![রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [৭ মে ১৮৬১-৭ আগস্ট ১৯৪১; ২৫ বৈশাখ ১২৬৮-২২ শ্রাবণ ১৩৪৮]](https://samakal.com/uploads/2022/08/online/photos/Untitled-53-samakal-62ec2a31300f1.jpg)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [৭ মে ১৮৬১-৭ আগস্ট ১৯৪১; ২৫ বৈশাখ ১২৬৮-২২ শ্রাবণ ১৩৪৮]
ফকির লালন সাঁই তাঁর এক গানে বলেছেন :
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে
ঠিক তেমনি হিন্দু ও মুসলমান- এই দুটি সম্প্রদায় প্রায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করলেও তারা একে অপরের প্রায়-অচেনাই হয়ে আছে। শুধু অপরিচয়ের কুয়াশাই নয়, বিবাদে-বিরোধে তারা আত্মবিনাশের সমাধি খনন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর ভেবেছেন। এই সমস্যা-সংকটের স্বরূপ, মূল কারণ ও তার সমাধান-সূত্র কী- সে-বিষয়ে তাঁর ভাবনার স্বাক্ষর মিলবে নানা লেখায়। নিকট-পড়শি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এমন গভীর আগ্রহ, মনোযোগ, প্রীতি ও সহমর্মিতা আর-কোনো বাঙালি মনীষী দেখিয়েছেন, তার নজির নেই।
'এদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের বিভীষিকায় মন যখন হতাশ্বাস হয়ে পড়ে, এই বর্বরতার অন্ত কোথায় ভেবে পাই না, তখন মাঝে মাঝে দূরে দূরে সহসা দেখতে পাই দুই বিপরীত কুলকে দুই বাহু দিয়ে আপন করে আছে এমন এক-একটি সেতু'- কাজী আবদুল ওদুদের 'হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ' পুস্তিকার 'ভূমিকা'য় তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন। এই কথা যে তাঁর নিজের সম্পর্কেও গভীরভাবে প্রযোজ্য- সব থেকে বেশি সত্য, তা তো কবুল না করে উপায় নেই।
রবীন্দ্রনাথের মননচর্চায় যেমন সৃজনসাহিত্যেও তেমনি মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর সৌজন্য ও প্রীতিময় মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু এর পরেও অনুদার-রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের একাংশের কাছে তাঁর ভূমিকা বারবার বিতর্ক ও বিরূপতার মুখোমুখি হয়েছে- জানা যায় :'রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সাম্প্র্রদায়িকতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে; বলা হয়েছে, প্রতিবেশী সমাজের কোনো ছবি তাঁর সাহিত্যে নেই; যেটুকু আছে, তাও নিন্দাসূচক' (আনিসুজ্জামানের 'ভূমিকা'; ভূঁইয়া ইকবাল : 'রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ', ঢাকা, বৈশাখ ১৪১৭)। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মুসলমান সমাজের এই ভ্রান্তি ও অপ্রসন্নতা কাটাতে এই সমাজ থেকেই মুক্তবুদ্ধির কিছু লেখক এগিয়ে আসেন। এ বিষয়ে প্রথম পর্যায়ে আবদুল হামিদ খান ইউসফ্জয়ী ও মৌলভী এক্রামদ্দীন এবং কিছু পরে কাজী আবদুল ওদুদ ও তাঁর সাহিত্যসতীর্থদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
দুই.
