বাংলাদেশের একাত্তরের ইতিহাসে কার কী ভূমিকা ছিল সে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু জনগোষ্ঠীগত বা অঞ্চলগতভাবে কিংবা সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা আলাদা মানুষের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে আলোচনা কম হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- আমাদের একাত্তরের ইতিহাসটা তৈরি হয়েছে ব্যক্তি বা দলকেন্দ্রিক কিংবা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক; জনগোষ্ঠীকেন্দ্র্রিক না। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধে জনগোষ্ঠীর গুরুত্বটা অনেক সময় আমরা ধরতে পারি না। যেহেতু এটি সমাজের আন্দোলনের ভিত্তির বদলে বীরত্বগাথাভিত্তিক ইতিহাস হয়েছে- আমরা তাই বীর খুঁজেছি। কিন্তু একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধটা যে পরিসরের মধ্যে হয়েছে, সেই পরিসরটাকে নিয়ে ততটা আলোচনা হয়নি। একাত্তরের সেই প্রধান পরিসর হচ্ছে আমাদের গ্রাম। একাত্তরের ইতিহাসে গ্রাম গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কারণে। ঠিক একই কারণে মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের বাস্তবতা নিয়ে চর্চাটা কম হয়েছে।
প্রথমত, পাকিস্তানিদের আক্রমণটা হয়েছে ঢাকা শহরে। ২৫ মার্চের সেই আক্রমণটা আমাদের জন-ইতিহাসে এবং জনকল্পনাতে একটি বড় অবস্থান নিয়েছে। বস্তুতপক্ষে সেই রাতের আক্রমণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা ঘোষণা করেছে যে, পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য আমরা তোমাদের ওপর গণহত্যা পর্যন্ত চালাতে পারি। এই আক্রমণের দুই দিন পরে যখন কারফিউ তোলা হলো, তখন অসংখ্য মানুষ পালিয়ে গিয়েছিল। সেই মানুষগুলো কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে?
জিঞ্জিরা হত্যাকাণ্ডের কথা আমরা বলি। ঢাকা থেকে মানুষ পালিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারে আশ্রয় নিয়েছে- সেখানে পাকিস্তানিরা হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আরও অসংখ্য মানুষ জিঞ্জিরা থেকে পার হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় পেয়েছে। ঢাকা শহরের প্রতিটি পাড়া থেকে মানুষ গেছে। এমন কোনো পাড়া পাওয়া যাবে না, যেখান থেকে মানুষ পালিয়ে যায়নি। এই প্রতিটি মানুষ আশ্রয় পেয়েছে গ্রামে। কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে এই আশ্রয়ের ভূমিকাকে আমরা সামান্য করে দেখি। অথচ একাত্তরের ইতিহাসের মূল সূত্র হচ্ছে আশ্রয়। এই আশ্রয়ের মাধ্যমেই একাত্তরের সমাজটা টিকেছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে গ্রামের মানুষ। ইতিহাসে তার বয়ানটা নেই।
এই সময়টাতেই প্রতিরোধ যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেছে। যার মাধ্যমে পাকিস্তান আর্মি একেবারেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। তাদের ধারণাই ছিল না, বাংলাদেশের মানুষ এমনভাবে প্রতিরোধ করবে। আগপিছ না ভেবে তারা তখন যুদ্ধে নেমে পড়েছে। কিন্তু সেই যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। যে কারণে তারা তখন বিশাল একটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রতিরোধে কারা ছিল? যেখানে সেনাবাহিনী ছিল সেখানে সেনাবাহিনী প্রতিরোধ করেছে, যেখানে পুলিশ কিংবা ইপিআর ছিল সেখানে তারা প্রতিরোধ করেছে, আনসাররা প্রতিরোধ করেছে। এবং সবচেয়ে বড় প্রতিরোধটা করেছে সাধারণ মানুষ। যারা বারবার পরিসরটাকে তৈরি করে দিয়েছে, বারবার প্রতিরোধটাকে সম্ভব করে তুলেছে। পাকিস্তান আর্মিও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে গিয়েই লুটতরাজ-নির্যাতন শুরু করেছে। তারা লুট করেছে টিকে থাকার জন্য। কারণ তাদের খাবার নেই, রসদ নেই। না খেতে পেলে মানুষ মারবে কীভাবে! তাই তারা হত্যা-নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে লুট করা শুরু করে। পাকিস্তান আর্মি তখন কেবল প্রতিশোধের জন্য হত্যা-নির্যাতন নয়, বেঁচে থাকার জন্যও মানুষের খাবার লুট করেছে। জাতীয় রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, গ্রামের