
'চেয়ারম্যান সাব, কোনো অসুবিধা হইতেছে না তো?'
হেডমাস্টার ইউসুফ মোক্তার বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন।
ইউসুফ মোক্তার কালিহাটি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। তিনি আবুল চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন লোক। ইলেকশনে তার পক্ষে জনসংযোগ করেছেন। হেডমাস্টারের কথায় প্রীত চোখে তাকাল চেয়ারম্যান। বলল-
মাস্টার সাহেব, আপনি থাকতে অসুবিধা হবে ক্যান? আপনাদের জন্য ইলেকশনে জিতেছি। সেই আনন্দে কর্মীদের নিয়ে একটু পানাহার করব, তারপর বাড়ি চলে যাব। দপ্তরি দরজায় তালা লাগায়ে দেবে। আপনি বাড়ি যেতে পারেন। রাত হচ্ছে।
সালামালেকুম বলে বাড়ির পথে হাঁটলেন ইউসুফ মাস্টার। বাঁশঝাড়ের ছায়া বিছানো অন্ধকারে মাস্টারের শরীর ডুবে গেলে ঘোঁৎ শব্দ করে ঢেঁকুর তুলল চেয়ারম্যান। অন্ধকার পথের দিকে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলল-
মাস্টারকে এবার এমপিওর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কথা দিয়েছি।
বস্, কথা তো মেলা দিয়েছেন, ক'টা রাখতে পারবেন?
পাশ থেকে আক্কাস কথা বলে উঠলে গিরগিটির মতো ঘাড় মুচড়ে তার দিকে তাকাল আবুল চেয়ারম্যান। আক্কাস আলী তার ডান হাত। ছায়ার মতো সাথে সাথে থাকে।
ক'টা রাখতে পারব, পারব না, সেটা আমার বিষয়। তোকে ভাবতে হবে না। তবে ভোটের রাজারে প্রতিশ্রুতি না দিলে প্রার্থীকে দাম দেয় কেউ?
তা ঠিক। প্রার্থীর দাম না উঠলে ভোটারের নজর পড়বে কেমনে। তবে বস্, মাঝে মাঝে ভোটের বাজার আর গরু-ছাগলের বাজার আমার কাছে একরকম মনে হয়।
এইটা কী রকম কথা? গরু-ছাগল আর মানুষ কি এক জিনিস?
এক জিনিস না বস্।
আক্কাস গলার সুর নরম করে বলল-
গরু-ছাগলের চার পা আর মানুষের দুই পা। গরু-ছাগল নিরীহ, বোকা; আর মানুষ হইল বুদ্ধিমান, চতুর। তবে দুইটা-ই বেচাকেনা হয়। কি রে হাসিমুদ্দি, ঠিক বলেছি না?
তাড়ির গ্লাস হাতে কালো মহিষের মতো শরীরটা নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেছে হাসিমুদ্দি। সে আবুল চেয়ারম্যানের বাম হাত। আক্কাসের কথায় সাড়া দিল না হাসিমুদ্দি। কেবল ভাবলেশহীন ট্যারা চোখ দুটো মেলে রাখল আক্কাসের দিকে। লোকটা কথা বলে কম। তাকায় সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে।
আবুল চেয়ারম্যান অপ্রসন্ন চোখে আক্কাসের দিকে তাকাল, তারপর গ্লাসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল-
নে, পানি ঢাল। মাঝে মাঝে তোর কথা শুনলে চান্দি গরম হয়ে যায়। ফাজিল কোথাকার!
চেয়ারম্যানের কথা আক্কাস গায়ে মাখল না। সে জগ কাত করে গ্লাসে তাড়ি ঢালে। গ্লাসের গলায় সাদা ফেনার সর ফুঁসে উঠলে, গ্লাসটা চেয়ারম্যানকে ফিরিয়ে দেয়। আক্কাস আলীর ঠোঁটে এক চিলতে চতুর হাসির ঝিলিক দিচ্ছে। আবুল চেয়ারম্যান খেয়াল করে না।
নদী থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাস বাজের মতো ছোঁ মেরে যায়। স্কুল ঘরের বারান্দা ঘেঁষে আমগাছের ডালডালা নড়েচড়ে ওঠে। টিনের চালে খসখসানি শব্দ হয়। সুপারির মাথা থেকে ঝটপট শব্দে ডানা মেলে উড়ে যায় একটা বাদুড়। বাতাসের ঝাপটায় অন্ধকার মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সহোদর ইউক্যালিপটাস হেলেদুলে নাচে। পাতা থেকে হিসহিস শব্দ করে শ্বাস ফেলে। এসব কিছুই লক্ষ্য করে না ওরা। তাড়ির নেশায় নিজেদের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকে তিনটে লোক। রাত যত ঘনিয়ে আসে ওদের চোখেমুখে স্ম্ফূর্তির আমেজ নেশার রং ছড়াতে থাকে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আবুল চেয়ারম্যান তৃপ্তিতে মাথা ঝাঁকায়। আক্কাসের দিকে নেশা-ধরা চোখ তুলে বলে-
আমাদের বাশার কাজীর তালের পাকা রস বরাবরই এক নম্বর। যেমন ঘ্রাণ! তেমন স্বাদ! শীতের রাতে লেপের ভিতর ঢুকলে যেমন ওম লাগে, চুমুকে চুমুকে তেমনি গা গরম হয়, নেশা লাগে আস্তে ধীরে।
ঠিক বলেছেন, বস্। কাজীর মালের স্বাদ-ই আলাদা।
চেয়ারম্যানের কথায় সায় দিয়ে আক্কাস হাসল। ঘরের একপাশে রাখা হারিকেনের নিষ্প্রভ হলদে আলো উজিয়ে পড়ছে তার চোখেমুখে, মসৃণ ফর্সা চোয়ালে। চোখের মণিতে চকচক করে নেশার দ্যুতি।
আক্কাস তার হাতের থাবার নিচে আটকে রাখা গ্লাসটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তারপর চোখ তুলে চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়। চেয়ারম্যানের কাঁচাপাকা গোঁফে সাদা ফেনা জমে আছে। একটু কেশে গলা পরিস্কার করল আক্কাস। বলল-
বস্, আপনাকে তো জিতায়ে দিলাম। বলেছিলেন, ইলেকশনে জিতলে আমাদের খুশি করবেন।
বলেছি। আমার মনে আছে। বল, কী চাস?
