- কালের খেয়া
- এক টুকরো আয়োজন
এক টুকরো আয়োজন

'আপনাকে যে গোপন কথাটা বলব, তা শুনে চমকে উঠবেন আপনি।'
পেয়ারার টুকরোটা মুখে দিচ্ছিলাম, থেমে রইল তা মাঝপথেই। ঝট করে নয়, আলতো ঘুরে, আড়চোখে, গোপন বার্তার ছেলেটির দিকে তাকালাম। ছোট্ট একটা ধাক্কা খেলাম সঙ্গে সঙ্গে, কোনো জড়বস্তুর সঙ্গে নয়, চোখ আর মনের সঙ্গে। এ প্লেইন বিউটি- যতটুকু ফর্সা হলে একটা মানুষ রোদ-আলোতে মিশে যায়, ছেলেটি তাই।
সোজা হলাম আমি আবার। ভার্সিটির যে ছায়া-মোড়ানো রাস্তা দিয়ে, বাঁ হাতে ছোট্ট পলিথিনে, অতিশয় ঝালমিশ্রিত পেয়ারার টুকরো নিয়ে বাস কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিলাম, পা বাড়ালাম সেদিকে। থেমে থাকা পেয়ারার টুকরোটা চালান করে দিলাম মুখের ভেতর। ঝালটা একটু বেশিই হয়েছে। মৃদু একটা হিস করে, শিস দেওয়ার ভঙ্গিতে ঠোঁট দুটো সরু করে রাখলাম কিছুক্ষণ। ঝট করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলেটাকে ভড়কে দেব, কঠিন কঠিন কিছু কথা বলব তাকে-
'চমকানোর প্রহর কেটে গেছে সেই অনেক আগেই, যেদিন বুঝলাম- নগ্ন আর ক্ষুুধার্ত হয়েই জন্মেছি আমরা, কিন্তু এই নগ্নতা আর ক্ষুধা দিনদিন বেড়েই চলছে আমাদের। এসব নিয়েই বড় হচ্ছি আমরা। এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন।'
'তাই?'
চেহারায় কাঠিন্য, কিন্তু চোখ দুটো হাসি হাসি।
'হ্যাঁ।'
চেহারাটা কঠিন করে ফেলি আমিও।
'কিন্তু চমকানোর আরও অনেক কিছু আছে।'
আমার তত্ত্বে বাগড়া দিল সে-
'আপনি কি জানেন- আমরা কখনোই বড় হই না, আমরা শুধু শিখি কীভাবে মানুষের সামনে নিখুঁতভাবে অভিনয় করতে হয়।'
ভ্রু কুঁচকালাম আমি। কিন্তু সেটা দেখার সুযোগ দিলাম না তাকে। একটু চমকেই উঠলাম- যতটুকু বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম বোকাকৃতির এই ছেলেটাকে, তার চেয়ে বেশিই সে। সম্ভবত আরও বেশি। একটু ধাতস্থ হলাম আমি-
'কিন্তু অভিনয় করেই মানুষ আজকাল বড় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এই অভিনয়কে অনুশীলন করছে।'
পলিথিন থেকে আরেকটা পেয়ারার টুকরো তুলে নিলাম হাতে-
'জানেন তো, অনুশীলন মানুষকে নিখুঁত করে।'
'কিন্তু কোনো মানুষই নিখুঁত নয়।'
পা থামালাম আমি। কৌশলী প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলাম। কিন্তু ব্যক্তিত্বের ধার না কমিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকালাম-
'কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, এটা বিশ্বাস করেন আপনি?'
'নিজেকে আমি বুদ্ধিমান মনে করি না, সুখী মনে করতে চাই। যারা সন্দেহ প্রকাশ করে, তারা বুদ্ধিমান; আর যারা বিশ্বাস করে, তারা সুখী।'
মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি, মুগ্ধতা আঁকড়ে ধরছে আমাকে।
ডান দিকে বাঁক নেওয়া রাস্তাটা পেরোতেই পরস্পরের গা স্পর্শ হতে যাচ্ছিল, ছেলেটা থমকে দাঁড়াল। অনাহূত স্পর্শ এড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। মুগ্ধতা আরও বেড়ে গেল আমার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছুঁতে যাওয়া প্রচলিত কোনো ছেলের উপকরণ তার মাঝে খুঁজে না পেয়ে মনটা ভরে উঠল। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস তার-
'বিশ্বাস ব্যাপারটাই আসলে অন্যরকম। যদি আপনি বলেন, আকাশে দশ হাজার কোটি তারা আছে, সবাই বিশ্বাস করবে তা। কিন্তু সদ্য রং করা কোনো জিনিস দেখিয়ে যদি বলেন, রংটা এখনও কাঁচা আছে, অবিশ্বাস করে সঙ্গে সঙ্গে সবাই সেটা ছুঁয়ে দেখবে।'
পেয়ারার টুকরোগুলো শেষ করে পলিথিনটা ফেলে দিলাম আমি। ভার্সিটির বাস কাউন্টার পৌঁছতে মিনিট তিনেক লাগবে আরও। চুপচাপ কেটে গেল মিনিটখানেক। হঠাৎ কৈফিয়ত চাওয়ার মতো বললাম-
'আচ্ছা, আপনি হঠাৎ-।'
থেমে গেলাম। শেষ করলাম না বাক্যটা। গাছ থেকে একটা ছোট্ট লাল পাতা নিচে নামছিল। মাটির সঙ্গে সৃষ্টির পরম আত্মীয়তা। সেই আত্মিক ছোঁয়া পেতেই কিনা, পাতাটা বেশ নাচার ভঙ্গিতে নিচে নামছিল। এ রকম ঝরা পাতা প্রতিদিনই দেখি ক্যাম্পাসে। মুগ্ধ হইনি, আজ হলাম। কেন হলাম, তার কারণ খুঁজে পেলাম না যদিও।
প্রসঙ্গ বদলালাম আমি-
'আমার বাস দাঁড়িয়ে আছে সামনে, যেতে হবে এখন আমাকে।'
'আমাকেও।'
হাত বাড়িয়ে বাম পাশটা দেখাল সে-
'আপনার বাসের পাশেই একটা বাহন দাঁড়িয়ে আছে আমার, আমি ওটাতে যাব।'
খুব সাধারণ বিষয়ে মুগ্ধ হই আমি, আবার অনেক অসাধারণ বিষয়ও মুগ্ধ করতে পারে না আমাকে। রাস্তায় তো অনেক গাড়ি দেখি আমরা, ছেলেটা যে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, অবিকল তার মতো ফর্সা, অভিজাতও। নাটকীয় প্যাঁচালের মতো সে বলল না- চলুন, আপনাকে পৌঁছে দেই।
অল্প একটু হাত নাড়ল সে কেবল। গাড়িতে উঠে পড়ল তারপর। আমি বাসে। যে গোপন কথাটা শুনে চমকে ওঠার কথা আমার, শোনা হলো না সেটাও।
২.
বাবা যে উকিল সাহেবের চেম্বারে কাজ করেন, তিনি একজন অদ্ভুত মানুষ। মাঝে মাঝেই, সপ্তাহে অন্তত একদিন একগাদা বাজার পাঠিয়ে দেন আমাদের বাসায়। তিনিও সেদিন তার বাসার জন্য বাজার করেন, সঙ্গে বাবাকে নিয়ে যান, তখনই বাবার হাতে আমাদের জন্যও অনেক কিছু কিনে দেন। আজ একটা বড়সড় চিতল মাছ কিনে দিয়েছেন তিনি।
সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছেই দেখি মহা হুলস্থুল ব্যাপার। মা মাছ কাটছে, বাবা পাশে বসে আছেন একটা বই হাতে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওটা একটা রান্নার বই। মাছের ১০১টি সুস্বাদু রান্না। আমাকে দেখেই বাবা উচ্ছ্বসিত হলেন-
'রেবা, তুই আজ চিতল মাছের কোপ্তা রান্না করে খাওয়াবি। অনেকদিন ধরে কোপ্তা খাওয়ার সাধ জেগেছে। কিন্তু আমার তো ওরকম মাছ কেনার সাধ্য নেই!'