মানুষ তো সে রাজনীতির সঙ্গে ততটা সম্পৃক্ত নয়। তবু তারা কেন প্রতিরোধ করল? এটাকেই আমি বলি, তারা প্রতিরোধ করেছে তাদের ঐতিহাসিক প্রস্তুতির কারণে। গ্রামের মানুষ মুক্তি চেয়েছে। নির্যাতনের বিপক্ষে মুক্তি। আমরা দেখি যেসব এলাকায় সংগ্রাম কমিটি হয়েছে- এই সংগ্রাম কমিটিগুলো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু গ্রামের মানুষের হঠাৎ করে কী হলো যে তারা এইসব সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে সপ্তা কিংবা মাসখানেকের সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল! গ্রামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই বিশ্নেষণটা করা প্রয়োজন। গ্রামের মানুষ মুক্তি চায় আর প্রতিরোধের মাধ্যমেই তারা সেই মুক্তি অর্জন করতে পেরেছে। প্রতিরোধই তাকে ওপরে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারুক আর না পারুক- ঐতিহাসিকভাবে এই প্রতিরোধের মাধ্যমেই সে প্রধান পরিসরে পরিণত হয়। মুক্তিকামী মানুষের লড়াই যদি হয়ে থাকে তা হয়েছে গ্রামে, শহরে তেমন কোনো সম্মুখযুদ্ধ হয়নি। শহরে গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে। পিলখানা আর রাজারবাগে হয়েছে স্বল্পকালীন- এ ছাড়া ঢাকা শহরে তো তেমন কোনো যুদ্ধই হয়নি। কিন্তু শত শত গ্রামে প্রতিরোধ লড়াইগুলো যেমন হয়েছে, তেমনি অধিকাংশ সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে সেখানেই।


এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান আর্মি স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্দখল করল। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা কিছুদিনের মধ্যে ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে। তারা তখন কোথায় আশ্রয় পেয়েছে? তারা আশ্রয় পেয়েছে গ্রামেই। আবার কোন জায়গায় পিস কমিটি, শান্তিবাহিনী হয়েছে? গ্রামে হয়েছে। কারণ পাকিস্তানিরা জানত, শহরগুলোকে তারা সেনাবাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, কিন্তু গ্রামগুলোকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। গ্রামের নিয়ন্ত্রণ তার আওতার বাইরে। এই বিদ্রোহী গ্রামকে তো পাকিস্তান আগে কোনোদিন দেখেনি। বাংলাদেশের গ্রাম হলো দুইশ বছর ধরে প্রস্তুত বিদ্রোহী। বাংলাদেশের গ্রাম বিদ্রোহ করেছে সবার আগে ১৭৬০ সালে। কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে গ্রামের প্রথম সরাসরি মিলন হয়েছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় থেকে। এর আগে প্রায় ২০০ বছর ধরে বিদ্রোহ করে আসছে বাংলাদেশের কৃষক শ্রেণি। যখনই বিদ্রোহের প্রশ্ন এসেছে, এই কৃষক সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করার দরকার হয় না। কারণ সে তো ঐতিহাসিকভাবেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। আমাদের মধ্যবিত্ত-নির্ভর ইতিহাস চর্চায় এই ধারণাটা কখনোই আসে না। আমরা সব সময় বিশেষ কোনো কারণ খুঁজি, কখন ভাষার জন্য কিংবা কোনো নির্দিষ্ট অধিকারের জন্য বিদ্রোহের অবস্থা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কৃষক তো সার্বক্ষণিক নির্যাতনের শিকার- সে জন্য সে সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। অপরদিকে শহরের মানুষের বিদ্রোহের বয়স কত? শহরে তো কোনো বিদ্রোহই হয়নি। ভাষা আন্দোলন তো আর বিদ্রোহ না। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু সেটা তো যুদ্ধ নয়।
গ্রামের মানুষ সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন থেকে। অত্যাচারী, নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করেছে। তাদের বিদ্রোহের ঐতিহ্য শহরের মানুষের চেয়ে কমপক্ষে দেড়শ বছরেরও বেশি। বিদ্রোহ আর প্রতিরোধযুদ্ধে যেমন, তেমনি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেও কৃষক শ্রেণির ভোটের ভূমিকাই মুখ্য। ১৯৩৭ সালের যে নির্বাচন থেকে উঠে এসেছিল আমাদের নেতারা- যেখান থেকে পূর্ববঙ্গের অস্তিত্ব শুরু হলো; সেখানে প্রধান ভোট এসেছে কৃষক শ্রেণি থেকে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচন- যার মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান হবার কথা ছিল, সেখানেও প্রধান ভোট কৃষকদের। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, যেখানে বাংলাদেশ প্রায় কমবেশি পাকিস্তানকে অস্বীকারই করে দিচ্ছিল- সেই ভোটটাও এসেছে কৃষকের কাছ থেকে, গ্রাম থেকে। আর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তো প্রশ্নাতীতভাবে গ্রামের মানুষই বেশিরভাগ ভোট দিয়েছে। জনগোষ্ঠীর দিক থেকে গ্রামেই অধিকাংশ মানুষ বাস করে, সুতরাং গ্রামকে ছাড়া বা কৃষক শ্রেণির ভূমিকাকে বাদ দিয়ে কোনো ইতিহাসই বদলানো সম্ভব না, তৈরিও সম্ভব না। না বিদ্রোহে, না ভোটে।
