এক. অদ্যকার সরল কথা :
ব্যাপারটা সাফসাফা রকমে বুঝে উঠি, আমার মাথার এখন তেমন সুস্থ দশা নেই। অথচ ব্যাপারটা বোঝা দরকার। এমন আচম্বিতে, এমন সত্য সত্যই যেটি ঘটে গেছে, তাকে পরিস্কার করে বুঝে ওঠাটা বিষম দরকার আমার। এমন একটা ব্যাপার, কেমন করে ঘটল! কীভাবে! সেটার কোনো ব্যাখ্যা আমি দিতে পারছি না। শুধু বুঝছি যে, বড় গোলমেলে, বড় ভয় ধরিয়ে দেওয়ার একটা ঘটনা ঘটেছে।
আমার ভয় লাগছে। ভয়ে, আত্মা আর কলজের পানি শুকিয়ে গিয়ে; ওইগুলা সাহারা মরুভূমির মতো হুহুক্কারঅলা, খরমরা, দিশাশূন্য বালি হয়ে গেছে। এমন ব্যাপারটা ঘটে কীভাবে!
আমার মাথার এই যে অস্থির অবস্থাটা! সেটা কিন্তু ওই বেমক্কা ঘটনাটা ঘটার কারণে হয়নি। মাথার ঝামেলাটা হয়েছে আগেই। তিন দিন আগে। আর, ভয়-ছলকে দিতে থাকা ঘটনাটা ঘটেছে সদ্য। এই তো আজকের সকালে ঘটেছে। ঘটেছে বেলা এগারোটায়।
এখন আমি কোনটা রেখে কোনটার কথা আগে বলি? ভয়টার কথা আগে বলব, না মাথার হুজ্জোতটার কথা আগে? আচ্ছা, আগে বরং আমার মাথার অসুখের কথাটাই সারি!
আমার মাথার ভেতরে কেমন একটা যেন আচুইক্কা ব্যামোর আনাগোনা চলছে, গত তিন দিন ধরে। আমি আপাতত কর্মহীন লোক। অতিমারির থাবড়া পাওয়া দুনিয়ায়, লোকেরা যে গোপনে-নিভৃতে মুদ্রাসংকটের কড়াইয়ে, অতি অন্তরঙ্গ রকমে, ভাজাভাজা হয়ে চলছে; সেটা গোড়াতেই যেদিন হাওয়া এসে আমাকে জানান্তি দিয়েছে, আমি সেইদিনই, তদনগদ, যন্ত্রমন্ত্র দিয়ে পাঠদানের পুণ্যকর্ম থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়ে দিয়েছি।
ছাত্রদের কাছ থেকে, এই দুর্বিপাকের কালেও, সেমিস্টার ফি আদায়ের মহাব্রত পালনের অংশী হবার শক্তি পাই নাই আমি। একটুও পাই নাই। তো, কী আর করা! আমি যে উচ্চমাত্রার অপদার্থ, সে-কথা তো আমার ভ্রাতাভগ্নীময় জগতের অবিদিত নয়! এই এতকাল কিন্তু, ওই কর্মহীনতা ইত্যাদি নিয়ে কোনো জটিলতা আসে নাই। মন-খারাপ হওয়া তো দূর, এমনকি মনেও সুদ্ধ পড়ে নাই যে, আমি জীবিকা অর্জন-ফর্জনের ছুটের মধ্যে নেই।
ভালো চলছিল দুনিয়া! তবে আজকে তিন দিন হয়, কেমন জানি লাগছে।
কেমন জানি কী-একটা-কিছু জানি আমাকে ভোগান্তি দেওয়া শুরু করেছে। এটা যেন শক্তমক্ত, ধার কড়কড়া বা ধড়ফড় করানেঅলা কোনো ভোগান্তি না। বরং এইটা যেন রঙ-জ্বলা, ত্যানা ত্যানা ধরনের একটা কিছু। কিন্তু এর যেন কোনো শেষ নেই। চলছেই সেটা, আমারে প্যারা দিয়ে চলছেই।
হচ্ছে কী, হঠাৎই আঁতকার ওপরে আমি শুনছি যে, চিল ডেকে উঠছে! চিল ডেকে উঠছে আচমকা আচমকা। কোন দূর আকাশে জানি, অনেক জোর ডাক ডেকে উঠছে। চিহিৎ চিহি চিহি চিহি! চিহিৎ চিহিৎ! বাপরে কী চিহিৎকার! কী শানানো কী তেজালো কী ফনফনা তীক্ষ্ণ!