বাবার পাশে বেতের মোড়াটায় বসি আমি। হাতের বইটা নিয়ে পাশে রেখে ওই হাতটা আমার দু'হাতের মাঝে আনি। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি, মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটা দেখি মায়ের। মাঝখানে ছোট্ট শব্দে প্রগাঢ় কিছু নিঃশ্বাস। ব্যস, আর কিছু না।
রাহাত ভাইয়া বুয়েটের শেষ পাটটা শেষ করায় ব্যস্ত। হাতির ঝিলের এক অতিশয় ধনীর কন্যাকে সপ্তাহে তিন দিন পড়ায়। সন্ধ্যার পর পড়াতে যায় তাকে। ফেরে বেশ রাতে, অধিকাংশ দিন ওই বাসা থেকে খেয়ে আসে সে। কন্যার বাবা-মা নাকি অনেক পছন্দ করেন ভাইয়াকে। ব্যাপারটা মধুর, কিছুটা আশঙ্কারও। এটা নিয়ে ভাইয়াকে প্রায়ই খোঁচাই আমি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উদার হাসি হাসে ভাইয়া তখন, কিছু বলে না।
ভাইয়া আজও কন্যাকে পড়াতে গিয়েছে। বাবা তার অতি প্রাচীন মোবাইল দিয়ে ফোন করলেন তাকে। আজ একটু কম পড়িয়ে, কোনো কিছু না খেয়ে, বাসায় আসতে বললেন দ্রুত।
রাতে ভাত খাওয়ার আগে বাবা আমাদের নেতিয়ে পড়া মাদুরে এমনভাবে বসলেন, সম্রাট আকবর বেঁচে থাকলে এবং বাবার বসার এই স্টাইল দেখলে নিজের সিংহাসনে বসার স্টাইল দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলতেন। বাবার এক পাশে আমি, আরেক পাশে ভাইয়া। নীলু তিন দিন আগে, ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে, মানিকগঞ্জে খালার বাসায় বেড়াতে গেছে বলে বাবা তার খাওয়াপূর্ব বক্তৃতায় বেশ শোক প্রকাশ করলেন। ছোট মেয়েকে ছাড়া তিনি এ রকম একটা মাছ খাবেন, সেটা তিনি মানতে পারছেন না। ফোনে তিনি নীলুকে কালকেই আসতে বলেছেন, বেশ কয়েকটা মাছের বড় টুকরো তার জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে ফ্রিজে। নীলু কালকেই চলে আসবে। মাছ খাওয়ার লোভে না, পরশু থেকে তার কোচিং, নাসায় চাকরি পাওয়া যায়, এমন একটা সাবজেক্টে নাকি পড়বে সে। বাবা শুনে সে কী খুশি। অথচ আমাদের পড়াতে বাবার কী অক্লান্ত পরিশ্রম! স্যান্ডো গেঞ্জি কেউ কখনও সেলাই করে পরে কিনা জানি না, আমার বাবা পরেন। গেঞ্জি একটু ফুটো হলেই বাবা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেন, মা নিপুণ শিল্পীর মতো সেটা মেরামত করে দেন তা সব যত্ন দিয়ে।
বাবা আমার পাতে একটা কোপ্তা দিলেন। আমি সেটার দিকে তাকালাম। কিন্তু মুখে দিতে নিতেই কেমন যেন থেমে গেলাম। ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ। কপাল কুঁচকে ফেললাম আমি। হঠাৎ তার কথা মনে পড়ল কেন আমার! বাবা অস্থির হয়ে বললেন-
'কিরে, খাচ্ছিস না কেন? কী মজা করেই না বানিয়েছিস কোপ্তাগুলো!
মুখে দিলাম আমি আমার প্লেটের খাবারটা। চাবাচ্ছি, কিন্তু কোনো মজা পাচ্ছি না। বুকের ভেতরটায় কোথায় যেন এক টুকরো কষ্ট জমা হয়ে গেছে। কী জন্য, কীসের জন্য- কোনোভাবেই সেটা বুঝতে পারছি না।
৩.
কার্জন হলের বড় বারান্দার কোনার জায়গাটা খুব প্রিয় আমার। মাঝে মাঝেই ওই জায়গাটায় বসি আমি। লাইব্রেরি থেকে বই এনে ওখানে বসে পড়ি। বেশ নির্জন আর একা একা, ভালো লাগে খুব।
'কাল এত কথা হলো, কিন্তু নামই জানা হলো না আপনার।'
শব্দে চমকে উঠি আমি, বিরক্তও হই। কিন্তু মাথা ঘুরাতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একগাদা বই হাতে ছেলেটা একটু ফাঁকে দাঁড়িয়ে। হাত দিয়ে ইশারা করে পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলি-
'নাম জানা হয়নি আপনারও।'
একটু থামি আমি-
'আর চমকে ওঠার সেই গোপন কথাটিও।'
খুব কসরত করে বারান্দায় বসল সে। বারান্দার এই সমতল জায়গায় বসতে বেশ কষ্টই হচ্ছে তার। খারাপ লাগল। অস্বস্তি নিয়ে বললাম-
'চলুন, অন্য কোথাও বসি।'
বসার বিড়ম্বনা কাটানোর চেষ্টা করল সে। হেসে ফেললাম আমি। পা দুটো মেলে দিল লজ্জা পেয়ে। মাঠে বসার আনাড়িপনায় কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা মনে হলো তাকে। সামনের ছোট বাগানটাতে দুটো প্রজাপতি খেলা করছে, তার মনোযোগ এখন সেদিকে, আমার মনোযোগ তার দিকে।
উঠে দাঁড়ায় সে হঠাৎ-
'বসতে ভালো লাগছে না, চলুন হাঁটি।'
'হাঁটতে ভালো লাগবে আপনার?'
'একা একা ভালো লাগে না।'
সারলিক স্বীকারে হাসতে নিয়েই থেমে যাই। মাথা নিচু করে পথ হাঁটি। কথার চেয়ে পায়ের শব্দ বেশি। কখনও কখনও শিস কেটে কোনো পাখি উড়ে যায় কাছ দিয়ে। চমকে উঠে দুজনই তাকাই সেদিকে, কিন্তু দুজন দুজনের দিকে তাকাই না এক মুহূর্তও।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ আগেই। আমরা একবিন্দুও টের পাইনি অন্ধকার নেমেছিল কখন চারপাশে, আমাদের ঘিরে।
৪.
ঘোলাটে চাঁদের বিষণ্ণ আলোয় বহুদূর চোখ মেলি আমি। এই নির্জনতায় কোনো শিশু ফরমালিন মাখা খাবার খাচ্ছে, বসতি ছেয়ে যাওয়া নকল ওষুধ গলায় ঢুকিয়ে কোনো রোগাক্রান্ত রোগমুক্তের আশা জাগাচ্ছে মনে, গাড়ি চাপায় কেউ পড়ে আছে রাস্তার কোনো কিনারে, জগতের সব কল্যাণ-অকল্যাণে একাকার হয়ে যাচ্ছে পাতা ঝরা বাতাসে- যাই কিছু হোক, আমার আজ কিচ্ছু আসে যায় না। আমি আজ বিরহী। কারণ গত দু'দিন ভার্সিটিতে আসেনি সে।
কোনো কোনো দিন খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। আজ যেমন। আমি আজ পথহারার মতো সমস্ত ক্যাম্পাস ঘুরেছি; অকারণে বসে থেকেছি এখানে ওখানে; ফ্লাস্কে বিক্রি করা চা খাইনি আমি কখনও; আজ দু'কাপ খেয়েছি। কখনও উঁচু স্বরে কথা বলা হয় না আমার, আজ কাকে যেন সামান্য ধমকও দিয়েছি।
নিম্নমধ্যবিত্ত এই আমরা যেসব বাসায় ভাড়া থাকি, সেসব বাসায় কোনো বারান্দা থাকে না। ছোট্ট জানালার ছোট্ট জায়গা দিয়ে আকাশও দেখতে পাই না আমরা কখনও। কেবল মাঝে মাঝে চাঁদ যখন খুব উজাড় করে তার সব আলো ঢেলে দেয়, সেই উপচে পড়া আলোর কিছুটা আমাদের জানালায় এসে উঁকি দেয়। আমরা সেদিন ওটুকু দেখেই পরম তৃপ্তিতে ঘুমাতে যাই।
জানালায় আজ উপচে পড়া চাঁদের আলোর ছটা, আমার তবুও ঘুম আসছে না। সমস্ত বিষাদ অভিমান হয়ে লেপ্টে আছে ঠোঁটে। সেই অভিমান আবার গলে গলে পড়ছে চোখ বেয়ে।
৫.
