বড়বাবা, আমরা ডুবি যাইরাম!
অরণি বলল।
বড়বাবা, আমরা ডুবে যাচ্ছি।
কী খুশি আমাদের ছোট্টমোট্ট বেটি। আমি ভিডিওকলে তাকে দেখছি। আমাদের ঘরে পানি ঢুকেছে। বানভাসি। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হয়েছে। অরণি। বানভাসির ডর বোঝার বয়স তার হয় নাই। ঘরে পানি, উঠানে পানি, রাস্তায় পানি, সবখানে পানি- মহাখুশি সে। বাপের স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঘরের পানিতে ছপছপ করে হাঁটছে। এঘরে যাচ্ছে ওঘরে যাচ্ছে। -তুই বেটি মহাখুশি থাক, তোর মতো থাক।
আমার বানভাসি ভালো লাগে না। কোনোদিনই না। আমি হলাম ভাটির কুলাঙ্গার। বানভাসির থইথই পানি ডরাই। উথালপাথাল ঢেউ ডরাই। পানি শাসনের বিষাদ ধরে থাকে মনে। অগাধ জলরাশি আর আপ্লুত করে না কিছুতে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আপ্লুত করে না। বৃষ্টিমেদুর দিন ভালো লাগে একা ঘরে বসে দেখতে। কোথাও আটকা পড়ে থাকলে আর না। ভালো লাগে অন্ধকারেও, ছাতা নিয়ে বা না নিয়ে, ইলশেগুঁড়ি বা কুকুর-বেড়াল যে কোনো ধরনের বৃষ্টিতে হাঁটতে। বৃষ্টির নাম ইলশেগুঁড়ি, বৃষ্টির নাম কুকুর-বেড়াল। আরেকটা বাংলা মুষলধারে। কথা হলো? যারা অতলান্তিক, উত্তমাশা অন্তরীপ, ভূমধ্যসাগর এসব বাংলা নামকরণ করেছেন তারা বৃষ্টির জাতের নামকরণ করেননি। ভালো করেননি।
গত কদিন ধরে শুনছি খুব বৃষ্টি হচ্ছে আমাদের শহরে। মান্না বলে, তুষার অমিয় বলে, ফরিদ বলে। তিনু, পূর্ণা বলে। সুমু, অরণি বলে। যখন ফোন করি তখনই বৃষ্টি।
'ঝুম বৃষ্টি রে ভাই!'
তারা ফোনে বৃষ্টির শব্দও শোনায়।
বৃষ্টি জোছনার মুল্লুক আমাদের শহর। তার এমন দুর্দশা আগে আর হয় নাই। সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে অতর্কিত বানভাসিতে। সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির লাইন বিকল। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। অচিন্তনীয়, এক দুর্দশা। মাথার ভেতরে মনে হয় একটা বরফের চারকোনা বাক্স জমাট হয়ে আছে। করোনা অধ্যুষিত দিনরাত ফুরায়নি, তার মধ্যে এই ইতরপনা। আর কত! টেলিভিশনে দেখছি, অনলাইনে দেখছি, পানি কমছে না বৃষ্টি হচ্ছেই। সব বৃষ্টিগাছ ডুবে যাবে শহরের? সব তালগাছ? তবে এই বৃষ্টি ভালো লাগে কার? বৃষ্টিমেদুর দিন ভেবে যত নচ্ছাড় ভাবালুতা। মানে হয় না।
অরণি বুধবারে না বিষ্যুদবারে বলল, বড়বাবা আমরা ডুবি যাইরাম? বুধবারে। সেই সন্ধ্যায় ফোন করেছিল মান্না। এপাড়া ওপাড়ায় পানি উঠছে, বৃষ্টিমেদুর দিন। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে শহরে। এখনও হচ্ছে, তারা হাঁটছে। মান্না তুষার খোকন। তিন মাস্কেটিয়ার। রোজ তারা সান্ধ্যভ্রমণ করে একসঙ্গে। হেঁটে হেঁটে দ্যুমার আরেক মাস্কেটিয়ার দাঁ আরতানা প্রকাশ ফরিদের কাছে যায়। ফরিদের ফার্মেসি বাসস্ট্যান্ড রোডে। গণজমায়েতের ভেন্যু হয় সন্ধ্যায়। রোমেন, আবেদিন, মসরু, শামিম, নাসের, সমররা থাকে। অল্পসল্প বেনোপানি এই প্রাণজাত গণজমায়েত