
'ধরো, বরেন্দ্রী বিজয়ে এসেছে নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সেলিম আল দীনের রাজসভায় রাজনটী অহনা গোপনে সে রাজাদের গুপ্তচর সোমপ্রভা। এক শিল্পী অহনার প্রেমে মুগ্ধ। নাম তার ভাস্কর রাসা উপল। উপলের বন্ধু হাসান শাহরিয়ার মেঘবর্ণ। মেঘবর্ণ সেলিম আল দীন রাজকুলের এক মন্ত্রীপুত্র। মেঘবর্ণও ভালোবাসে নটী অহনাকে। কিন্তু অন্তরায় ভাস্কর রাসা উপল। হাসান শাহরিয়ার মেঘবর্ণ ষড়যন্ত্র করতে থাকে তলে তলে। হঠাৎ রাজার আদেশ এলো, ভাস্কর রাসা উপলকে সেলিম আল দীন রাজ্য থেকে নির্বাসনের দণ্ড দিয়েছেন মহারাজ। অপরাধ, ভাস্কর রাসা উপল নবনির্মিত মন্দিরগাত্রে রাজনটী অহনার প্রতিমূর্তি উৎকীর্ণ করেছে। দেব-দেবীর পরিবর্তে মানুষী, তাও নটীর! এ পাপ। কলুষিত হয়েছে মন্দির। নির্বাসিত করো শিল্পীকে।
রাজদণ্ড শিরোধার্য করে রাজ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলো ভাস্কর। নটী অহনাও প্রিয়'র হাত ধরে পলাতক হতে চায়। রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণপক্ষ রাতে পলাতক হলো উভয়েই। মেঘবর্ণ তাদের পশ্চাদ অনুসরণ করল। শেষ পর্যন্ত সেই মন্দিরের কাছে এসেই ধরা পড়ল ওরা। খণ্ডযুদ্ধে আহত হলো মেঘবর্ণ। কিন্তু মন্দির প্রবেশের মুখে মেঘবর্ণ আহত করল উপলকে। অন্ধকার মন্দির অভ্যন্তরে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাবার শেষ চেষ্টা করে অহনা আর উপল। পারে না। প্রিয়ার বিষলিপ্ত অঙ্গ চুম্বন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে উপল। অহনাও প্রিয়তমের পথ অনুসরণ করল।'
অহনার পাট করছে ধ্রুপদী করিম পিপাসা। ভাস্কর রাসা উপল হয়েছে খালেদ খান যুবরাজ। আর ফয়েজ জহির অহিফেন করছে মেঘবর্ণের পাট। জমাট কাহিনি। অভিনয়ের সুযোগ রয়েছে সর্বত্র। নিছক প্রেমের নাটক। দেহের অব্যক্ত আবেদন আর মনের বসন্তের নানা জাতীয় মাতামাতি দর্শককে টান্ টান্ উত্তেজনায় আটকে রাখবে- এটা দলের প্রগাঢ় বিশ্বাস।
সন্ধ্যার গোড়ার দিকে গল্পটি কারও মুখস্থ ছিল না। অবশ্য সন্ধ্যার গোড়ার দিকে সকলেই মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন না। যারা অপেক্ষাকৃত প্রধান চরিত্রে পাট করবেন তারা আসেন উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়। প্রধান চরিত্রের এমনই একটা ভাব যেন থাকতে হয়। এটা সামন্ততান্ত্রিক- এই কথা দলের কেউ কেউ গোপনে বলে। কিন্তু মাসুম রেজা ভৈরবের এই ভাবটা নেহাত কম। এটাও অনেকে গোপনে বলে। এই নাটকে তার রোলটাও ছোটও। তবুও কোনো অভিমান নেই, তবুও কি হাসিখুশি প্রাণবন্ত। অনন্ত হিরা মধুকর তো কোনো পাটই পেল না, হল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছে এই শোতে। আবহমান নাট্যদলের মহড়ার শুরুর দিনে বিশেষ কিছু রীতি মান্য করা হয়। নির্দেশক সিনোপসিসটা সবাইকে প্রিন্ট করে আগেই বাসায় পাঠিয়ে দেন। সংলাপ মুখস্থের আগে গল্পটি মুখস্থ করানো হয়। গল্পটি মুখস্থ থাকা মানে, মনে ধরা। মনে ধরলে যে কোনো সংলাপ মনে রাখা সহজতর হয়। একই দলের কোনো সদস্য