পরধর্ম ও ভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আচরণে-বক্তব্যে চিরকালই সৌজন্য-সহিষ্ণুতা-উদার মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে এ কথা বেশি সত্য। ইসলাম ধর্ম ও তার প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ (স.) সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানা উপলক্ষে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি ইসলামকে 'মহান ধর্ম' ও এই ধর্মের প্রবর্তককে 'ঐড়ষু চৎড়ঢ়যবঃ্থ বা 'মহাপুরুষ' বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
মুসলমান সমাজকে অন্তরঙ্গভাবে জানার-বোঝার উপায় যে 'সাহিত্যের পথ' সে-কথায় গভীর বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথের। আবুল ফজলের 'চৌচির' (১৯৩৪) উপন্যাসটি পড়ে তাঁকে যে-চিঠি (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪০) তিনি লেখেন তাতে এই মনোভাবটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুসলমান সমাজের জীবনযাত্রা ও ঘরোয়া খবর জানতে রবীন্দ্রনাথ যে কী পরিমাণে উৎসুক ছিলেন তা বেশ বোঝা যায় কাজী আবদুল ওদুদের 'নদীবক্ষে' (১৯১৯) ও কাজী ইমদাদুল হকের 'আবদুল্লাহ' (১৯৩৩) উপন্যাসের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়। হিন্দু-মুসলমানের আচার-সংস্কার-ধর্মান্ধতার স্বরূপ যে অভিন্ন 'আবদুল্লাহ' উপন্যাস পড়ে সে-কথাই তাঁর মনে হয়েছে : 'দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে সেই অন্ধতাই ধুতিচাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। একি মাটির গুণ? এই রোগবিষে ভরা বর্ব্বরতার হাওয়া এ দেশে আর কতদিন বইবে। আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব।' এ-ও তাঁর অগোচর থাকে না, ধর্মীয় উগ্রতার বশে একজন 'কাফের' ও অপরজন 'ম্লেচ্ছ' বলে পরস্পরকে গাল দিয়ে 'আত্মীয়তা'র পথে কাঁটা ছড়িয়ে রাখে ('সমস্যা', কালান্তর)।
হিন্দু-মুসলমান বিরোধের রোগ তিনি বাইরের উপসর্গ দেখে সারানোর চেষ্টা করেননি, গভীরে গিয়ে কারণ আবিস্কার করে একে নির্মূল করতে চেয়েছেন। অবশ্য এই পথে তিনি ছিলেন প্রায় নিঃসঙ্গ পথিক, তাই তাঁর একক কণ্ঠের আওয়াজে সমাজের ঘুম ভাঙেনি- যাদের জন্য তাঁর এই উৎকণ্ঠা তাদের সংবিৎ ফেরেনি- বোধোদয় হয়নি। যদিও তাঁর সদিচ্ছা ও ব্যাকুলতা বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো ফল বয়ে আনেনি, তবুও কিছু সমানধর্মা বিবেকবান মানুষের মধ্যে সেই চিন্তা চারিত হয়েছে- সমকাল সাড়া না দিলেও উত্তরকাল একেবারে বিমুখ করেনি।
তিন.
সামাজিক পীড়ন, রাজনৈতিক বঞ্চনা কিংবা যে কোনো অবিচার-বৈষম্যের শিকার হলে ন্যায্য বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সমাজের পক্ষে কথা বলেছেন, আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছেন, সমর্থন জুগিয়েছেন। মুসলমানদের তরফে যখন শিক্ষার ক্ষেত্রে- পাঠ্যপুস্তকের বিষয়-নির্বাচনের ব্যাপারে বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন এই অভিযোগ সম্পর্কে সহমত পোষণ করে স্পষ্টভাবেই বলেন : '... বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্যপুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানদের কোনো কথা না থাকা অন্যায় ও অসঙ্গত' ('ভারতী', ভাদ্র-কার্তিক ১৩০৭)।
হিন্দু-মুসলমানের তুচ্ছ-স্থূল বিরোধকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। মসজিদের সামনে বাদ্যি বাজানো- অপরদিকে গো-কোরবানির কারণে যে কলহ-বিবাদ তা ধর্মান্ধ মানুষের মূঢ়তার ফল। বিহারের গো-কোরবানির ফলে এক দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'নিজের ধর্মের নামে পশু হত্যা করিব অথচ অন্যের ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না' ('ছোটো ও বড়ো', কালান্তর)। আবার জাতপাত-ছোঁয়াছুঁয়ির সংস্কার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সে-সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণযোগ্য : '...আমাদের দেশে এমন অসংখ্য লোক আছে, মুসলমান যাদের কুয়ো থেকে জল তুলতে এলে মুসলমানকে মেরে খুন করতে যারা কুণ্ঠিত হয় না' ('চরকা', কালান্তর)।
রবীন্দ্রনাথ এ-কথা বুঝলেও সমাজপতি ও রাজনীতিকেরা বোঝেননি যে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির ওপরেই নির্ভর করে দেশের উন্নতি- মানুষের কল্যাণ। তাই তিনি বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন :'ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব' ('স্বামী শ্রদ্ধানন্দ', কালান্তর)।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিদ্বেষ-সমস্যার পরিচয় তুলে ধরে এর সমাধানের যে-যে পথ নির্দেশ করেছিলেন তিনি, তার মধ্যে 'সমকক্ষতা'র ধারণাটি ছিল সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব : 'মুসলমানেরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্যবশত, জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্রসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ূক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্ন মনে প্রার্থনা করি' ('সভাপতির অভিভাষণ', 'সমূহ', রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, ১৩৫৭)।
চার.