ক্লাস ছিল, তবুও তিন দিন ক্লাসে যাইনি। এমনি। হয়তো অনাহূত কোনো ভূমিকা। আজ ক্লাসে ঢুকেই মনে হলো- সবকিছু অপরিচিত, অপাঙ্ক্তেয়। স্যারের ওই লেকচার, নোট কিংবা জানালার পাশে যে প্রতিদিন একজোড়া দোয়েল এসে চেঁচামেচি করে, তাও। স্যার কথা বলছেন, সেটা কানে বাজছে না, কেবল হাত নাড়ানো আর দু'ঠোঁটের বদলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখছি।
দ্বিতীয় ক্লাসটা আর করতে ইচ্ছে করছে না। মাথায়ও আসছে না কোনো কিছু। একদম ফাঁকা, হুহু করে বাতাস বইয়ে যাওয়ার মতো মুক্ত। ক্লাসের বাইরে অযত্নে বেড়ে ওঠা অ্যালাম্যান্ডা গাছটা যে বেশ যত্ন করে কয়েকটা ফুল ফুটিয়েছে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ সেদিকে। অকারণে আকাশের দিকেও তাকালাম- ধূসর আকাশ, কেবল মেঘ চিড়ে কোনো যন্ত্র বয়ে যাওয়ার চিহ্ন ফুটে আছে লম্বাভাবে।
সম্ভবত আজ একটু বেশিই সেজে এসেছি আমি। সবাই কেমন যেন ঘুরেফিরে তাকাচ্ছে। কিন্তু কোনো উপলক্ষ মনে দানা বাঁধেনি কখনও। আমাদের স্টিলের আলমারির আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হলো- সবকিছু পরে কপালটায় একটা ফোঁটা দিলে মন্দ হয় না। আমার প্রশস্ত কপালে প্রশস্ত ফোঁটা, রবীন্দ্রনাথ দেখলে নির্ঘাত একটা গল্প লিখে ফেলতেন, জীবনানন্দ হলে কবিতা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আনমনে কার্জন হলের বারান্দার কোনায় এসেছি, বুঝতে পারিনি। চিনতে পারিনি মাথা নিচু করে একটা ইংরেজি নভেল পড়তে থাকা ছেলেটিকে। পায়ের শব্দে নয়, অবয়বের মিহি ছায়ায় নভেল থেকে চোখ ফেরাল সে আমার দিকে। কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আভিমানও; দূর থেকে ভেসে আসা প্রিয় কোনো গানের কলির মতো বলল-
'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
মাথায় সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে গেল আমার। আমার কখনও এ রকম হয় না যদিও। হুহ, নিজেরই দেখা নেই, আবার জীবনানন্দ সাজা হচ্ছে- এতদিন কোথায় ছিলেন, নাটোরের বনলতা সেন। মনে হচ্ছে, কী মনে হচ্ছে স্থির করতে পারলাম না তা কয়েক সেকেন্ডেও।
আবার মনোযোগ দিয়েছে সে বইয়ের পাতায়। সূক্ষ্ণ একটা অপমান এসে আছড়ে পড়ল মনে। ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। আগের মতোই মৃদু স্বরে বলল-
'চলে যাচ্ছেন যে!'
না ঘুরে দাঁড়িয়েই বললাম-
'আপনি তো ব্যস্ত।'
'সেটা তো আপনার জন্য।'
'আমার জন্য!'
'আপনার সঙ্গে কথা বলব বলে অনেক কথা খুঁজে বেড়াচ্ছি এই বইয়ে।'
বইয়ের দু'পাশটা এক করে পাশে রাখল সে-
'তিন দিন আসেননি যে!'
'তিন দিন আমি ভার্সিটিতে আসিনি এটা আপনি জানেন!'
সে না বললেও তার পাশে বসে পড়লাম আমি।
'ভার্সিটিতে এসে ক্লাস না করে তিন দিন ধরেই তো বসে থাকি আমি এখানে।'
কোনো কিছু থেকে নিজেকে লুকোনোর জন্য সম্ভবত পাশে রাখা বইটা আবার হাতে নেয় সে।
বুকের ভেতর মিহি একটা ঠান্ডা বইয়ে যায় দ্রুত। মনটাও শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু সেসব খোলসে ঢেকে কৈফিয়তের ঢঙে বললাম-
'আপনিও তো দু'দিন আসেননি।'
'এসেছিলাম।'
'এসেছিলেন!'
নিজের ব্যক্তিত্বের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে-
'কই দেখলাম না যে!'
মৃদু হাসল সে, কিছু বলল না। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। হাত এগিয়ে দিল আমার দিকে-
'চলুন, আজ সারাদিন যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়াব।'
মানুষটার হাতের দিকে তাকালাম আমি। আমার ইতস্ততা টের পেল সে। সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল হাতটা। তার আগেই আমি ধরে ফেললাম সেটা। কোনো ভালো লাগা থেকে না, স্রেফ সম্মান জানাতে।
হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল-
'নাম জানা হয়নি এখনও আমাদের। আমি জাফির।'
'আমি রেবা।'
'সারাদিন আমরা আজ বাইরে থাকব, আপনার বাবা-মা কিছু বলবেন না তো?'
জাফিরের চোখের দিকে তাকাই আমি-
'ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, বাবা-মা এটা কখন বোঝেন জানেন- যখন ছেলেমেয়ে জানতে চায় না সে কোথা থেকে এই পৃথিবীতে এসেছে, বাসা থেকে বের হলেও বলতে চায় না সে কোথায় যাচ্ছে, বাসায় ফিরেও সে জানাতে চায় না বাসার বাইরে এতক্ষণ সে কী করেছে।'
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সে-
'আজ আপনাকে আমি আমার একটা ইচ্ছের কথা বলব।'
প্রতিধ্বনি করে উঠি আমি-
'ইচ্ছে!'
কিছু বলল না সে। মাথা নাড়ল কেবল।
৬.
বাসায় এসে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রেখেছিলাম আমি সেদিন- দুই মাস একুশ দিন আগে জাফির তার ইচ্ছের কথা বলেছিল আমাকে। খুব মামুলি একটা ইচ্ছে, নিতান্তই সাধারণ, চরাচরে মিশে যাওয়া বাতাসের মতো। কিন্তু আমার কাছে তা ছিল কঠিন, মানসম্মানের, লজ্জার। অনেকটা বিব্রতকর।
ক্লাস নাইনের পাঁচটা মেয়ে এসে পড়ে আমাদের বাসায়। বিজ্ঞান পড়াই আমি ওদের। ওরা এক হাজার করে টাকা দেয় আমাকে। দু'মাসে দশ হাজার টাকা জমিয়েছি। আগেও হাজার সাতেক টাকা জমিয়েছিলাম। মোট সতেরো হাজার টাকা নিয়ে নীলুকে পাঁচ দিন আগে বললাম-
'চল, একটা ডাইনিং টেবিল কিনে নিয়ে আসি বাসায়।'
রসগোল্লার মতো চোখ বড় বড় করে ফেলল নীলু-
'ডাইনিং টেবিল কিনবে, টাকা পাবে কোথায়!'
'কিছু টাকা জমিয়েছি আমি।'
'বাবাকে জানিয়েছ? মাকে?'
'বাবাকে জানাই নাই, কারণ বাবা এতে বিব্রত হবেন। একটা ডাইনিং টেবিল কিনে দিতে না পারায় তিনি কষ্ট পাবেন, সেটা আবার তার সন্তানরা কিনছে ভেবে লজ্জা পাবেন। সুতরাং হঠাৎ করেই এটা কিনে ফেলব আমি। মাকে জানাই নাই, কারণ মাকে সারপ্রাইজ দেব।'
বিকেলের দিকে ভালো একটা ফার্নিচারের দোকানে ঢুকেই কাচের একটা ডাইনিং টেবিল পছন্দ হয়ে গেল আমার। পছন্দ হয়ে গেল নীলুরও। খুব সিম্পল টাইপের একটা টেবিল, সুন্দর, পরিপাটি। কিন্তু দাম শুনেই সব আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে গেল আমাদের। চব্বিশ হাজার টাকা, একদাম। জিনিসটা এতই পছন্দ হয়েছে আমাদের, আর কোনো ফার্নিচারের দোকানে না ঢুকে বিরস বদনে বাসায় চলে এলে এলাম আমরা।
রাতের খাওয়ার পর আমাকে আর নীলুকে রুমে ডাকলেন রাহাত ভাইয়া। টেবিলে অল্প আলোর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়েন তিনি। আলো-আঁধারির রুমে দাঁড়িয়ে একটু অস্বস্তিই লাগতে লাগল আমার। কিন্তু ভাইয়া মুখটা হাসি হাসি করে বললেন-
'বিকেলে তোদের দুজনকে একটা ফার্নিচারের দোকান থেকে বের হতে দেখেছি। কোনো দরকারে গিয়েছিলি?'
