অগাস্টের তিন তারিখ অফিসে যাওয়ার পর আমার হাতে এইচআরের একটা চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হলো :
কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনাকে বিনা বেতনে ছুটি দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হলে আপনি আবার কাজে যোগদান করবেন।
আমি জানতাম, পরবর্তী নির্দেশ কখনও আসবে না। ওটা কথার কথা- ছেলেভোলানো সান্ত্ব্বনা। পাশের ডেস্কে সায়েমও পেয়েছে এই চিঠি।
সে বলল-
রফিক ভাই, মোট চারজন স্যাক হইছে।
আমি কিছু বললাম না। মার্চ মাসে সরকার যখন প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে তখন থেকেই শুনছিলাম, লে-অফ হবে। আশঙ্কা সত্যি হলো অগাস্টে এসে। চাকরি চলে যাওয়া যে এত সোজা, কে জানত? এইচআর থেকে একটা দু'লাইনের চিঠি আসবে। ব্যস, শেষ।
প্রতিবাদ, মিটিং-মিছিল, প্রেস কনফারেন্স হয়তো হবে কিছুদিন। তারপর সবাই ভুলে যাবে। ২০১৪-তে ইয়েলো ইন্টারন্যাশনালে যোগ দিয়েছিলাম ইন্টার্ন কপিরাইটার হিসেবে। ছাঁটাইয়ের সময় আমি কপি সুপারভাইজার। ৩৪ বছর বয়সে আবার শূন্যে এসে দাঁড়ালাম।
গাড়ি ড্রাইভ করে যখন পার্কিং লট থেকে বের হচ্ছি, অপমানের একটা চোরা স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। ছয় বছর ধরে এই অফিসে কাজ করছি। কয়েকশ জিঙ্গেল লিখেছি, আমার লেখা বিজ্ঞাপনের কপি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। অথচ ২০২০-এ এসে চারজন অদরকারি মানুষের শর্ট লিস্ট তৈরি হলো। এবং সেখানে আমার নাম আছে। দারুণ!
মনে মনে হিসাব করলাম, ব্যাংকে আছে এক লাখ বায়ান্ন হাজার টাকা। ভাঙাচোরা একটা স্টারলেট রিফলেক্ট চালাই। বেচলে পাওয়া যাবে চার লাখের মতো। সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ। এই টাকা শেষ হওয়ার আগেই অন্য একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। কিন্তু কী ব্যবস্থা?
ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। ভাবার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে বার। এসির মধ্যে বসে মদ টানলে মাথা খোলে। পরীক্ষিত সত্য- অন্তত আমার ক্ষেত্রে। পিয়াসিতে যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তিনটা বেজে দশ। অফিশিয়ালি বারের দরজা খোলে সন্ধ্যা ছয়টায়। তবে পেছন দিকে একটা গোপন সিঁড়ি আছে। যে জানে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় তিনতলায়।
ফ্লোর ম্যানেজার কামাল ভাই। খাতির করেন আমাকে খুব। তাকে ডেকে পরোটা আর বিফ অর্ডার করলাম। দুপুরে খাওয়া হয়নি কিছু। খালি পেটে মদ খেলে অল্পেই নেশা ধরে। সে রিস্কে যাওয়া যাবে না।
বারে দ্বিতীয় কোনো কাস্টমার নেই। ভরদুপুর, তার ওপর করোনা। এ দুয়ের কম্বিনেশনে বাসা থেকে কেউ বোধহয় বের হয়নি। কিছুক্ষণ পর সাজ্জাদ ভাই এসে ঢুকলেন। তিনি পিয়াসির অনেকে পুরোনো কাস্টমার। যারা নিয়মিত এখানে আসে, সবাই চেনে তাকে। দিলদরিয়া লোক। টিভিতে নাটক বানান। দেখলাম, তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, চিবুকে ক্লান্তি। আগেই চার-পাঁচ পেগ টেনে এখানে এসেছেন, বোঝা যায়।
পরোটার প্লেট হাতে নিজের টেবিল ছেড়ে গিয়ে বসলাম তার টেবিলে। বললাম, কী অবস্থা ভাই? সকাল থেকেই টানতেছেন নাকি?