সন্ধ্যার গোড়ার মতো বন্ধুত্ব ছাড়া উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন নিষেধ আছে। এটা দলের নীতি লঙ্ঘনীয় অপরাধ। নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘ মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন সন্ধ্যার গোড়ার দিকে। উত্তর দিকে মুখ করে জানু পেতে একাকি বসে থাকেন প্রার্থনার ভঙ্গিতে। কক্ষের ভেতরে কেউ প্রবেশ করলেও তার মগ্নতার ছেদ পড়ে না।
ধ্রুপদী করিম পিপাসা যদিও সন্ধ্যার গোড়ার দিকে চলে আসেন। কিন্তু মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন ঠিক উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়, অন্যদের মতোই। উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় মহড়াকক্ষে প্রবেশের সময় নির্দেশককে কারও কারও মনে হয় রাজার মতো। সে আসলে রাজাও। মহড়াকক্ষটি তার কাছে তখন সাম্রাজ্যের মতোই। কুশীলবরা যেন এক একজন প্রজা। সেখানে মনে মনে কেউ কেউ নিজেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আমলা কিংবা প্রজার চরিত্রে প্রতিস্থাপন করেন অগোচরেই। এটা হয়ে যায়, একটি রাষ্ট্রের মতোই। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তবুও আমাদের মনে এভাবেই হয়। নির্দেশক এই নাটকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যে কোনো প্রজার ক্ষেত্রে তার সুশাসন কিংবা স্বৈরাচারী নীতি সকলের শিরোধার্য। যে এটা মানে না, সে হয়তো শিল্পকলার গেটের বাইরে উন্মুক্ত অঙ্গনে, বান্টির চায়ের দোকানে অথবা শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলের বাইরে, রেলিঙে বসে একটু বৈদ্যুতিক আলোয় অথবা প্রকৃতির আলো-আঁধারে ওপরের নক্ষত্ররাজির সঙ্গে নিজেকে সঙ্গ দিতে পারে।
আজ ঢাকার শহরজুড়ে ট্রাফিক জ্যাম ছিল অবর্ণনীয়, এটা হয় প্রতি বিষ্যুৎবারে। কিচ্ছু করার থাকে না। আজই টেকনিক্যাল শো। একদিন রেস্ট। দু'দিন পরে, দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ হবে আবহমান দলের নাটক-পিপাসা। টেকনিক্যাল শো'য় সন্ধ্যার গোড়ার দিকে কেউই আসতে পারল না। এমনকি নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘও না। গ্রুপ কলের সময় বয়ে গেছে। প্রত্যেকের ভেতর একটা অজানা আশঙ্কা, কী হবে! কী হবে! এমন সময়, উত্তীর্ণ সন্ধ্যার পরে, শিল্পকলা একাডেমির ভেতরের দিকের লিফট উত্তোলনের সুইচ টিপে দাঁড়িয়ে আছেন নাটকের নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘ। তার পেছনের কিউতে কেউ যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে ব্যাপারে সে নির্লিপ্ত। লিফট নিচে এলো। উঠেই বোতাম চাপলেন পাভেল আজাদ মহার্ঘ। লিফট বন্ধ হতেই কেউ একজন বাইরে থেকে সুইচ টিপলেন। ওপরে না গিয়ে নিচেই লিফটের দরজা খুলে গেল। নটী অহনা চরিত্রের অভিনেত্রী ধ্রুপদী করিম পিপাসা লিফটের ভেতরে ঢুকলেন।
'পাভেল ভাই, দেরি হয়ে গেল।'
পাভেল আজাদ মহার্ঘ-'আমারও।'