আমি কিছু বলার আগেই গড়গড় করে সব বলে ফেলল নীলু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ভাইয়া তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন-
'চল।'
জগতের চরম বিস্ময় নিয়ে আমি বললাম-
'কোথায়?'
'আমার মাত্র দুটো ছোট বোন, ওদেরকে আমি কখনোই কোনো কিছু দিতে পারিনি, দেওয়ার সামর্থ্যও নেই আমার। টিউশনি করে যা পাই তা লেখাপড়ার পেছনেই শেষ হয়ে যায়। একটা ভালো ল্যাপটপ কেনার দরকার ছিল খুব। কিছু টাকা জমিয়েছিলাম তার জন্য। চল, তিন ভাইবোনের জমানো টাকা দিয়ে একটা ডাইনিং টেবিল কিনে আনি। জন্মের পর থেকেই তো মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার খেলাম, চল না, নিজেদের ঘরে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে কেমন লাগে, তা একটু উপভোগ করি। মা-বাবাকেও চমকে দেওয়া যাবে।'
চোখ ঝেঁপে আসতে লাগল আমার। আমার সমস্ত অনুভূতি স্থির হয়ে গেল হঠাৎ। ভাইয়া এক হাতে আমার হাত, আরেক হাতে নীলুর হাত ধরে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে।
৭.
তিন দিন আগে আমাদের বাসায় একটা ডাইনিং টেবিল এসেছে। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার খেতাম আমরা। এখন থেকে ডাইনিং টেবিলে বসে খাব।
রাতে বাবা বাসায় এসে ডাইনিং টেবিলটা দেখে হা হা করে উঠলেন। মাকে চিৎকার করে ডেকে উঠে বললেন-
'রানু, তোমার ছেলে-মেয়েরা এটা কী করেছে! আমি তো ছোট হয়ে গেলাম!'
রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা বাবার সামনে এসে বলল-
'ছেলেমেয়েরা সংসারের কোনো জিনিস কিনে আনলেই বুঝি বাবা-মা ছোট হয়ে যায়!'
'আমি ঠিক ...।'
কথা শেষ করতে পারেন না বাবা। টেবিলের কাচের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলেন-
'কী সুন্দর দেখতে টেবিলটা?'
বাবা ভাইয়ার দিকে তাকালেন-
'কত নিয়েছে রে, রাহাত?'
ভাইয়ার সঙ্গে বাবার চিরকালের বন্ধুত্ব। ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে বাবাকে কিছুটা জড়িয়ে ধরার মতো করে বলেন-
'জিনিসটার দাম কত, সেটা প্রশ্ন না। প্রশ্ন হলো- জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়েছে। পছন্দের জিনিসের কী দাম দিয়ে মূল্যায়ন করা যায়, বাবা!'
মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাবা বললেন-
'ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা টেবিল ক্লথ দরকার তো ওটার জন্য।'
'কাল আপনি অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় ...।'
আঁচল দিয়ে টেবিলের কাচটা মুছতে মুছতে মা বলল-
'একটা কিনে আনবেন।'
বাধ্যগত ছাত্রের মতো বাবা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন-
'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।'
৮.
বাবার আজ ছুটির দিন। পরশু রাতে বাবা একনায়কতন্ত্রের মতো ঘোষণা দিয়েছেন-
'আজ রাতে ভালো কিছু রান্না হবে আমাদের বাসায়। তারপর আমরা পাঁচজন মিলে ওই ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়ে টেবিলটার উদ্বোধন করব।'
'পাঁচজন না, ছয়জন।'
তথ্যগত সহায়তা করি আমি বাবাকে।
'ছয়জন কোথায় পেলি!'
কিঞ্চিৎ অধৈর্য হয়ে বলেন বাবা।
'ধরো, খাওয়ার সময় একজন গেস্ট এলো।'
বাবা আনন্দে তুড়ি বাজালেন-
'ঠিক বলেছিস, একদম ঠিক।'
রান্নাঘর থেকে জিভে পানি আসা খাবারের সুবাস এসে লাগছে নাকে। মাকে এতক্ষণ আমি সাহায্য করেছি, এখন নীলু করছে। আমার ঘরের জানালার গ্রিল চেপে ধরে আমি রাতের অন্ধকার দেখি। ফ্রেমবন্দি অন্ধকার। সেই ফ্রেম থেকে হঠাৎ বের হয়ে আসে জাফির-
'আজ আপনাকে একটা ইচ্ছের কথা বলব। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আব্বু আর আম্মুকে কখনও একসঙ্গে পাইনি আমি। আব্বু তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, আম্মু তার সোসাইটি নিয়ে। দুজন দু'সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান, ফেরেনও দু'সময়ে। জানেন, আমাদের কখনও একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়নি, গল্পও করা হয়নি কখনও। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে বসে, সবাই মিলে, গল্প করতে করতে খেতে কেমন লাগে। প্রথম দিন আপনাকে একটা গোপন কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি, যা শুনে চমকে উঠবেন আপনি। আপনার বন্ধুদের সঙ্গে খুব চমৎকার করে গল্প করতে পারেন আপনি, সবাই আপনার কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে। আচ্ছা, আপনাদের বাসায় কি ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া হয়?'
৯.
খুব মনোযাগ দিয়ে রান্নাঘরে রান্না করছে মা। পাশে গিয়ে মার কাঁধে মাথা ঠেকানোর মতো করে বলি-
'মা।'
রান্নায় মনোযোগী হয়েই মা বলল-
'বল।'
'ধরো, তোমার অপরিচিত কেউ একজন হঠাৎ একটু পর আমাদের বাসায় এলো, আমাদের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে করতে খেল, ব্যাপারটা তোমার কেমন লাগবে?'
আলতো করে ঘুরে দাঁড়াল মা আমার দিকে। আমার মাথার একপাশে হাত রেখে গভীরভাবে কী যেন দেখল আমার চোখে। তারপর ছলছল চোখে কিছুটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল-
'খুব ভালো লাগবে।'
১০.
বাবার সনাতনী মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম-
'একটা ফোন করব, বাবা।'
অফিসের কী একটা কাজ করছিলেন বাসায়, পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে দিলেন তিনি আমার।
আমার ঘরে চলে এলাম, রিং করলাম জাফিরকে। ফোনটা রিসিভ করতেই নাম বললাম আমি আমার-
'তুমি কি ব্যস্ত?'
'মোটেই না।'
'একটু আসতে পারবে আমাদের বাসায়? ঠিকানা হচ্ছে-।'
থামিয়ে দিল জাফির আমাকে-
'তোমাদের বাসা আমি চিনি তো!'
'কীভাবে?'
শব্দ করে একটু হেসে উঠল জাফির-
কিছু বলল না। ভেতরের সমস্ত আনন্দ নিয়ে বলল-
'কখন আসব, এখনই?'
অনেক কথার উদ্গিরণে আমি কেবল ছোট্ট করে বললাম-
'হ্যাঁ।'
১১.
