আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল পথ
পথের পাশে নদী
নদীর পাশে নৌকা বাঁধা ঘাট
ঘাটের পাশে শেষপারানির কড়ি
গাছঠাকুরের পুজো
দাঁড়িয়ে ছিল হাজার অমারাত
দেউটি হাতে একলা মাঠের চাঁদ
-আবু হাসান শাহরিয়ার
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে শীত একদম জেঁকে বসেছে। নবাগত পূর্বদেশীয় মানুষের জন্য শীতের শেফিল্ডের মতো এমন নির্মম স্থান সম্ভবত খুব একটা নেই। এখানকার পাহাড়ি হাওয়া বেশ নির্দয়-নিষ্ঠুর। জনবহুল ও অতিযান্ত্রিক লন্ডন শহরে দেখেছি- ঠান্ডা অতটা প্রকট নয়। ব্যস্ত রাজধানীতে কালেভদ্রে বরফের গুঁড়ো ঝরলেই মানুষজন উল্লাসে মেতে উঠত। এর তুলনায় এই মফস্বলের বৈরী ঠান্ডায় আমার নাকাল হবার দশা। কিছুদিন ধরে উত্তর-বিলেতে সূর্যটাও হয়ে গেছে বেশ ভুলোমনা। আসমানে আসীন মেঘরাজ ক্ষণে ক্ষণে ছায়াঘন-পরোয়ানা জারি করেন। তাই সূর্য-বেচারা প্রায়শই ফেরারি আসামির মতো লাপাত্তা হয়ে যায়। তখন বিরহী আকাশ কাঁদতে থাকে আকুল হয়ে। একটু থেমে আবার বৃষ্টি-বাদল বাড়তে থাকে, ঠান্ডা হাওয়া বয়। প্যাচপেচে বৃষ্টির সুচ গায়ে বা মাথায় বিঁধলে আর বুঝি রক্ষা নেই। বিশ্রী সর্দিজ্বর লেগে যাবেই। তাই সতর্ক মানুষজন ভারী লংকোট, হুডি বা ক্যাপ চেপে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছায়। চলমান মানুষের পায়ের নিচে ভেজা রাস্তাকে দেখায় কুচকুচে কালো। বিষণ্ণ পথচারীদের খসখসে সাদা মুখ ছাড়া প্রায় সবকিছুতেই কালচে বা ধূসর রংমাখা। সুঠাম মানুষদের গায়ে কালো বা ছাইরঙা কোট, মাথায় বাদুড়ে টুপি বা নানান কিসিমের কালচে হ্যাট, হাতে গ্লাভস আর পায়ে শক্ত বুট। আশপাশের সব স্থাপনাও তো ম্যাড়মেড়ে ধূসর, নীলচে, মেটে, হলদেটে বা কালো। মাঝে মাঝে লালচে খুপরি বাড়ি আর ঘোলা-কাচের আকাশচুম্বী অট্টালিকা। দালানের কার্নিশে বা পত্রশূন্য ডালে ঝিমিয়ে পড়ে বেকার ম্যাগপাই, বিরক্ত দাঁড়কাক বা জড়সড় কবুতর। বাড়ির বহির্মুখী পাইপ দিয়ে কালচে ধোঁয়া বয়। ঘোর বরষা বলে দিনের বেলাতেও মাঝেমধ্যে কালো ল্যাম্পপোস্টের আগা থেকে হলদেটে আলো ঝরে। ছপছপ করে যানবাহন এগোয় বেশ মন্থর হয়ে। পথচারীদের সবার সঙ্গী দীর্ঘ ডাঁটের কালো ছাতা। সবার ওপরে মেঘমালা ভাসে ভবঘুরের মতো। গগণবিহারি মেঘের যে কত রং- ফিফটি শেডস অব গ্রে। চলিষুষ্ণ মেঘ দালানের মাথায় ছোঁয়া দিয়ে পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খায়। এই সময়টায় ধোঁয়াশা-ঢাকা পাহাড়ি জনপদকে বেশ থমথমে দেখায়। বাতাসের শোঁ শোঁ বয়। দূরে কোথাও পাখি ডাকে করুণ স্বরে। পাথুরে গির্জা থেকে একটু পরপর ঘণ্টা বাজে। শুধু লংকোট-পরা নারীদের লাল ঠোঁট, মুকুটশোভিত রঙিন পোস্টবক্স, চলন্ত বাস-ট্রাম, মালবেরির বর্ণিল পাতা আর ব্যস্ত মানুষের মুখরতা খানিকটা সজীবতার ইঙ্গিত দেয়।