আর সেই ডাক, এই কোন দোতলার আধা অন্ধকার রুমের ভেতরে, বেকার পড়ে থাকা আমার মাথার ভেতরটাকে, চিরে চিরে ফালি ফালি করে দিয়ে যাচ্ছে। হায়রে আমার মাথা-মগজ! ওই ধারালো ডাকের বঁটি কিনা তোমারে এমন আলুভাজার চিরল আলুর মতো ফালিফালি ঝুরঝুরে করে দিচ্ছে।
এই যে দোতলা, যেইখানে আমার নিবাস; সেটার মাথার ওপরে আছে আরও চার-চারটি তলা। তারপরে আকাশ। চিলের ডাক- সেই সীমাহীন দূর ঊর্ধ্বলোক থেকে- এই দোতলায় নেমে আসে কেমনে! তারে অমন তপ্ত সুতীব্রা শোনায়ইবা কীভাবে! আর, এই যে একটা-দুটা মাত্র জানালা এই ঘরের। সেগুলো তো ঠেসে বন্ধ করেও রেখেছি। তাও চিহিৎকার আসছেই। কঠিন চিহিৎকার নামছেই! কীভাবে? কীভাবে এসে যাচ্ছে! সেইটা নির্ণয় করার সাধ্য আমার নেই।
আচ্ছা! চিহিৎকার তো নেমে এলো। ঠিক আছে। কিন্তু তারপরেই আর যেন কিছু ঠিক নেই। আওয়াজটা আমার মাথার ভেতরটাকে চিরে চিরে দিচ্ছে; আর তক্ষণ তক্ষণই যেন আমার সর্বদেহ- কঠিন একটা ভূমিকম্পের টালমাটালামি পাওয়া শুরু করছে। টলছে টলছে! আমার একা-একলা দুনিয়াটা টলছে। চরাচর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে!
এই না চলছে তিন দিন ধরে? তার মধ্যেই আজকে বেলা এগারোটার দিকে খেয়াল করে দেখি, আশ্চর্য এই ব্যাপারখানা ঘটে আছে। মাটি মাটি বাদামিরঙা একটা ইনভেলাপ কিনা এসে হাজির হয়ে আছে আমার টেবিলে। এমন ইনভেলাপে করে আমাকে কোনো পত্র অথবা দরকারি কাগজটাগজ পাঠাবার কেউই নেই। জগৎ-সংসারে এমন কেউই নেই। না আমার কোনো অফিস আছে, না আমার কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো প্রকার দাপ্তরিক যোগাযোগ আছে!
তাহলে এটা কে পাঠাল? কেনইবা আমাকেই? চিৎকার-ফালাফালা হতে থাকা আমার মাথা, সেই বিত্তান্তের মীমাংসা করার কোনো শক্তি পায় না।
বিত্তান্তের তো এখানেই শেষ না! এই চিঠি, এই শয্যাগত আমার রুমে এসে, পৌঁছেইবা কীভাবে? আমার দোতলায় ঢোকার দরজা আজকে তিন দিন হয় সপাটে বন্ধ! আমি বেরুই তো নি-ই, আমার কাছেও কোনো জন আসেনি! আরও তাজ্জবের কথা এই, একদম নিচে যেই সদর দরজা আছে, সেটার পাহারাদারের নজর এড়ায়ে এমন অজ্ঞাত কুলশীল পত্র আমার কাছে এসে পৌঁছুলইবা কোন প্রকারে!