কী করে ঠেকাবে? যত রাত বাড়বে কী ঘটবে কেউ চিন্তা করে নাই সেই সন্ধ্যায়। বানভাসি অভ্যস্ত ভাটির সন্তানগণ। বানের পানি এমন আতকা চড়াও হবে, পূর্ব-অভিজ্ঞতা বা কোনো প্রকার স্মৃতি নাই তাদের। শতাধিক বছরের মধ্যে হয় নাই এরকম। তারা কী করছে এই পরিস্থিতিতে? গণজমায়েত বন্ধ হয়ে গেছে? ফরিদের ফার্মেসি পানিবদ্ধ। অরণি কী করছে? দুপুর বিবি? তিনু, পূর্ণা? আমি কী করছি? এই কদিনে কতবার কল দিয়েছি মান্না, সুমুকে? পূর্ণা ফরিদ অনজনকে? কোনো একটা ফোনে কল যায় না। জানা কথা যাবে না, তাও নাগাড়ে কল দিয়েই যাচ্ছি। মেসেজ রিসেন্ড করছি, রিসেন্ড করছি- তোরা ঠিক আছিস? - নো রিপ্লাই।
কেউ ঠিক নাই কিছু ঠিক নাই। শহরের সব ঘরদোর পানির ঘরদোর হয়ে গেছে। পানি কমছে না, বৃষ্টি হচ্ছেই। ভূতগ্রস্ত বৃষ্টি! অরণিরা ছাড়া তেমন আমোদ নিয়ে কে দেখবে বা চায় দেখতে? আমার কি বৃষ্টি ভালো লাগত কখনও? বৃষ্টিমেদুর দিন? ঘরে বসে দেখতে ভালো লাগত? ভুলে গেছি। আর ভালো লাগছে না মোটে। বৃষ্টিমেদুর দিন! হ্যাহ্‌!
আগে ফিরাইল ছিল ভাটি অঞ্চলে। তারা বৃষ্টি বন্ধন দিতে পারত। তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লোকজ বিশ্বাস, কুসংস্কার এসব শিক্ষিত মানুষের কথাবার্তা। প্রমাণের কিছু নাই যে বৃষ্টি বন্ধন দিতে পারত ফিরাইলরা। বৃষ্টি পড়ত না ফিরাইলের বান্ধা জমিনে। শিল পড়ত না, ঠাটা পড়ত না।
আজ রবিবার। ১৯ জুন যাচ্ছে। ৬ আষাঢ়। ১৯ জিলকদ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস তবে গেল কোনদিন? আষাঢ়ের এক তারিখেই? বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ফুটে গেছে? ফুটলে কী, না ফুটলেইবা কী? আর আষাঢ়স্য প্রথম দিবস! আষাঢ় মাসটাই এই বঙ্গাব্দের পঞ্জিকা থেকে বাদ হয়ে যাক। বৃষ্টির সম্ভাবনা পরের শ্রাবণে যাক, আশ্বিনে কার্তিকে। বানভাসির পানি কমুক। ডুব থেকে উঠুক আমাদের শহর। মানুষ বাঁচুক। অরণি তার বাপের স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে এঘরে ওঘরে ঘুরুক। মহাখুশিতে থাকুক বেটি। বড়বাবা আমরা ডুবি যাইরাম! কী খুশির কথা।
ঝুপঝুপ বৃষ্টি আজ হচ্ছে ঢাকায়ও। বৃষ্টির মহড়া। রাত ১১টা বেজে গেছে। আমি একা থাকি। কাজে বসি রাত দশটার কিছু পরে। না হলে বই পড়ি বা বই দেখি। এই সময় কেন কেউ আমার কাছে আসবে এমন এক হতচ্ছাড়া রাতে? কলবেল দিল। কে? দরজা খুলে যাকে দেখলাম, তাকে আমি ডরাই। সে কী চায়? আমার ভাই ডিউকের সঙ্গে তার কথা হয়েছে দিনে। ডিউক তাকে নিশ্চিত করেছে আমাদের পাড়ার কয়েক ঘর মানুষ একসঙ্গে আছে একটা বিল্ডিংয়ে। নিরাপদে আছে।
ধন্যবাদ। এবার দূর হও তুমি বাছা! আমার বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে।
হাইয়ার না করে সে যায়? করে গেল। বন্যা পরিস্থিতি এমন না হলে এখন আমি নিশ্চয় কল দিতাম ফরিদকে। ব্লাড প্রেশারের ওষুধ খাব কিনা জেনে নিতাম। আজব! আজব! আজব! আজব! ফরিদ কল দিল। আমার ফোনে তার নাম্বার সেভ করা ফড়িং লিখে। ফড়িং কলিং। কী করে?