ছোট্ট ছাতার নিচে জড়সড় হয়ে আমি সাহেব-বেশে স্যাঁতসেঁতে পথ মাড়িয়ে অনুষদে আসি। হিটারের বদৌলতে এখানকার সব কক্ষে বেশ আরামপ্রদ উষ্ণতা। বরফরঙা সহপাঠিনীদের সাথে আড্ডা দিই, আগুনগরম চা খাই, খানিকটা চাঙ্গা হই। গবেষণাকক্ষে একটু জিরিয়ে বিভিন্ন সেমিনার-মিটিং-টিউটোরিয়ালে হাজির হতে হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী এক অধ্যাপকের কক্ষে গিয়ে হাজির হলে তিনি বললেন, হ্যালো, হ্যাভ ইউ কাম 'টুডাই'? আমি ভ্যাকাচ্যাকা খেয়েও হেসে সম্ভাষণ জানালাম। তিনি আমার নতুন পার্সোনাল টিউটর। মনে মনে ভাবলাম, কী বিশ্রী প্রশ্ন! এই পচা আবহাওয়ায় প্রায় সবারই মাথা বিগড়ে যায়। সাদা চুলের অধ্যাপকের মেজাজও কী খিটখিটে হয়ে গেছে। তিনি দুই পেয়ালা কফি বানিয়ে এক পেয়ালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের কফিতে আয়েশ করে চুমুক দেন। শুরুতেই দাঁতমুখ খিঁচে বললেন, আমার হাতে একদম সময় নেই। পিএইচডি একটা ম্যারাথনের মতো। সুপারভাইজাররা স্বাভাবিকভাবেই বেশ ব্যস্ত থাকবেন। সেজন্য তোমাকেই তোমার গবেষণার কাজে মগ্ন থাকতে হবে। তোমাকে হতে হবে লৌন উলফ। আমি বাগধারাটির মানে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, যে দায়িত্ব নিয়ে নিজের কাজ করে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি 'আর্লি বার্ড' হতে পার। আমার উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এর মানে খুব ভোরে উঠে কাজ শুরু করা। আমার বিচারক পরিচয় শুনে বললেন, কোর্ট-কাছারি ছেড়ে গবেষণার গজদন্ত মিনারে কেন এলে? আমি প্রত্যুত্তর করলাম, আমাদের বিচারব্যবস্থার আঁতুড়ঘর হলো ব্রিটিশ কমন আইন। তাই আমাদের সমস্যার নিদান তালাশে তোমাদের এখানে এসেছি। তিনি হেসে বললেন, গুড চয়েস। তোমার দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনে ধরেছে। একটা জিনিস জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, বিচারক হিসেবে তোমার শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা কতটুকু? আমি বললাম, মৃত্যুদ। ভদ্রলোক আঁতকে উঠে এমনভাবে বিষম খেলেন যে, একটু এদিক-সেদিক হলেই কফির পেয়ালা উল্টে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, কী উদ্ভট, কী নির্মম। আমি বললাম, প্রিয় অধ্যাপক, আমাকে জল্লাদ-টল্লাদ ভেবেছ নাকি? ভদ্রলোক খানিকটা লজ্জিত স্বরে বললেন, না, না, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। আমি যোগ করলাম, তোমাদের এখানে তো অন্তত দুইশ অপরাধের সাজা ছিল মৃত্যুদ। ঘোড়া চুরি, পকেটমার ছিল গুরুতর অপরাধের তালিকায়। আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর পূর্বে ব্রিটিশ শাসকরাই তো আমাদের দ বিধি রচনা করেছেন। আইনবিদ লর্ড মেকলে ভারতীয়দের জন্য মৃত্যুদে র কড়া বিধান লিখে দিয়েছেন। প্রফেসর বললেন, ও, আচ্ছা। কিন্তু ইংল্যান্ডে মৃত্যুদ রহিত হয়ে গেছে অনেক আগে-সত্তরের দশকে। আমি বললাম, মৃত্যুদে র প্রয়োজনীয়তা বা কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে, আর ব্যক্তিগতভাবে আমি কঠোরতর শাস্তির সমর্থকও নই। তবে ঔপনিবেশিক আইনে এখনও মৃত্যুদ রয়ে গেছে। নতুন নতুন আইনেও জারি করা হয়েছে মৃত্যুদে র খড়্‌গ। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমার মতো বিচারককে সমাজের কথা বিবেচনা করে একটু কঠোরও হতে হয়- 'টু বি ক্রুয়েল টু বি কাইন্ড'। ভদ্রলোক বাঁধানো দাঁতে হাসলেন। আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বর্তমান বাস্তবতায় আইন সংস্কারও তো জরুরি। এবার মাথা ঝুঁকে সায় দেওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর থাকে না। মিটিংয়ের শেষদিকে তিনি শোনালেন এক মজার গল্প-