আমাদের বাসায় কোনো কলিংবেল নেই। ছিটকিনিটা খুলে বাইরের ঘরের দরজাটা চাপিয়ে রাখলাম আমি। জগতে হাজার কোটি বর্ণিল ফুল ফুটে উঠছে এ মুহূর্তে, বিমূঢ়তার সব চমকে বিমূঢ় করছে প্রকৃতি তার সৃষ্টিকে, আকাশে তারার হাট বসেছে রূপকথার গল্পের- না, আমার কোনো দিকে দৃষ্টি নেই, চোখের পাতা মেলার অবসর নেই অন্য কোথাও। আমি কেবল তাকিয়ে আছি নীরব দরজায়; আমার সমস্ত আয়োজনে, সকল সমর্পণে।
পেয়ারার টুকরোটা মুখে দিচ্ছিলাম, থেমে রইল তা মাঝপথেই। ঝট করে নয়, আলতো ঘুরে, আড়চোখে, গোপন বার্তার ছেলেটির দিকে তাকালাম। ছোট্ট একটা ধাক্কা খেলাম সঙ্গে সঙ্গে, কোনো জড়বস্তুর সঙ্গে নয়, চোখ আর মনের সঙ্গে। এ প্লেইন বিউটি- যতটুকু ফর্সা হলে একটা মানুষ রোদ-আলোতে মিশে যায়, ছেলেটি তাই।
সোজা হলাম আমি আবার। ভার্সিটির যে ছায়া-মোড়ানো রাস্তা দিয়ে, বাঁ হাতে ছোট্ট পলিথিনে, অতিশয় ঝালমিশ্রিত পেয়ারার টুকরো নিয়ে বাস কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিলাম, পা বাড়ালাম সেদিকে। থেমে থাকা পেয়ারার টুকরোটা চালান করে দিলাম মুখের ভেতর। ঝালটা একটু বেশিই হয়েছে। মৃদু একটা হিস করে, শিস দেওয়ার ভঙ্গিতে ঠোঁট দুটো সরু করে রাখলাম কিছুক্ষণ। ঝট করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলেটাকে ভড়কে দেব, কঠিন কঠিন কিছু কথা বলব তাকে-
'চমকানোর প্রহর কেটে গেছে সেই অনেক আগেই, যেদিন বুঝলাম- নগ্ন আর ক্ষুুধার্ত হয়েই জন্মেছি আমরা, কিন্তু এই নগ্নতা আর ক্ষুধা দিনদিন বেড়েই চলছে আমাদের। এসব নিয়েই বড় হচ্ছি আমরা। এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন।'
'তাই?'
চেহারায় কাঠিন্য, কিন্তু চোখ দুটো হাসি হাসি।
'হ্যাঁ।'
চেহারাটা কঠিন করে ফেলি আমিও।
'কিন্তু চমকানোর আরও অনেক কিছু আছে।'
আমার তত্ত্বে বাগড়া দিল সে-
'আপনি কি জানেন- আমরা কখনোই বড় হই না, আমরা শুধু শিখি কীভাবে মানুষের সামনে নিখুঁতভাবে অভিনয় করতে হয়।'
ভ্রু কুঁচকালাম আমি। কিন্তু সেটা দেখার সুযোগ দিলাম না তাকে। একটু চমকেই উঠলাম- যতটুকু বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম বোকাকৃতির এই ছেলেটাকে, তার চেয়ে বেশিই সে। সম্ভবত আরও বেশি। একটু ধাতস্থ হলাম আমি-
'কিন্তু অভিনয় করেই মানুষ আজকাল বড় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এই অভিনয়কে অনুশীলন করছে।'
পলিথিন থেকে আরেকটা পেয়ারার টুকরো তুলে নিলাম হাতে-
'জানেন তো, অনুশীলন মানুষকে নিখুঁত করে।'
'কিন্তু কোনো মানুষই নিখুঁত নয়।'
পা থামালাম আমি। কৌশলী প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলাম। কিন্তু ব্যক্তিত্বের ধার না কমিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকালাম-
'কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, এটা বিশ্বাস করেন আপনি?'
'নিজেকে আমি বুদ্ধিমান মনে করি না, সুখী মনে করতে চাই। যারা সন্দেহ প্রকাশ করে, তারা বুদ্ধিমান; আর যারা বিশ্বাস করে, তারা সুখী।'
মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি, মুগ্ধতা আঁকড়ে ধরছে আমাকে।
ডান দিকে বাঁক নেওয়া রাস্তাটা পেরোতেই পরস্পরের গা স্পর্শ হতে যাচ্ছিল, ছেলেটা থমকে দাঁড়াল। অনাহূত স্পর্শ এড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। মুগ্ধতা আরও বেড়ে গেল আমার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছুঁতে যাওয়া প্রচলিত কোনো ছেলের উপকরণ তার মাঝে খুঁজে না পেয়ে মনটা ভরে উঠল। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস তার-
'বিশ্বাস ব্যাপারটাই আসলে অন্যরকম। যদি আপনি বলেন, আকাশে দশ হাজার কোটি তারা আছে, সবাই বিশ্বাস করবে তা। কিন্তু সদ্য রং করা কোনো জিনিস দেখিয়ে যদি বলেন, রংটা এখনও কাঁচা আছে, অবিশ্বাস করে সঙ্গে সঙ্গে সবাই সেটা ছুঁয়ে দেখবে।'
পেয়ারার টুকরোগুলো শেষ করে পলিথিনটা ফেলে দিলাম আমি। ভার্সিটির বাস কাউন্টার পৌঁছতে মিনিট তিনেক লাগবে আরও। চুপচাপ কেটে গেল মিনিটখানেক। হঠাৎ কৈফিয়ত চাওয়ার মতো বললাম-
'আচ্ছা, আপনি হঠাৎ-।'
থেমে গেলাম। শেষ করলাম না বাক্যটা। গাছ থেকে একটা ছোট্ট লাল পাতা নিচে নামছিল। মাটির সঙ্গে সৃষ্টির পরম আত্মীয়তা। সেই আত্মিক ছোঁয়া পেতেই কিনা, পাতাটা বেশ নাচার ভঙ্গিতে নিচে নামছিল। এ রকম ঝরা পাতা প্রতিদিনই দেখি ক্যাম্পাসে। মুগ্ধ হইনি, আজ হলাম। কেন হলাম, তার কারণ খুঁজে পেলাম না যদিও।
প্রসঙ্গ বদলালাম আমি-
'আমার বাস দাঁড়িয়ে আছে সামনে, যেতে হবে এখন আমাকে।'
'আমাকেও।'
হাত বাড়িয়ে বাম পাশটা দেখাল সে-
'আপনার বাসের পাশেই একটা বাহন দাঁড়িয়ে আছে আমার, আমি ওটাতে যাব।'
খুব সাধারণ বিষয়ে মুগ্ধ হই আমি, আবার অনেক অসাধারণ বিষয়ও মুগ্ধ করতে পারে না আমাকে। রাস্তায় তো অনেক গাড়ি দেখি আমরা, ছেলেটা যে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, অবিকল তার মতো ফর্সা, অভিজাতও। নাটকীয় প্যাঁচালের মতো সে বলল না- চলুন, আপনাকে পৌঁছে দেই।
অল্প একটু হাত নাড়ল সে কেবল। গাড়িতে উঠে পড়ল তারপর। আমি বাসে। যে গোপন কথাটা শুনে চমকে ওঠার কথা আমার, শোনা হলো না সেটাও।
২.
বাবা যে উকিল সাহেবের চেম্বারে কাজ করেন, তিনি একজন অদ্ভুত মানুষ। মাঝে মাঝেই, সপ্তাহে অন্তত একদিন একগাদা বাজার পাঠিয়ে দেন আমাদের বাসায়। তিনিও সেদিন তার বাসার জন্য বাজার করেন, সঙ্গে বাবাকে নিয়ে যান, তখনই বাবার হাতে আমাদের জন্যও অনেক কিছু কিনে দেন। আজ একটা বড়সড় চিতল মাছ কিনে দিয়েছেন তিনি।
সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছেই দেখি মহা হুলস্থুল ব্যাপার। মা মাছ কাটছে, বাবা পাশে বসে আছেন একটা বই হাতে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওটা একটা রান্নার বই। মাছের ১০১টি সুস্বাদু রান্না। আমাকে দেখেই বাবা উচ্ছ্বসিত হলেন-
'রেবা, তুই আজ চিতল মাছের কোপ্তা রান্না করে খাওয়াবি। অনেকদিন ধরে কোপ্তা খাওয়ার সাধ জেগেছে। কিন্তু আমার তো ওরকম মাছ কেনার সাধ্য নেই!'