বন্ধ হওয়া লিফট ওপরের দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেউ সুইচ চাপেনি। তাই দরজা বন্ধ হওয়া লিফট যথারীতি কারও হাতের স্পর্শ চাইছিল ওপরে ওঠার। যদিও নির্দেশক কিংবা প্রধান অভিনেত্রী নটী অহনা মানে ধ্রুপদী করিম পিপাসা কেউই মহড়াকক্ষে যাবার জন্য সাত তলার বোতাম চাপেনি। এই ভুল ইচ্ছেকৃত যে নয় সেটা সহজেই অনুমেয়। একে তো দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর টেকনিক্যাল শো'র চাপ রয়েছে মাথায়।
কিন্তু এবার, লিফটে যে দৃশ্যটি কেউ দেখেনি, সেটা দেখেছে বাতাস। সেটা দেখেছে বদ্ধঘরের অফুরন্ত কেউ। কিন্তু কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক, বাতাসে ভাসছিল এই দৃশ্যের ঢেউ-
'মঞ্চের নায়কের সঙ্গে অভিনয় করা যায়, কিন্তু মনের নায়কের সঙ্গে অভিনয় চলে না।'
মুহূর্তেই ধ্রুপদী করিম পিপাসা পাভেল আজাদ মহার্ঘকে জড়িয়ে ধরে বলল-'ইলেকট্রিসিটি চলে যায়নি। এই লিফটে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে বন্ধ হয়, খোলে না। ওপরেও ওঠে না, নিচেও নামে না। এই সময়টা স্থবির। এরকম স্থবির সময়ে একটা চুমু, ঠিক লিপে, লিফটে নয়। যে চুমুটা আমাকে দিতে হবে মঞ্চে, দর্শকের সামনে- আপনার নির্দেশে। মঞ্চের বাইরে এটা আমার নির্দেশ। চেপে ধরুন, দুই হাত দিয়ে এদিকে...তারপর চুমুটা দিন- গলা ভিজিয়ে প্রবল তৃষ্ণায়, আমরা যেভাবে চুমুকে চুমুকে ঠোঁট ভিজাই বান্টির চায়ের পেয়ালায়।'
এমন সময় যা হয়। লিফট খুলে গেল। মঞ্চে, দর্শকের সামনে যে চুমুটা পিপাসার, সেটা নির্দেশকের ওষ্ঠ ছুঁয়েছিল কিনা তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না। কারণ, আমরা কেউ দর্শক হয়ে উবারে, কেউ সিএনজিতে। কেউ কুশীলব হয়ে হেঁটে, বন্ধুর গাড়িতে পৌঁছতে চাচ্ছি শিল্পকলার গেটে। আমরা শুধু পিপাসা ও মহার্ঘর চা খাওয়ার দৃশ্যটাই শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ গৃহের বাইরে, রেলিঙে বসে দেখতে পারি। ফলে আরও একটা নাটকের জন্ম হয়। হয়তো, হয় না?
রাজদণ্ড শিরোধার্য করে রাজ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলো ভাস্কর। নটী অহনাও প্রিয়'র হাত ধরে পলাতক হতে চায়। রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণপক্ষ রাতে পলাতক হলো উভয়েই। মেঘবর্ণ তাদের পশ্চাদ অনুসরণ করল। শেষ পর্যন্ত সেই মন্দিরের কাছে এসেই ধরা পড়ল ওরা। খণ্ডযুদ্ধে আহত হলো মেঘবর্ণ। কিন্তু মন্দির প্রবেশের মুখে মেঘবর্ণ আহত করল উপলকে। অন্ধকার মন্দির অভ্যন্তরে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাবার শেষ চেষ্টা করে অহনা আর উপল। পারে না। প্রিয়ার বিষলিপ্ত অঙ্গ চুম্বন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে উপল। অহনাও প্রিয়তমের পথ অনুসরণ করল।'
অহনার পাট করছে ধ্রুপদী করিম পিপাসা। ভাস্কর রাসা উপল হয়েছে খালেদ খান যুবরাজ। আর ফয়েজ জহির অহিফেন করছে মেঘবর্ণের পাট। জমাট কাহিনি। অভিনয়ের সুযোগ রয়েছে সর্বত্র। নিছক প্রেমের নাটক। দেহের অব্যক্ত আবেদন আর মনের বসন্তের নানা জাতীয় মাতামাতি দর্শককে টান্ টান্ উত্তেজনায় আটকে রাখবে- এটা দলের প্রগাঢ় বিশ্বাস।