তরুণ ফাইনম্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গিয়ে সুপারভাইজারের সাথে প্রথম মিটিংয়ে বসলেন। সুপারভাইজার সময়ের মূল্য বোঝাবার জন্য মহামূল্য নিজ ঘড়ি টেবিলের ওপর রেখে বললেন, তুমি তিন মিনিট দেরি করে এসেছ। আমি প্রচ ব্যস্ত, তোমার গবেষণার বিশেষজ্ঞ তুমি নিজেই। কোনো পরামর্শ প্রয়োজন মনে করলে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসবে। অকারণে আমাকে বিরক্ত করো না। পরের মিটিংয়ে তরুণ ফাইনম্যান নিজের ছালওঠা কম দামি হাতঘড়ি টেবিলে রেখে ইঙ্গিত দিলেন, অকারণে অপচয় করার সময় তারও নেই। এই ফাইনম্যান নোবেলজয়ী হয়ে সাদামাটা গুরুকে ছাপিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানের নতুন সমীকরণ আঁকলেন।
আমার প্রাজ্ঞ টিউটরের নসিহতে বুঝতে অসুবিধে হয় না, পিএইচডি একান্তই নিজের যজ্ঞ। অভিজ্ঞ সুপারভাইজার শুধু মাঝে মাঝে ঘি ঢেলে বলবেন- বাছা, থামো, ডাইনে চলো বা বাঁয়ে যাও। অবশ্য আমার সুপারভাইজার লাল দাগের আঁচড়ে আমার কাঁচা লেখা কেটেকুটে একশেষ করেন। অস্বীকার করব না, শুরুতে পার্সোনাল টিউটরের মুখে মুখে 'টুডাই' শুনে বেশ দমে গিয়েছিলাম। আবার ঠিক ঠিক মেলাতেও পারছিলাম না, তিনি বেশ হেসে হেসেই কথা বলেছেন পরম মমতায়। কফিও তো খাওয়ালেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, যে কোনো সমস্যায় আমাকে জানাবে। চলমান জলধারা দেখিয়ে হাসেন, খবরদার, এই শীতের বিষণ্ণতা যেন তোমাকে কোনোমতেই পেয়ে না বসে। শেষে হাত নেড়ে বললেন, বাই ফর টুডাই।
এবার তাঁর 'টুডাই'-এর পাঠোদ্ধার করতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, তোমার উচ্চারণ বুঝতে শুরুতে আমার একটু সমস্যা হয়েছিল। জানতে কৌতূহল হচ্ছে, এই যে তুমি বললে 'টুডাই'। তুমি তো রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আমি একদিন মরব ঠিকই, কিন্তু এখনই কেন? তিনি ছোট্ট কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে হো হো হেসে উঠে বললেন, তুমি তো মজার মানুষ। শোন, আমার মা ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান। তাই এত বছর বিলেতে থেকেও আমার মুখে মায়ের অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণটাই রয়ে গেছে- আমি 'টুডে' বলতে এখনও 'টুডাই' বলে ফেলি!
গবেষণাকক্ষে ফিরতে গিয়ে দেখি, ছায়াময় দিন একদম বামন হয়ে গেছে। আকাশও বেশ গোমড়ামুখী। অপরাহেপ্ত চারপাশ কিছুটা পরিস্কার দেখালেও আকাশে মেঘ উড়ে জলদস্যুর মতো। কিন্তু তাপমাত্রা স্থির থাকে একই হিমাঙ্কে। নিজ ডেস্কে বসে ঘোলা জানালা দিয়ে দেখি, আকাশচারী এক নিপুণ পটুয়া মেঘের যে কত খসড়া আঁকে। মন প্রফুল্ল রাখতে কিচেনে গিয়ে লাঞ্চ সারলাম দলবেঁধে। তবু অকারণ অবসাদ লাগে। শীতের বিষাদ থেকে নিস্তার নেই। দুপুর শেষে শুরু হলো ঠান্ডা বৃষ্টির-মৃদুলয়ের যুগলবন্দি। চারপাশ ছেয়ে যায় আবছা-ধূসরতায়। স্মার্টওয়াচ থেকে আবহাওয়ার সংকেত পাচ্ছি- তুষারঝড় হবে। তটস্থ হয়ে ফিরে চলি বাসস্টপেজের দিকে। পিচ্ছিল ফুটপাতে কেউ একজন পিছলে