বাবার পাশে বেতের মোড়াটায় বসি আমি। হাতের বইটা নিয়ে পাশে রেখে ওই হাতটা আমার দু'হাতের মাঝে আনি। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি, মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটা দেখি মায়ের। মাঝখানে ছোট্ট শব্দে প্রগাঢ় কিছু নিঃশ্বাস। ব্যস, আর কিছু না।
রাহাত ভাইয়া বুয়েটের শেষ পাটটা শেষ করায় ব্যস্ত। হাতির ঝিলের এক অতিশয় ধনীর কন্যাকে সপ্তাহে তিন দিন পড়ায়। সন্ধ্যার পর পড়াতে যায় তাকে। ফেরে বেশ রাতে, অধিকাংশ দিন ওই বাসা থেকে খেয়ে আসে সে। কন্যার বাবা-মা নাকি অনেক পছন্দ করেন ভাইয়াকে। ব্যাপারটা মধুর, কিছুটা আশঙ্কারও। এটা নিয়ে ভাইয়াকে প্রায়ই খোঁচাই আমি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উদার হাসি হাসে ভাইয়া তখন, কিছু বলে না।
ভাইয়া আজও কন্যাকে পড়াতে গিয়েছে। বাবা তার অতি প্রাচীন মোবাইল দিয়ে ফোন করলেন তাকে। আজ একটু কম পড়িয়ে, কোনো কিছু না খেয়ে, বাসায় আসতে বললেন দ্রুত।
রাতে ভাত খাওয়ার আগে বাবা আমাদের নেতিয়ে পড়া মাদুরে এমনভাবে বসলেন, সম্রাট আকবর বেঁচে থাকলে এবং বাবার বসার এই স্টাইল দেখলে নিজের সিংহাসনে বসার স্টাইল দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলতেন। বাবার এক পাশে আমি, আরেক পাশে ভাইয়া। নীলু তিন দিন আগে, ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে, মানিকগঞ্জে খালার বাসায় বেড়াতে গেছে বলে বাবা তার খাওয়াপূর্ব বক্তৃতায় বেশ শোক প্রকাশ করলেন। ছোট মেয়েকে ছাড়া তিনি এ রকম একটা মাছ খাবেন, সেটা তিনি মানতে পারছেন না। ফোনে তিনি নীলুকে কালকেই আসতে বলেছেন, বেশ কয়েকটা মাছের বড় টুকরো তার জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে ফ্রিজে। নীলু কালকেই চলে আসবে। মাছ খাওয়ার লোভে না, পরশু থেকে তার কোচিং, নাসায় চাকরি পাওয়া যায়, এমন একটা সাবজেক্টে নাকি পড়বে সে। বাবা শুনে সে কী খুশি। অথচ আমাদের পড়াতে বাবার কী অক্লান্ত পরিশ্রম! স্যান্ডো গেঞ্জি কেউ কখনও সেলাই করে পরে কিনা জানি না, আমার বাবা পরেন। গেঞ্জি একটু ফুটো হলেই বাবা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেন, মা নিপুণ শিল্পীর মতো সেটা মেরামত করে দেন তা সব যত্ন দিয়ে।
বাবা আমার পাতে একটা কোপ্তা দিলেন। আমি সেটার দিকে তাকালাম। কিন্তু মুখে দিতে নিতেই কেমন যেন থেমে গেলাম। ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ। কপাল কুঁচকে ফেললাম আমি। হঠাৎ তার কথা মনে পড়ল কেন আমার! বাবা অস্থির হয়ে বললেন-
'কিরে, খাচ্ছিস না কেন? কী মজা করেই না বানিয়েছিস কোপ্তাগুলো!
মুখে দিলাম আমি আমার প্লেটের খাবারটা। চাবাচ্ছি, কিন্তু কোনো মজা পাচ্ছি না। বুকের ভেতরটায় কোথায় যেন এক টুকরো কষ্ট জমা হয়ে গেছে। কী জন্য, কীসের জন্য- কোনোভাবেই সেটা বুঝতে পারছি না।
৩.
কার্জন হলের বড় বারান্দার কোনার জায়গাটা খুব প্রিয় আমার। মাঝে মাঝেই ওই জায়গাটায় বসি আমি। লাইব্রেরি থেকে বই এনে ওখানে বসে পড়ি। বেশ নির্জন আর একা একা, ভালো লাগে খুব।
'কাল এত কথা হলো, কিন্তু নামই জানা হলো না আপনার।'
শব্দে চমকে উঠি আমি, বিরক্তও হই। কিন্তু মাথা ঘুরাতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একগাদা বই হাতে ছেলেটা একটু ফাঁকে দাঁড়িয়ে। হাত দিয়ে ইশারা করে পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলি-
'নাম জানা হয়নি আপনারও।'
একটু থামি আমি-
'আর চমকে ওঠার সেই গোপন কথাটিও।'
খুব কসরত করে বারান্দায় বসল সে। বারান্দার এই সমতল জায়গায় বসতে বেশ কষ্টই হচ্ছে তার। খারাপ লাগল। অস্বস্তি নিয়ে বললাম-
'চলুন, অন্য কোথাও বসি।'
বসার বিড়ম্বনা কাটানোর চেষ্টা করল সে। হেসে ফেললাম আমি। পা দুটো মেলে দিল লজ্জা পেয়ে। মাঠে বসার আনাড়িপনায় কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা মনে হলো তাকে। সামনের ছোট বাগানটাতে দুটো প্রজাপতি খেলা করছে, তার মনোযোগ এখন সেদিকে, আমার মনোযোগ তার দিকে।
উঠে দাঁড়ায় সে হঠাৎ-
'বসতে ভালো লাগছে না, চলুন হাঁটি।'
'হাঁটতে ভালো লাগবে আপনার?'
'একা একা ভালো লাগে না।'
সারলিক স্বীকারে হাসতে নিয়েই থেমে যাই। মাথা নিচু করে পথ হাঁটি। কথার চেয়ে পায়ের শব্দ বেশি। কখনও কখনও শিস কেটে কোনো পাখি উড়ে যায় কাছ দিয়ে। চমকে উঠে দুজনই তাকাই সেদিকে, কিন্তু দুজন দুজনের দিকে তাকাই না এক মুহূর্তও।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ আগেই। আমরা একবিন্দুও টের পাইনি অন্ধকার নেমেছিল কখন চারপাশে, আমাদের ঘিরে।
৪.
ঘোলাটে চাঁদের বিষণ্ণ আলোয় বহুদূর চোখ মেলি আমি। এই নির্জনতায় কোনো শিশু ফরমালিন মাখা খাবার খাচ্ছে, বসতি ছেয়ে যাওয়া নকল ওষুধ গলায় ঢুকিয়ে কোনো রোগাক্রান্ত রোগমুক্তের আশা জাগাচ্ছে মনে, গাড়ি চাপায় কেউ পড়ে আছে রাস্তার কোনো কিনারে, জগতের সব কল্যাণ-অকল্যাণে একাকার হয়ে যাচ্ছে পাতা ঝরা বাতাসে- যাই কিছু হোক, আমার আজ কিচ্ছু আসে যায় না। আমি আজ বিরহী। কারণ গত দু'দিন ভার্সিটিতে আসেনি সে।
কোনো কোনো দিন খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। আজ যেমন। আমি আজ পথহারার মতো সমস্ত ক্যাম্পাস ঘুরেছি; অকারণে বসে থেকেছি এখানে ওখানে; ফ্লাস্কে বিক্রি করা চা খাইনি আমি কখনও; আজ দু'কাপ খেয়েছি। কখনও উঁচু স্বরে কথা বলা হয় না আমার, আজ কাকে যেন সামান্য ধমকও দিয়েছি।
নিম্নমধ্যবিত্ত এই আমরা যেসব বাসায় ভাড়া থাকি, সেসব বাসায় কোনো বারান্দা থাকে না। ছোট্ট জানালার ছোট্ট জায়গা দিয়ে আকাশও দেখতে পাই না আমরা কখনও। কেবল মাঝে মাঝে চাঁদ যখন খুব উজাড় করে তার সব আলো ঢেলে দেয়, সেই উপচে পড়া আলোর কিছুটা আমাদের জানালায় এসে উঁকি দেয়। আমরা সেদিন ওটুকু দেখেই পরম তৃপ্তিতে ঘুমাতে যাই।
জানালায় আজ উপচে পড়া চাঁদের আলোর ছটা, আমার তবুও ঘুম আসছে না। সমস্ত বিষাদ অভিমান হয়ে লেপ্টে আছে ঠোঁটে। সেই অভিমান আবার গলে গলে পড়ছে চোখ বেয়ে।
৫.