তিনি বললেন, আর বইলো না। মেজাজ খারাপ। আলবালুপার বোতলে একটু তলানি ছিল। ঘুম থেকে উঠেই উড়ায়ে দিছি।
হইছেটা কী?
ফালতু এক রাইটারের পাল্লায় পড়ছি। সকালে স্ট্ক্রিপ্ট দেওয়ার কথা। টাকাও অ্যাডভান্স করা এক সপ্তাহ আগে। কাল থেকে শুটিং। করোনার মধ্যে অনেক ঝামেলা করে আর্টিস্টের ডেটফেট মিলাইছি। এখন বলতেছে, স্ট্ক্রিপ্ট শেষ হয় নাই। কী করছে তাইলে এক সপ্তাহ ধরে!
সাজ্জাদ ভাই হাত ইশারায় বেয়ারাকে ডেকে বললেন, হাফ বোতল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। সাথে চাউমিন।
বেয়ারা চলে যেতেই তিনি বললেন, শোনো রফিক, তুমারে খুঁজতেছিলাম মনে মনে। দেখা হয়ে ভালো হইছে। তুমি তোমার সময় সুযোগমতো আমারে একটা স্ট্ক্রিপ্ট দিয়ো তো।
ভাই, আমি বিজ্ঞাপনের কপি লিখি। নাটকের স্ট্ক্রিপ্ট অন্য জিনিস।
দিছিলা তো একটা আগে। সেই স্ট্ক্রিপ্টে নাটক বানায়ে আমি একটা পুরস্কারও পাইছিলাম।
ওইটা লিখতে গিয়াই বুঝছি, কাজটা কঠিন। নাটক-ফাটক আমার ডিপার্টমেন্ট না ভাই। আমি লিখি ৪০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন। ৪০ মিনিটের ফিকশন অন্য জিনিস। হবে না আমাকে দিয়ে।
যার হয়, তার সবকিছুতেই হয়। যে লেখবে তার ভেতরে মাল আছে কিনা, সেইটা হইলো কথা। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা কোনো ব্যাপার না। ভুজংভাজং বাদ দাও মিয়া। যা বলতেছি, সেইটা করো। সিঙ্গেল নাটক না। একটা ১০৪ পর্বের সিরিয়াল লেখ। পার এপিসোড ছয় হাজার পাবা।
খুবই টেম্পটিং প্রস্তাব ভাই। কিন্তু এত বড় নাটক ক্যামনে লিখব? দুই-একটা সিঙ্গেল লিখছি আগে। এইটা তো ১০৪ পর্ব!
আমি আছি কী করতে? তুমারে গাইড করব।
সব ঠিক আছে। কিন্তু ১০৪ পর্ব একটু বেশি হয়ে যায় আমার জন্য। টানতে পারব না গল্প। ১৩ বা ২৬ পর্ব হইলে একটা ট্রাই দিয়ে দেখতাম।
মনে করো, ২৬ পর্ব। একবারে ১০৪ পর্ব নিয়ে ভাইবো না। ওইটারে চার ভাগ করো। প্রতি মাসে ২৬ পর্ব করে লিখবা। চার মাসে ২৬ ইনটু ৪, মানে ১০৪ পর্ব দিবা। ওকে?
কত পৃষ্ঠায় এক পর্ব হয়?
১২ ফন্ট সাইজ আর সিঙ্গেল লাইন স্পেসে প্রতি ছয় পৃষ্ঠায় এক পর্ব।
তার মানে প্রতি পৃষ্ঠায় এক হাজার টাকা পাব?
রাইট।
সেই রকম ব্যাপার!
সেই রকম ব্যাপার হইলে শুরু করে দাও কাজ। দেরি করার কিছু নাই। শুক্র, শনি তো তুমার ছুটি। সারাদিন লিখবা।
ওকে।
আর অফিস ডে-তে ছুটির পর বাসায় ফিরে দুই ঘণ্টা সময় দিবা। ছয় পৃষ্ঠা দাঁড় করানোর জন্য দুই ঘণ্টাই যথেষ্ট। বারে আসার ধান্দা করবা না। তোমার বাসায় মদের সাপ্লাই আমি পৌঁছায়ে দিব। এইটা গিফট। রেমুনারেশনের বাইরের হিসাব। অ্যাডভান্স লাগবে কোনো?
