'কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল
আর কোনটা যে সূর্যমুখী-
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না।
ওলকপি এবং শালগম,
মৃগেলের বাচ্চা এবং বাটামাছ,
মানুষ এবং মানুষের মতো মানুষ-
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না
বই এবং পড়ার মতো বই,
স্বপ্ন এবং দেখার মতো স্বপ্ন,
কবিতা এবং কবিতার মতো কবিতা,
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না'
-তারাপদ রায়
খোদেজার সাথে আমার ইজিবাইকে দেখা। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। সহযাত্রী খোদেজা। প্রতিদিন কলেজ যাই-আসি। স্নান-খাওয়ার মতো নিত্যকর্ম। মফস্বলি জীবনে অন্তরে অসীম উদগ্র জীবনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাস করা আমার আটপৌরে জীবনে একটাই খোলা জানালা, বিশ্বদর্শন। সহযাত্রী। একেকদিন একেকজন, একেকজন একেকরকম। তারা ফোনে কথা বলে, সুউচ্চ ধমকে মামলার খবর জানতে চায়। কেউ ঝগড়া করতে থাকে, উন্মত্ত হয়ে, না তাকে সব টাকা ফেরত দিতে হবে না। আপাতত অর্ধেকটা দিলেই চলবে। কেউ কনেবাড়ির খাসির মাংসের বদনাম করে, এত ঝাল দেয় কেউ বিয়ের খাবারে। আমি চুপচাপ শুনি। প্রতিদিন, প্রতিবেলা। প্রতিটি ফোনালাপে একাধিক গল্প আছে, মানুষের জীবন জুড়ে আছে উপন্যাস। ফিকশনের সাধ্য কি তার সবটুকু ছুঁতে পারে। আমি আমার রুটিনবাঁধা নিত্যদিনে পাবলিক যানে বিচিত্র জীবন দেখি। আমার আটপৌরে জীবন এই এক টুকরো রঙে ঝলসে ওঠে।
জীবন মূলত এক অপেক্ষার নাম। ঝলসে ওঠার অপেক্ষা। কিছু প্রাপ্তির ঝলসে ওঠা, কিছু আনন্দের ঝলসে ওঠা, কিছু অর্জনের ঝলসে ওঠা, কিছু অহংকারের ঝলসে ওঠা। আর এই অনিশ্চিত ঝলসে ওঠার জন্য জীবনভর আটপৌরে ছুটে চলা, নিয়মবাঁধা দৌড়। হয়তো কখনও কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে দেখা হয় সেই অনিশ্চিত আনন্দের সাথে, একটা দিন কিংবা একটা মুহূর্ত। সহস্র দিনের ছুটে চলার ক্লান্তি মুছে জানিয়ে যায়, জীবন সুন্দর। কারও হয়তো সে আনন্দের সাথে দেখাই হয় না আজীবন। সে আনন্দও তো আপেক্ষিক, পরিমাপের বাটখারাহীন। প্রতিদিন ডাল-ভাত খাওয়া কারও কাছে একবেলা মাছের সালুন, অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে দু'দিন কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত কারও কাছে। কোনটা কম কোনটা বেশি, কেউ জানে না।