পূর্ববঙ্গে জমিদারির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার নতুন ও বিচিত্র রূপ দেখলেন। এতদিন এদের মিলনের ও ব্যবধান ঘোচানোর যেসব কথা ভেবেছেন, শিলাইদহে কিছু পরিমাণে হাতেকলমে তা তিনি করে দেখাতে পারলেন। জমিদারিতে এসেই ঘোষণা দিলেন- তিনি এবার 'সাহা'দের হাত থেকে 'শেখ'দের বাঁচাবেন। 'সাহা'রা সুদখোর বড় মহাজন আর 'শেখ'রা গরিব মুসলমান প্রজা। কথা রাখলেন কবি-জমিদার- ফলে চরের বেয়াড়া মুসলমান প্রজারাও তাঁর বশ মানল। পুণ্যাহ উপলক্ষে যে দরবার বসত, সেখানে হিন্দু ও মুসলমান প্রজার বসার ব্যবস্থা ছিল আলাদা আলাদা- হিন্দুরা বসত জাজিমের ওপর আর মুসলমানদের জাজিম উল্টে বসতে দেওয়া হতো- রবীন্দ্রনাথ সেই আসন-বৈষম্য ঘোচালেন। আবার তাঁর জমিদারি এলাকায় গো-কোরবানি নিয়ে গোল বাধল। রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে জানিয়েছেন : 'আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করিনি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে, তারা তখনই তা মেনে নিলে। আমাদের সেখানে এ পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন' ('হিন্দু-মুসলমান', কালান্তর)।
পাঁচ.
শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথের সুযোগ হয় বাউলদের সঙ্গে মেলামেশার। সরাসরি আলাপের সুযোগ হয় গগন হরকরা আর লালন ফকিরের শিষ্য-শাবকদের সঙ্গে। নানা সাধকের কণ্ঠে শোনেন লালনের গান। বাউলেরা তো জাতধর্ম মানেন না- শাস্ত্র মানেন না- হিন্দু-মুসলমানে ভেদ করেন না- লালনের অনেক গান আছে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার- জাতপাত আর শাস্ত্রধর্মের বিপক্ষে। সম্প্রদায়-সম্প্র্রীতির প্রেরণার জন্য রবীন্দ্রনাথ লালন ও বাউলদের কাছেও কিছু পরিমাণে ঋণী। হিন্দু-মুসলমানের মিলন-প্রয়াসে এই বাউলসম্প্রদায় ও শিক্ষিত ভদ্রজনের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাউলগানের সংকলন 'হারামণি'র 'ভূমিকা'য় রবীন্দ্রনাথ খোলাসা করে বলেছেন : 'আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউলসাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্ব্বরতা। বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কী রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।'
বেশ বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমানকে মিলিয়ে দেওয়ার যে সাধনা তার মূলে মরমিসাধনার সম্প্র্রদায়-সম্প্র্রীতির আদর্শও কাজ করেছে। তাই এই 'হারামণি'র ভূমিকায় মানব-মিলনের সাধক হিসেবে যেমন বাংলার বাউল-ফকির তেমনি রামানন্দ, কবির, দাদু, রবিদাস, নানক- মধ্যযুগের এই মানবপ্রেমী সন্তসাধকদের কথাও তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। সর্বমানবের মিলনের মরমি সুর তাই রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যে ধ্বনিত হয়েছে : 'যে চাষী চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর, শঙ্খ-মুখরিত দেবালয়ে যে পূজারী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নামাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর' (বিজয়া সম্মিলনীর ভাষণ : ১৩১২)।
ছয়.