কথাটা বলে সাজ্জাদ ভাই পকেটে হাত ঢোকালেন। আমি সাথে সাথে বাধা দিলাম। বললাম, ভাই এখনি দিয়েন না কিছু। পরে চেয়ে নেব।
ভ্রু কুঁচকে উনি বললেন, এখন দিলে সমস্যা কী?
আমি আর একটু ভাবি। একটা কাজ হাতে নিলাম। দেখা গেল, করতে পারলাম না। পরে তো আপনি আমারে গাইলাবেন।
তুমি পারবা। অফিসের সাথে জাস্ট টাইমটা একটু অ্যাডজাস্ট করে নিবা।
অ্যাডজাস্ট করতে হবে না ভাই। আমার চাকরি নাই।
মানে কী?
আমি চুপ করে রইলাম।
সাজ্জাদ ভাই আমার মুখের দিকে গুম হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
তারপর বললেন, লে-অফ করছে?
মিথ্যা বলার কোনো দরকার ছিল না। তবু কী একটা অভিমানে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল-
না ভাই। আমিই ছাড়ছি।
হঠাৎ!
একটা উপন্যাস লেখা শুরু করছিলাম। চাকরির কারণে কনসেনট্রেট পারতেছিলাম না। আধাখেচড়াভাবে কাজটা আগাইতেছিল। এইবার সেইটা লিখে শেষ করব।
উপন্যাস লিখবা বলে চাকরি ছাইড়া দিলা?
বলে দুম করে টেবিলে একটা ঘুসি মারলেন সাজ্জাদ ভাই।
আমি কেঁপে উঠলাম।
শাব্বাশ!
তিনি বললেন-
বাঘের বাচ্চা। তুমারে ভিতুর ডিম ভাবছিলাম। এখন তো দেখি বিচির জোর আছে। কী নাম তোমার উপন্যাসের?
এইবার আমি বিপদে পড়ে গেলাম। একটা মিথ্যা হঠাৎ বলে ফেলা সহজ। কিন্তু সেই মিথ্যায় ডিটেইলিং করা কঠিন। একটু ভেবে বললাম-
আপাতত দুইটা নাম ঠিক করছি। একটা ফাইনাল করব এর মধ্য থেকে।
কী নাম, বল দেখি।
সাওদাজ আর জীবন অপেরা।
সাওদাজ মানে কী?
এইটা একটা পর্তুগিজ শব্দ। অর্থ হইলো দুঃখবিলাস।
এই নাম বাদ।
ক্যান?
সাওদাজ ফাওদাজ এইসব কেউ বুঝবে না। আর তুমি কি জনে জনে গিয়ে বুঝায়ে আসবা নামের মানে? এইটা তো ফিল্ম না যে সিনেমা চলবে আর নিচ দিয়ে সাবটাইটেল যাবে।
তা ঠিকই বলছেন।
জীবন অপেরা নামটা ফাইনাল করো। প্লটটা বলো তো দেখি? নাটক বানানো যায় কিনা এই প্লটে একটু বোঝার চেষ্টা করি।
আমি অকূল সমুদ্রে পড়লাম। ভালো যন্ত্রণা শুরু হলো। একটা মিথ্যা বলতে গিয়ে এখন দেখি মিথ্যার ঝুলি খুলে বসতে হবে। বললাম, প্লট আহামরি কিছু না। অন্য একদিন সময় নিয়ে বলবোনে।
সাজ্জাদ ভাই মাথা নেড়ে বললেন-
আজকে সমস্যা কী? বার তো ফাঁকা। চিল্লাপাল্লা নাই। আজকেই বলো।
গল্পটা একটা ছেলেকে নিয়ে। সে চাকরি ছেড়ে দিছে। কারণ সে একটা উপন্যাস লিখবে। উপন্যাসের নাম জীবন অপেরা।
তারপর?
একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে ভাই। এসে বলতেছি।
ওয়াশরুমে গিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে মনে মনে কঠিন কিছু শব্দ হাতড়ালাম ...। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় কবি-সাহিত্যিকরা যেসব শব্দ বলে সে রকম কিছু শব্দের একটা শর্ট লিস্ট তৈরি হলো। মনে মনে শব্দগুলো আওড়ালাম কবার। উত্তর আধুনিকতা, বোর্হেস, ম্যাজিক রিয়েলিজম, এইথিজম, ডিকনস্ট্রাকশন, অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ ...। এরপর এই শব্দগুলো পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে যতদূর সম্ভব জটিল দুটো বাক্য বানালাম।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে বললাম-
আসলে ভাই আমার গল্পটাকে যদি অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ করি, তবে এটা আদতে ধুলিধূসর ইটকাঠের প্রাকারের মধ্য দিয়ে প্রবহমান এক নৈর্ব্যক্তিক দৃশ্যকল্প। বোর্হেসের ম্যাজিক রিয়েলিজমের সাথে সর্বাত্মকভাবে যোগ হবে উত্তর আধুনিকতা, এইথিজম, ডিকনস্ট্রাকশন ...।
কথাগুলো বলার সময় আবিস্কার করলাম, সাজ্জাদ ভাইয়ের চোখ দুটো পিংপং বলের মতো গোল হয়ে গেছে।

বার থেকে বের হলাম সন্ধ্যায়। কিন্তু জীবন অপেরা নামটা মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। মগবাজার মোড় থেকে এক প্যাকেট মার্লবোরো লাইট কিনে বাসায় ফিরলাম। সারাদিন আকাশ গুম হয়ে ছিল। রাত সাড়ে আটটায় বাতাস শুরু হলো খুব। ঝড় হবে বোধহয়। ল্যাপটপটা টেনে ওয়ার্ড ফাইল ওপেন করলাম একটা। কালপুরুষ ফন্টে বড় করে লিখলাম, জীবন অপেরা।
আমার সাথে আছে এক প্যাকেট সিগারেট, চারটা হ্যানিক্যান, আর বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আয়োজনের কোনো কমতি নেই। লিখতে জানলে এক টানে উপন্যাসের ওয়ান ফোর্থ লিখে ফেলতে পারতাম হয়তো সে রাতে। তার বদলে জীবন অপেরা নামটা টাইপ করলাম দেড়শ বারের মতো।
রাত দুটোর দিকে কাগজ-কলম নিয়ে বোর্হেসের একটা স্কেচ করলাম। বাঁশবাগানের মাথার ওপর তিনি চাঁদ হয়ে ঝুলে আছেন। ভোরের দিকে মনে হলো, একটা চিঠি লিখি। চিঠি বলাও আসলে ঠিক হচ্ছে না। ইমেইল বলাটাই যুক্তিসংগত। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় টুম্পা নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। ভয়াবহ প্রেম। টুম্পাও খানিকটা প্রশ্রয় দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত আমার জীবনের একমাত্র অফিশিয়াল ক্রাশ হলো টুম্পা। সে এখন আমেরিকায় থাকে। অনেক দূরে।
চিঠিটা টুম্পাকেই লিখলাম। লেখার সময় মাথায় আসেনি, কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে হলো, এটাই হতে পারে আমার উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠা।
দুপুরে ঘুম থেকে উঠি দেখি প্যাকেটে সিগারেট নেই। চায়ের সাথে সিগারেট না খেলে পেট ক্লিয়ার হয় না। সারাদিন শরীরের মধ্যে দলাপাকানো অস্বস্তি কাজ করে। বাধ্য হয়ে নিচে নামলাম। দেখি, সুমন বসে আছে চায়ের দোকানে। আমাকে দেখেই বলল-
চাকরি নাকি ছেড়ে দিছিস?
অবাক হয়ে বললাম-
তুই জানলি ক্যামনে?
গতকাল যারা পিয়াসিতে গেছে সবাই জানে। সাজ্জাদ ভাই বদ্ধ মাতাল হয়ে গেছিল। তোর নাম বলতেছিল বারবার।
মানে কী?
