
বেড়ালতমা, লেখক-হাসান মাহবুব, প্রকাশক-পেন্ডুলাম, প্রচ্ছদ-সিপাহী রেজা, মূল্য-২৮৫ টাকা
বেড়ালতমার কথক মনুষ্যত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়। হাসান মাহবুবের লেখায় প্রধান চরিত্রগুলোর ভেতর যা সহজাত। তবে এখানে আরও খানিকটা জল গড়িয়েছে। 'বেড়ালতমা' দেখিয়েছে, মনুষ্যত্বকে প্রত্যাখ্যানের যে চেষ্টা তা মূলত মনুষ্যত্বে ফিরে আসারই পথ। যেন একটা মানুষ বাড়ি থেকে পালাচ্ছে, কারণ সে বাড়িতে ফিরে আসতে চায়। উপন্যাসটা এই পথে দার্শনিক অভিপ্রায়ের, বলা যায়।
'বেড়ালতমা'র যে কাবেরিনগর, সেই শহর তার নাগরিকদের জীবন-যাপন দুরূহ করে রেখেছে। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে যেমন শারীরবৃত্তি দুরূহ, শহরের মৃত্যুর সময়ও নাগরিকদের শহরবৃত্তি দুর্বহ হয়ে ওঠে। সেই অর্থে বলা যায়, কাবেরিনগর মৃত্যুপথযাত্রী। তার প্রাণময়তা প্রকাশ করার যে অল্প ক'টা জায়গা এখনও টিকে আছে, তার একটা হলো ঝিনুক হ্রদ। সেখানে এখনও সম্পর্কবিচরী প্রেমিক-প্রেমিকাদের সমাবেশ ঘটে। বয়স্ক আর শিশুরাও সেখানে আসে। দেখা যাচ্ছে ওটা সম্পর্কের বিচরণক্ষেত্র।
একটি বিশেষ পক্ষ ঝিনুক হ্রদের এই বিচরণক্ষেত্র নষ্ট করতে চায়। তার সূত্র ধরে শহরকে ধ্বংস করতে চায়। এই ধ্বংসকে এগিয়ে আনার জন্যে সেই পক্ষ অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয়। এই পর্যায়ে উপন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের অবতারণা হয়েছে। গোলাপের খামারে বিরতিহীন তৈরি হতে থাকে কালো গোলাপ। এবং কৌশলে সেই গোলাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলা হয় তাদের ভেতর, যাদের মধ্যে নিবিড় মধুর সম্পর্ক বজায় আছে।
যা কালো, তার সব রঙের অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিতি একটা কৃষ্ণগহ্বরের মতো। যেখানে যা আলো, তা সে শুষে নেয়। সম্পর্কের আলো শুষে নেওয়া এই কালো গোলাপের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বীভৎস। উপন্যাসের কথককে এই কালো গোলাপের খামারে কাজ করতে হয় বিধায়, আমরা এর ভেতরটা দেখতে পাই। গোলাপের উপকরণ হিসেবে তিনি মানুষের হৃদপিণ্ড কেটে বার করছিলেন।
হাসান মাহবুব শব্দের ক্ষমতা সম্বন্ধে সাবধান। নয়তো তিনি বীভৎসতা আরও বাড়াতে পারতেন। তীব্রতার স্বার্থে আমি বীভৎসতার দৃশ্যমানতা তৈরিকারী আরও শব্দের অভাব বোধ করেছি। ওই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, আমার ভেতর থেকে অন্য আমিকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সেই আমি কাবেরিনগরের নৃশংস পরিবেশে বসবাসের উপযুক্ত। উপন্যাসে কথক যেন কদর্য সুন্দরের উৎকৃষ্ট উকিলে পরিণত হচ্ছে। আমার মতোই, সেও একটা দুঃস্বপ্টম্ন কৌতূহল নিয়ে দেখে যাচ্ছিল। আমাদের বিবেকি সত্তা স্বপ্টেম্নর বাইরে ছটফট ছটফট! এমন স্পর্শকাতর সময়ের আশ্রয় বেড়ালতমা; উপন্যাসের নাম-প্রটাগনিস্ট।
বেড়ালতমা ছিল সন্তানকেন্দ্রিক সাংসারিকতার স্বপ্ন দেখা মানুষ। একটা স্থির আয়ের নিশ্চয়তা, ছাদ খুঁজত। কিন্তু কথকের প্রাণসংশয়ী সবচেয়ে বড় বিপদে হাতের রগ ফুলিয়ে যে শক্তিশেল ছুড়েছিল, সে কিন্তু আগের মানুষটা নয়। যেন তার পুনর্জন্ম হয়েছে। সুস্থ সাপের মতো যে নিজেই ছাড়াতে পেরেছে নিজের খোলস।