হিন্দু-মুসলমান বিরোধের শুরুটা কবে থেকে- এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া ভারি মুশকিল! অনেকেই মনে করেন ব্রিটিশের ভেদনীতিই এই বিবাদের উৎস। কী রাজনীতিক, কী ইতিহাসবিদ, তাঁদেরও এই একই মত। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আগেই এমন তথ্য জানিয়েছিলেন। হাল আমলে ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী ব্রিটিশ শাসনকেই এর জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু মার্জনা চেয়ে সবিনয়ে বলি, অতীত কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। মোগল আমলেও যে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সে তথ্য মেলে 'সিয়ারুল মোতাআখেরীন' পুস্তকে। মধ্যযুগের সাহিত্যেও হয়তো এর নমুনা ছিটেফোঁটা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিম শাসনের গোড়ার দিকে বিরোধটা যত তীব্র ছিল, ধীরে ধীরে তা থিতিয়ে আসে- তার মানে দ্বন্দ্বটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এর কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : '... মুসলমান শাসনে সেই বিরুদ্ধতার তীব্রতা ক্রমশই কমে আসছিল, কেননা তারা এই দেশকেই আপন দেশ করে নিয়েছিল- সুতরাং দেশকে ভোগ করা সম্বন্ধে আমরা পরস্পরের অংশীদার হয়ে উঠলুম। ... কিন্তু তীব্রতর বিরুদ্ধতা রয়ে গেল ধর্ম নিয়ে। মুসলমান শাসনের আরম্ভকাল থেকেই ভারতের উভয় সম্প্র্রদায়ের মহাত্মা যাঁরা জন্মেছেন তাঁরাই আপন জীবনে ও বাক্যপ্রচারে এই বিরুদ্ধতার সমন্বয়-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন' ('হারামণি'র ভূমিকা)।
তাই বলা যায়, এই দুই সম্প্র্রদায়ের মনান্তর ও বিরোধের ইতিহাস যথেষ্টই পুরোনো। তবে আপন স্বার্থের প্রয়োজনে এই বিচ্ছেদ-কলহের 'অগ্নিতে ঘৃতাহুতি' দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ জীবনভর বিচ্ছিন্ন-বিবদমান এই দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের সাধনা করেছেন- হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সেতু হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। এই দুই নিকট-পড়শির মিলনের আকাঙ্ক্ষায় রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, সেই কথা আজ স্মরণ করতে হয় : 'হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই, কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে, গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব; যদি না আসি তবে, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়' ('হিন্দু-মুসলমান', কালান্তর)।
সাত.
শাস্ত্র-ধর্ম ও জাতপাতের আচার-সংস্কার যেন মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষের দেয়াল না তোলে- রবীন্দ্রনাথের এই আকুতি ও আবেদন আমাদের বিশ্বাস ও আচরণে সত্য হয়ে উঠুক- শুভবুদ্ধির উদয় হোক মনুষ্যত্বের অমৃতধারায় স্নাত হয়ে- এ-ই কামনা।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে
ঠিক তেমনি হিন্দু ও মুসলমান- এই দুটি সম্প্রদায় প্রায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করলেও তারা একে অপরের প্রায়-অচেনাই হয়ে আছে। শুধু অপরিচয়ের কুয়াশাই নয়, বিবাদে-বিরোধে তারা আত্মবিনাশের সমাধি খনন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর ভেবেছেন। এই সমস্যা-সংকটের স্বরূপ, মূল কারণ ও তার সমাধান-সূত্র কী- সে-বিষয়ে তাঁর ভাবনার স্বাক্ষর মিলবে নানা লেখায়। নিকট-পড়শি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এমন গভীর আগ্রহ, মনোযোগ, প্রীতি ও সহমর্মিতা আর-কোনো বাঙালি মনীষী দেখিয়েছেন, তার নজির নেই।
'এদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের বিভীষিকায় মন যখন হতাশ্বাস হয়ে পড়ে, এই বর্বরতার অন্ত কোথায় ভেবে পাই না, তখন মাঝে মাঝে দূরে দূরে সহসা দেখতে পাই দুই বিপরীত কুলকে দুই বাহু দিয়ে আপন করে আছে এমন এক-একটি সেতু'- কাজী আবদুল ওদুদের 'হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ' পুস্তিকার 'ভূমিকা'য় তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন। এই কথা যে তাঁর নিজের সম্পর্কেও গভীরভাবে প্রযোজ্য- সব থেকে বেশি সত্য, তা তো কবুল না করে উপায় নেই।
রবীন্দ্রনাথের মননচর্চায় যেমন সৃজনসাহিত্যেও তেমনি মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর সৌজন্য ও প্রীতিময় মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু এর পরেও অনুদার-রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের একাংশের কাছে তাঁর ভূমিকা বারবার বিতর্ক ও বিরূপতার মুখোমুখি হয়েছে- জানা যায় :'রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সাম্প্র্রদায়িকতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে; বলা হয়েছে, প্রতিবেশী সমাজের কোনো ছবি তাঁর সাহিত্যে নেই; যেটুকু আছে, তাও নিন্দাসূচক' (আনিসুজ্জামানের 'ভূমিকা'; ভূঁইয়া ইকবাল : 'রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ', ঢাকা, বৈশাখ ১৪১৭)। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মুসলমান সমাজের এই ভ্রান্তি ও অপ্রসন্নতা কাটাতে এই সমাজ থেকেই মুক্তবুদ্ধির কিছু লেখক এগিয়ে আসেন। এ বিষয়ে প্রথম পর্যায়ে আবদুল হামিদ খান ইউসফ্জয়ী ও মৌলভী এক্রামদ্দীন এবং কিছু পরে কাজী আবদুল ওদুদ ও তাঁর সাহিত্যসতীর্থদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
দুই.