বলতেছিল, রফিককে দেইখা শেখ তোমরা। কী প্যাশন! উপন্যাস লিখবে বলে চাকরি ছেড়ে দিছে।
আমি চুপ করে রইলাম। সুমন আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড। কবিতা লেখে। পিয়াসির পেছনের গলিতে ওদের ছয়তলা বিল্ডিং। মোট ১৪টা ফ্ল্যাট থেকে মাস গেলে ভাড়া পায়। সুমনের চাকরিবাকরির দরকার পড়ে না। টাকাপয়সা নিয়েও ভাবতে হয় না। দুনিয়াদারি নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। দেখে মনে হয়, সত্যিকারের এক আনন্দময় জীবন কাটাচ্ছে। সে তুলনায় আমার জীবনটা ম্যাড়মেড়ে।
সুমন বলল-
চাকরি ছাড়াটা গুড ডিসিশন দোস্ত। ল্যাখ, লিখতে লিখতে ফাটায়ে ফ্যাল।
ওর কথায় কান না দিয়ে বললাম-
গাড়িটা বেচব। একটা কাস্টমার দেখিস।
ওই রদ্দি মাল কে কিনবে? মডেল কত?
৯৮, স্টারলেট রিফলেক্ট।
বেচবি ক্যান?
উপন্যাস লিখতেছি তো। মাথায় সব সময় গল্প ঘোরে। গাড়ি চালানোর সময় কনসেনট্রেট করতে পারি না। কখন কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট করে বসব ঠিক নাই। আর এখন তো অফিস যেতে হবে না। গাড়িফাড়ির দরকার নাই।
ফেসবুকে গাড়ির ছবি দিয়ে পোস্ট দে।
তোর প্রোফাইল থেকেই দে। তুই তো ফেসবুক কাঁপানো কবি। তুই একটা পোস্ট দিলে সেইটার রিচ হবে অনেক।
সুমন খুশি হলো আমার কথা শুনে। বের হতে যাওয়া কোদাল সাইজের দাঁত দুটো সামলে নিয়ে বলল, আচ্ছা দিবনে। তা তোর উপন্যাসের গল্পটা কী নিয়ে?
বললাম-
এক ছেলে একটা চিঠি লেখে। ভার্সিটিতে থাকতে এক মেয়ের ওপর তার ক্রাশ ছিল। সেই মেয়েকে লেখে। ওটা থেকেই গল্প শুরু।
চিঠি না ইমেইল?
ইমেইল?
ওকে। ছেলেটার নাম কী?
রফিক আর সায়েম- এর মধ্যে যে কোনো একটা নাম বেছে নেব। আপাতত রফিক হিসেবে লিখে যাচ্ছি।
তোর নায়িকার নাম টুম্পা না তো আবার?
আমি চুপ করে রইলাম।
ভদ্রলোকরা কখনও তাদের এক্সদের নামে গল্প লেখে না। ওর ঘর ভাঙবি নাকি তুই?
আমি ভদ্রলোক এই দাবি কখন করলাম?
টুম্পা নাম চলবে না। মেয়েটারে এইবার মাফ দে। অনেকদিন তো হইছে। আর ঝামেলা করিস না।
পারব না।
বেশি চেঞ্জ করতে হবে না। 'টু'-টা জাস্ট ফেলে দে। নাম রাখ রুম্পা।
আমার উপন্যাসের নায়িকার নাম আমি টুম্পা রাখব। এইটা নিয়ে তোর কোনো সাজেশন চাচ্ছি না।
আচ্ছা। এরপর কী হয়?
কীসের পর কী হয়?
মানে টুম্পাকে চিঠি লেখার পর কী হয়?
হয় কিছু একটা।
ফাইজলামি করবি না। ঠিকভাবে বল কী হয়। ও কি চিঠির উত্তর দেয়?