চেয়ারম্যান প্রীত চোখে তাকাল। এখন তার খোশ দিল। পাকা রসের অমৃতের স্বাদে শরীর মন চনমনে। চোখে একটু ঢুলু ঢুলু ভাব থাকলেও ভিতরে ভিতরে লোকটা যে খরগোসের মতো সজাগ, আক্কাস আলী সেটা জানে। মানুষটার সঙ্গে এতদিন চলেফিরে তার ভাবগতিক রপ্ত হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের কথায় আক্কাস চুলে আঙুল ডুবিয়ে মাথা চুলকাতে লাগে। চাহিদার ফর্দ দিতে একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। চোরা চোখে হাসিমুদ্দির দিকে তাকায়। বলদটা নির্বিকার মুখে তাড়িতে চুমু খাচ্ছে। আক্কাসের ইতস্তত ভাব দেখে আবুল চেয়ারম্যান মনে মনে হাসে। ছেলেটা ইলেকশনে তার জন্য জান দিয়ে খেটেছে। তাকে খুশি করবে না কেন? সে গলায় উচ্ছ্বাস ঢেলে বলল-
বড় বাজারের নতুন রাস্তার কাজ শেষের পথে, নতুন রাস্তাটা তোকে দেই?
বস্, রাস্তা দিয়া কী করব?
আক্কাস আলী অপছন্দের চোখ তুলে তাকাল।
আহাম্মক বলে কী?
আক্কাসের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায় চেয়ারম্যান। একটু দম নিয়ে বলে-
রাস্তায় টেম্পোস্ট্যান্ড আছে না? চান্দা তুলবি। হকারের দোকান বসাবি, টোল তুলবি, অই রাস্তায় মোড়লগঞ্জ রুটের বাস চলাচল করে-
হাত তুলে চেয়ারম্যানকে কথার মাঝপথে থামিয়ে দিল আক্কাস-
বস্, আমার রাস্তার দরকার নাই।
তা হলে নদীটা নে।
নদী দিয়া কী করব?
আরে বেকুব, নদী থেকে বালু তুলবি আর বেচবি। গুদারাঘাটে টোল তুলবি। জাইল্লার কাছ থেকে চাঁদা তুলবি।
না, বস্।
মাথা দোলাতে দোলাতে অপারগতা প্রকাশ করে আক্কাস।
তা হলে তোকে বাজার কমিটিতে বসাই-
আক্কাসের মাথার দুলুনি থামে না।
ওইসব আপনার জন্যি রাখেন। আপনি না রাখলে হাসিমুদ্দিকে দেন। আমার দরকার নাই।
তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের অসহিষুষ্ণ সুর গাঙফড়িংয়ের পাখনার মতো ফরফর করে বেজে উঠলে চেয়ারম্যান মুখের কাছে ধরে রাখা গ্লাসটা আস্তে করে নামিয়ে রাখে। দুই চোখে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আক্কাসের চোখমুখ লেহন করতে করতে শান্ত গলায় বলল-
তা হলে তুই কী চাস, বলত?
আক্কাসের চোখেমুখে জড়তা। সে মেনিমুখ করে আবুল চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়। তারপর পাশে বসা হাসিমুদ্দির দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে-
এই বেটা, পা নাচাইতেছ ক্যান? পেসাব ধরেছে তো পেসাব করে আয়।
হাসিমুদ্দির কালো মুখটা অন্ধকারে মিশে থাকা তক্ষকের মতো কুৎসিত দেখাচ্ছে। সে ভাবলেশহীন চোখ তুলে আক্কাসের দিকে তাকাল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে। আক্কাস এখন চেয়ারম্যানের সাথে একা কথা বলতে চায়। হাসিমুদ্দি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল তারপর মাঠের ওধারে শিমুল গাছের নিচে জমে থাকা অন্ধকার ডিবি লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকে। শিমুলের চূড়ায় ঝুলছে এক টুকরো হলদে চাঁদ। পূর্ণিমা লাগতে দেরি আছে।
বস্, আমার তো কেউ নাই। আপনি আমার মা-বাপ। আপনার কাছে চাইতে শরম কী।
শরমের কথা আসে কেন? কী চাস বলত?