পড়তে গিয়েও সামলে উঠে। হন্তদন্ত হয়ে চলতে অভ্যস্ত মানুষজন এ সময়টায় শঙ্কিত পায়ে হাঁটে- একটু অমনোযোগেই যেন পা পিছলে আলুর দমের অবস্থা। এ প্রসঙ্গে একটা বিচিত্র বিলেতি আইনের কথা জানিয়ে রাখি। মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন অনুযায়ী, রাজপথের বরফে পিছলে পড়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ! এদিকে জলের ছিটে উড়িয়ে রাজপথ ধরে নিয়নরঙা অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশের গাড়ি চলে যায় তীক্ষষ্ট বাঁশি বাজিয়ে। এ বেলায় প্রাত্যহিক পাবলিক বাসগুলোও যেন লাপাত্তা হয়ে গেছে। কী করে যে শহরতলির বাসায় পৌঁছাব এই চিন্তায় অস্থির হয়ে চামড়ার দস্তানা পরে নিই। এক অপেক্ষমাণ প্রৌঢ় সশব্দে নাক ঝেড়ে টিস্যুপেপারে মুড়ে সাইডপকেটে পুরল। ঘিন ঘিন লাগে। একটু সরে দাঁড়াই। খবিশ ব্যাটা চোখ স্থির করে যাত্রীছাউনির একপাশে দাঁড়িয়ে চুরুটে আগুন ধরিয়ে লম্বা টান দেয়। কড়া তামাকের মৌতাত ছড়িয়ে পড়ল চারধারে। বলা দরকার, বিলেতে কিন্তু তামাকের চল শুরু হয় রানী প্রথম এলিজাবেথের যুগে। রানীর প্রেমিক সেনাপতি ওয়াল্টার র‌্যালে আমেরিকার উপকূল জয় করে প্রথম তামাক আর আলু নিয়ে রানীর চরণে হাজির করেছিলেন। বিজয়ী র‌্যালে যখন মাথার বিস্তৃত হ্যাটে চুরির ফলা গেঁথে ধূমায়িত চুরুট মুখে পুরে লন্ডনে হাজির হলেন, উৎসুক এক অমাত্য নাকি জলের বালতি নিয়ে সামনে এগিয়েছিল- এই বুঝি র‌্যালের গায়ে আগুন ধরে যায়। রানীর ফরমানবলে র‌্যালে এবার হলেন রানীর ব্যক্তিগত সেনাধ্যক্ষ। রানী আর সেনাধ্যক্ষের তুমুল অভিসার শুরু হলো। এ নিয়ে বেশ রটনাও ছড়িয়ে পড়ে। বহুগামী রানী আবার এজেক্স নামের এক তরুণের প্রেমে পড়লেন। ওয়াল্টার র‌্যালেও আরেক তরুণী সহচরীর রূপে আকৃষ্ট হলেন। কামার্ত র‌্যালে গোপনে নতুন এক প্রেমিকার সাথে সর্বনাশা লীলায় মগ্ন হলেন। রানী এ সংবাদ শুনলেন আরেক অনুচর মারফত। তথ্য যাচাই করে এলিজাবেথ তখন অগ্নিশর্মা। প্রেমিক র‌্যালের এত অধঃপতন? এবার রানী ঘোষণা করলেন এক কঠিন ব্যতিক্রমী শাস্তি। রানী আর তার নতুন প্রেমিক এজেক্সের অভিসারের সময় সাবেক প্রেমিক র‌্যালে বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করবেন। দি ত র‌্যালে গম্ভীরমুখে রাজকীয় খাসকামরার ওপাশে দীর্ঘ পদক্ষেপে পায়চারি করতে করতে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেন। আবার অকস্মাৎ ঘটনার নতুন বাঁক এলো। খেয়ালি রানী এবার প্রতারণার অভিযোগ এনে তরুণ প্রেমিক এজাক্সকে মৃত্যুদ দিয়ে বসলেন। রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে অ্যালেক্সের স্থায়ী ঠিকানা হলো বধ্যভূমি। উল্লসিত র‌্যালে আবার ঠাঁই পেলেন রানীর বুকে। শীতের দেশের মানুষের কাছে র‌্যালের আমদানিকৃত আলুভাজা আর তামাকের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় হুহু করে। অর্থগৃধ্নু রানী কর আরোপ করলেন তামাকের ওপর। অবশ্য প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নতুন রাজা প্রথম জেমসের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে র‌্যালেকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।
২.