আমাদের সদর দরজার পাহারাদার, ছলবলা-স্বভাবের কোনো লঘুচিত্তজন নয়। তিনি বাক্য-অনীহ, দৃষ্টিগম্ভীর, সদা অনিদ্র ও সংশয়াচ্ছন্ন। তিনি এক কামরাঙা গাছ। এই পত্র যে তার নজর এড়িয়েই, আমার আলোমৃত কক্ষে এসে ঢুকে গেছে, সেটা বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হয় না! কিন্তু কীসের এই পত্র? আমাকেইবা পাঠানো হলো কেন? আর, এই পত্রের উদ্দেশ্যইবা কী?
এতসব কথার কোনো সয়-সুস্থির জবাব তো কোনোদিকে নেই! হায় হায়! আমার তো দেখি কঠিন ভয় লাগছে। এই পত্রের পরিচয়ইবা কী? আর তাতে কোনো সমাচারইবা লেখা আছে?

দুই. অদ্যকার অসরল পত্রের খোলামেলা পরিচয় :
কী যে ভয় পাচ্ছি আমি। ভয়ের হাত ধরে আমার দিনদুনিয়ায় আরেকটা কে এসে গেছে? এসে গেছে কটকট্টা হলদা কতগুলা আলোর ফুলকি। তারা অবিরল লাফান্তি দিয়ে চলছে। আমার চক্ষের সম্মুখে কেবলই লাফান্তি দিয়ে চলছে। লাফান্তি দিতে দিতে আমার দশ দিকের সকল বস্তুকে করে তুলছে চিলিকবিলিক হলুদ রঙা। বোঝ অবস্থা।
তারপর কেমনে যে কী হয়, আমি বুঝতেও পারি না। দিশেহারা থাকতে থাকতে শেষে, আমার এই চিহিৎকার ছ্যাড়াভ্যাড়া হাত দুটা করে কী, ছড়ঘর ছড়ঘড় করে ইনভেলাপের একদিকের মাথাটা ছিঁড়ে ফেলে। কেমনে যে সে ওই হিম্মতটা পায়, তা এখনও আমার বোধগম্য নয়। যেমন একটুও আমার বোধগম্য নয়, এই পত্রের বিষয়বস্তু আর পত্রলিখনরীতি! বাপরে বাপ! এইগুলা কী লিখছে! কেনইবা এমন করে লিখছে!
কী বলছে এই পত্র?
বলছে এই :
মাতা প্রকৃতি সহায়!

রোষযুক্ত সম্ভাষণমাবেদনমিদম
অবহিতকরণ উদ্দেশ্যে এই পত্র প্রেরিত হইতেছে। বিস্তর পরীক্ষাপূর্বক এই সত্য সর্বজ্ঞাত হইয়াছে যে, আপনার ঊর্ধ্বতন দুই পুরুষের কোনো জনই, জীবিকা অর্জন নিমিত্তে কদাপি এক পন্থগামী রহেন নাই! ফাঁক ফুরসত জুটাইয়া সর্বদাই বিবিধ পন্থায় জীবিকা অর্জনের দিকে ধাবিত হইয়াছেন। মনুষ্যগণের এই প্রবণতাকে ধিক। কদাপি তাহারা সামান্যে সন্তুষ্ট হইবার জীব নহে।
তথাপি মনুষ্যদিগের নানাবিধ জীবিকা-পন্থ অন্বেষণের এমত উদ্‌ভ্রান্ত ছুটকে, আমাদিগের নিকট নিতান্ত অসার কিংবা নিষ্ফম্ফল কর্ম বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই! ভীরু, নিঃসহায় দ্বিপদের পক্ষে অন্য করণীয় আর কীইবা রহিয়াছে!