এই গ্রামের মানুষই মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে একাত্তরে। আশ্রয়ের কথাটা আমি আবার বলছি- কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কোনো কাজ করতে গেলেই আমি দেখেছি আশ্রয়। অসংখ্য আশ্রয়ের ঘটনা আছে।
একজন মহিলার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। আমাকে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি সীমান্ত এলাকায় থাকতেন। হিন্দু জনগোষ্ঠীর অজস্র মানুষ সেখান দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাচ্ছে। তিনি সেই মানুষগুলোকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রান্না করে খাওয়াতেন। বেশ অবস্থাপন্ন মহিলা। তিনি বলেছেন যে, 'আমরা এই মানুষগুলোকে খাওয়াতাম এবং সঙ্গে করে কিছু না কিছু দিয়ে দিতাম।' কিন্তু যাদের এই মহিলা খাওয়াচ্ছিলেন, তাদের তো তিনি চিনতেন না। তাহলে তাদের খাইয়েছেন কেন? খাইয়েছেন, কারণ এটাই হচ্ছে তার সংস্কৃতি। এবং আমি মনে করি এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। একাত্তরের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পরে যখন তার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল, তখনও কিন্তু তিনি একই কথা বলেছেন যে, এটা তার জীবনের একটা অহংকার। এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যারা একাত্তরে এসব অসহায় মানুষকে খাইয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে।
আরেকটা আশ্রয়ের ঘটনার কথা বলি, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা এসে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে তারা কয়েকদিন থেকেছিল। সে বাড়ির লোকজন নিজেদের সাধ্যমতো তাদের খাইয়েছে। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্যাম্প থেকে অনেকটা দূরবর্তী কোনো গোপন জায়গায় আশ্রয় নিত। নিজের গ্রামে আসত না, কারণ চিনে ফেলবে তাকে। রাজাকাররা সব সময় লক্ষ্য রাখছে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনার দিকে। যা-ই হোক, যুদ্ধের পরে যখন সেই মুক্তিযোদ্ধারা সে বাড়িটিতে খোঁজ করতে গেছে- তারা জানতে পেরেছে ওই মানুষগুলোর অবস্থা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে মারা গেছে। না খেতে পেয়ে মারা গেছে লোকগুলো। শহরেও এমন অনেক ঘটনা আছে। পুরো বাংলাদেশে আছে অসংখ্য। বলে শেষ করা যাবে না।


আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে, ভারতে গিয়েছিল যারা, তারা আশ্রয় চেয়েছিল এবং ভারত আশ্রয়টা দিয়েছিল। ভারতের রাজনীতি ছিল অবশ্যই কিন্তু এর সঙ্গে এই আশ্রয় দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। একাত্তরটা আশ্রয়ের। এবং আন্তর্জাতিকভাবেও যদি দেখা যায় বা বাংলাদেশের একাত্তর-সংক্রান্ত জাতিসংঘের দলিলগুলো পড়া যায়- তাহলে পরিস্কার বোঝা যায় যে এই শরণার্থীদের যে চিত্র, সেটি দেখেই কিন্তু সারা পৃথিবী মনে করেছে একটা কিছু করা দরকার। আশ্রয় বিষয়টাই হয়ে উঠেছিল প্রধান বিষয়- সেটা চাপ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে হোক, টিকে থাকার ক্ষেত্রে হোক, বিজয়ের জন্য হোক। মানুষ যদি আশ্রয় না দিত, তাহলে আমাদের শহীদের সংখ্যা কত হতো তা বলা যায় না! একাত্তরে মানুষ বেঁচেছে অনেক বেশি- কারণ কেউ না কেউ তাকে বাঁচতে সাহায্য করেছে। এই হচ্ছে গ্রাম।