ঠান্ডার সময় শ্বেতাঙ্গদের ধূমপানসহ নানবিধ খানাপিনার পরিমাণ বেড়ে যায়। অভিজাত ঘরে ঘরে জ্বলে পুরোনো ফায়ারপ্লেস। বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিলেতের শীতে প্রচুর গরুর মাংস খেতেন বলে এক পত্রে বিদ্যাসাগর মশাইকে জানিয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতের ঠান্ডা, গোমাংস আর শ্বেতাঙ্গীদের রূপের জয়গান করেছেন। এখনও তুষারগ্রস্ত অভিবাসী কেউ কেউ গদ্য, পদ্য ও মদ্যে মজে যায়। তবে মূল অনুষঙ্গ রহস্যময়ী নারী। গোবেচারা আমি সূর্যের আলো দুষ্প্রাপ্য বলে চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন ডি খাই। লেবু-আদা-মধু দিয়ে নিয়মিত ঈষদোষ্ণ জল খাই। আয়রন-ভিটামিনের লেভেল কমে যায় বলে অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি দুঃখবিলাসে মগ্ন হতে, বিষণ্ণতায় ভুগতে। অনেকে সমানে খাবার খেতে শুরু করে। নিজস্ব খুপরিতে শ্রমজীবী মানুষ সস্তা মদ, বানরুটি, বাদাম, সসেজ খেয়ে আড্ডায় মেতে ওঠে। হতশ্রী ঠান্ডা বাড়তেই থাকে। তুষারপাতের সময় গৃহবন্দি আমির-ফকির সবারই মেজাজ খিটখিটে হয়। ছিটগ্রস্ত মানুষের মাঝে ভর করে চরম আলস্য-অবসাদ-অতৃপ্তি। ত্রিসদ্বমাসের ছুটিতে গৃহবন্দি শিশু-কিশোরদের নানারকম উপদ্রব তো আছেই। বড়শিশু-গৃহস্বামীও শুয়ে-বসে সারাক্ষণ মদ-মাংস-আলু খেয়ে শুধু এটা-সেটা ফরমায়েশ করে। সর্বংসহা গৃহিণীর মেজাজও একসময় তিরিক্ষি হয়। মদখোর অনেকের মাঝে ভর করে বিচিত্র যৌনাচার। স্নানে অনীহ বিলেতিদের এই শীতে নিয়মিত গোসলের বালাই নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিলেতের রানী প্রথম এলিজাবেথ নাকি জীবনে কখনও পরিপূর্ণ অবগাহন করেননি! যা হোক, প্রায়শই অশৌচ গৃহী-গৃহিণীর তালু গরম হয়ে ওঠে। ঘরে-বাইরে নানান ছুতোয় মানুষজনের ঝগড়া বেধে যায়। রাতের বেলায় বিশেষত সপ্তাহান্তে পানশালাগুলো কিন্তু বেশ জমে ওঠে। দিলখোলা মানুষজন তখন আগুনের আঁচে হল্লা করে, নাচে-গায়-হাসে।
শুনেছি, অনেকেই শীতের শুরুতে নাকি মানসিক স্বাস্থ্য সুষম রাখার কোর্স করে রাখে। কিন্তু ঠান্ডা এলেই সব প্রশিক্ষণ ভুলে যায়, একটানা সুরা খায়, অখাদ্য কামড়ায়, ভালোবাসে, আবার আড়ি দেয়। এ বিপন্ন সময়ে বিলেতে অনেক প্রেম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও অনেক সময় এদেরকে খুব একটা আক্ষেপ দেখা যায় না। কিছুদিন মদ্যপান করলে সব কষ্ট উপশম হয়ে যায়। বিরহী মানুষ নতুন করে সম্পর্কে জড়ায়। শুধু বয়সী নারীদের চোখে জলের ধারা বয়। পশ্চিমে নর-নারীর সম্পর্ক আবর্তিত হয় মূলত দেহ-রূপ-যৌবন আর অর্থকে ঘিরে। ব্যতিক্রম যে নেই তাও ঠিক নয়। তবে ব্যতিক্রম খুঁজতে আতশি কাচ লাগবে। পার্টনার, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড বা স্পাউসের বাইরে আর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাও হয়তো কিছুদিন, কিছু মাস বা কিছু বছরের সম্পর্ক। আমরা যে শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান করে 'বাবা-মা' ডাকি, এটা শুনে আমার এক শ্বেতাঙ্গী বন্ধু হেসেই খুন। পশ্চিমের মানুষজন এক কাজিন শব্দ দিয়ে মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো, জেঠাতো, খালাতো