ক্লাস ছিল, তবুও তিন দিন ক্লাসে যাইনি। এমনি। হয়তো অনাহূত কোনো ভূমিকা। আজ ক্লাসে ঢুকেই মনে হলো- সবকিছু অপরিচিত, অপাঙ্ক্তেয়। স্যারের ওই লেকচার, নোট কিংবা জানালার পাশে যে প্রতিদিন একজোড়া দোয়েল এসে চেঁচামেচি করে, তাও। স্যার কথা বলছেন, সেটা কানে বাজছে না, কেবল হাত নাড়ানো আর দু'ঠোঁটের বদলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখছি।
দ্বিতীয় ক্লাসটা আর করতে ইচ্ছে করছে না। মাথায়ও আসছে না কোনো কিছু। একদম ফাঁকা, হুহু করে বাতাস বইয়ে যাওয়ার মতো মুক্ত। ক্লাসের বাইরে অযত্নে বেড়ে ওঠা অ্যালাম্যান্ডা গাছটা যে বেশ যত্ন করে কয়েকটা ফুল ফুটিয়েছে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ সেদিকে। অকারণে আকাশের দিকেও তাকালাম- ধূসর আকাশ, কেবল মেঘ চিড়ে কোনো যন্ত্র বয়ে যাওয়ার চিহ্ন ফুটে আছে লম্বাভাবে।
সম্ভবত আজ একটু বেশিই সেজে এসেছি আমি। সবাই কেমন যেন ঘুরেফিরে তাকাচ্ছে। কিন্তু কোনো উপলক্ষ মনে দানা বাঁধেনি কখনও। আমাদের স্টিলের আলমারির আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হলো- সবকিছু পরে কপালটায় একটা ফোঁটা দিলে মন্দ হয় না। আমার প্রশস্ত কপালে প্রশস্ত ফোঁটা, রবীন্দ্রনাথ দেখলে নির্ঘাত একটা গল্প লিখে ফেলতেন, জীবনানন্দ হলে কবিতা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আনমনে কার্জন হলের বারান্দার কোনায় এসেছি, বুঝতে পারিনি। চিনতে পারিনি মাথা নিচু করে একটা ইংরেজি নভেল পড়তে থাকা ছেলেটিকে। পায়ের শব্দে নয়, অবয়বের মিহি ছায়ায় নভেল থেকে চোখ ফেরাল সে আমার দিকে। কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আভিমানও; দূর থেকে ভেসে আসা প্রিয় কোনো গানের কলির মতো বলল-
'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
মাথায় সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে গেল আমার। আমার কখনও এ রকম হয় না যদিও। হুহ, নিজেরই দেখা নেই, আবার জীবনানন্দ সাজা হচ্ছে- এতদিন কোথায় ছিলেন, নাটোরের বনলতা সেন। মনে হচ্ছে, কী মনে হচ্ছে স্থির করতে পারলাম না তা কয়েক সেকেন্ডেও।
আবার মনোযোগ দিয়েছে সে বইয়ের পাতায়। সূক্ষ্ণ একটা অপমান এসে আছড়ে পড়ল মনে। ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। আগের মতোই মৃদু স্বরে বলল-
'চলে যাচ্ছেন যে!'
না ঘুরে দাঁড়িয়েই বললাম-
'আপনি তো ব্যস্ত।'
'সেটা তো আপনার জন্য।'
'আমার জন্য!'
'আপনার সঙ্গে কথা বলব বলে অনেক কথা খুঁজে বেড়াচ্ছি এই বইয়ে।'
বইয়ের দু'পাশটা এক করে পাশে রাখল সে-
'তিন দিন আসেননি যে!'
'তিন দিন আমি ভার্সিটিতে আসিনি এটা আপনি জানেন!'
সে না বললেও তার পাশে বসে পড়লাম আমি।
'ভার্সিটিতে এসে ক্লাস না করে তিন দিন ধরেই তো বসে থাকি আমি এখানে।'
কোনো কিছু থেকে নিজেকে লুকোনোর জন্য সম্ভবত পাশে রাখা বইটা আবার হাতে নেয় সে।
বুকের ভেতর মিহি একটা ঠান্ডা বইয়ে যায় দ্রুত। মনটাও শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু সেসব খোলসে ঢেকে কৈফিয়তের ঢঙে বললাম-
'আপনিও তো দু'দিন আসেননি।'
'এসেছিলাম।'
'এসেছিলেন!'
নিজের ব্যক্তিত্বের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে-
'কই দেখলাম না যে!'
মৃদু হাসল সে, কিছু বলল না। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। হাত এগিয়ে দিল আমার দিকে-
'চলুন, আজ সারাদিন যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়াব।'
মানুষটার হাতের দিকে তাকালাম আমি। আমার ইতস্ততা টের পেল সে। সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল হাতটা। তার আগেই আমি ধরে ফেললাম সেটা। কোনো ভালো লাগা থেকে না, স্রেফ সম্মান জানাতে।
হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল-
'নাম জানা হয়নি এখনও আমাদের। আমি জাফির।'
'আমি রেবা।'
'সারাদিন আমরা আজ বাইরে থাকব, আপনার বাবা-মা কিছু বলবেন না তো?'
জাফিরের চোখের দিকে তাকাই আমি-
'ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, বাবা-মা এটা কখন বোঝেন জানেন- যখন ছেলেমেয়ে জানতে চায় না সে কোথা থেকে এই পৃথিবীতে এসেছে, বাসা থেকে বের হলেও বলতে চায় না সে কোথায় যাচ্ছে, বাসায় ফিরেও সে জানাতে চায় না বাসার বাইরে এতক্ষণ সে কী করেছে।'
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সে-
'আজ আপনাকে আমি আমার একটা ইচ্ছের কথা বলব।'
প্রতিধ্বনি করে উঠি আমি-
'ইচ্ছে!'
কিছু বলল না সে। মাথা নাড়ল কেবল।
৬.
বাসায় এসে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রেখেছিলাম আমি সেদিন- দুই মাস একুশ দিন আগে জাফির তার ইচ্ছের কথা বলেছিল আমাকে। খুব মামুলি একটা ইচ্ছে, নিতান্তই সাধারণ, চরাচরে মিশে যাওয়া বাতাসের মতো। কিন্তু আমার কাছে তা ছিল কঠিন, মানসম্মানের, লজ্জার। অনেকটা বিব্রতকর।
ক্লাস নাইনের পাঁচটা মেয়ে এসে পড়ে আমাদের বাসায়। বিজ্ঞান পড়াই আমি ওদের। ওরা এক হাজার করে টাকা দেয় আমাকে। দু'মাসে দশ হাজার টাকা জমিয়েছি। আগেও হাজার সাতেক টাকা জমিয়েছিলাম। মোট সতেরো হাজার টাকা নিয়ে নীলুকে পাঁচ দিন আগে বললাম-
'চল, একটা ডাইনিং টেবিল কিনে নিয়ে আসি বাসায়।'
রসগোল্লার মতো চোখ বড় বড় করে ফেলল নীলু-
'ডাইনিং টেবিল কিনবে, টাকা পাবে কোথায়!'
'কিছু টাকা জমিয়েছি আমি।'
'বাবাকে জানিয়েছ? মাকে?'
'বাবাকে জানাই নাই, কারণ বাবা এতে বিব্রত হবেন। একটা ডাইনিং টেবিল কিনে দিতে না পারায় তিনি কষ্ট পাবেন, সেটা আবার তার সন্তানরা কিনছে ভেবে লজ্জা পাবেন। সুতরাং হঠাৎ করেই এটা কিনে ফেলব আমি। মাকে জানাই নাই, কারণ মাকে সারপ্রাইজ দেব।'
বিকেলের দিকে ভালো একটা ফার্নিচারের দোকানে ঢুকেই কাচের একটা ডাইনিং টেবিল পছন্দ হয়ে গেল আমার। পছন্দ হয়ে গেল নীলুরও। খুব সিম্পল টাইপের একটা টেবিল, সুন্দর, পরিপাটি। কিন্তু দাম শুনেই সব আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে গেল আমাদের। চব্বিশ হাজার টাকা, একদাম। জিনিসটা এতই পছন্দ হয়েছে আমাদের, আর কোনো ফার্নিচারের দোকানে না ঢুকে বিরস বদনে বাসায় চলে এলে এলাম আমরা।
রাতের খাওয়ার পর আমাকে আর নীলুকে রুমে ডাকলেন রাহাত ভাইয়া। টেবিলে অল্প আলোর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়েন তিনি। আলো-আঁধারির রুমে দাঁড়িয়ে একটু অস্বস্তিই লাগতে লাগল আমার। কিন্তু ভাইয়া মুখটা হাসি হাসি করে বললেন-
'বিকেলে তোদের দুজনকে একটা ফার্নিচারের দোকান থেকে বের হতে দেখেছি। কোনো দরকারে গিয়েছিলি?'