পরধর্ম ও ভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আচরণে-বক্তব্যে চিরকালই সৌজন্য-সহিষ্ণুতা-উদার মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে এ কথা বেশি সত্য। ইসলাম ধর্ম ও তার প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ (স.) সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানা উপলক্ষে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি ইসলামকে 'মহান ধর্ম' ও এই ধর্মের প্রবর্তককে 'ঐড়ষু চৎড়ঢ়যবঃ্থ বা 'মহাপুরুষ' বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
মুসলমান সমাজকে অন্তরঙ্গভাবে জানার-বোঝার উপায় যে 'সাহিত্যের পথ' সে-কথায় গভীর বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথের। আবুল ফজলের 'চৌচির' (১৯৩৪) উপন্যাসটি পড়ে তাঁকে যে-চিঠি (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪০) তিনি লেখেন তাতে এই মনোভাবটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুসলমান সমাজের জীবনযাত্রা ও ঘরোয়া খবর জানতে রবীন্দ্রনাথ যে কী পরিমাণে উৎসুক ছিলেন তা বেশ বোঝা যায় কাজী আবদুল ওদুদের 'নদীবক্ষে' (১৯১৯) ও কাজী ইমদাদুল হকের 'আবদুল্লাহ' (১৯৩৩) উপন্যাসের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়। হিন্দু-মুসলমানের আচার-সংস্কার-ধর্মান্ধতার স্বরূপ যে অভিন্ন 'আবদুল্লাহ' উপন্যাস পড়ে সে-কথাই তাঁর মনে হয়েছে : 'দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে সেই অন্ধতাই ধুতিচাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। একি মাটির গুণ? এই রোগবিষে ভরা বর্ব্বরতার হাওয়া এ দেশে আর কতদিন বইবে। আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব।' এ-ও তাঁর অগোচর থাকে না, ধর্মীয় উগ্রতার বশে একজন 'কাফের' ও অপরজন 'ম্লেচ্ছ' বলে পরস্পরকে গাল দিয়ে 'আত্মীয়তা'র পথে কাঁটা ছড়িয়ে রাখে ('সমস্যা', কালান্তর)।
হিন্দু-মুসলমান বিরোধের রোগ তিনি বাইরের উপসর্গ দেখে সারানোর চেষ্টা করেননি, গভীরে গিয়ে কারণ আবিস্কার করে একে নির্মূল করতে চেয়েছেন। অবশ্য এই পথে তিনি ছিলেন প্রায় নিঃসঙ্গ পথিক, তাই তাঁর একক কণ্ঠের আওয়াজে সমাজের ঘুম ভাঙেনি- যাদের জন্য তাঁর এই উৎকণ্ঠা তাদের সংবিৎ ফেরেনি- বোধোদয় হয়নি। যদিও তাঁর সদিচ্ছা ও ব্যাকুলতা বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো ফল বয়ে আনেনি, তবুও কিছু সমানধর্মা বিবেকবান মানুষের মধ্যে সেই চিন্তা চারিত হয়েছে- সমকাল সাড়া না দিলেও উত্তরকাল একেবারে বিমুখ করেনি।
তিন.