ভাইবোন বুঝিয়ে থাকে। খুব অভিজাত পরিবার না হলে কাজিনরা একে অন্যকে চিনেও না। তবে এক বাসায় ছোট্ট বয়সে সৎভাই-বোনরা একসাথে বড় হয়। উপমহাদেশে যে আত্মীয়তা বা গোষ্ঠীগত সম্পর্কের কারণে নানাবিধ গোলমাল বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আসে, পশ্চিমাদের অস্থায়ী সম্পর্ক বা একান্ত নিউক্লিয়ার পরিবার এদেরকে নৈর্ব্যক্তিক থাকতে অনেকাংশে সহায়তা করে বলে আমার ধারণা। কেউ বেকার বা অসহায় হয়ে গেলে উপযুক্ত ভাতা পায়। অবসরজীবী মানুষ বেশ হূষ্টচিত্তেই ওল্ডহোমে থাকে। তরুণ-তরুণীরা একসাথে থাকে, তবু বিয়েতে বেশ অনীহা। ব্যাংককার্ড, সুস্বাস্থ্য, ভ্রমণ আর নানাবিধ শখ নিয়ে এদের জীবনাচার। আর্থিক সক্ষমতা আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এদের জীবনের মূল অনুষঙ্গ বলে কেউ কারও তোয়াক্কা করে না। আনুষ্ঠানিকভাবে চলনে-বলনে ভদ্রতা চোখে পড়লেও মাতাল হলে আর হুঁশজ্ঞান থাকে না। এ দেশে সমকামিতারও জয়জয়কার। তুষারপাতে অবধারিতভাবেই অনেক সম্পর্কচ্ছেদ হয়; ডিভোর্সের হারও বাড়ে আশঙ্কাজনক হারে।
বিলেতের গ্রামে থাকার টাটকা অভিজ্ঞতা পেতে শহরতলির দিকে একটা পুরোনো বাড়িতে উঠেছি মাস কয়েকের জন্য। এই অরণ্যময় এলাকা দেখে বেশ উৎফুল্লই হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ঠান্ডার প্রকোপ আর যাতায়াতের বিড়ম্বনার কথা একদম মনে আসেনি। মেঘলা দিনে নীলচে বাস ধীরলয়ে চলে মেঘছোঁয়া পাহাড়ি পথে। বন্ধুর পথ বেয়ে নামতে গিয়ে লক্ষ্য করি, গত কয়েক দিনের ঢল-বৃষ্টির জন্য মরা নদীটি বইছে পাগলপারা হয়ে। গাছপালার ফাঁকে মাথা উঁচিয়ে দেখি, শেষবেলার আকাশ বেশ ঝাপসা। চলতি পথে হাত বাড়ালেই বৃষ্টিভেজা জংলি ঝোপঝাড়। আশপাশের ঘাস-লতা-গুল্মে বিনা পরিচর্যায় ফুটে আছে ম্রিয়মাণ বুনোফুল। এদের রং ম্লান কমলা, লালচে, কালচে বা হলদে। ভূপাতিত পাতার বুকে শুয়ে আছে রাশি রাশি জংলি ফুল। মলিন সাঁঝে লোভী পাখিরা এসে শেষবারের মতো ঠোকর দেয় বেরিঝাড়ে। আবার দলবেঁধে উড়ে চলে ডানা মেলে। কী যে সুন্দর দৃশ্য। আচমকাই আমার মাথার হ্যাটে বিষ্টা পড়লে বিরক্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বদমাশ কাককে গালি দিতে গিয়েও নিরস্ত হয়ে দুর্বল ছড়া বানাই- 'গাছের ঝরে ফল, ফুলের ঝরে পাপড়ি, কাকের ঝরে মল'। দীর্ঘ বনস্পতির শীতল ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে কবি এডগার এলান পো'র 'দাঁড়কাক' কবিতার স্তবক আর একটু উষ্ণতা কল্পনা করি। হঠাৎ মনে পড়ল, বিলেতের একটা কুসংস্কার হলো, মাথায় পাখির মল পড়া চরম সৌভাগ্যের প্রতীক! লক্ষ্য করলাম, পথের দু'ধারে মরা ঘাস আর জীর্ণ লতার বিস্তার। সর্পিল পথ একটু এগিয়ে হারিয়ে গেছে ন্যাড়া পাহাড়ের মোড়ে। পাশের সমতল ভূমিতে এক সারি তিন-চার তলা কাউন্সিল-ফ্ল্যাট। এখানকার ঝুলবারান্দায় বিশ্রীভাবে লটকানো আছে ভিজে কাপড়চোপড়। অবশ্য মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন অনুযায়ী, রাস্তার দিকে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা দ নীয় অপরাধ। এই গাঁও-গেরামে বাসিন্দাদের এসব বিধিবিধান মানার বালাই নেই বলে মনে হয়। এই পা ববর্জিত মফস্বলে এই আইনের