আমি কিছু বলার আগেই গড়গড় করে সব বলে ফেলল নীলু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ভাইয়া তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন-
'চল।'
জগতের চরম বিস্ময় নিয়ে আমি বললাম-
'কোথায়?'
'আমার মাত্র দুটো ছোট বোন, ওদেরকে আমি কখনোই কোনো কিছু দিতে পারিনি, দেওয়ার সামর্থ্যও নেই আমার। টিউশনি করে যা পাই তা লেখাপড়ার পেছনেই শেষ হয়ে যায়। একটা ভালো ল্যাপটপ কেনার দরকার ছিল খুব। কিছু টাকা জমিয়েছিলাম তার জন্য। চল, তিন ভাইবোনের জমানো টাকা দিয়ে একটা ডাইনিং টেবিল কিনে আনি। জন্মের পর থেকেই তো মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার খেলাম, চল না, নিজেদের ঘরে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে কেমন লাগে, তা একটু উপভোগ করি। মা-বাবাকেও চমকে দেওয়া যাবে।'
চোখ ঝেঁপে আসতে লাগল আমার। আমার সমস্ত অনুভূতি স্থির হয়ে গেল হঠাৎ। ভাইয়া এক হাতে আমার হাত, আরেক হাতে নীলুর হাত ধরে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে।
৭.
তিন দিন আগে আমাদের বাসায় একটা ডাইনিং টেবিল এসেছে। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার খেতাম আমরা। এখন থেকে ডাইনিং টেবিলে বসে খাব।
রাতে বাবা বাসায় এসে ডাইনিং টেবিলটা দেখে হা হা করে উঠলেন। মাকে চিৎকার করে ডেকে উঠে বললেন-
'রানু, তোমার ছেলে-মেয়েরা এটা কী করেছে! আমি তো ছোট হয়ে গেলাম!'
রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা বাবার সামনে এসে বলল-
'ছেলেমেয়েরা সংসারের কোনো জিনিস কিনে আনলেই বুঝি বাবা-মা ছোট হয়ে যায়!'
'আমি ঠিক ...।'
কথা শেষ করতে পারেন না বাবা। টেবিলের কাচের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলেন-
'কী সুন্দর দেখতে টেবিলটা?'
বাবা ভাইয়ার দিকে তাকালেন-
'কত নিয়েছে রে, রাহাত?'
ভাইয়ার সঙ্গে বাবার চিরকালের বন্ধুত্ব। ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে বাবাকে কিছুটা জড়িয়ে ধরার মতো করে বলেন-
'জিনিসটার দাম কত, সেটা প্রশ্ন না। প্রশ্ন হলো- জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়েছে। পছন্দের জিনিসের কী দাম দিয়ে মূল্যায়ন করা যায়, বাবা!'
মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাবা বললেন-
'ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা টেবিল ক্লথ দরকার তো ওটার জন্য।'
'কাল আপনি অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় ...।'
আঁচল দিয়ে টেবিলের কাচটা মুছতে মুছতে মা বলল-
'একটা কিনে আনবেন।'
বাধ্যগত ছাত্রের মতো বাবা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন-
'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।'
৮.
বাবার আজ ছুটির দিন। পরশু রাতে বাবা একনায়কতন্ত্রের মতো ঘোষণা দিয়েছেন-
'আজ রাতে ভালো কিছু রান্না হবে আমাদের বাসায়। তারপর আমরা পাঁচজন মিলে ওই ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়ে টেবিলটার উদ্বোধন করব।'
'পাঁচজন না, ছয়জন।'
তথ্যগত সহায়তা করি আমি বাবাকে।
'ছয়জন কোথায় পেলি!'
কিঞ্চিৎ অধৈর্য হয়ে বলেন বাবা।
'ধরো, খাওয়ার সময় একজন গেস্ট এলো।'
বাবা আনন্দে তুড়ি বাজালেন-
'ঠিক বলেছিস, একদম ঠিক।'
রান্নাঘর থেকে জিভে পানি আসা খাবারের সুবাস এসে লাগছে নাকে। মাকে এতক্ষণ আমি সাহায্য করেছি, এখন নীলু করছে। আমার ঘরের জানালার গ্রিল চেপে ধরে আমি রাতের অন্ধকার দেখি। ফ্রেমবন্দি অন্ধকার। সেই ফ্রেম থেকে হঠাৎ বের হয়ে আসে জাফির-
'আজ আপনাকে একটা ইচ্ছের কথা বলব। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আব্বু আর আম্মুকে কখনও একসঙ্গে পাইনি আমি। আব্বু তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, আম্মু তার সোসাইটি নিয়ে। দুজন দু'সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান, ফেরেনও দু'সময়ে। জানেন, আমাদের কখনও একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়নি, গল্পও করা হয়নি কখনও। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে বসে, সবাই মিলে, গল্প করতে করতে খেতে কেমন লাগে। প্রথম দিন আপনাকে একটা গোপন কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি, যা শুনে চমকে উঠবেন আপনি। আপনার বন্ধুদের সঙ্গে খুব চমৎকার করে গল্প করতে পারেন আপনি, সবাই আপনার কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে। আচ্ছা, আপনাদের বাসায় কি ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া হয়?'
৯.
খুব মনোযাগ দিয়ে রান্নাঘরে রান্না করছে মা। পাশে গিয়ে মার কাঁধে মাথা ঠেকানোর মতো করে বলি-
'মা।'
রান্নায় মনোযোগী হয়েই মা বলল-
'বল।'
'ধরো, তোমার অপরিচিত কেউ একজন হঠাৎ একটু পর আমাদের বাসায় এলো, আমাদের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে করতে খেল, ব্যাপারটা তোমার কেমন লাগবে?'
আলতো করে ঘুরে দাঁড়াল মা আমার দিকে। আমার মাথার একপাশে হাত রেখে গভীরভাবে কী যেন দেখল আমার চোখে। তারপর ছলছল চোখে কিছুটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল-
'খুব ভালো লাগবে।'
১০.
বাবার সনাতনী মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম-
'একটা ফোন করব, বাবা।'
অফিসের কী একটা কাজ করছিলেন বাসায়, পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে দিলেন তিনি আমার।
আমার ঘরে চলে এলাম, রিং করলাম জাফিরকে। ফোনটা রিসিভ করতেই নাম বললাম আমি আমার-
'তুমি কি ব্যস্ত?'
'মোটেই না।'
'একটু আসতে পারবে আমাদের বাসায়? ঠিকানা হচ্ছে-।'
থামিয়ে দিল জাফির আমাকে-
'তোমাদের বাসা আমি চিনি তো!'
'কীভাবে?'
শব্দ করে একটু হেসে উঠল জাফির-
কিছু বলল না। ভেতরের সমস্ত আনন্দ নিয়ে বলল-
'কখন আসব, এখনই?'
অনেক কথার উদ্গিরণে আমি কেবল ছোট্ট করে বললাম-
'হ্যাঁ।'
১১.
আমাদের বাসায় কোনো কলিংবেল নেই। ছিটকিনিটা খুলে বাইরের ঘরের দরজাটা চাপিয়ে রাখলাম আমি। জগতে হাজার কোটি বর্ণিল ফুল ফুটে উঠছে এ মুহূর্তে, বিমূঢ়তার সব চমকে বিমূঢ় করছে প্রকৃতি তার সৃষ্টিকে, আকাশে তারার হাট বসেছে রূপকথার গল্পের- না, আমার কোনো দিকে দৃষ্টি নেই, চোখের পাতা মেলার অবসর নেই অন্য কোথাও। আমি কেবল তাকিয়ে আছি নীরব দরজায়; আমার সমস্ত আয়োজনে, সকল সমর্পণে।
মন্তব্য করুন