এই মতে যাচাই করিয়া আমাদিগের প্রতীতি জন্মাইয়াছে, আপনার পিতৃপুরুষগণ নিয়ত জীবিকা-অন্বেষণের বহুবিধ পন্থগামী ছিলেন। তাহারা সতত সঞ্চরমাণ মেঘরাশির ন্যায় সঞ্চরণশীল ছিলেন। তাহারা সন্তোষ-উদ্বেলিত চিত্তে, এক জীবিকাকর্মসম্পন্নকরত অন্য জীবিকা কর্মে আপনাদিগকে নিরন্তর নিক্ষেপ করিতেন।
তাহাদিগেরই সাক্ষাৎ অধস্তন উত্তরপুরুষ হইয়া আপনি, অকস্মাৎই, অকর্মণ্য হইবার তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন! অথচ আপনকার পূর্বজনের ন্যায়, এক্ষণে আপনার, নানা জীবিকা-পন্থগামিতায় সাগ্রহ অংশগ্রহণেরই কথা। অথচ আপনার মধ্যে তেমত কোনো উদ্যোগ-উদ্যমের চিহ্নমাত্র পরিলক্ষিত হইতেছে না। ধরিত্রীমাতা স্বয়ং এই সত্যাবস্থার সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত রহিয়াছেন।
আপনি যেমত বৈরাগ্যসাধনার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা আপনকার পূর্বসূরিগণের বংশধরের পক্ষে করণীয় সঠিক কর্ম বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে না। ইহাকে বরঞ্চ বিপথগামিতারই নামান্তর বলিয়া গণ্য করিতে হইবেক! অ হো! ইহা কী বিষম পরিতাপের বিষয়!
কিন্তুক দৃষ্টি সমক্ষে, এই মত নৈরাজ্য এবং অরাজক পরিস্থিতি চলিতে দেওয়া আমাদিগের পক্ষে সম্ভবপর নহে। এমত অবস্থা সহ্য করা মাতা বসুমতীর পক্ষেও সম্ভবাতীত। অতএব, ইহার বিধানকল্পে যথাবিহিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমাদিগের আশু কর্তব্য।
সেই ন্যায়কর্ম সম্পাদনের নিমিত্তে, আগামী আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথিতে, রাত্রি মধ্যযামে, এক সুন্যায়সাধন সভাকার্য সম্পন্ন হইবেক। সভাকার্য সম্পন্নস্থান : মুগদা গোরস্তানলগ্ন মহানিম বৃক্ষতল। এই পুণ্যময় ভূত চর্তুদশী রাত্রির বিচারসভার একমাত্র অভিযুক্ত প্রাণীই হইতেছেন আপনি। তিলার্ধমাত্র বিলম্ব্ব না-করতঃ নির্ধারিত প্রহরে উপস্থিত থাকিতে আপনাকে আজ্ঞা প্রদান করা যাইতেছে।
আপনার বিশদ অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে, সুমুখে নিজ বিচারনিমিত্তে আসিয়া উপস্থিত না হইলে, আমাদিগের বিষমুখ প্রহরীগণ আপনাকে রজ্জুবদ্ধকরতঃ সভাক্ষেত্রে আনিয়া বহাল করিতে প্রস্তুত রহিয়াছে।
কিমধিকমিতি
সুন্যায় সাধনব্রতধারী ও সাম্যবিধানকারী প্রকৃতিআদালত
সন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ ভাদ্রমাসের অন্তিম

পুনশ্চ : এই পত্র সহিত একখানা নাতিবিশদ কর্মনামাও সংযুক্ত করা হইলেক। ইহাতে আপনার লজ্জাকর অকর্মণ্যতার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রহিয়াছে। এবং অতীতদিনে আপনার পূর্বপুরুষগণ কর্তৃক গৃহীত জীবিকা-পন্থসমূহের বিশদ বিবরণও লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। উক্ত বিবরণ পাঠকালীন ক্ষণে আপনকার সুমতি জাগ্রত হইলেই মঙ্গল!