চিঠির উত্তর তো টুম্পাকে দিতেই হবে। না দিলে গল্প আগাবে না।
সুমন মাথা নেড়ে বলল, ওকে ফাইন। বাকিটা বল। গল্প পছন্দ হলে তোকে আজ শ্যালেতে মদ খাওয়াব।
মদের গন্ধ পেয়ে ঠা ঠা দুপুরের রোদে মাথার ভেতর থেকে গড়গড় করে গল্প বেরিয়ে এল। একটুও না থেমে আমি বলে গেলাম।
ইমেইল সেন্ড করে রফিক ঘুমায়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, যে বিছানায় সে ঘুমাচ্ছিল সেই বিছানাটা বদলে গেছে। আগে সে থাকত এক ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে। কিন্তু এখন শুয়ে আছে অন্য এক বাসায়। কী করে এটা হইল, সে জানে না। এর মধ্যে বাথরুমের দরজা খুলে গেছে। গোসল শেষে বের হইছে শরীরে তোয়ালে প্যাঁচানো এক মেয়ে। মেয়েটা আর কেউ না। আমাদের নায়িকা টুম্পা। রফিক বুঝতে পারল, টুম্পা তার বিয়ে করা বউ।
মানে কী?
মানে জানি না।
কয় মণ গাঁজা টানছিলি এই গল্প লেখার আগে?
আমি চুপ করে রইলাম।
মাথা নেড়ে সুমন বলল, এ কেমন গল্প!
প্যারালাল ইউনিভার্সের গল্প, বললাম আমি, রফিক প্যারালাল ইউনিভার্সে ঢুকে পড়ছে। যে জীবন সে মনে মনে চাইত, ঘুম ভেঙে দেখে সেই জীবনই সে আসলে যাপন করে। উইশফুল থিংকিং।
সায়েন্স ফিকশন লিখতেছিস নাকি?
আরে না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব ওই কাজ করার জন্য এখনও বেঁচে আছেন। তিনি একজন সিনিয়র সিটিজেন। তার সাথে মারামারি করতে চাচ্ছি না।
তুই প্রথম চ্যাপ্টারটা আমাকে আজই দিবি। একটা ওয়েবজিনে ছাপানোর ব্যবস্থা করব।
কয় টাকা দেবে ওরা?
লিসেন, সাহিত্য পত্রিকা টাকা দেয় না। নাম দেয়। তোর নাম কেউ জানে না, পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকরা তোর নাম জানবে। পাবলিসিটি হবে।
পাবলিসিটি কে চাইছে তোর কাছে। টাকা না দিলে লেখা দেব না।
মদ যে খাওয়াব ফ্রি-তে, সেইটা টাকা না? তুই বাসায় যেয়েই আমারে ফার্স্ট চ্যাপ্টার পাঠাবি? ওকে?
আজ পারব না।
কেন?
উপন্যাস পুরোটা শেষ না করে আমি দেব না। গল্প চেঞ্জ হইতে পারে। হঠাৎ মনে হইতে পারে, এ গল্প আমি লিখব না।
মনের ভুলেও এ কাজ করবি না। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। শেষ না করলে তোকে খুন করব। শ্যালেতে চল এখন। ইমতিয়াজ ভাইকে ফোন দেই। মদ খেতে খেতে ওনাকে তোর গল্প শুনাবি।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইমতিয়াজ ভাই কে?
সুমন চোখ উল্টে বলল, ইমতিয়াজ ভাইকে চিনিস না? বাকরাম প্রকাশনীর মালিক।
ও। ওনাকে কেন গল্প শোনাতে হবে?
আজব তো। বই পাবলিশ করবি, পাবলিশার লাগবে না?
তা তো লাগবে। ঠিক আছে যাব। তার আগে একটু বাসায় যাইতে হবে দোস্ত।
কেন?