চেয়ারম্যানের গলায় সন্দেহের সুর খসখস করে ওঠে।
বস্, আমি বিয়া করে সংসারী হতে চাই।
আক্কাসের কথা শুনে আবুল চেয়ারম্যান একটু চুপ করে থাকে, তার চোখমুখ থেকে সন্দেহের মেঘ কাটে না। শান্ত গলায় বলে-
বিয়া করবি, সে তো ভালো কথা। মেয়ে পছন্দ করছস?
করেছি?
মেয়েটা কে?
হাসনা।
আবুল চেয়ারম্যান শেয়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখ মেলে আক্কাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো-আঁধারের ঘেরাটোপে আক্কাসের চোখের মণি দুটো স্থির, চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে আছে। মনে মনে দুর্ধর্ষ ছেলেটার চেহারায় কিছু একটা হাতড়াতে হাতড়াতে শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল আবুল চেয়ারম্যান। নদী থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা সুড়সুড়ি জাগানো বাতাস বাঁশঝাড়ে হুল্লোড় তুলেছে। স্কুলের মাঠে দড়িতে টানানো চেয়ারম্যানের পোস্টারের কাগজ ফরফর শব্দ করে উড়তে থাকে। সেই শব্দের সাথে আবুল চেয়ারম্যান বুক থেকে বের হওয়া চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে যায়। সে নিঃশব্দে গ্লাসটা ঠেলে দেয় আক্কাসের দিকে। আক্কাস জগটা কাত করে গ্লাস ভরে দেয়। গ্লাসের মুখে সাদা ফেনার সর ফুলে ওঠে। চেয়ারম্যান ফেনার গভীরে ঠোঁট ভিজিয়ে আক্কাসের দিকে মুখ ফেরাল। আক্কাসের যুবকসুলভ দাম্ভিক চেহারা আলো-আঁধারে ডুবে রয়েছে। দাঁড়াশের মতো গলা উঁচু করে দুটো টলটলে কালো চোখের ফণা চেয়ারম্যানের মুখে স্থির মেলে রেখেছে সে।
তোর নামে আটটা মামলা আছে না?
আছে তো। আপনি হলেন আমাদের কত্তা। আপনার হুকুমে কাজ করি। থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা আপনি সামলাবেন।
এতগুলো খুন-জখম করেছিস, এমনি এমনি পার পেয়ে যাবি? আজরাইল তো তোর পিছন পিছন ঘুরতেছে।
সেইটা আমি সামলাব।
আমার মা মরা মেয়ে। আমাকে তো দেখেশুনে তার বিয়া দেওয়া লাগবে, নাকি?
জি।
আবুল চেয়ারম্যান মাটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকল। একটা কিছু চিন্তা করছে। এক সময় মুখ তুলে সামনের মাঠের দিকে তাকাল। অন্ধকার ফুঁড়ে বেঢপ সাইজের শরীরটা নিয়ে হেলতে দুলতে আসছে হাসিমুদ্দি। আবুল চেয়ারম্যান সেদিকে মুখ রেখে গম্ভীর গলায় বলল-
বিষয়টা নিয়ে আমি এট্টু চিন্তাভাবনা করে দেখি। তুই বাড়ি যা।
আক্কাস চলে গেলে দুটো মানুষকে ঘিরে যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হাসিমুদ্দি গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নির্বিকার চোখে চেয়ারম্যানকে দেখছে। লোকটা চিন্তিত, অন্যমনস্ক। চোখ দুটো টেবিলে ছুরির ফলার মতো বিঁধে রয়েছে, কপালের চামড়া কুঁচকানো। চেয়ারম্যান মনে মনে একটা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। আক্কাস দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একে থামানো দরকার। ইদানীং যে আক্কাসের নজর হাসনার দিকে পড়েছে সেটা আকারে ইঙ্গিতে তার কানে পৌঁছেছে। ইলেকশনের জন্য বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। চেয়ারম্যানকে খুশি করতে গিয়ে আক্কাস অনেক শত্রু বানিয়েছে। ইলেকশনের সময় প্রতিপক্ষ রতন মেম্বারের লোকজনের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল। মেম্বারের দুই সমর্থক হাসপাতালে, তাদের যখন-তখন অবস্থা। শুনেছে রতনের লোকজন তক্কে তক্কে রয়েছে। আক্কাসের লাশ পড়বেই। তবে রতন মেম্বারের জন্য বসে থাকা যাবে না। সুযোগটা তাকেই, এখনই কাজে লাগাতে হবে।
হারিকেনের সলতে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ প্রায়। সলতেটা নিভে গেলে চারপাশ গিলে খাবার জন্য হাঁ মেলে আছে অন্ধকার। চেয়ারম্যান তাড়ির গ্লাস একপাশে সরিয়ে রাখল, একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিল। তারপর হাসিমুদ্দিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
কেউ যদি আগুন জ্বালাতে চায়, দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠিই যথেষ্ট। ফস করে একবার জ্বলে উঠলেই হলো। ঠিক না হাসিমুদ্দি?
জি।
আগুন জ্বালানোর সুয়োগ দেওয়া যাবে না। হাসিমুদ্দি, আমার কথা কিছু বুঝা গেছে?