ধারণা করা যায়, বেড়ালতমায় সাপ এসেছে বিশেষ সুমেরীয় পৌরাণিক তাৎপর্য নিয়ে। আদম-হাওয়াকেন্দ্রিক পুরাণের উত্তরাধিকারী ধর্মগ্রন্থগুলো যা করেছে, তা হলো স্বর্গে সাপের মাধ্যমে শয়তানকে আনিয়ে সাপকে করেছে ব্রাত্য। 'বেড়ালতমা' সে সাপের প্রতি মমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছে। লেখক যেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতবর্ষের পথ দেখালেন।
সুমেরীয় পৌরাণিকতা মেনে এখানে কথক (আদম) আছে, বেড়ালতমা (হাওয়া) আছে, চলে এসেছে সাপও। আর এমন সময়ে সাপ আত্মপ্রকাশ করছে যখন বেড়ালতমা 'হবা' বা 'হাওয়া' থেকে বিকশিত হয়ে হলেন 'লিলিথ'। যিনি প্রকৃত 'প্রথম নারী'।
কাবেরিনগরের পর সাপের খামার অধ্যায় হলো একটু শ্বাস ফেলার মাঝবিরতি। এখানে নরকের ভেতর স্বর্গ যাপনের স্বাদ পেলাম। পরাবাস্তব ধূসর জোছনায় সাগরপাড়ে বেড়ালতমাকে নিয়ে বেড়ালাম, মদ পান করলাম। তবে ডিসটোপিয়ান ছুটি নিশ্চয়ই ফুলেল সুবাস ছড়িয়ে শেষ হবে না। হয়ওনি।
ওইটুকু ছুটির পর, যাহোক, আবারও মহাযাত্রা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দম্পতি যত বেশি শক্তি সংগ্রহ করবে, তত বেশি নরকের উপযুক্ত হয়ে উঠবে, এটা অনিবার্য। সুতরাং কথক আর বেড়ালতমার চরিত্র-বিকাশ শেষ পর্যন্ত তাদের নরকের ট্রেনে চড়াবে এটা অবধারিত ছিল। 'বেড়ালতমা'য় আমরা এক অভিনব নরক দেখতে পেলাম, বর্ণনার চেয়ে যা বুদ্ধিদীপ্ত। পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যথা সেখানে চক্রবৃদ্ধিতে বাড়ে। মানুষ তার বেদনাবোধের জ্বালানি।
উপন্যাসের শেষে এক 'আয়নার' সামনে দাঁড়ানো যায়। উপন্যাসের নাম 'বেড়ালতমা' কেন- সে উত্তর এখানে পাওয়া যায়।
গোলাপবাগানের মধ্যস্থতাকারীর সংলাপে আরও স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারতেন লেখক। আর গোলাপবাগানের বহুরূপী মালিকটির মন কী করে কালো হয়ে উঠল? এর পেছনে কোনো গল্প আছে। জানতে চাই। সেই গল্পের ভেতর কাবেরিনগরের ভবিষ্যৎ এন্টাগনিস্টদের বধসূত্র লুকিয়ে আছে।
'বেড়ালতমা'র যে কাবেরিনগর, সেই শহর তার নাগরিকদের জীবন-যাপন দুরূহ করে রেখেছে। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে যেমন শারীরবৃত্তি দুরূহ, শহরের মৃত্যুর সময়ও নাগরিকদের শহরবৃত্তি দুর্বহ হয়ে ওঠে। সেই অর্থে বলা যায়, কাবেরিনগর মৃত্যুপথযাত্রী। তার প্রাণময়তা প্রকাশ করার যে অল্প ক'টা জায়গা এখনও টিকে আছে, তার একটা হলো ঝিনুক হ্রদ। সেখানে এখনও সম্পর্কবিচরী প্রেমিক-প্রেমিকাদের সমাবেশ ঘটে। বয়স্ক আর শিশুরাও সেখানে আসে। দেখা যাচ্ছে ওটা সম্পর্কের বিচরণক্ষেত্র।
একটি বিশেষ পক্ষ ঝিনুক হ্রদের এই বিচরণক্ষেত্র নষ্ট করতে চায়। তার সূত্র ধরে শহরকে ধ্বংস করতে চায়। এই ধ্বংসকে এগিয়ে আনার জন্যে সেই পক্ষ অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয়। এই পর্যায়ে উপন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের অবতারণা হয়েছে। গোলাপের খামারে বিরতিহীন তৈরি হতে থাকে কালো গোলাপ। এবং কৌশলে সেই গোলাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলা হয় তাদের ভেতর, যাদের মধ্যে নিবিড় মধুর সম্পর্ক বজায় আছে।
যা কালো, তার সব রঙের অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিতি একটা কৃষ্ণগহ্বরের মতো। যেখানে যা আলো, তা সে শুষে নেয়। সম্পর্কের আলো শুষে নেওয়া এই কালো গোলাপের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বীভৎস। উপন্যাসের কথককে এই কালো গোলাপের খামারে কাজ করতে হয় বিধায়, আমরা এর ভেতরটা দেখতে পাই। গোলাপের উপকরণ হিসেবে তিনি মানুষের হৃদপিণ্ড কেটে বার করছিলেন।