পেট ক্লিয়ার হয় নাই সকালে।
তাড়াতাড়ি যা। পেট ক্লিয়ার থাকা লেখকের জন্য খুব জরুরি। নইলে লেখাটার মধ্যে কনস্টিপেশন মার্কা শব্দ ঢুকে পড়বে। আর ওই সব বোকা বোকা শব্দ পড়লে মনে হবে, লেখকের হাগা কষা, বাইর হয় না।
বিকাল পাঁচটায় আমরা শ্যালেতে এলাম। ইমতিয়াজ ভাই এলেন সন্ধ্যার দিকে। লেবু, লবণ আর ভদকার সাথে বিশাল এক গল্প ফেঁদে বসলাম। এক মুহূর্তের জন্য ভাবতে হলো না। তবে এবার গল্প বদলে গেল।
ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে মিল রেখে নতুন গল্পের নায়কের নাম ইশতিয়াক। বলাই বাহুল্য, এই নতুন নায়ক একজন প্রকাশক। সেখানেও প্যারালাল ইউনিভার্স চলে এল। কী করে এল আমি জানি না।
নতুন গল্পে লিফটে চেপে ইশতিয়াক চলে যায় এক সমান্তরাল দুনিয়ায়। সেই দুনিয়ায় সে দেখা পায় টুম্পার। এবং প্রেমে পড়ে যায়। কিছুদিন আগে পত্রিকায় একটা ফিচার পড়েছিলাম, 'অ্যান এলিভেটর টু অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড'। সেই নলেজ কপি পেস্ট করে দিলাম গল্পের মধ্যে।
ইমতিয়াজ ভাই যে গল্প শুনে খুবই খুশি হয়েছেন সেটা তার চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। বইমেলার তখনও প্রায় পাঁচ-ছয় মাস বাকি। কিন্তু তিনি পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করলেন।
আমি বললাম, বস কত টাকা পাওয়া যাবে?
উনি বললেন, আপনাকে রয়্যালিটি দেওয়া হবে ১০ পারসেন্ট- বিক্রির ওপর। যত বিক্রি, তত টাকা।
গ্রেট। কী রকম বিক্রি হতে পারে?
প্রথমে ছাপব ৫০০ কপি।
সেলের পর টাকা পাব?
হুম।
৫০০ কপি সেল হইতে কতদিন লাগে?
বইয়ের মেরিটের ওপর ডিপেন্ড করে। কোনো কোনো বই সেল হয় না তেমন। গোডাউনে পচতে থাকে। তবে আপনার গল্প ভালো, এক বছরে শেষ হয়ে যাবে।
জোস। তবে আমি আসলে একটু বোঝার চেষ্টা করতেছি, কত টাকা আসতে পারে বই থেকে।
বইটা কত শব্দের?
ঠিক মনে নাই।
আন্দাজ করে বলেন।
৫০ হাজার।
ওকে। ২০০ পৃষ্ঠার মতো হবে। বইয়ের দাম রাখব ৩০০ টাকা। আপনি প্রতি বইয়ে ১০ পারসেন্ট হিসেবে রয়্যালটি পাবেন ৩০ টাকা।
তার মানে ৫০০ বই থেকে পাব ১৫ হাজার?
হ্যাঁ।
এক বছরের ইনকাম ১৫ হাজার টাকা!
যদি ৫০০ কপি বিক্রি হয়।
আমার নেশা কেটে গেল- ফুটবল লিক হয়ে যাওয়ার পর একটু একটু করে যেভাবে বাতাস বের হয়ে যায় ঠিক সেভাবে। ২০০ পৃষ্ঠার বই থেকে ১৫ হাজার টাকা। মানে প্রতি পৃষ্ঠা ৭৫ টাকা করে। এটা করে আর যা-ই হোক, ভাত জুটবে না।
রাতে বাড়িতে ফিরে হেব্বি একটা শাওয়ার নিলাম। বেডরুমে ঢুকে দেখি মোবাইলে ছয়টা মিসড কল। কল ব্যাক করতেই ও পাশ থেকে রহমান বলল-
তুই নাকি চাকরি ছাইড়া দিছিস?
হ্যাঁ দোস্ত, আমি বললাম।
উপন্যাস লিখবি বলে?
আমি ঠা ঠা করে হেসে বললাম, উপন্যাস কে লিখবে? আমারে কি তোর গাছবলদ মনে হয়?
শুনলাম যে।
ভুল শুনছিস।
জীবন অপেরা নাকি তোর উপন্যাসের নাম?
ধুর। এই নামে একটা ধারাবাহিক নাটক লিখতেছি। সাজ্জাদ ভাইয়ের জন্য।
ও আচ্ছা। টাকাপয়সা কেমন পাবি?