কার্যকারিতা আছে কিনা, তাও এক প্রশ্ন। বলে রাখি, বিলেতের বাস্তুহীন মানুষকে সরকারি উদ্যোগে এসব কাউন্সিল ফ্ল্যাটের ইজারা দেওয়া হয়। লন্ডনের এরূপ এক ভগ্নপ্রায় কাউন্সিল-ফ্ল্যাটের এক শিশু বড় হয়ে নিজ মেধা-নিষ্ঠা-পরিশ্রমে লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টানা দুইবার। ট্রাকচালক পিতার এই চৌকশ ছেলের নাম সাদিক খান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তড়িঘড়ি করে বানানো এসব ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা গরিব-গুর্বো মানুষ। সাবেক ব্রিটিশ কলোনি সোমালিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া, ইরিত্রিয়া আর পূর্ব ইউরোপের নেশাখোর বেকার আর প্রৌঢ় মানুষের আখড়া ছিল এই গাঁ- ওভেরন ড্রাইভ। ইদানীং কিছু ভদ্রমতো মানুষ এখানে বসতি কিনে থিতু হয়েছে। জামাপরা কুকুর নিয়ে উল্টোদিক থেকে হেলেদুলে এসে পাশ কেটে যায় এক পৃথুলা নারী। এখানকার মানুষজনের পোশাক-আশাকে কিছুটা দীনতা চোখে পড়ে। দারিদ্র্য আছে আচরণেও। চোখাচোখি হলে ভদ্র শেফিল্ডবাসীদের মতো মুচকি হাসে না। এক নেশাখোরমতো লোক কাঠের বেঞ্চিতে বসে বিড়বিড় করে ভিক্ষা চাইলে দ্রুতলয়ে সামনে হাঁটি। স্থানীয় রেডিওতে শুনেছি, এই এলাকায় কিছুদিন আগে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। শীতের দিন বলে হতচ্ছাড়া গাঁয়ে সর্বগ্রাসী আঁধার নামে তড়তড়িয়ে। মৃতপ্রায় আগাছার বন পেরিয়ে হাজির হলাম নিজ ঘরে। চারদিক একদম ঝিম মেরে আছে, এই বুঝি ঝড় এলো। শুধু লাগোয়া বাড়িতে মুখরা প্রতিবেশিনীর বিড়ালের গলার ঘণ্টা টুংটাং স্বরে বাজে।
এখন ঢাকায় মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। তাই আর দেশে ফোন করা হয় না। বিষণ্ণতা কাটাতে কিছুক্ষণ মুভি দেখি। ধুর, একদম ভাল্লাগছে না। স্ত্রী দেশে গেছে পাক্কা দুই মাস হতে চলল। আহারে, মায়াবী নারী এখন কি ঘুমিয়ে পড়েছে খোলা চুল একপাশে সরিয়ে। হাতে নিই- কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাব্যসংগ্রহ। এক জায়গায় এসে চোখ ভিজে যায়-
আহারে বৃষ্টির রাত, সোহাগী লো, আমি থাকি দূর প্রবাসে
কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর?
কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে কাটাও প্রহর?
পরান ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে।
কম্বলের আরামে বেশ আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। মাঝরাতে আড়মোড়া ভেঙে আধ-খোলা বই বন্ধ করি। এত ঠান্ডায় বেডের ওম ছেড়ে টয়লেটে যেতেও অনিচ্ছা হয়। জানালার পর্দা খুলে চোখ কচলে বাইরে দেখি, এ যেন ছবিতে দেখা তুন্দ্রা অঞ্চল। বরফশোভিত চারধার। তীব্র ঘুমে ভুলেই গেছি- রাতে তুষারপাত শুরু হয়েছিল। এখন আকাশে মেঘমগ্ন শুক্লা চাঁদ। তাই যতদূর চোখ যায় ফ্যাকাসে বরফের প্রান্তর। চারপাশে ফুলের রেণুর মতো বরফের তীর চুইয়ে পড়ে। গতকালের শুকনো ঘাসতরু-লতাপাতার চিহ্নমাত্র নেই। কোনো এক কুহকী মায়ায় লম্বা গাছগুলোও হয়ে গেছে শুভ্র কাচবৃক্ষ। অনভ্যস্ত চোখে কেমন যেন অচেনা লাগে, ঘোর ঘোর লাগে। অতি উৎসাহী হয়ে জানালা খুলতে গিয়ে বুকে ঠান্ডা টের পেলাম খুব। আঙুলের