হাসান মাহবুব শব্দের ক্ষমতা সম্বন্ধে সাবধান। নয়তো তিনি বীভৎসতা আরও বাড়াতে পারতেন। তীব্রতার স্বার্থে আমি বীভৎসতার দৃশ্যমানতা তৈরিকারী আরও শব্দের অভাব বোধ করেছি। ওই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, আমার ভেতর থেকে অন্য আমিকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সেই আমি কাবেরিনগরের নৃশংস পরিবেশে বসবাসের উপযুক্ত। উপন্যাসে কথক যেন কদর্য সুন্দরের উৎকৃষ্ট উকিলে পরিণত হচ্ছে। আমার মতোই, সেও একটা দুঃস্বপ্টম্ন কৌতূহল নিয়ে দেখে যাচ্ছিল। আমাদের বিবেকি সত্তা স্বপ্টেম্নর বাইরে ছটফট ছটফট! এমন স্পর্শকাতর সময়ের আশ্রয় বেড়ালতমা; উপন্যাসের নাম-প্রটাগনিস্ট।
বেড়ালতমা ছিল সন্তানকেন্দ্রিক সাংসারিকতার স্বপ্ন দেখা মানুষ। একটা স্থির আয়ের নিশ্চয়তা, ছাদ খুঁজত। কিন্তু কথকের প্রাণসংশয়ী সবচেয়ে বড় বিপদে হাতের রগ ফুলিয়ে যে শক্তিশেল ছুড়েছিল, সে কিন্তু আগের মানুষটা নয়। যেন তার পুনর্জন্ম হয়েছে। সুস্থ সাপের মতো যে নিজেই ছাড়াতে পেরেছে নিজের খোলস।
ধারণা করা যায়, বেড়ালতমায় সাপ এসেছে বিশেষ সুমেরীয় পৌরাণিক তাৎপর্য নিয়ে। আদম-হাওয়াকেন্দ্রিক পুরাণের উত্তরাধিকারী ধর্মগ্রন্থগুলো যা করেছে, তা হলো স্বর্গে সাপের মাধ্যমে শয়তানকে আনিয়ে সাপকে করেছে ব্রাত্য। 'বেড়ালতমা' সে সাপের প্রতি মমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছে। লেখক যেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতবর্ষের পথ দেখালেন।
সুমেরীয় পৌরাণিকতা মেনে এখানে কথক (আদম) আছে, বেড়ালতমা (হাওয়া) আছে, চলে এসেছে সাপও। আর এমন সময়ে সাপ আত্মপ্রকাশ করছে যখন বেড়ালতমা 'হবা' বা 'হাওয়া' থেকে বিকশিত হয়ে হলেন 'লিলিথ'। যিনি প্রকৃত 'প্রথম নারী'।
কাবেরিনগরের পর সাপের খামার অধ্যায় হলো একটু শ্বাস ফেলার মাঝবিরতি। এখানে নরকের ভেতর স্বর্গ যাপনের স্বাদ পেলাম। পরাবাস্তব ধূসর জোছনায় সাগরপাড়ে বেড়ালতমাকে নিয়ে বেড়ালাম, মদ পান করলাম। তবে ডিসটোপিয়ান ছুটি নিশ্চয়ই ফুলেল সুবাস ছড়িয়ে শেষ হবে না। হয়ওনি।
ওইটুকু ছুটির পর, যাহোক, আবারও মহাযাত্রা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দম্পতি যত বেশি শক্তি সংগ্রহ করবে, তত বেশি নরকের উপযুক্ত হয়ে উঠবে, এটা অনিবার্য। সুতরাং কথক আর বেড়ালতমার চরিত্র-বিকাশ শেষ পর্যন্ত তাদের নরকের ট্রেনে চড়াবে এটা অবধারিত ছিল। 'বেড়ালতমা'য় আমরা এক অভিনব নরক দেখতে পেলাম, বর্ণনার চেয়ে যা বুদ্ধিদীপ্ত। পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যথা সেখানে চক্রবৃদ্ধিতে বাড়ে। মানুষ তার বেদনাবোধের জ্বালানি।
উপন্যাসের শেষে এক 'আয়নার' সামনে দাঁড়ানো যায়। উপন্যাসের নাম 'বেড়ালতমা' কেন- সে উত্তর এখানে পাওয়া যায়।
গোলাপবাগানের মধ্যস্থতাকারীর সংলাপে আরও স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারতেন লেখক। আর গোলাপবাগানের বহুরূপী মালিকটির মন কী করে কালো হয়ে উঠল? এর পেছনে কোনো গল্প আছে। জানতে চাই। সেই গল্পের ভেতর কাবেরিনগরের ভবিষ্যৎ এন্টাগনিস্টদের বধসূত্র লুকিয়ে আছে।
মন্তব্য করুন