ডোনার বিয়ে। সে এসেছে আমার কাছে শেষ বিদায় নিতে। কথা না বলে অনেক রাত আমরা হাত ধরে বসে থাকলাম।
ডোনা আমার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। হেঁটে চলে যাচ্ছে। একবারও পিছু ফিরে তাকাচ্ছে না। আমি ডোনার চলে যাওয়া দেখছি। কিছুদূর গিয়ে ডোনা থমকে দাঁড়াল। ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার দু' ঠোঁটে আঁকড়ে ধরল আমার ঠোঁট। ডোনা কাঁদছে আর ফিসফিস করে বলছে- তোমাকে ভালোবাসি।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে টাকার অভাবে ডোনা আমার হলো না, সেই টাকাই হবে আমার জীবনের একমাত্র ব্রত। আমার নাম বললে তুমি আমাকে চিনতে পারবে। আমার নাম ডোনাল্ড গোল্ড।
জেনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইল। তার কথা আটকে গেছে।
আমি ডোনাল্ড গোল্ড গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। গোল্ড আমার নামের অংশ নয়। আমার প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য প্রথম জীবনে আমি ঝুঁকিপূর্ণ সোনা চোরাচালানের জীবন বেছে নিয়েছিলাম। যে সোনা দিয়ে আমার জীবনের দ্রুত উত্থান, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেই সোনাকে আমার নামের অংশ করে নিয়েছি। ডোনাল্ড গোল্ড নামে পৃথিবী এখন আমাকে চেনে। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের অন্যান্য চাহিদার দিকে আমি তাকাতে পারিনি। অর্থহীন জীবন।
জেনি উৎসাহী হয়ে বলল-
স্যার, টাকা থাকলে পৃথিবী হাতের মুঠোয়। স্বপ্ন পূরণ ইশারার অপেক্ষা মাত্র। আপনার যা ইচ্ছে করতে পারেন।
ডোনাল্ড বলল-
না, পারি না। আমি ডোনাকে ফিরে পেতে পারি না। আমার যৌবন ফিরে পাব না। প্রেম পাব না। যে কোনো দামি জুয়েলারি, দামি সেক্স পাওয়া সম্ভব।
জেনি বলল-
স্যার, কিছুক্ষণ আগে আপনি আমাকে বলেছেন, 'আনন্দের কোনো সম্ভাবনা তোমার জীবনে আলোকবিন্দুর মতো জেগে উঠতে পারে।' আমি কি সেই আলোকবিন্দু দেখতে পাচ্ছি?
যেমন?
স্যার, আপনার টাকা আছে যৌবন নেই। আমার যৌবন আছে টাকা নেই। দুয়ের সমন্বয়ে কি সুখের পল্গ্যান করা যায়?
ডোনাল্ড মৃদু হেসে বলল-
যায় না। তুমি বিজনেসম্যানের মতো কথা বললে। এটা কোনো বিজনেস ডিল না। তোমাকে অর্জন করতে হবে। যা কিছু অর্জন সেটুকু তোমার গৌরব। সেটুকু তোমার অধিকার।
জেনিকে উদ্‌ভ্রান্ত দেখায়। বলল-
আমার সম্মান আমার উপার্জন ফিরে পেতে চাই। পুরুষের চোখে শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। কীভাবে সম্ভব?
ডোনাল্ড বলল-
আসো আমরা একটা বাজি ধরি। চ্যালেঞ্জ।
জেনি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, সে কেমন?
পুনরুজ্জীবনের সুযোগ। জীবনকে তুমি যেভাবে চেয়েছ সেভাবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ। নিজের যোগ্যতায় অর্জন করবে। আমি তোমাকে সূত্র দিয়ে সহযোগিতা করব। বাকি কাজ তোমাকে করতে হবে।
আপনার কোম্পানিতে আমাকে চাকরি দেবেন?
না। আমার এই কার্ড নিয়ে তুমি নিচের ঠিকানায় দেখা করবে। যোগ্যতা অনুযায়ী তুমি একটি চাকরি পাবে। তোমার বাইরের সৌন্দর্য দৃশ্যমান, যা অনেক সময় তোমার বিপদ ডেকে আনে। এখন থেকে তোমার চেষ্টা হবে তোমার অন্তরের সৌন্দর্য বিকশিত করা। তোমার শ্রম, কর্মদক্ষতা, মানসিক দৃঢ়তা, সহযোগিতা, নম্রতা, বিনয়ী, রুচিজ্ঞান সৌন্দর্য- এ গুণগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তোমার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বিকশিত করা। আমার বিশ্বাস, তুমি পারবে।
স্যার, আপনি কী করবেন?
আমি এখন তোমারই মতো নিঃস্ব একজন মানুষ। ডোনাল্ড গোল্ড গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সব সম্পদ এই সমুদ্রসৈকতে আসার আগে বিভিন্ন জনকল্যাণ ট্রাস্টিতে দান করে দিয়েছি। আমিও চেষ্টা করব শূন্য হাতে আবার দাঁড়ানো যায় কিনা। আমার বর্তমান পরিচয়ে নয়। ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে। যদি বেঁচে থাকি পাঁচ বছর পর এখানে এই সমুদ্রসৈকতে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
স্যার, পাঁচ বছর আগেই যদি আমি সফল হই তাহলে আপনার সঙ্গে কি আমি দেখা করতে পারব?
পারবে। কার্ডে আমার ফোন নাম্বার আছে।
ডোনাল্ড উঠে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জেনিও। হ্যান্ডশেক করে ডোনাল্ড বলল-
বেস্ট অব লাক।
ডোনাল্ড দু'পা এগিয়েছে।
জেনি পেছন থেকে ডাকল-
স্যার।
তারপর ছুটে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল-
জীবনে এই প্রথম একজন পুরুষ মানুষের কাছ থেকে মানুষের মতো ব্যবহার পেলাম। এত সম্মান দিয়ে মমতা দিয়ে আমার সঙ্গে কেউ কখনও কথা বলেনি।
জেনির চোখ ভিজে ওঠে।
থ্যাংক ইউ স্যার, আমাকে অনার করার জন্য।
জেনি হঠাৎ দু'হাত বাড়িয়ে ডোনাল্ডকে জড়িয়ে ধরল। মুখ উঁচু করে আঁকড়ে ধরে ডোনাল্ডের দু' ঠোঁট। কতক্ষণ ক' মুহূর্ত জেনির খেয়াল নেই। জেনির গালে দু' ফোঁটা চোখের জল পড়লে জেনির তন্দ্রা ভাঙল। অপ্রস্তুত হয়ে জেনি জিজ্ঞেস করল-
স্যার, কাঁদছেন কেন?
ডোনাল্ড বলল-
চল্লিশ বছর আগের ডোনাকে মনে পড়ছে।

বিষয় : গল্প সিরাজউদ্দিন আহমেদ

মন্তব্য করুন