জি। বুঝতে পারছি।
মুখ নামিয়ে খসখসে নিচু গলায় চেয়ারম্যান বলল-
অস্ত্র আছে সাথে?
জি, বাইরে রেখে আসছি।
পোলাডার অনেক বাড় বাড়ছে। কোপায়া লাশ ফালায়া দিবি। খুনের দায় যাবে রতনের লোকজনের ওপর। পারবি না? চেয়ারম্যানের মুখ থেকে ভুসভুস করে তাড়ির গন্ধ বের হয়। সে হাতের চেটো দিয়ে কষ থেকে ফেনা মুছে, মাথা ঝুঁকিয়ে কঠিন চোখে হাসিমুদ্দির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শরীর নিয়ে দুলে উঠল হাসিমুদ্দি, উবু হয়ে চেয়ারম্যানের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে করতে বলল-
জি বস্, আমি কাম শেষ করে আসব। আমার ওপর একটু নজর রাখবেন। কমিটিতে যেন পদ থাকে।
হবে, হবে। শূন্যে হাত দুলিয়ে আবুল চেয়ারম্যান তাকে আশ্বস্ত করল।
উড়ন্ত মেঘের নিচে চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকারে গুলিয়ে উঠে চারপাশ। রাতের বাতাস সুপারির মাথায় আছড়ে পড়ে। শব্দ করে পাতাগুলো নড়েচড়ে ওঠে। একটা প্যাঁচা তীব্র চিৎকার করতে করতে উড়ে যায় দূরে বট গাছটার দিকে।
অন্ধকার যেন মৌমাছির ঝাঁকের মতো ঘিরে আছে চারপাশ থেকে। নেশার ঘোরে, টালমাটাল পায়ে সাবধানে হাঁটে আবুল চেয়ারম্যান। মাটি থেকে বারবার পা সরে যেতে চায় যেন। অন্ধকারে উবু হয়ে বসে থাকা খড়ের গাদা পার হয়। সুপারি গাছের নিচে সাদা মাটির পিঠ বের করে থাকা পথটা থমথমে। উঠানের একপ্রান্তে বড় ঘরের সিঁড়িটা যেন অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। নেশা আর ঘুমজড়ানো চোখে সেদিকে হাঁটে চেয়ারম্যান। সিঁড়ির পাশে হারিকেন জ্বলছে। চেয়ারম্যানের ফিরতে রাত হলে আঙুরী আলোটা সিঁড়ির পাশে জ্বালিয়ে রাখে। চিমনির ভিতর থেকে হলদে চোখ হারিকেন মেলে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আলোটা। তাকিয়ে থাকে আঙুরীর জেগে থাকা চোখ দুটিও। আঙুরী আবুল চেয়ারম্যানের তৃতীয়পক্ষ। যুবতী বয়স। খুবই স্বামীভক্ত।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে আঙুরী ছুটে আসে। চেয়ারম্যানের নেতানো শরীর জাপটে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। খাটের ওপর শরীরটাকে ছুড়ে ফেলে আবুল জিজ্ঞাসা করে-
হাসনা ঘুমাইছে?
ঘুমাইছে।
আঙুরী ছোট্ট জবাব দেয়।
ইলেকশনের জন্য অনেক রাত স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেনি আবুল চেয়ারম্যান। আজকে তার খুব ঘুম পাচ্ছে। আঙুরী ফুঁ দিয়ে হারিকেনটা নিভিয়ে দেয়। ঘরের চারপাশ থেকে অন্ধকার থৈ থৈ করে নাচতে লাগে। শাড়ির খসখসানি আর চুড়ির টুংটুং শব্দে ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে যেতে একসময় আবুলের মনে হয় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আক্কাস আলী। দুই চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চেয়ারম্যান, ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলে-
আক্কাস, তুই?
আক্কাসের মুখে, গোঁফের নিচে ক্রূর হাসি। চোখ থেকে আগুন ঝরছে। দোজখের আগুন। আগুনের তাপে ঝলসে যাচ্ছে চেয়ারম্যানের শরীর। চেয়ারম্যানের গোটা বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে।
আবুল চেয়ারম্যান ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। ঘামে ওর শরীর ভিজে গেছে। হাতের তালুতে দুই চোখ কচলাতে কচলাতে সে নিজেকেই প্রশ্ন করে-
আক্কাস মরে নাই?
পাশ থেকে চুড়ির শব্দ হয়। আঙুরী ঘুমজড়ানো গলায় বলে- খোয়াব দেখতেছিলেন। ঘুমান, বিয়ান হইতে দেরি আছে। আঙুরীর নরম হাত দুটো আবুল চেয়ারম্যানকে ময়ালের মতো জড়িয়ে ধরে।
ভোরবেলা আঙুরীর ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল আবুল চেয়ারম্যানের। চোখ মুছতে মুছতে সে আঙুরীর দিকে তাকায়। আঙুরীর ফর্সা মুখে ভীষণ উদ্বেগের ছাপ।
কী অইছে?