'তুই কেমনে?'
'আমি তো সিলেটে রে ভাই।'
'অ। ভালা। টাউনের কার কিতা অবস্থা?'
'নিরাপদে আছোইন হক্কলেই। বিজুদা তো মারা গেছোইন শুনছস?'
'ছোটকাকু!'
ছোটকাকু অসুস্থ। বানভাসির আগ থেকেই অসুস্থ। তার চলে যাওয়ার সময় হলো এই! দোলন, তিনু, পূর্ণা কী করছে? শ্মশানঘাট ডুবে নাই শহরের? দাহ হয়ে গেছে?
ফরিদ এতকিছু বলতে পারল না।
ছোটকাকু নাই। আমাদের ছোটকাকু। অরণির ছোড়দা। বানভাসির পর অরণি কি পূর্ণাদের ঘরে গিয়ে তার ছোড়দাকে খুঁজবে? ছোড়দার কোলে উঠে এক চক্কর পাড়া না ঘুরলে তার সকাল কিনা সকাল হয় না। ১২টা বাজতে ২ মিনিট আর। শতাব্দী মেসেজ দিল, 'দাদা পানি কমতেছে।'
শতাব্দী জাহিদ। হাতিরঝিলে থাকে। আমাদের শহরের খবর কে তাকে বলল? অনলাইনে দেখেছে। পানি কমছে এবং বৃষ্টি হচ্ছে না। -স্বস্তি। এই কয়দিনে এই সামান্য স্বস্তি। পানি কমুক। আপাতত আর বৃষ্টি না হোক। আর বৃষ্টি আমাদের ভালো লাগছে না। একটুও ভালো লাগছে না, বৃষ্টিমেদুর এই একেকটা দিন।
বড়বাবা আমরা ডুবি যাইরাম।
অরণির এই বড়বাবা কে?
আমি না। তবে?
বিরাট শিশু সেই? আনমনা যে?
দুর!
ঘুম ধরে এমন পরিস্থিতিতে?
খুব ধরে। ওষুধে ধরে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। স্নায়ু শিথিল হয়ে আসে। ঘুমাব? ঘুমাই। কথা হলো আষাঢ় মাস বঙ্গাব্দ থেকে কাটা পড়ে নাই। বৃষ্টি হচ্ছে এবং হবেই। বৃষ্টির শব্দে ঘুম গাঢ় হয়।
পানির পীর খোয়াজ খিজির
তার নামে করি জিকির...
কারা জিকির করে? কারা ঘুমায়?
কারা জিকির করে ঘুমিয়ে?
বৃষ্টির মধ্যে। বৃষ্টি কোথায়?
রেইন সাউন্ডস ওয়ান আওয়ার ফর স্লিপিং : স্লিপ এইড ফর এভরিবডি- নামানো আছে পেনড্রাইভে। প্লে দিয়ে রেখেছি। ঘুম ধরে যাবে, ধরে যাচ্ছে, কোন ঘর থেকে অরণি বলছে, বড়বাবা আমরা ডুবি যাইরাম। বৃষ্টির ঘর থেকে। ঘুমাও অরণি। বৃষ্টির রাত বাবা। স্বপ্টম্ন দেখো ঘুমিয়ে।
বড়বাবা আমরা ডুবি যাইরাম।
ডুবে যাও। বানভাসি না, বৃষ্টিতে না, বৃষ্টির শব্দে ডুবে যাও মা।

বিষয় : প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ

মন্তব্য করুন