হিউজ। এখন একটু ব্যস্ত দোস্ত। পরে নক দিবনে। লিখতেছি।
ফোন কেটে দেওয়ার পর মাথা ভার হয়ে এল। পরের দু'দিন আমি ধুমসে আড্ডা মারলাম। বারে বসে মদ খেলাম, তর্ক করলাম, গ্লাস ভাঙলাম। মাথার ভার কমল না। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় সাজ্জাদ ভাই ৫০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করলেন নাটক লেখার জন্য। অ্যাডভান্স নেওয়া মানে হলো ট্রেনে চেপে বসা। ট্রেন পরবর্তী স্টেশনে থামলে তবেই নামা যাবে। মাঝপথে ঝাঁপ দেওয়ার উপায় নেই।
কিন্তু আমার ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে হলো। ফেসবুকে সদ্য পরিচিত এক মেয়েকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হলাম। সে ইলিশ মাছ খেতে চাইল, আমি মাওয়া ঘাটের দিকে গাড়ি ঘোরালাম। ফেরার পথে গাড়িতে বসে তাকে একটা চুমুও খেলাম। কাজ হলো না কোনো। তিন মণ ওজনের মাথা ঘাড়ের ওপর চেপে বসে রইল।
রাতে বাসায় ফিরে মেইল চেক করলাম। টুম্পা রিপ্লাই দেয়নি কোনো। দেবেও না বোধহয়। কিন্তু ও রিপ্লাই না দিলে লেখাটা শুরু করতে পারব না। ওর ওপর নির্ভর করছে পুরোটা। টুম্পার সাহায্য ছাড়া এই গল্প টানা সম্ভব না।
হঠাৎ মনে হলো, আমি খুব একা। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু অনেক দূর থেকে একটা পাখি কিছুক্ষণ পরপর ডাকছে। আমি থাকি মগবাজার মোড়ে। এখানে গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। দূরবর্তী কল্পনায়ও পাখির ডাক শুনতে পাওয়ার কথা নয়। কিছু একটা প্যাচ লেগে গেছে। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের গল্প ভাবতে ভাবতে তবে কি নিজেই অন্য জগতে চলে এসেছি?
হেঁটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ফস্টারের একটা ক্যান নিয়ে এলাম। মুখটা খুলতে গিয়ে বোমা ফাটার মতো শব্দ হলো। তারপর আবার সব নীরব। আমি সেই নৈঃশব্দ্য কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। নীরবতা মানে যে কেবল শব্দের অনুপস্থিতি তা নয়। এর নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে নীরব ভাষায় কিছু একটা বলতে চায়। রাতভর যুদ্ধ করে সেই ভাষার অর্থ খুঁজলাম।
পরদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে কিচেনে গেলাম চা বানাতে। কিন্তু সেখানে আগেই একজন দাঁড়িয়ে ছিল। একটা মেয়ে- ম্যাক্সি টাইপের ড্রেস পরা। আমি পেছন থেকে দেখলাম। চুলায় আগুন জ্বলছে, চায়ের পানি চাপানো। মেয়েটা চায়ের পাতা ছাড়ছে পানিতে। দাঁড়ানোর ওই বিশেষ ভঙ্গি আমার খুব চেনা। কেউ আমায় বলে দিল না, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জেনে গেলাম, মেয়েটা টুম্পা। আমেরিকা থেকে ব্যাক করে টুম্পা আমার কিচেনে ঢুকে পড়েছে! বেশ!
চা যখন বানাচ্ছে, তখন সে নিজে থেকেই হাঁটতে-চলতে পারবে। গত পাঁচ দিনের চেপে থাকা ভারটা মাথা থেকে হঠাৎ নেমে গেল। এখন আমার আর খুব বেশি কিছু করার নেই। চুপচাপ টুম্পাকে ফলো করতে হবে। ও কী করে, কী খায়, কী কথা বলে, কী অভিমান ওর মনে- আমি দেখব এবং সেগুলো ল্যাপটপে টুকে নেব।
উপন্যাস কিংবা নাটক- যা-ই হোক, জীবন এবার প্রস্তুত অপেরার জন্য।