তিন. কী আছে অই কর্মনামায়!
মা মা! কারা এইসব কী কথা বলে! কী কথা লেখে! দেশে কী তবে লোকের পারসোনাল গূঢ় বিষয়-বৃত্তান্ত নিয়ে দাবড়াদাবড়িও শুরু হয়ে গেছে নাকি? কী ভয়ানক! কী মারাত্মক কথা! এসব কী? এটাকেই কি সাইবার ক্রাইম বলে নাকি! নাকি আমাকে জিম্মি করে নিতে যাচ্ছে- কে বা কারা জানি! কী উপায় রে এখন!
মাবুদ! আমাকে এখন কে রক্ষা করে!
পত্রপাঠ ভড়কে গিয়ে আমি এমতে কেঁপেকুঁপে একশেষ হয়েছি, ঠিক! কিন্তু তাও পত্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া কর্মনামার পৃষ্ঠাগুলো পড়ে উঠতে ছাড়ি নাই আমি। বিষয়টা স্পষ্ট রকমে বুঝে উঠতে হবে তো! তাই না? কিন্তু কী আর বুঝব! পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে ওতে কেবল আছে অতীতকালের পিতৃ-পিতামহের কর্ম ফিরিস্তি।
অমুকে দেখো এইটা করতে করতে ওইটা করতে গেছে! তমুকে দেখো তো, অবসরের পাশে একদণ্ডের জন্যও বসতে যায় নাই! এই করতে করতেই তারা একেকজনে দুনিয়ার মায়াকে বিদায় জানায়ে কোন সেই নিরুদ্দেশের পথে রওনা হয়ে গেছে!
কী আজব লোকসকল! এমন সদাসতত জীবিকার রাস্তা ধরে চল-চলচলন্ত পিঁপড়া-স্বভাবের ছিল কেমনে তারা? এটা কোনো মনুষ্যসন্তানের জীবন হলো?
কর্মনামার শেষপাতায় আরও কী দেখা যায়?
দেখা যায়, আমার নামখানাও সেই পাতায় লিখিত হয়ে আছে। লেখা আছে, শুধু ওই নাম। আর খটোমটো খানিকটা কথা। আর কিছু নেই। আশ্চর্য!
নিচে সেইসব লেখাপত্র হুবহু তুলে ধরা গেল।
ক) চলমান পৃষ্ঠা ১ : বর্তমান কর্মচোরা বিবাদীর প্রয়াত পিতামহ অনুসৃত জীবিকা পন্থাদির বিবরণ।
বর্ণিত হইতেছে যে, উক্ত মনুষ্য নিয়ত কৃষিজীবী ছিল। তবে তাহার ক্ষেত্রে উৎপাদিত ধান্যদ্বারা সম্বচ্ছরের অন্নসংস্থানের কর্ম সাধন সম্ভবপর হইত না বিধায়, তাহাকে অন্য ক্ষেত্র-মহাজনসকলের ক্ষেতিখোলার কর্মে কামলা খাটিতে যাইতে হইত। নতুনা অন্য কোন প্রকারে তিনি সংসারের লোকসকলের মুখে আহার্য জোগাইবেন!