সন্ধ্যার গোড়ার দিকে গল্পটি কারও মুখস্থ ছিল না। অবশ্য সন্ধ্যার গোড়ার দিকে সকলেই মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন না। যারা অপেক্ষাকৃত প্রধান চরিত্রে পাট করবেন তারা আসেন উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়। প্রধান চরিত্রের এমনই একটা ভাব যেন থাকতে হয়। এটা সামন্ততান্ত্রিক- এই কথা দলের কেউ কেউ গোপনে বলে। কিন্তু মাসুম রেজা ভৈরবের এই ভাবটা নেহাত কম। এটাও অনেকে গোপনে বলে। এই নাটকে তার রোলটাও ছোটও। তবুও কোনো অভিমান নেই, তবুও কি হাসিখুশি প্রাণবন্ত। অনন্ত হিরা মধুকর তো কোনো পাটই পেল না, হল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছে এই শোতে। আবহমান নাট্যদলের মহড়ার শুরুর দিনে বিশেষ কিছু রীতি মান্য করা হয়। নির্দেশক সিনোপসিসটা সবাইকে প্রিন্ট করে আগেই বাসায় পাঠিয়ে দেন। সংলাপ মুখস্থের আগে গল্পটি মুখস্থ করানো হয়। গল্পটি মুখস্থ থাকা মানে, মনে ধরা। মনে ধরলে যে কোনো সংলাপ মনে রাখা সহজতর হয়। একই দলের কোনো সদস্য সন্ধ্যার গোড়ার মতো বন্ধুত্ব ছাড়া উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন নিষেধ আছে। এটা দলের নীতি লঙ্ঘনীয় অপরাধ। নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘ মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন সন্ধ্যার গোড়ার দিকে। উত্তর দিকে মুখ করে জানু পেতে একাকি বসে থাকেন প্রার্থনার ভঙ্গিতে। কক্ষের ভেতরে কেউ প্রবেশ করলেও তার মগ্নতার ছেদ পড়ে না।
ধ্রুপদী করিম পিপাসা যদিও সন্ধ্যার গোড়ার দিকে চলে আসেন। কিন্তু মহড়াকক্ষে প্রবেশ করেন ঠিক উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়, অন্যদের মতোই। উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় মহড়াকক্ষে প্রবেশের সময় নির্দেশককে কারও কারও মনে হয় রাজার মতো। সে আসলে রাজাও। মহড়াকক্ষটি তার কাছে তখন সাম্রাজ্যের মতোই। কুশীলবরা যেন এক একজন প্রজা। সেখানে মনে মনে কেউ কেউ নিজেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আমলা কিংবা প্রজার চরিত্রে প্রতিস্থাপন করেন অগোচরেই। এটা হয়ে যায়, একটি রাষ্ট্রের মতোই। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তবুও আমাদের মনে এভাবেই হয়। নির্দেশক এই নাটকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যে কোনো প্রজার ক্ষেত্রে তার সুশাসন কিংবা স্বৈরাচারী নীতি সকলের শিরোধার্য। যে এটা মানে না, সে হয়তো শিল্পকলার গেটের বাইরে উন্মুক্ত অঙ্গনে, বান্টির চায়ের দোকানে অথবা শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলের বাইরে, রেলিঙে বসে একটু বৈদ্যুতিক আলোয় অথবা প্রকৃতির আলো-আঁধারে ওপরের নক্ষত্ররাজির সঙ্গে নিজেকে সঙ্গ দিতে পারে।