আপনার মেয়ে পলাইছে! আঙুরীর গলায় গভীর শঙ্কার সুর বেজে উঠলে আবুলের বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠল। সে হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকল। খাটের ওপর হাসনার বাসি কাপড় পড়ে আছে। ঘরে হাসনা নেই, বাড়ির কোথাও হাসনা নেই।
হেডমাস্টার ইউসুফ মোক্তার বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন।
ইউসুফ মোক্তার কালিহাটি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। তিনি আবুল চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন লোক। ইলেকশনে তার পক্ষে জনসংযোগ করেছেন। হেডমাস্টারের কথায় প্রীত চোখে তাকাল চেয়ারম্যান। বলল-
মাস্টার সাহেব, আপনি থাকতে অসুবিধা হবে ক্যান? আপনাদের জন্য ইলেকশনে জিতেছি। সেই আনন্দে কর্মীদের নিয়ে একটু পানাহার করব, তারপর বাড়ি চলে যাব। দপ্তরি দরজায় তালা লাগায়ে দেবে। আপনি বাড়ি যেতে পারেন। রাত হচ্ছে।
সালামালেকুম বলে বাড়ির পথে হাঁটলেন ইউসুফ মাস্টার। বাঁশঝাড়ের ছায়া বিছানো অন্ধকারে মাস্টারের শরীর ডুবে গেলে ঘোঁৎ শব্দ করে ঢেঁকুর তুলল চেয়ারম্যান। অন্ধকার পথের দিকে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলল-
মাস্টারকে এবার এমপিওর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কথা দিয়েছি।
বস্, কথা তো মেলা দিয়েছেন, ক'টা রাখতে পারবেন?
পাশ থেকে আক্কাস কথা বলে উঠলে গিরগিটির মতো ঘাড় মুচড়ে তার দিকে তাকাল আবুল চেয়ারম্যান। আক্কাস আলী তার ডান হাত। ছায়ার মতো সাথে সাথে থাকে।
ক'টা রাখতে পারব, পারব না, সেটা আমার বিষয়। তোকে ভাবতে হবে না। তবে ভোটের রাজারে প্রতিশ্রুতি না দিলে প্রার্থীকে দাম দেয় কেউ?
তা ঠিক। প্রার্থীর দাম না উঠলে ভোটারের নজর পড়বে কেমনে। তবে বস্, মাঝে মাঝে ভোটের বাজার আর গরু-ছাগলের বাজার আমার কাছে একরকম মনে হয়।
এইটা কী রকম কথা? গরু-ছাগল আর মানুষ কি এক জিনিস?
এক জিনিস না বস্।
আক্কাস গলার সুর নরম করে বলল-
গরু-ছাগলের চার পা আর মানুষের দুই পা। গরু-ছাগল নিরীহ, বোকা; আর মানুষ হইল বুদ্ধিমান, চতুর। তবে দুইটা-ই বেচাকেনা হয়। কি রে হাসিমুদ্দি, ঠিক বলেছি না?
তাড়ির গ্লাস হাতে কালো মহিষের মতো শরীরটা নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেছে হাসিমুদ্দি। সে আবুল চেয়ারম্যানের বাম হাত। আক্কাসের কথায় সাড়া দিল না হাসিমুদ্দি। কেবল ভাবলেশহীন ট্যারা চোখ দুটো মেলে রাখল আক্কাসের দিকে। লোকটা কথা বলে কম। তাকায় সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে।
আবুল চেয়ারম্যান অপ্রসন্ন চোখে আক্কাসের দিকে তাকাল, তারপর গ্লাসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল-
নে, পানি ঢাল। মাঝে মাঝে তোর কথা শুনলে চান্দি গরম হয়ে যায়। ফাজিল কোথাকার!
চেয়ারম্যানের কথা আক্কাস গায়ে মাখল না। সে জগ কাত করে গ্লাসে তাড়ি ঢালে। গ্লাসের গলায় সাদা ফেনার সর ফুঁসে উঠলে, গ্লাসটা চেয়ারম্যানকে ফিরিয়ে দেয়। আক্কাস আলীর ঠোঁটে এক চিলতে চতুর হাসির ঝিলিক দিচ্ছে। আবুল চেয়ারম্যান খেয়াল করে না।
নদী থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাস বাজের মতো ছোঁ মেরে যায়। স্কুল ঘরের বারান্দা ঘেঁষে আমগাছের ডালডালা নড়েচড়ে ওঠে। টিনের চালে খসখসানি শব্দ হয়। সুপারির মাথা থেকে ঝটপট শব্দে ডানা মেলে উড়ে যায় একটা বাদুড়। বাতাসের ঝাপটায় অন্ধকার মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সহোদর ইউক্যালিপটাস হেলেদুলে নাচে। পাতা থেকে হিসহিস শব্দ করে শ্বাস ফেলে। এসব কিছুই লক্ষ্য করে না ওরা। তাড়ির নেশায় নিজেদের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকে তিনটে লোক। রাত যত ঘনিয়ে আসে ওদের চোখেমুখে স্ম্ফূর্তির আমেজ নেশার রং ছড়াতে থাকে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আবুল চেয়ারম্যান তৃপ্তিতে মাথা ঝাঁকায়। আক্কাসের দিকে নেশা-ধরা চোখ তুলে বলে-
আমাদের বাশার কাজীর তালের পাকা রস বরাবরই এক নম্বর। যেমন ঘ্রাণ! তেমন স্বাদ! শীতের রাতে লেপের ভিতর ঢুকলে যেমন ওম লাগে, চুমুকে চুমুকে তেমনি গা গরম হয়, নেশা লাগে আস্তে ধীরে।
ঠিক বলেছেন, বস্। কাজীর মালের স্বাদ-ই আলাদা।
চেয়ারম্যানের কথায় সায় দিয়ে আক্কাস হাসল। ঘরের একপাশে রাখা হারিকেনের নিষ্প্রভ হলদে আলো উজিয়ে পড়ছে তার চোখেমুখে, মসৃণ ফর্সা চোয়ালে। চোখের মণিতে চকচক করে নেশার দ্যুতি।
আক্কাস তার হাতের থাবার নিচে আটকে রাখা গ্লাসটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তারপর চোখ তুলে চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়। চেয়ারম্যানের কাঁচাপাকা গোঁফে সাদা ফেনা জমে আছে। একটু কেশে গলা পরিস্কার করল আক্কাস। বলল-
বস্, আপনাকে তো জিতায়ে দিলাম। বলেছিলেন, ইলেকশনে জিতলে আমাদের খুশি করবেন।
বলেছি। আমার মনে আছে। বল, কী চাস?