ডগায় ছুরির ফলার মতো হিমেল মাতাল হাওয়া এসে শীতল কামড় দেয়। বাতাসের কী যে হীরক-স্নিগ্ধতা- একবার কিশোর বয়সে কচি ধানগাছে লেগে ছ্যাঁত করে আঙুল কেটে গিয়েছিল- ঠিক সেই অনুভূতি। টেনেটুনে জানালা বন্ধ করি। কিচেনে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় হিটার জ্বালাই। টোস্ট আর গরম কফি খেয়ে জানালার পর্দা খুলে শয্যায় থেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রই গ্লিডলেস উপত্যকার দিকে। ম্লান জ্যোৎস্নায় আবার পাখির পালকের মতো রত্তি রত্তি তুষারকণা ধেয়ে আসছে আসমান বেয়ে। হুশহুশ করে ঝড়ের ঝাপটা এসে জানালার কাচে বাড়ি খায়। জানি না, এই অপরূপ সৌন্দর্য আর কে কখন দেখেছে। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে যেন অবশ হয়ে যাই।
কিছুক্ষণ তা ব চালিয়ে তুষারঝড় একদম থেমে গেল। চাঁদের আলোয় সবকিছু ঘোলাটে দেখায়। সারসের রোমের মতো শুভ্র শুভ্র ফলা আটকা পড়েছে ঝোপের গায়ে, ঘাসের ডগায়, মেপলের শাখে, ফুটপাতে, এবড়োখেবড়ো পথে। কী অপার্থিব সৌন্দর্য। জোড়-বালিশে হেলান দিয়ে ডায়েরিতে কয়েক ছত্র হিজিবিজি নোট লিখি। কম্বল মুড়ি দিয়েও আর ঘুম আসে না। কিছুটা সময় পার হয়। ঘড়ি দেখতেও আলস্য লাগে। জলনিরোধী গরম কাপড়চোপড় পরে সন্তর্পণে ঘর থেকে বের হই। পাশের বাড়িতে সতর্ক বেড়ালের ঘণ্টা বেজে ওঠে। নির্বিকার আমি ভূতগ্রস্তের মতো বরফ-ছাওয়া পথ ধরে হাঁটি। মৃদু ছপছপ শব্দ হয়। শক্ত বরফের গায়ে জুতার আলপনা হয়ে যায়। শ্বেতঝোপে বেরিফলকে দেখায় শক্ত মার্বেলের মতো। সনাতনী গির্জাটির সুচালো শীর্ষ যেন বৃহৎ হীরকদ। কী যে সুনসান নীরবতা। বড় রাস্তা ঢেকে গেছে সাদা বরফে। চারধার একদম নির্জন- নিস্তব্ধ। কেমন যেন মায়াবী বিভ্রম চারধারে। মুখর পাখিরাও কোথায় যেন লুকিয়ে গেছে। পানশালার মোড়ে কেউ কি জবুথবু হয়ে বসে আছে? জিন-ভূত নাকি? ভয় পাবার উপক্রম। ভাবলাম, কোনো ছিন্নমূল, অসুস্থ বা পাঁড়মাতাল মানুষ কিনা। কাছে গিয়ে দেখি- কারা যেন ভালোবেসে বরফ দিয়ে মানবমূর্তি বানিয়ে গেছে আগেভাগেই। বুঝলাম, আমার মতো না ঘুমানোর দল এই জঙ্গলেও আছে। নিজেকে কেমন যেন অভিযাত্রীর মতো লাগে। কী বিশুদ্ধ হিমহিম বাতাস। বরফপ্রপাত শেষে উষ্ণতা খানিকটা বেড়ে যায়। সাহস করে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে মুখ দিয়ে প্রশ্বাস ছাড়লাম। ছোট্ট ছোট্ট ধোঁয়ার কু লী বেরোয় মুখ দিয়ে। বরফ-আচ্ছাদিত ফুটপাত ধরে আরেকটু এগোই। চেনা পথও এখন অচেনা লাগে। বরফে ঢাকা গাছের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে হ্যাংলার মতো। বাস স্টপেজের ওদিকটায় যেন বিস্তৃত কাচের সাগর। চেনা মের্সব্রুক নদীটির চিহ্নমাত্র নেই। এর বুকে অর্ধগলিত-হিমবাহ। বুড়ো সেতুর দুই রেলিংয়ের মাঝে আটকা পড়েছে বরফস্তূপ। রেসের নৌকাও ডুবে গেছে তুষারপাতে। নদীর পাড়ের বেঞ্চিকে দেখায় কাফনবাহী খাটিয়ার মতো। এর বরফের অবয়ব বেয়ে একটু-আধটু জল চুইয়ে পড়ে নিচের দিকে। এবার গা যেন ছমছম করে ওঠে। তবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো জ্যোৎস্না-ধোয়া পথে হেঁটে চলি সামনের দিকে। বুঝলাম, এখনও আসলে ভোর হয়নি। অবতল পথের মোড়ে বিস্তৃত কাচের পাহাড়।