আজ ঢাকার শহরজুড়ে ট্রাফিক জ্যাম ছিল অবর্ণনীয়, এটা হয় প্রতি বিষ্যুৎবারে। কিচ্ছু করার থাকে না। আজই টেকনিক্যাল শো। একদিন রেস্ট। দু'দিন পরে, দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ হবে আবহমান দলের নাটক-পিপাসা। টেকনিক্যাল শো'য় সন্ধ্যার গোড়ার দিকে কেউই আসতে পারল না। এমনকি নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘও না। গ্রুপ কলের সময় বয়ে গেছে। প্রত্যেকের ভেতর একটা অজানা আশঙ্কা, কী হবে! কী হবে! এমন সময়, উত্তীর্ণ সন্ধ্যার পরে, শিল্পকলা একাডেমির ভেতরের দিকের লিফট উত্তোলনের সুইচ টিপে দাঁড়িয়ে আছেন নাটকের নির্দেশক পাভেল আজাদ মহার্ঘ। তার পেছনের কিউতে কেউ যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে ব্যাপারে সে নির্লিপ্ত। লিফট নিচে এলো। উঠেই বোতাম চাপলেন পাভেল আজাদ মহার্ঘ। লিফট বন্ধ হতেই কেউ একজন বাইরে থেকে সুইচ টিপলেন। ওপরে না গিয়ে নিচেই লিফটের দরজা খুলে গেল। নটী অহনা চরিত্রের অভিনেত্রী ধ্রুপদী করিম পিপাসা লিফটের ভেতরে ঢুকলেন।
'পাভেল ভাই, দেরি হয়ে গেল।'
পাভেল আজাদ মহার্ঘ-'আমারও।'
বন্ধ হওয়া লিফট ওপরের দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেউ সুইচ চাপেনি। তাই দরজা বন্ধ হওয়া লিফট যথারীতি কারও হাতের স্পর্শ চাইছিল ওপরে ওঠার। যদিও নির্দেশক কিংবা প্রধান অভিনেত্রী নটী অহনা মানে ধ্রুপদী করিম পিপাসা কেউই মহড়াকক্ষে যাবার জন্য সাত তলার বোতাম চাপেনি। এই ভুল ইচ্ছেকৃত যে নয় সেটা সহজেই অনুমেয়। একে তো দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর টেকনিক্যাল শো'র চাপ রয়েছে মাথায়।
কিন্তু এবার, লিফটে যে দৃশ্যটি কেউ দেখেনি, সেটা দেখেছে বাতাস। সেটা দেখেছে বদ্ধঘরের অফুরন্ত কেউ। কিন্তু কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক, বাতাসে ভাসছিল এই দৃশ্যের ঢেউ-
'মঞ্চের নায়কের সঙ্গে অভিনয় করা যায়, কিন্তু মনের নায়কের সঙ্গে অভিনয় চলে না।'
মুহূর্তেই ধ্রুপদী করিম পিপাসা পাভেল আজাদ মহার্ঘকে জড়িয়ে ধরে বলল-'ইলেকট্রিসিটি চলে যায়নি। এই লিফটে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে বন্ধ হয়, খোলে না। ওপরেও ওঠে না, নিচেও নামে না। এই সময়টা স্থবির। এরকম স্থবির সময়ে একটা চুমু, ঠিক লিপে, লিফটে নয়। যে চুমুটা আমাকে দিতে হবে মঞ্চে, দর্শকের সামনে- আপনার নির্দেশে। মঞ্চের বাইরে এটা আমার নির্দেশ। চেপে ধরুন, দুই হাত দিয়ে এদিকে...তারপর চুমুটা দিন- গলা ভিজিয়ে প্রবল তৃষ্ণায়, আমরা যেভাবে চুমুকে চুমুকে ঠোঁট ভিজাই বান্টির চায়ের পেয়ালায়।'
এমন সময় যা হয়। লিফট খুলে গেল। মঞ্চে, দর্শকের সামনে যে চুমুটা পিপাসার, সেটা নির্দেশকের ওষ্ঠ ছুঁয়েছিল কিনা তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না। কারণ, আমরা কেউ দর্শক হয়ে উবারে, কেউ সিএনজিতে। কেউ কুশীলব হয়ে হেঁটে, বন্ধুর গাড়িতে পৌঁছতে চাচ্ছি শিল্পকলার গেটে। আমরা শুধু পিপাসা ও মহার্ঘর চা খাওয়ার দৃশ্যটাই শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ গৃহের বাইরে, রেলিঙে বসে দেখতে পারি। ফলে আরও একটা নাটকের জন্ম হয়। হয়তো, হয় না?
মন্তব্য করুন