চেয়ারম্যান প্রীত চোখে তাকাল। এখন তার খোশ দিল। পাকা রসের অমৃতের স্বাদে শরীর মন চনমনে। চোখে একটু ঢুলু ঢুলু ভাব থাকলেও ভিতরে ভিতরে লোকটা যে খরগোসের মতো সজাগ, আক্কাস আলী সেটা জানে। মানুষটার সঙ্গে এতদিন চলেফিরে তার ভাবগতিক রপ্ত হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের কথায় আক্কাস চুলে আঙুল ডুবিয়ে মাথা চুলকাতে লাগে। চাহিদার ফর্দ দিতে একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। চোরা চোখে হাসিমুদ্দির দিকে তাকায়। বলদটা নির্বিকার মুখে তাড়িতে চুমু খাচ্ছে। আক্কাসের ইতস্তত ভাব দেখে আবুল চেয়ারম্যান মনে মনে হাসে। ছেলেটা ইলেকশনে তার জন্য জান দিয়ে খেটেছে। তাকে খুশি করবে না কেন? সে গলায় উচ্ছ্বাস ঢেলে বলল-
বড় বাজারের নতুন রাস্তার কাজ শেষের পথে, নতুন রাস্তাটা তোকে দেই?
বস্, রাস্তা দিয়া কী করব?
আক্কাস আলী অপছন্দের চোখ তুলে তাকাল।
আহাম্মক বলে কী?
আক্কাসের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায় চেয়ারম্যান। একটু দম নিয়ে বলে-
রাস্তায় টেম্পোস্ট্যান্ড আছে না? চান্দা তুলবি। হকারের দোকান বসাবি, টোল তুলবি, অই রাস্তায় মোড়লগঞ্জ রুটের বাস চলাচল করে-
হাত তুলে চেয়ারম্যানকে কথার মাঝপথে থামিয়ে দিল আক্কাস-
বস্, আমার রাস্তার দরকার নাই।
তা হলে নদীটা নে।
নদী দিয়া কী করব?
আরে বেকুব, নদী থেকে বালু তুলবি আর বেচবি। গুদারাঘাটে টোল তুলবি। জাইল্লার কাছ থেকে চাঁদা তুলবি।
না, বস্।
মাথা দোলাতে দোলাতে অপারগতা প্রকাশ করে আক্কাস।
তা হলে তোকে বাজার কমিটিতে বসাই-
আক্কাসের মাথার দুলুনি থামে না।
ওইসব আপনার জন্যি রাখেন। আপনি না রাখলে হাসিমুদ্দিকে দেন। আমার দরকার নাই।
তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের অসহিষুষ্ণ সুর গাঙফড়িংয়ের পাখনার মতো ফরফর করে বেজে উঠলে চেয়ারম্যান মুখের কাছে ধরে রাখা গ্লাসটা আস্তে করে নামিয়ে রাখে। দুই চোখে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আক্কাসের চোখমুখ লেহন করতে করতে শান্ত গলায় বলল-
তা হলে তুই কী চাস, বলত?
আক্কাসের চোখেমুখে জড়তা। সে মেনিমুখ করে আবুল চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়। তারপর পাশে বসা হাসিমুদ্দির দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে-
এই বেটা, পা নাচাইতেছ ক্যান? পেসাব ধরেছে তো পেসাব করে আয়।
হাসিমুদ্দির কালো মুখটা অন্ধকারে মিশে থাকা তক্ষকের মতো কুৎসিত দেখাচ্ছে। সে ভাবলেশহীন চোখ তুলে আক্কাসের দিকে তাকাল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে। আক্কাস এখন চেয়ারম্যানের সাথে একা কথা বলতে চায়। হাসিমুদ্দি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল তারপর মাঠের ওধারে শিমুল গাছের নিচে জমে থাকা অন্ধকার ডিবি লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকে। শিমুলের চূড়ায় ঝুলছে এক টুকরো হলদে চাঁদ। পূর্ণিমা লাগতে দেরি আছে।
বস্, আমার তো কেউ নাই। আপনি আমার মা-বাপ। আপনার কাছে চাইতে শরম কী।
শরমের কথা আসে কেন? কী চাস বলত?