তাহার যৌবনকালে, ফসল উত্তোলনের মৌসুমে তিনি, নিজ ক্ষেত্রের পকস্ফ ধান্য, রাত্রি প্রথম প্রহরে কর্তন করিতেন। তৎকালে তাহার বালিকা ধর্মপত্নী, রেড়ির তেলের কুপি হস্তে ধারণ করিয়া তাহাকে যৎকিঞ্চিৎ আলো দেখাইবার বিফল চেষ্টা করিত। দিনভর তিনি অন্য মনুষ্যের ক্ষেত্রের কর্ম সম্পাদনে ব্যাপৃত থাকিতেন।
বরষার কালেও তাহার কর্মপদ্ধতি অই পূর্বপ্রকারেরই ছিল। সমস্ত দিবস কাল তিনি অন্যের ক্ষেত্রের পাট কর্তন করিতেন। তৎপরে সন্ধ্যাকালে তিনি নিজ ক্ষেত্রের পাট কর্তন করিতে পানিতে নামিতেন। কোনো প্রকার আলস্য তাহাকে কদাপি স্পর্শ করিতে সমর্থ হইত না।
অই পাট সিজিলমিছিলকরণ কর্মও একসময় নিষ্পন্ন হইত। বরষা কালের আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় পক্ষ উপস্থিত হইবার পূর্বেই উহা সম্পন্ন হইত। তৎকালে উক্ত ব্যক্তি কী করিত? দেহকে বিশ্রাম প্রদান করিতে যাইত কী?
কদাপি নহে।
ভরা বরষায় অত্র অঞ্চলের গ্রামবাসীগণ সাময়িক কর্মবিরতি পাইত। ক্ষেত্রসকল তখন ভরা নদী মেঘনার তলে। ধান্য কর্তন সেই কোন পূর্বেই সম্পন্ন করা হইয়াছে। পাটেরেও সুভালাভালি শুস্ককরণ শেষ। অই অবকাশকালে গৃহস্থগণ নিজেদের গ্রামে গ্রামে চারণ কবিগণকে ডাকিত, পালাগানের আসর জমাইবার জন্য। কোনো পালা চলিত দুই পক্ষকাল। কোনোটি এক পক্ষ।
অত্র বিবাদীর পিতামহ- উত্তম খঞ্জনি বাদক আছিলেক। পর সমাচার, তিনি মূল গায়েনের সহিত উৎকৃষ্ট প্রকারে ধুয়া ধরিতে জানিতেন। ফলে, গাথা গাহিবার জন্য, খঞ্জনি বাজাইবার জন্য, তিনি তখন এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে গায়েন দলের সঙ্গী হইতে থাকিতেন। বিনা মজুরিতে উক্ত কর্ম সম্পাদিত হইত না!
পালা অনুসারে আতপ ধান্যের প্রণামি প্রদানের বেশ-কম ইত্যাদি নির্ধারিত হইত। নিজ কর্মের ন্যায্য পাওনা হইতে উক্ত পিতামহও বঞ্চিত হইতেন না।
এমত পন্থছুট করিয়াও পিতামহ, কিঞ্চিৎমাত্রও পরিশ্রান্ত বোধ করিতেন বলিয়া প্রমাণ মিলে না। কোন ভেলকিগুণে উহা সম্ভবপর হইয়াছিল? সেইটা সম্ভব হইয়াছিল, কারণ পিতামহ তাহার সংসার-পরিজনকে রক্ষার দায় আপনার বক্ষে সত্যপ্রকারে বোধ করিতেন। ইহা ব্যতীত ভিন্ন আরেকখানা বিষয়ও এই স্থানে বিরাজ করিত। পিতামহের অন্তরে আশা জাগ্রত ছিল। নিজ পুত্রটিকে শিক্ষাপ্রাপ্ত করিয়া তুলিবার আশা। অই আশাই তাহাকে করিয়া তুলিয়াছিল- অটল অচল পর্বতের ন্যায়! যদিও তিনি কদাকস্মিনকালেও নিজ অক্ষিতে পর্বত দর্শনের সৌভাগ্য লাভ করেন নাই, কিন্তু অদৃষ্টগুণে তিনি স্বয়ং পর্বতসম হইয়া উঠিয়াছিলেন!