সামাজিক পীড়ন, রাজনৈতিক বঞ্চনা কিংবা যে কোনো অবিচার-বৈষম্যের শিকার হলে ন্যায্য বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সমাজের পক্ষে কথা বলেছেন, আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছেন, সমর্থন জুগিয়েছেন। মুসলমানদের তরফে যখন শিক্ষার ক্ষেত্রে- পাঠ্যপুস্তকের বিষয়-নির্বাচনের ব্যাপারে বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন এই অভিযোগ সম্পর্কে সহমত পোষণ করে স্পষ্টভাবেই বলেন : '... বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্যপুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানদের কোনো কথা না থাকা অন্যায় ও অসঙ্গত' ('ভারতী', ভাদ্র-কার্তিক ১৩০৭)।
হিন্দু-মুসলমানের তুচ্ছ-স্থূল বিরোধকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। মসজিদের সামনে বাদ্যি বাজানো- অপরদিকে গো-কোরবানির কারণে যে কলহ-বিবাদ তা ধর্মান্ধ মানুষের মূঢ়তার ফল। বিহারের গো-কোরবানির ফলে এক দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'নিজের ধর্মের নামে পশু হত্যা করিব অথচ অন্যের ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না' ('ছোটো ও বড়ো', কালান্তর)। আবার জাতপাত-ছোঁয়াছুঁয়ির সংস্কার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সে-সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণযোগ্য : '...আমাদের দেশে এমন অসংখ্য লোক আছে, মুসলমান যাদের কুয়ো থেকে জল তুলতে এলে মুসলমানকে মেরে খুন করতে যারা কুণ্ঠিত হয় না' ('চরকা', কালান্তর)।
রবীন্দ্রনাথ এ-কথা বুঝলেও সমাজপতি ও রাজনীতিকেরা বোঝেননি যে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির ওপরেই নির্ভর করে দেশের উন্নতি- মানুষের কল্যাণ। তাই তিনি বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন :'ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব' ('স্বামী শ্রদ্ধানন্দ', কালান্তর)।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিদ্বেষ-সমস্যার পরিচয় তুলে ধরে এর সমাধানের যে-যে পথ নির্দেশ করেছিলেন তিনি, তার মধ্যে 'সমকক্ষতা'র ধারণাটি ছিল সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব : 'মুসলমানেরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্যবশত, জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্রসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ূক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্ন মনে প্রার্থনা করি' ('সভাপতির অভিভাষণ', 'সমূহ', রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, ১৩৫৭)।
চার.
পূর্ববঙ্গে জমিদারির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার নতুন ও বিচিত্র রূপ দেখলেন। এতদিন এদের মিলনের ও ব্যবধান ঘোচানোর যেসব কথা ভেবেছেন, শিলাইদহে কিছু পরিমাণে হাতেকলমে তা তিনি করে দেখাতে পারলেন। জমিদারিতে এসেই ঘোষণা দিলেন- তিনি এবার 'সাহা'দের হাত থেকে 'শেখ'দের বাঁচাবেন। 'সাহা'রা সুদখোর বড় মহাজন আর 'শেখ'রা গরিব মুসলমান প্রজা। কথা রাখলেন কবি-জমিদার- ফলে চরের বেয়াড়া মুসলমান প্রজারাও তাঁর বশ মানল। পুণ্যাহ উপলক্ষে যে দরবার বসত, সেখানে হিন্দু ও মুসলমান প্রজার বসার ব্যবস্থা ছিল আলাদা আলাদা- হিন্দুরা বসত জাজিমের ওপর আর মুসলমানদের জাজিম উল্টে বসতে দেওয়া হতো- রবীন্দ্রনাথ সেই আসন-বৈষম্য ঘোচালেন। আবার তাঁর জমিদারি এলাকায় গো-কোরবানি নিয়ে গোল বাধল। রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে জানিয়েছেন : 'আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করিনি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে, তারা তখনই তা মেনে নিলে। আমাদের সেখানে এ পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন' ('হিন্দু-মুসলমান', কালান্তর)।
পাঁচ.
শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথের সুযোগ হয় বাউলদের সঙ্গে মেলামেশার। সরাসরি আলাপের সুযোগ হয় গগন হরকরা আর লালন ফকিরের শিষ্য-শাবকদের সঙ্গে। নানা সাধকের কণ্ঠে শোনেন লালনের গান। বাউলেরা তো জাতধর্ম মানেন না- শাস্ত্র মানেন না- হিন্দু-মুসলমানে ভেদ করেন না- লালনের অনেক গান আছে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার- জাতপাত আর শাস্ত্রধর্মের বিপক্ষে। সম্প্রদায়-সম্প্র্রীতির প্রেরণার জন্য রবীন্দ্রনাথ লালন ও বাউলদের কাছেও কিছু পরিমাণে ঋণী। হিন্দু-মুসলমানের মিলন-প্রয়াসে এই বাউলসম্প্রদায় ও শিক্ষিত ভদ্রজনের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাউলগানের সংকলন 'হারামণি'র 'ভূমিকা'য় রবীন্দ্রনাথ খোলাসা করে বলেছেন : 'আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউলসাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্ব্বরতা। বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কী রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।'
বেশ বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমানকে মিলিয়ে দেওয়ার যে সাধনা তার মূলে মরমিসাধনার সম্প্র্রদায়-সম্প্র্রীতির আদর্শও কাজ করেছে। তাই এই 'হারামণি'র ভূমিকায় মানব-মিলনের সাধক হিসেবে যেমন বাংলার বাউল-ফকির তেমনি রামানন্দ, কবির, দাদু, রবিদাস, নানক- মধ্যযুগের এই মানবপ্রেমী সন্তসাধকদের কথাও তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। সর্বমানবের মিলনের মরমি সুর তাই রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যে ধ্বনিত হয়েছে : 'যে চাষী চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর, শঙ্খ-মুখরিত দেবালয়ে যে পূজারী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নামাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর' (বিজয়া সম্মিলনীর ভাষণ : ১৩১২)।
ছয়.
হিন্দু-মুসলমান বিরোধের শুরুটা কবে থেকে- এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া ভারি মুশকিল! অনেকেই মনে করেন ব্রিটিশের ভেদনীতিই এই বিবাদের উৎস। কী রাজনীতিক, কী ইতিহাসবিদ, তাঁদেরও এই একই মত। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আগেই এমন তথ্য জানিয়েছিলেন। হাল আমলে ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী ব্রিটিশ শাসনকেই এর জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু মার্জনা চেয়ে সবিনয়ে বলি, অতীত কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। মোগল আমলেও যে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সে তথ্য মেলে 'সিয়ারুল মোতাআখেরীন' পুস্তকে। মধ্যযুগের সাহিত্যেও হয়তো এর নমুনা ছিটেফোঁটা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিম শাসনের গোড়ার দিকে বিরোধটা যত তীব্র ছিল, ধীরে ধীরে তা থিতিয়ে আসে- তার মানে দ্বন্দ্বটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এর কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : '... মুসলমান শাসনে সেই বিরুদ্ধতার তীব্রতা ক্রমশই কমে আসছিল, কেননা তারা এই দেশকেই আপন দেশ করে নিয়েছিল- সুতরাং দেশকে ভোগ করা সম্বন্ধে আমরা পরস্পরের অংশীদার হয়ে উঠলুম। ... কিন্তু তীব্রতর বিরুদ্ধতা রয়ে গেল ধর্ম নিয়ে। মুসলমান শাসনের আরম্ভকাল থেকেই ভারতের উভয় সম্প্র্রদায়ের মহাত্মা যাঁরা জন্মেছেন তাঁরাই আপন জীবনে ও বাক্যপ্রচারে এই বিরুদ্ধতার সমন্বয়-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন' ('হারামণি'র ভূমিকা)।
তাই বলা যায়, এই দুই সম্প্র্রদায়ের মনান্তর ও বিরোধের ইতিহাস যথেষ্টই পুরোনো। তবে আপন স্বার্থের প্রয়োজনে এই বিচ্ছেদ-কলহের 'অগ্নিতে ঘৃতাহুতি' দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ জীবনভর বিচ্ছিন্ন-বিবদমান এই দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের সাধনা করেছেন- হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সেতু হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। এই দুই নিকট-পড়শির মিলনের আকাঙ্ক্ষায় রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, সেই কথা আজ স্মরণ করতে হয় : 'হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই, কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে, গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব; যদি না আসি তবে, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়' ('হিন্দু-মুসলমান', কালান্তর)।
সাত.
শাস্ত্র-ধর্ম ও জাতপাতের আচার-সংস্কার যেন মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষের দেয়াল না তোলে- রবীন্দ্রনাথের এই আকুতি ও আবেদন আমাদের বিশ্বাস ও আচরণে সত্য হয়ে উঠুক- শুভবুদ্ধির উদয় হোক মনুষ্যত্বের অমৃতধারায় স্নাত হয়ে- এ-ই কামনা।
মন্তব্য করুন