চেয়ারম্যানের গলায় সন্দেহের সুর খসখস করে ওঠে।
বস্, আমি বিয়া করে সংসারী হতে চাই।
আক্কাসের কথা শুনে আবুল চেয়ারম্যান একটু চুপ করে থাকে, তার চোখমুখ থেকে সন্দেহের মেঘ কাটে না। শান্ত গলায় বলে-
বিয়া করবি, সে তো ভালো কথা। মেয়ে পছন্দ করছস?
করেছি?
মেয়েটা কে?
হাসনা।
আবুল চেয়ারম্যান শেয়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখ মেলে আক্কাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো-আঁধারের ঘেরাটোপে আক্কাসের চোখের মণি দুটো স্থির, চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে আছে। মনে মনে দুর্ধর্ষ ছেলেটার চেহারায় কিছু একটা হাতড়াতে হাতড়াতে শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল আবুল চেয়ারম্যান। নদী থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা সুড়সুড়ি জাগানো বাতাস বাঁশঝাড়ে হুল্লোড় তুলেছে। স্কুলের মাঠে দড়িতে টানানো চেয়ারম্যানের পোস্টারের কাগজ ফরফর শব্দ করে উড়তে থাকে। সেই শব্দের সাথে আবুল চেয়ারম্যান বুক থেকে বের হওয়া চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে যায়। সে নিঃশব্দে গ্লাসটা ঠেলে দেয় আক্কাসের দিকে। আক্কাস জগটা কাত করে গ্লাস ভরে দেয়। গ্লাসের মুখে সাদা ফেনার সর ফুলে ওঠে। চেয়ারম্যান ফেনার গভীরে ঠোঁট ভিজিয়ে আক্কাসের দিকে মুখ ফেরাল। আক্কাসের যুবকসুলভ দাম্ভিক চেহারা আলো-আঁধারে ডুবে রয়েছে। দাঁড়াশের মতো গলা উঁচু করে দুটো টলটলে কালো চোখের ফণা চেয়ারম্যানের মুখে স্থির মেলে রেখেছে সে।
তোর নামে আটটা মামলা আছে না?
আছে তো। আপনি হলেন আমাদের কত্তা। আপনার হুকুমে কাজ করি। থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা আপনি সামলাবেন।
এতগুলো খুন-জখম করেছিস, এমনি এমনি পার পেয়ে যাবি? আজরাইল তো তোর পিছন পিছন ঘুরতেছে।
সেইটা আমি সামলাব।
আমার মা মরা মেয়ে। আমাকে তো দেখেশুনে তার বিয়া দেওয়া লাগবে, নাকি?
জি।
আবুল চেয়ারম্যান মাটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকল। একটা কিছু চিন্তা করছে। এক সময় মুখ তুলে সামনের মাঠের দিকে তাকাল। অন্ধকার ফুঁড়ে বেঢপ সাইজের শরীরটা নিয়ে হেলতে দুলতে আসছে হাসিমুদ্দি। আবুল চেয়ারম্যান সেদিকে মুখ রেখে গম্ভীর গলায় বলল-
বিষয়টা নিয়ে আমি এট্টু চিন্তাভাবনা করে দেখি। তুই বাড়ি যা।
আক্কাস চলে গেলে দুটো মানুষকে ঘিরে যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হাসিমুদ্দি গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নির্বিকার চোখে চেয়ারম্যানকে দেখছে। লোকটা চিন্তিত, অন্যমনস্ক। চোখ দুটো টেবিলে ছুরির ফলার মতো বিঁধে রয়েছে, কপালের চামড়া কুঁচকানো। চেয়ারম্যান মনে মনে একটা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। আক্কাস দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একে থামানো দরকার। ইদানীং যে আক্কাসের নজর হাসনার দিকে পড়েছে সেটা আকারে ইঙ্গিতে তার কানে পৌঁছেছে। ইলেকশনের জন্য বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। চেয়ারম্যানকে খুশি করতে গিয়ে আক্কাস অনেক শত্রু বানিয়েছে। ইলেকশনের সময় প্রতিপক্ষ রতন মেম্বারের লোকজনের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল। মেম্বারের দুই সমর্থক হাসপাতালে, তাদের যখন-তখন অবস্থা। শুনেছে রতনের লোকজন তক্কে তক্কে রয়েছে। আক্কাসের লাশ পড়বেই। তবে রতন মেম্বারের জন্য বসে থাকা যাবে না। সুযোগটা তাকেই, এখনই কাজে লাগাতে হবে।
হারিকেনের সলতে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ প্রায়। সলতেটা নিভে গেলে চারপাশ গিলে খাবার জন্য হাঁ মেলে আছে অন্ধকার। চেয়ারম্যান তাড়ির গ্লাস একপাশে সরিয়ে রাখল, একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিল। তারপর হাসিমুদ্দিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
কেউ যদি আগুন জ্বালাতে চায়, দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠিই যথেষ্ট। ফস করে একবার জ্বলে উঠলেই হলো। ঠিক না হাসিমুদ্দি?
জি।
আগুন জ্বালানোর সুয়োগ দেওয়া যাবে না। হাসিমুদ্দি, আমার কথা কিছু বুঝা গেছে?