এমন জীবিকা কর্মগ্রস্ত মহাজনের এমন মন্দভাগ্য কীরূপে হইতে পারে? এমত কর্মবিমুখ, আলস্য-পরবশ বংশধর তাহাকে কোন কর্মফলে পাইতে হইবেক? জগতের এই জিজ্ঞাসারই বিহিত সাধন করিতে- এই আদালত বদ্ধপরিকর।
ইতি চলমান পৃষ্ঠা ১ সমাপ্ত হইলেক।
খ) চলমান পৃষ্ঠা ২ : 'এই স্থানে অভিযুক্ত জনের পিতাপুরুষের ও মাতা-কঠোরার জীবিকা সংস্থানের ইতিকথা বর্ণিত হইবেক।'
ওরে বাবা! এই পৃষ্ঠার এইটুকু পড়লেই আমার চলবে। আমি জানি তো, আব্বাকে কী কী করতে হয়েছে! খুব ভালো রকমে জানি তো, আম্মাকে কোন কোন রাস্তা ধরে ধরে চলে চলে, আমাদের ওই রাবণের গুষ্টিকে সামলে রাখতে হয়েছে। আমি জানি জানি।
বরং তিন নম্বর পৃষ্ঠায় কী আছে, সেটা দেখি তো!
চলমান পৃষ্ঠা ৩. এই পাতায় বর্তমান বিবাদীর জীবিকা-পন্থা লিপিবদ্ধ হইবার কথা থাকিলেও, উহা সবৈব রকমে অগ্রাহ্য করা হইল। কেননা যেহেতু সে বিচারাধীন জীব, তাহার আমল অথবা কর্মনামা অথবা জীবিকা সংস্থানের নানা পথে যাইতে তাহার যে অনীহা, সেই অনীহানামা; তাহাকে হাতে হাতে বুঝাইয়া দেওয়ার সিদ্ধান্তই এই ক্ষেত্রে সাব্যস্ত হইল।

চার. শেষ কথা :
সত্য বলছি, আশ্বিন মাস কবে আসে কবে যায়; আমি তো সেটাই ঠিকমতো জানি না! সেই আমিই, কী করে খুঁজে বার করব কোনটা আশ্বিনমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথি! আর কোনটা কিনা ভূত চতুর্দশীর রাত! আর, মুগদা গোরস্তানের কোনো একটা দিকেও তো মহানিম গাছের নামনিশানাও নাই! নাকি আছে? আমি কী ওই গাছও চিনি নাকি!
তবে কর্মনামা পড়ে, আমার কিন্তু জব্বর একপ্রকার বোধোদয় হয়েছে। আমি একদম সাফসাফা রকমে বোধ করতে পেরেছি যে, অকর্মণ্য হওয়ার ভাগ্য আমার নয়। ই ভাগ্যটা আছে শুধু তুর্গেনেভের নায়ক রুডিনেরই! বা বুদ্ধদেব বসুর নায়কদের কোনো কোনো জনের! আমার জন্য সেটা নয়। নয়।
বেশ! যাচ্ছি তবে আমি নিজেকে জীবিকা-অন্ব্বেষণের নব বিধি-বন্দোবস্ত শিক্ষা দিতে! কে যায় আদালত-অপমান সামলাতে! আমি তো যাচ্ছি না। যতই না কেন সমন পাঠাক, আমি না গেলে কে কী করবে? যামু না আমি। বিষ-আগুন মুখের প্রহরী পাঠাবে, আমাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
আমাদের চির পাহারাদার ওই কামরাঙা গাছের লগে হেরা পারব বুদ্ধিতে? জীবনেও পারবে না। ওই বিচারের গুন্ডামি দেখতে আমি আদৌ যাইতেছি না!
তার চেয়ে ঢের ঢের ভালো না, দুই-চারটা বিবিধ জাতের জীবিকার আস্তা-রাস্তা খুঁজে নেওয়া? সাতটা টিউশনি, পাঁচ জাতের বুক রিভিউ কর্মের দায়, আর প্রুফ রিডিংয়ের পুণ্যকর্ম পেয়ে যাই যদি! ব্যস! নাকি অন্যকিছুতে যাব আবার?
ভাইসব! হেল্প করতে চাইলে আওয়াজ দিয়েন, প্লিজ!