
বাংলাদেশের একাত্তরের আন্তর্জাতিক পরিসরের নানা বিষয় নিয়ে অনেক বেশি এবং অনেক রকম কথা আমরা শুনে থাকি। বস্তুতপক্ষে অনেক সময় এ বিষয়ে পড়তে গেলে মনে হয় যেন এটা ঠান্ডা যুদ্ধ অর্থাৎ 'কোল্ড ওয়ারের' একটা অংশ, এটা ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের একটা অংশ বা আন্তর্জাতিকভাবে আরও যে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ছিল- এটা সেগুলোর অংশ, কিংবা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সঙ্গে পুঁজিবাদী দুনিয়ার দ্বন্দ্বের একটি অংশ ইত্যাদি। এবং এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের নিজের যে পক্ষ অর্থাৎ বাংলাদেশিরা- তাদেরকে সরাসরি খর্ব করা হয়; তাদেরকে ছোট করা হয়, হ্রস্বকরণ করা হয় তাদের অংশগ্রহণের মৌলিকতাকে।
এর একটা কারণ হয়তো এটা যে, অনেকেরই এই কথাটা বলার বা ভাবার আত্মবিশ্বাসটা নাই যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাংলাদেশের জনযুদ্ধ যা-ই বলি না কেন এটা অনেকগুলো মানুষের, অনেকগুলো শক্তির একটা যৌথ মিলিত একটা প্রয়াস-প্রচেষ্টা। এবং সেখানে আন্তর্জাতিক শক্তি অবশ্যই ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কোনো ভূমিকাই আন্তর্জাতিক শক্তি পালন করতে পারত না যদি বাংলাদেশের মানুষ নিজেরা সংগ্রাম না করত। বিভ্রান্তিবশত আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা নিজেদেরকে বড় করতে গিয়ে বা ভাবতে গিয়ে পৃথিবীর অনেক বিষয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ করছি। আমার মতে, বরং উল্টোটা করে আন্তর্জাতিক যে পরিপ্রেক্ষিতগুলো আছে সেটার স্থানীয়করণ করে দেখা দরকার যে, একাত্তর সালে যেই যুদ্ধটা হয়েছিল- সেখানে তাদের ভূমিকাই উল্টো কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধের মাধ্যমে। প্রতিরোধটা ছিল বিভিন্ন ধরনের। সরাসরি এবং সক্রিয় প্রতিরোধ যেমন ছিল, প্রতিক্রিয়াও ছিল। বাংলাদেশিদের এই প্রতিরোধের মাধ্যমে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যেটা থেকে আন্তর্জাতিক শক্তিরাও বের হয়ে আসতে পারেনি। এবং আমার মনে হয় সেই কারণেই আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চায় আন্তর্জাতিকীকরণের একটু বেশি প্রভাব দেখা যায়। এ ছাড়া আমাদের মতো কৃষক সমাজে যখন মধ্যবিত্ত তৈরি হয়, তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটু আত্মমর্যাদাবোধ কম থাকে, তাদের মধ্যে পরমুখীনতাই বেশি দেখা যায়। এবং এর প্রভাব আমাদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
আমরা যখন একাত্তর সালের আন্তর্জাতিক শক্তি ও অবস্থা সম্পর্কে কথা বলতে যাই, আমরা তিন-চারটা দেশের কথা বলি। কিন্তু সারা দুনিয়ার প্রতিটা দেশের কে কী করেছিল সেটা তো বলি না। আমরা বলি যে, মার্কিনরা কী করেছিল এবং মার্কিনদের গালি দেই। মার্কিনদের সহায়ক হিসেবে চীন কী করেছিল তা নিয়ে আমরা কথা বলি। এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কী করেছিল তা নিয়ে কথা বলি যে, তারা আমাদের পক্ষে ছিল, ভারতের সঙ্গে ছিল ইত্যাদি। আর ভারতকে আমরা আমাদের যুদ্ধের অংশ মনে করি, যেহেতু তাদের সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধের যৌথবাহিনী গঠিত হয়েছিল। এবং পাকিস্তানকে সরাসরি আমরা শত্রু মনে করি, তবে এটাকে বিদেশ নয় অনেকটা দেশীয় পক্ষ মনে করি। এই যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত আর পাকিস্তান- কয়টি দেশের মধ্যেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ। তবে আমি যে ধরনের গবেষণা ও বিশ্নেষণের ধারায় হাঁটাচলা করি, তাতে সবগুলোই হচ্ছে বিদেশ। ভারতও বিদেশ, চীনও বিদেশ, পাকিস্তানও বিদেশ। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে আলাদা এ কারণে যে তারা আমাদের দেশকে দখল করে রাখা বিদেশ। আমরা দখলকৃত হয়েছি বিদেশি শক্তির দ্বারাই।