একবার খোদেজা নাম নিয়ে গল্প লিখে খুব বিপদে পড়েছিলাম। আজ সত্যি আমার সামনে যিনি বসে ছিলেন তিনি খোদেজা। চোখে দেখতে পান না। মুখের চামড়ার সহস্র ভাঁজ সংখ্যাজ্ঞানের কাছে হার মানা। আমার হঠাৎ প্রশ্নে তিনি চমকে তাকান- খালা বাড়ি কই? তার ঝাপসা চোখে তরঙ্গ ওঠে। দৃষ্টিতে এমন এক অচেনা ছায়া, যার কোনো নাম দিতে পারি না। স্পষ্ট বুঝতে পারি, একদা এ চোখ দেখত জীবন, জগৎ, আনন্দ-বেদনা। সব দেখতে পেতেন। অভাবও দেখতেন, স্বভাবও। এখন জগৎ দেখেন না, অথচ জীবন তার পিছু ছাড়েনি। বাড়ি দুই নম্বর পুল। চোখে দেখেন না খালা? না, সব ঝাপসা। কেউ নাই আপনার? ছিল একটা মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। কার সাথে থাকেন? ওই আরেক বেটির সাথে। বেটিও ভিক্ষা করে, আমিও ভিক্ষা করি। আমি চুপ করে যাই।
গতকালও মা আমাকে কষে বকা দিয়েছেন। মায়ের চোখের ডাক্তার দেখাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার আটপৌরে ব্যস্ততা আমাকে জাপটে ধরে উপায়ান্তরহীন। মায়ের বকা হজম করার আজন্ম অভ্যাসের ঋজুতা আমার হঠাৎ ধাক্কা খায়। ডাক্তার বলেছে মায়ের চোখে ছানি পড়েছে, অপারেশন লাগবে। এই মহিলারও চোখে ছানি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কেউ হয়তো তাকে বলেনি কখনও। বললাম, চলুন আপনার বাড়িটা দেখে আসি। বিনামূল্যে ছানি অপারেশন হলে আপনার অপারেশন করিয়ে দেব। হয়তো গুরুত্বটা খুব বুঝলেন না তিনি, তার দিন যাপনের রূঢ় অভিজ্ঞতায় এই প্রস্তাব হয়তো কোনো ভূমিকা রাখে না এসব শব্দ। ছানি, অপারেশন, বিনামূল্যে। হয়তো অপরিচিতই তার কাছে শব্দগুলো। হাতে একশ টাকার নোট গুঁজে দিলে তিনি আমার ফোন নম্বর চান। আমি সাদা কাগজে লিখে দিই। আমাকে বাড়ি পর্যন্ত নিতে তার অনীহা বুঝতে কষ্ট হয় না।
ক্লাসে যাই। কারক বিভক্তির বিরক্তিকর পাঠে ছাত্রদের পকেটে পকেটে স্মার্টফোন বেজে ওঠে নানান সুরে। দুই বছর আগের আমি আর আজকের আমার পার্থক্য টের পাই। শত বছরে আসা এক প্যানডামিক আমাদের কতকিছু কতভাবে বদলে দিয়েছে। আগে ফোন নিয়ে ক্লাসে ঢুকলে দেখামাত্র বের হয়ে যেতে বলতাম ছাত্রদের। এখন আমরা অনলাইন মানুষ। জীবন অ্যাকচুয়ালিটির বেড়া ডিঙিয়ে অনেকখানি ভার্চুয়াল। স্মার্টফোন সবচেয়ে জরুরি উপকরণ জীবনের। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনের অচল জীবনের সচল চাকা স্মার্টফোন।
নিয়মতান্ত্রিক জীবনে একটুকরো ঢিল আজ বুস্টার ডোজের মানসিক প্রস্তুতি। হাসপাতাল গিয়ে বিচিত্র রোগী দেখি, হাত ভাঙা, মাথায় ব্যান্ডেজ, অচেতন, স্ট্রেচারে শুয়ে চিৎকার করা। লেখক জীবনের অবিচ্ছেদ্য কবচ কু ল এই অন্তর্গত মানুষ দেখা। মানুষের ভেতরে মানুষ দেখা, মানুষের জীবন দেখা। হাতে প্লাস্টার করা লোকটির নির্বিকার বসে থাকা দেখে আমি তার ঘরের হাঁড়িপাতিল দেখে ফেলি, দেখে ফেলি তার দাওয়ায় নোয়ানো বরইগাছে এই পৌষে কেমন হলদেটে রং ধরেছে কাঁচা বরইয়ে। মাথায় ব্যান্ডেজ দুরন্ত ছেলেটির সেই বিকেলটা দেখে ফেলি, যে বিকেল শীতকে জাঁকিয়ে নিয়ে