জি। বুঝতে পারছি।
মুখ নামিয়ে খসখসে নিচু গলায় চেয়ারম্যান বলল-
অস্ত্র আছে সাথে?
জি, বাইরে রেখে আসছি।
পোলাডার অনেক বাড় বাড়ছে। কোপায়া লাশ ফালায়া দিবি। খুনের দায় যাবে রতনের লোকজনের ওপর। পারবি না? চেয়ারম্যানের মুখ থেকে ভুসভুস করে তাড়ির গন্ধ বের হয়। সে হাতের চেটো দিয়ে কষ থেকে ফেনা মুছে, মাথা ঝুঁকিয়ে কঠিন চোখে হাসিমুদ্দির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শরীর নিয়ে দুলে উঠল হাসিমুদ্দি, উবু হয়ে চেয়ারম্যানের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে করতে বলল-
জি বস্, আমি কাম শেষ করে আসব। আমার ওপর একটু নজর রাখবেন। কমিটিতে যেন পদ থাকে।
হবে, হবে। শূন্যে হাত দুলিয়ে আবুল চেয়ারম্যান তাকে আশ্বস্ত করল।
উড়ন্ত মেঘের নিচে চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকারে গুলিয়ে উঠে চারপাশ। রাতের বাতাস সুপারির মাথায় আছড়ে পড়ে। শব্দ করে পাতাগুলো নড়েচড়ে ওঠে। একটা প্যাঁচা তীব্র চিৎকার করতে করতে উড়ে যায় দূরে বট গাছটার দিকে।
অন্ধকার যেন মৌমাছির ঝাঁকের মতো ঘিরে আছে চারপাশ থেকে। নেশার ঘোরে, টালমাটাল পায়ে সাবধানে হাঁটে আবুল চেয়ারম্যান। মাটি থেকে বারবার পা সরে যেতে চায় যেন। অন্ধকারে উবু হয়ে বসে থাকা খড়ের গাদা পার হয়। সুপারি গাছের নিচে সাদা মাটির পিঠ বের করে থাকা পথটা থমথমে। উঠানের একপ্রান্তে বড় ঘরের সিঁড়িটা যেন অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। নেশা আর ঘুমজড়ানো চোখে সেদিকে হাঁটে চেয়ারম্যান। সিঁড়ির পাশে হারিকেন জ্বলছে। চেয়ারম্যানের ফিরতে রাত হলে আঙুরী আলোটা সিঁড়ির পাশে জ্বালিয়ে রাখে। চিমনির ভিতর থেকে হলদে চোখ হারিকেন মেলে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আলোটা। তাকিয়ে থাকে আঙুরীর জেগে থাকা চোখ দুটিও। আঙুরী আবুল চেয়ারম্যানের তৃতীয়পক্ষ। যুবতী বয়স। খুবই স্বামীভক্ত।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে আঙুরী ছুটে আসে। চেয়ারম্যানের নেতানো শরীর জাপটে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। খাটের ওপর শরীরটাকে ছুড়ে ফেলে আবুল জিজ্ঞাসা করে-
হাসনা ঘুমাইছে?
ঘুমাইছে।
আঙুরী ছোট্ট জবাব দেয়।
ইলেকশনের জন্য অনেক রাত স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেনি আবুল চেয়ারম্যান। আজকে তার খুব ঘুম পাচ্ছে। আঙুরী ফুঁ দিয়ে হারিকেনটা নিভিয়ে দেয়। ঘরের চারপাশ থেকে অন্ধকার থৈ থৈ করে নাচতে লাগে। শাড়ির খসখসানি আর চুড়ির টুংটুং শব্দে ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে যেতে একসময় আবুলের মনে হয় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আক্কাস আলী। দুই চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চেয়ারম্যান, ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলে-
আক্কাস, তুই?
আক্কাসের মুখে, গোঁফের নিচে ক্রূর হাসি। চোখ থেকে আগুন ঝরছে। দোজখের আগুন। আগুনের তাপে ঝলসে যাচ্ছে চেয়ারম্যানের শরীর। চেয়ারম্যানের গোটা বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে।
আবুল চেয়ারম্যান ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। ঘামে ওর শরীর ভিজে গেছে। হাতের তালুতে দুই চোখ কচলাতে কচলাতে সে নিজেকেই প্রশ্ন করে-
আক্কাস মরে নাই?
পাশ থেকে চুড়ির শব্দ হয়। আঙুরী ঘুমজড়ানো গলায় বলে- খোয়াব দেখতেছিলেন। ঘুমান, বিয়ান হইতে দেরি আছে। আঙুরীর নরম হাত দুটো আবুল চেয়ারম্যানকে ময়ালের মতো জড়িয়ে ধরে।
ভোরবেলা আঙুরীর ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল আবুল চেয়ারম্যানের। চোখ মুছতে মুছতে সে আঙুরীর দিকে তাকায়। আঙুরীর ফর্সা মুখে ভীষণ উদ্বেগের ছাপ।
কী অইছে?
আপনার মেয়ে পলাইছে! আঙুরীর গলায় গভীর শঙ্কার সুর বেজে উঠলে আবুলের বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠল। সে হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকল। খাটের ওপর হাসনার বাসি কাপড় পড়ে আছে। ঘরে হাসনা নেই, বাড়ির কোথাও হাসনা নেই।
মন্তব্য করুন