আমি যত দলিল পড়েছি, বিশেষ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের যে গোপন দলিলগুলো আছে, চীন সম্পর্কে যেসব নথিপত্র আছে এবং জাতিসংঘের দলিল আর অন্যান্য যে সমস্ত দলিল পাওয়া যায়- তাতে যেটা মনে হয় এক. বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়ে যাবে এই ব্যাপারে কারও দ্বিমত ছিল না। এটা অবধারিত হিসেবেই মেনে নেওয়া হয়েছিল। মূলত ২৫ মার্চের পরে এটা ক্রমেই পরিস্কার হতে থাকে যে, এই দেশটা স্বাধীন হবেই। তার একটি উল্লেখ আমি পাই- আমার সঙ্গে ভারতের এককালের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, একাত্তরে তাকে ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশের সাথে কথা বলতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বিভিন্ন দেশ বলেছিল, বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে এটা আমরা মেনেই নিয়েছি, কিন্তু আপনারা পাকিস্তানকে দখল করবেন না। এটাই ছিল কেবল বিদেশি বিভিন্ন পক্ষের চাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের কারও কোনো দ্বিধা ছিল না। মার্কিন দলিলগুলো পড়লে বোঝা যায় যে, তারা মূলত যে চেষ্টাটা করছিল- তা হলো আন্তর্জাতিকভাবে তারা যেন এই দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে। কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের এত নেতিবাচক ছিল যে, তাদের অন্য আর কোনো যুদ্ধ যার সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের সংশ্নিষ্টতা নেই সেটার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ার কোনো আগ্রহই ছিল না। অতএব খুব সক্রিয় হয়ে তেড়ে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছে, তা না বলে আমি বলব যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি। তারা পাকিস্তানকে যে সহায়তা করেছে, তবে সেটা বাংলাদেশের বিপক্ষ হিসেবে নয়। তারা পাকিস্তানকে সহায়তা করেছে নিজেদের স্বার্থে- কারণ পাকিস্তান তখন চীনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার- অনেকে যে কথাটা বলেন যে, পাকিস্তান অনেক বড় ভূমিকা পালন করে চীনকে তাদের কাছে টেনে এনেছে, বাস্তবে তা নয়। হয়তো একটা দুটো টেলিফোন। আমি দলিলপত্র দেখেছি; সেখানে এমন কিছু বলা হয়নি যে পাকিস্তানের কারণেই চীনের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছিল। তবে যতটুকুই হয়েছে তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল। কিন্তু চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষাটা ছিল তার নিজের জন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাই হচ্ছে সেদিনের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে একটা বড় বাস্তবতা।
দ্বিতীয়ত, এই চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাটাই বলি, যে কথা হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও আছে যে, অক্টোবরে তারা বলেই দিয়েছে যে, আমরা যুদ্ধে জড়িত হব না। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে যেটা ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের অভিযোগ আকারে এসেছে যে, আপনি তো জানতেন যে চীন আসবে না, এটাও জানতেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আপনার হয়ে যুদ্ধ করতে আসবে না- তাহলে কেন আপনি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে গেলেন!
অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হবার কোনো আগ্রহ ছিল না।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইন্দিরা গান্ধীকে তারা পুরোপুরি সহায়তা দিচ্ছে। কেন তারা সহায়তা দিচ্ছে? এক হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী বা ভারত হলো পাকিস্তান-বিরোধী। এবং চীন যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে- সেক্ষেত্রে তার যুদ্ধ হতে পারে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। সেখানে ভারত বা পাকিস্তানের যুদ্ধ তার কাছে বড় বিষয় নয়। অতএব সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো একটা ক্ষুদ্র সমস্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের যতটা না চিন্তা ছিল তার চেয়ে বড় বেশি চিন্তা ছিল তারা চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে সামলাবে তা নিয়ে।
আমি ভারতীয় আরও বেশ কিছু সাক্ষাৎকার পেয়েছি যেখানে তারা বলছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রথম পর্যায়ে আগ্রহী ছিল না। আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত শান্তি চুক্তির পর তারা এখানে মনোনিবেশ করলেও তেমন আগ্রাসীভাবে নিযুক্ত হয়নি। ভারতীয় অনেক দলিলে আছে যে, রাশিয়া বাধ্য হয়েছিলো মূলত ইন্দিরা গান্ধীর চাপে।
বস্তুতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাটাই তখন রাশিয়ার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টা সেখানে মৌলিক ছিলো না। তাছাড়া মার্কিন দলিলে যেটা পেয়েছি, যুক্তরাষ্ট্রই বলছে যে সোভিয়েত ইউনিয়নও এমন একটা যুদ্ধ চায় না। আরেকটা কথা আছে যেটা অবশ্য পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও চলে, তা হলো মার্কিন দলিল বলছে যে, বাংলাদেশের হওয়া না হওয়াটাকে তারা [রাশিয়া] তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করছে না। অন্যদিকে আবার অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার বই 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা'তে লিখেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা দুশ্চিন্তা ছিল যে গরিব আরেকটা রাষ্ট্র যদি জন্ম নেয় সাম্র্রাজ্যবাদীদের সেই দেশকে দখল বা কব্জা করতে বেশ সুবিধা হয়। সেই দিক থেকে দেখলে এটা হতেও পারে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নও চাইছিল না বাংলাদেশের জন্ম হোক।
এই যে এতগুলো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাকি রইল ভারত আর পাকিস্তান। সমস্ত পরিসরের মধ্যে দুইটা দেশ সরাসরিভাবে যুদ্ধে আগ্রহী ছিল। একটা হচ্ছে ভারত; সে যুদ্ধ করে পাকিস্তানের অর্ধেক অংশকে শেষ করবে। যার জন্য সে ১৯৪৭ সাল থেকেই কমবেশি চেষ্টা চালিয়ে আসছে। অন্য দেশটি হচ্ছে পাকিস্তান। যে এই অংশটাকে দখল করে রেখে জীবন চালাবে। তার আশা ছিল যদি আর দুই সপ্তাহ দখল করে রাখতে পারে, তখন জাতিসংঘের মাধ্যমে একটা 'সিজফায়ার' বা যুদ্ধবিরতির ভোট হয়ে যাবে। যুদ্ধবিরতিটা হয়ে গেলে যা অবস্থা তাই চলতে থাকবে এবং পাকিস্তানের এক ধরনের বিজয় হবে। আর পাকিস্তানের যে সেনাবাহিনী সরকার- সেই সরকারের ক্ষমতাটা আরেকটু হালাল হবে। এই হচ্ছে একাত্তরের আন্তর্জাতিক শক্তি সম্পর্কে আলোচিত হওয়া কয়েকটি দেশের বিষয়-আশয়।
কিন্তু এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্তর্জাতিক পরিসরের আলোচনায় যে শক্তিটার কথা আমরা একেবারেই বলছি না বা এড়িয়ে যাচ্ছি- সেটা হলো বাংলাদেশের নিজের শক্তি। পরাশক্তির যে রাজনীতি ছিল, সেটি ধরি মাছ না ছুঁই পানির রাজনীতি। প্রতিটা দেশের ক্ষেত্রেই এ কথাটা খাটে, ভারত আর পাকিস্তান বাদ দিয়ে। কিছু কিছু আওয়াজ তারা করেছে- যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছে। করেছিল কারণ তাদের চিন্তা ছিল যে বামপন্থিরা ঢুকছে। খন্দকার মোশতাকের লোকেরা বলেছিল যে, মুজিব বাহিনী বলতে যেটা বোঝায় অর্থাৎ বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি- এরা সব বামপন্থি, এরা সবাই খুব সক্রিয় হয়ে গেছে। এই বলে এরা একটা ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে যে ভয় পেয়েছে তার এমন কোনো প্রমাণ নেই। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানত যে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যখন তারা কথাবার্তা বলছে, তখন যুদ্ধ এতদূর এগিয়ে গেছে যে, স্থানীয়ভাবে এসব ছোটখাটো ষড়যন্ত্র করে পরিস্থিতি পাল্টানো যাবে না। তবে তারা এটাকে মদত দিয়ে গেছে। এ রকমটা তারা করেই থাকে। কিন্তু যুদ্ধের মূল পরিস্থিতিতে এইটার প্রভাব সীমিত ছিল। অন্যদিক দিয়ে ভারতীয় দলিলেও যেটা এমন কোনো বড় বিষয় হিসেবে আসেনি। অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিনিদের যে প্রভাব ছিল- এটাও সীমিত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব যতটুকু ছিল- সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্নিষ্টতা ইত্যাদি ছিল। কিন্তু সিপিআইয়ের নিজের ট্রেনিং ক্যাম্প খুলতে হয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। তার মানে এতটাই সবল ছিল ইন্দিরা গান্ধী অর্থাৎ মুজিবনগর সরকার যে, তারা চাইছিল না সিপিআই-কমিউনিস্ট পার্টি বা সোভিয়েতপন্থিরা প্রশিক্ষিত হোক। যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব অতটা থাকত, তাহলে তাদের লোকেরাই হতো সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত। কিন্তু সে পরিমাণে তারা প্রশিক্ষিত হয়নি। তারা সম্ভবত একটা যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করার সুযোগটা পেয়েছে- কিন্তু ততদিনে যুদ্ধ তো শেষ হয়েই গেছে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের একাত্তরের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের এই ধারণাগুলো কিন্তু আমরা বেশি বেশি করি- কারণ আমাদের এক ধরনের ভালো লাগা আছে; এসব বলতে এবং ভাবতে আমাদের ভালো লাগে যে, একাত্তরে আন্তর্জাতিকভাবে একটা বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল- কিন্তু সেটা এমন না যে, পৃথিবীর বড় দেশগুলোর জন্য এটা একটা বিশাল সংকট ছিল।
ভারত যে যুদ্ধে প্রবেশ করবে সেই সিদ্ধান্ত সে আগেই নিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তান যে একটা কিছু করতে বাধ্য হবে সেই পরিকল্পনাও ভারত আগেই নিয়েছে। পাকিস্তান সেটা করতে পারেনি। কিন্তু ডিসেম্বরে যখন যুদ্ধটা শুরু হলো এবং তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর প্রেরণ নিয়ে আমরা যে কথাগুলো বলি- কোনো দলিলে আমি পাইনি যে, সপ্তম নৌবহর এখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আসছিল। এবং কারও যদি ইচ্ছা হয়, আমার সম্পাদিত 'বাংলাদেশ একাত্তর'-এর চতুর্থ খণ্ডে ভারতীয়দের সাক্ষাৎকারগুলো পড়ে দেখলে বুঝতে পারবে যে, ভারতীয়রাও মনে করেনি যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের যুদ্ধে যোগ দিতে আসছে। এবং আমাকে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা-বিষয়ক উপদেষ্টাও বলেছিলেন যে, 'আমরা তো জানতাম যে ওর তো ফায়ারিং অর্ডারই নাই। অর্থাৎ যুদ্ধ করার জন্য ও আসছিল না'। বাংলাদেশের সোভিয়েতপন্থিরা এটাকে খুব বড় করে দেখে, কারণ এটাকে তারা রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা প্রক্সি যুদ্ধের মতো করে দেখে। ভারতও জানত যে এটা কেবল দেখাবার জন্য করা হচ্ছে। সামনে থেকে হয়তো বলা হয়েছে যে, এই এসে গেল- পাবলিক মবিলাইজেশনের জন্য যেটি বলা হয়েই থাকে। কিন্তু যারা বিশেষজ্ঞ- সেটা সুব্রামানিয়ম হোক, দীক্ষিত হোক বা অন্য কেউ হোক- সেটা কবিলাল হোক বা অন্য যেসব বড় বড় নেতা, আমলা ছিলেন বা সেনাবাহিনীর লোক হোক- জগজিৎ সিং অরোরা, মানেকশ, জ্যাকব এমন অনেকেই ছিলেন- এদের কারও কথায় বা লেখায় এটা পাওয়া যায় না যে, ওইটার জন্য ভারতের পুরো যুদ্ধে হেরে যাবার আশঙ্কার কথা। কারণ ভারত পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
[ক্রমশ]
মন্তব্য করুন