দ্রুত ফুরিয়ে যাবার আগে সদ্য ধান কাটা মাঠে তার দুরন্তপনার দাগ রেখে যায়। অচেনা মেয়েটি যে এক উত্তুঙ্গ যুবকের প্রেমে পড়ে সব খুইয়েছে তার অচেতন চেহারা দেখে আমি ঠিক বুঝে যাই। নারীত্বের অপমান এখনও অনেক মানুষের কাছে অসহনীয়, অসহ্য। হয়তো আরও অসহ্য হয়ে তাতে ঘা দিয়েছে পড়শির অপবাদ আর নিজের বিশ্বাস হারানোর নিঃস্বতা। যে নিঃস্বতার ভার বহনে অক্ষম জীবন তাকে প্ররোচিত করে স্বেচ্ছায় জীবনাবসানে। স্ট্রেচারে শুয়ে ছটফট করা লোকটার অন্দরে যাওয়া হয় না আমার। ফুরসত মিলে না। ঘরে ফেরার তাড়া।
ফিরতে ফিরতে আমার আবার খোদেজার কথা মনে পড়ে। আচ্ছা তিনি যখন ভিক্ষা করেন, তখন তার মেয়েটি কী করে? সংসার আগলায়? পুকুরঘাটে সন্তানকে সাবান ঘষে ঘষে গোসল করায়? এনামেলের হাঁড়িতে টগবগিয়ে ফুটতে থাকে ভাত। আর তার গন্ধ পেটের ক্ষিধে ছুঁয়ে চরাচরে জানিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতে এখনও জীবন্ত মানুষ বাস করে। যে মানুষের গর্ভধারিণী ভিক্ষে করে খায়, অথচ সন্তানের জীবনে কোনো ভাঁজ পড়ে না! একতরফা ভাবছি হয়তো! হয়তো সে মেয়েও নাচার। অনটনের সংসারে মায়ের একবেলা খোরাকিও খোঁটার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার, কিংবা তার নিজের ভাতেরই অনিশ্চয়তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কে জানে! আমার অ্যালেক্সকে মনে পড়ে হঠাৎ। গুডবাই লেনিন মুভির আ্যালেক্স। মাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা তার, মাকে কী করে জানাবে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির পতনের কথা! অথচ এই মা অসুস্থ হয়েছিল ছেলের ওপর নির্যাতন দেখে। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কের রসায়নটা কী! আউটসাইডারে ক্যামু কি নিজেকে এঁকেছেন? মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ির যে সম্পর্ককে আমরা মহত্ত্ব দিই তাকি কেবলই জৈবিক? মানবতা আমাদের আরোপিত। আমরা আরোপ করি কারণ সভ্যতার সাথে আমরা মানবতা অর্জন করেছি, উপজাত নয় কষ্টার্জিত। কষ্টার্জিত এই মানবতার জন্য আমরা আরও কষ্ট করি। মানবতার জন্য কষ্ট পাই। সে কষ্ট নিজের মায়ের জন্য যতটা, ততটা ইজিবাইকে সহযাত্রী নারীটির জন্যও।
আমার আটপৌরে জীবন নিয়ে বেদনার শেষ নেই। নিত্য চিনিছাড়া রং চা আর টোস্ট খেয়ে সাতসকালে দৌড়। ছাত্র পড়ানোর শেষে অন্ন ব্যঞ্জন। পরিবারের দায়িত্ব, অনস্বীকার্য সামাজিক দায়িত্ব। ঘরে চাল নেই কিংবা চিনি নেই। বাচ্চারা ছোট মাছ খায় না, একটা মুরগি দরকার। দু'দিন হাউস টিউটর আসছে না। একটা ফোন দিতে হবে। আবার প্রিন্সিপালের ফোন, লাইব্রেরিতে কী কী বই কিনতে হবে। তালিকাটা দিলেন না যে! ছোট মাছে ধনেপাতা ছেড়ে দিয়ে তালিকাটা মেইল করি দ্রুত। খেতে খেতে রিহার্সাল টাইম নক করতে থাকে। টায়ার্ড হয়ে ফিরতে ফিরতে রাতের রান্না, এর মাঝে উঁকি দেয় দুয়েকজন মেহমান, চা-নাশতা। টেবিল থেকে আকুল হয়ে ডাকতে থাকে নারায়ণ সান্ন্যালের অরণ্যদ ক। কয়েক পাতা এগোতেই সকাল তাড়া দেয়, উঠতে হবে ভোরে, ঘড়ি ধরে দৌড়াতে হবে। আহা দৌড়, আহা দৌড়। আটপৌরে জীবনের দৌড়।
আমি কী আকুল হয়ে নদীর এপারের মতো ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, দেখি আমার লেখক বন্ধুরা আলো করে আছে সাহিত্য সভা, একই পোশাক কোডের পাঠচক্র। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করছে সুখী সুখী সফল জীবন, বুঝি আমার জীবনই বঞ্চিত কেবল। আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা সংসার সমরাঙ্গনে!
শুনতে খুব কি বেখাপ্পা শোনায় যে আমার নিস্তরঙ্গ আটপৌরে দৌড়ের জীবনে এক বিরাট তরঙ্গ তোলা ঢেউ ছিল এই প্যানডেমিক! হঠাৎ পাওয়া ছুটি, উৎকণ্ঠা উদ্বেগময় মুহূর্ত, মৃত্যুর বিভীষিকা গ্রাস করা দিন হয়ে উঠল আমার আটপৌরে স্থির জীবনের উচ্ছল উন্মত্ত ঢেউ। আমি আবিস্কার করলাম এক অচেনা যাপন। এই যাপন অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ ব্যতিক্রম। নিত্য যাপন ভেঙে চুরমার করে প্রতিটি মুহূর্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। অনিশ্চিত প্রতিটি দিন গলায় আটকে থাকে অসহনীয় দমবন্ধতায়। এ আমার আটপৌরে দিন নয় একদম। অচেনা। একদম অচেনা।
টিকা আসে। প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ। ডেলটা, ওমিক্রন, আবার টিকা বুস্টার। ব্যতিক্রম যাপন পেরিয়ে আমাদের আবার আটপৌরেতে ফিরে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা। প্রতিদিন মৃত্যু, প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া দেখে দেখে ক্লান্ত আমরা, প্যানিক আমরা প্রাণপণে ফিরতে চাইছিলাম আটপৌরেতে। খুব অপ্রিয় একঘেয়ে আটপৌরে কত যে কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছিল তখন! আতঙ্কে নিস্তব্ধ পথঘাটে আমরা আবার ফিরে চাইছিলাম জনসমাগম। প্রাণপণে ফিরতে চাইছিলাম আটপৌরেতে।
মূলত আটপৌরে আছে বলে আমরা ব্যতিক্রমের জন্য অপেক্ষা করি। ব্যতিক্রম যখন জখম করে আটপৌরের পাড়, আঁচল। আমরা আটপৌরের মূল্য উপলব্ধি করতে পারি। আটপৌরে আছে বলেই ঢাকাই শাড়ির অপেক্ষা আছে। প্রতিদিন ঢাকাই শাড়ি হলে ঢাকাই শাড়ি যে আটপৌরে হয়ে উঠত, তখন কই খুঁজতাম আমরা অপেক্ষার আনন্দ? ঝলসে ওঠার আনন্দ।
আটপৌরে দিনে আমি এখন খোদেজার একটা ফোনকলের অপেক্ষা করছি। যার চোখে আমার মায়ের মতো ছানি পড়েছে।

বিষয় : প্রচ্ছদ আটপৌরে

মন্তব্য করুন