যুদ্ধের কথাই যদি বলি- বাংলাদেশের শহরগুলোতে যুদ্ধ হয়েছে একেবারে নভেম্বরের শেষের দিক থেকে; যখন ভারতীয় সৈন্যবাহিনী প্রবেশ করা শুরু করল অর্থাৎ নিয়মিত বাহিনী যখন সম্মুখ সমরে চলে গেল। কিন্তু সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে গ্রামের মানুষ। দেখা গেছে মিত্রবাহিনী নদী পার হতে পারছে না; গ্রামের মানুষ এসে সমস্ত কিছু ব্যবস্থা করে দিল। তাদের পথ দেখিয়ে দেশের ভেতরে দ্রুত প্রবেশ করতে সহায়তা করল। কিন্তু একাত্তরের এসব ঘটনার কথা আমরা বলিইনি কখনও।
আমরা ইতিহাসে সাধারণ মানুষের যুদ্ধের কথা বলি না। তারা যে পাকিস্তান আর্মির চলাচলের এবং পালিয়ে যাবার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। নদী পার হওয়ার ফেরি সরিয়ে ফেলা, বাঁধ কেটে দেওয়া, রাস্তা ভেঙে দেওয়া- এগুলো সশস্ত্র যোদ্ধারা যেমন করেছে, তেমনি সাধারণ মানুষও করেছে একাত্তর সালে। এ কারণে পরাজয়ের পর পাকিস্তানের তৈরি করা হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে দেখা যায়, তারা অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই মনে করেছে। তারা বলেছে- মুক্তিযোদ্ধারা সবকিছু বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। সে কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে দৌড়ে এসে তারা ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে।
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শক্তির কথা কখনও ভাবেনি। তাই জেনারেল নিয়াজির সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হলো। কারণ তার পরিকল্পনার কোনোটারই ভিত্তি ছিল না। সবচেয়ে বড় ভিত্তিহীন ভাবনা ছিল যে, স্থানীয় মানুষ তাদের পক্ষে থাকবে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ কোনোদিনই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না। দালাল তৈরি করা যায়, পয়সার বিনিময়ে দালাল তৈরি করা গেছে; ঢাকা শহরেও প্রচুর দালাল তৈরি হয়েছিল। গ্রামে তৈরি হয়েছিল শান্তি কমিটি। কিন্তু গ্রামের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ তো ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। সাধারণ মানুষের এই অবস্থান ও তার প্রভাব সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানতে চাই না। আমরা যেহেতু জনগোষ্ঠীগতভাবে ইতিহাসটাকে তৈরি করিনি- সেজন্য জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের গুরুত্বটাও ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারি না। একাত্তরের ইতিহাস লেখার সময়ে আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাসের পথ ধরেছি, আলাদা আলাদা ব্যক্তির ভূমিকা তুলে ধরেছি। কিন্তু সেই ব্যক্তির কাজটা করা সম্ভব হয়েছে যাদের কারণে, তাদের কথাটা আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। এই সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আমরা কোনটা নিয়ে তর্ক করি, আর কোনটা ভুলে যাই- এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা জিইয়ে রেখেছি ওপরতলার ইতিহাস। ভুলে গেছি সাধারণ মানুষের ইতিহাস।
পুরো একাত্তরে যে গ্রামগুলো নিরাপদ ছিল, যে গ্রামে পাকিস্তান আর্মি যেতে পারেনি বা যেখান থেকে আর্মি চলে এসেছে- সেটা সম্ভব হয়েছে কাদের মাধ্যমে? গ্রামের মানুষের মাধ্যমেই তো!
জগজিৎ সিং অরোরা আমাকে বলেছিলেন যে, 'গ্রামের লোকজন আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে। তারা যদি বলত- আমরা তোমাদের ঢুকতে দেব না, তাহলে যৌথবাহিনীর দেশের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা ছিল না।' কিন্তু আমরা এই কাজের কোনো স্বীকৃতি দিই না। কেন স্বীকৃতি দিই না যে, গ্রামের মানুষ যদি কাউকে অনুমতি না দিত তাহলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। তাহলে গ্রামের মানুষের অনুমতি ছাড়া যেটা ঘটেনি, সেটা আমার ইতিহাসের অংশ হয় কী করে? এখানে পরিস্কারভাবে বোঝাই যাচ্ছে যে, তারা ছিল বলেই বাকিটা হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি, একাত্তরের গ্রামের ইতিহাসের চর্চাটা আরও বেশি করে হওয়া দরকার। যাতে করে আমরা বুঝতে পারি যে, বহুলাংশে গ্রামের মানুষের ইতিহাস মানেই হচ্ছে একাত্তরের ইতিহাস। অন্যরাও আছে, কিন্তু সবার আগে ছিল গ্রাম।
[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত]