
প্রথম যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত ১টা; কিন্তু সময় দেখার কোন তাগিদ বোধ করল না অমলেশ। কোন কিছু না ভেবেই বিছানা থেকে উঠে সে টয়লেটে গেল। প্রস্রাব করে এসে বিছানায় যেতেই সে আবার ঘুমে ঢলে পড়লো।
দ্বিতীয়বার যখন ঘুম ভাঙলো তখন কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তার মনে পড়লো, আগে আরো একবার ঘুম ভেঙেছিল এবং টয়লেট করে এসে দ্বিতীয় দফা ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত কি শেষের দিকে? ঘুম ভাঙার আগে সে একটি স্বপ্টম্ন দেখেছে। কারো সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়েছে। দেখা হয়ে সে খুশি হয়েছে। এতটুকুই মনে আছে।
সে হাত বাড়িয়ে বালিশের পেছন থেকে ঘড়িটা বের করল। রাত পৌনে দুটো। আগেরবার ঘড়ি দেখা হয়নি। কতক্ষণ আগে প্রথমবার ঘুম ভেঙেছিল, অনুমান করা যাচ্ছে না। সে বিরক্তি বোধ করল।
কেন ঘুম ভেঙে গেল অসময়ে? হালকাভাবে এ প্রশ্নটা তার মনের ওপর দিয়ে কয়েক দফা এদিক ওদিক করে গেল।
রাতের নিস্তব্ধতা সজোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ইট কিংবা লোহার রডভর্তি একটি লরি ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত ছুটে গেল। দূর থেকে ভেসে এলো নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দ। বেশ শীত পড়েছে। কম্বলটা টেনে নিতেই ঘুমের আমেজ চলে এলো দ্রুত।
তৃতীয়বার যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত ৩টা। ঐ স্বপ্টম্নটা আবার দেখছিল। একটি মুখ। কার মুখ? মনে করতে পারলো না সে। কেবল ভালো লাগার রেশটুকু রয়ে গেছে।
ক্ষুধা ছিল পেটে ক্ষুধার তাড়নায় বারবার ঘুম চটে যাচ্ছে
ফ্রিজ খুলে দেখলো অমলেশ কী কী আছে। একটা আইসক্রিম বের করল। টেবিলের ওপর বিস্কুট রাখা ছিল; প্যাকেটটা খুলে ফেলল। আইসক্রিম খেতে খেতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অরুণিমা যখন চলে যায় তখন সবে সে গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। সেকি সন্তানের জন্ম দিয়েছিল নাকি নির্ঝঞ্ঝাট থাকার জন্য গর্ভপাত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিল এসব বিষয় তার মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
স্কুলে পড়ার সময় কুমিল্লা থেকে জ্যোতিষ রঘুনাথ কাকা এসেছিলেন। একে একে সবার হাত দেখেছিলেন। কিশোর অমলেশের হাত দেখে বলেছিলেন, 'কি-রে, তুই দেখছি বিরাট ভাগ্যবান! দুটি বিয়ে হবে তোর।'
অরুণিমা চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ থেকেছে অমলেশ। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে রাউন্ড শেষ করে বাসায় ফিরে আসার পর কখনো কখনো তার মনে হয়েছে, সে একা হয়ে গেছে। একা তো বটেই কিন্তু সঙ্গিনী জুটিয়ে নেয়ার বদলে অমলেশ ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, সারাদিনে না কেউ তাকে ফোন করে, না সে কাউকে ফোন করে। তার বাসায় অতিথি আসে কালেভদ্রে। সামাজিক নিমন্ত্রণগুলি সে কৌশলে এড়িয়ে চলে।
রাতে থাকার কেয়ারটেকারকে একদিন বিদায় করে দিল অমলেশ। বললো, 'বাসায় তেমন কাজকর্ম তো নেই মরিসন। তুমি অন্য কোথাও কাজ জুটিয়ে নাও। আমি সন্ধ্যায় দু'ঘণ্টার জন্য কাউকে রেখে নেব।'
মরিসন বললো, 'স্যার, আমিই না হয় সন্ধ্যায় এসে বাসাটা গুছিয়ে দিয়ে যাব।'
অমলেশ বলল, 'মরিসন, একজন মানুষ দুটো কাজ ভালোভাবে করতে পারে না। তবে যে ক'টা দিন নতুন কাজ না জোটে, সন্ধ্যার দিকে এসো।'
আগস্ট মাসে নতুন চাকুরি জুটিয়ে ফেলল মরিসন। পরের মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু। অন্য কারো বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ নয়; একজন ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে চাকুরি। রোগী এলে খাতায় নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে সিরিয়াল নম্বর দিয়ে নার্স দিদিমণিদের রুমে পাঠিয়ে দেয়ার কাজ।
'তোমাকে তো এখন থেকে ভালো জামাকাপড় পড়তে হবে। দু'সেট শার্ট-প্যান্ট, জুতো বানিয়ে নিও' বলে কিছু অতিরিক্ত টাকা মরিসনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল অমলেশ।
২.
কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছিল হাসপাতালের নতুন কনসালট্যান্ট ডা. ভূমেন্দ্র গুহ। দিল্লির এপোলো থেকে এসেছে। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি একা থাকো এ অ্যাপার্টমেন্টে এত বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট লাগে তোমার '
এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকবার হয়েছে অমলেশ। সে অক্লেশে মুখস্থ বলেছিল :লাগে না। একলা একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতটুকুন জায়গাই-বা লাগে! শিগগির হয়তো সে ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে উঠে যাবে।
কিন্তু সেরকম কখনো ভাবেনি সে কোনদিন।
'বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। কত বড় এটা '
'চার হাজার স্কয়ার ফুটের মতো।'
'সেরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি করোটা কী তোমার খালি খালি লাগে না '
অনিশ্চিতভাবে সামান্য হেসেছিল অমলেশ। উত্তর দেয়নি কোন। একা লাগে; খুবই একা লাগে। তাই বলে এ অ্যাপার্টমেণ্ট ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা যায় না।
ভূমেন পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরে দেখতে চাইলো। বললো, 'কাউকে যদি কোনো ঘরে লুকিয়ে না রেখে থাকো, তবে দেখাও তোমার এই প্রাসাদ।'
'তুমি ঘুরে ঘুরে দেখে নাও না! কোনো দরজায় তালা লাগানো নেই।'
ফ্রিজ থেকে ক্যানে ভরা টুনা ফিশ, চিজ আর ম্যায়োনিজ বের করে দুটো স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেললো অমলেশ। কফি পারকোলেটারটা চালু করলো। বাড়ি দেখা শেষ করে বেলকনিতে গিয়ে চেয়ারে বসেছে ভূমেন। সেখানে বসে কফি-স্যান্ডউইচে দাঁত ফোটানো, এটা ওটা কথা-বার্তা।
৩.
আইসক্রিম খেলে তার তেষ্টা পায়। পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেলল সে। তার মনে হল, রাত জাগা ঠিক হচ্ছে না। তিনবার ঘুম ভেঙেছে, এখন সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ঘুমোতে হবে; তা না হলে হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখার ফিটনেস থাকবে না।
ঘড়িতে সকাল ৬টায় ওঠার অ্যালার্ম দেয়া ছিল। ওটাকে ৮টা করলো অমলেশ। ঔষধের বাক্স থেকে একটা সিডেটিভ ট্যাবলেট বের করে এক ঢোক পানি দিয়ে পেটে চালান করে দিল।
ঘুমের ওষুধ খেলেই ঘুম আসে না। অমলেশ কাজের ঘরে গিয়ে একটু বসলো। টেবিলে কয়েক পাতা কাগজ ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা আছে। সে খুঁজে বের করলো সেই পাতাটি, যেখানে সে ফেলে রাখা কাজগুলোর তালিকা করে রেখেছে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তালিকাটি সে দেখতে লাগলো।
তালিকার প্রথমে লেখা :'ড্রাইভার্স লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।'
দুই নম্বরে লেখা :'অনলাইনে কয়েকটি বই অর্ডার করতে হবে'। কাগজের উল্টো পিঠে সে সাত-আটটি বইয়ের তালিকা করে রেখেছে। কয়েক দিন আগে সল বিলো নামে একজন মার্কিন কথাসাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তার একটি উপন্যাস ঐবহফবৎংড়হ :যব জধরহ করহম পড়ে বিস্মিত হয়েছে অমলেশ। কী দৃঢ় গদ্য; চিন্তাশক্তির কত না গভীরতা! সল বিলোর তিনটি উপন্যাসের নাম লিখে রেখেছে কিনবে বলে। গার্সিয়া মার্কেস নামে একজন কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক খুব নাম করেছে সম্প্রতি। তারও দুটি বইয়ের নাম সে টুকে রেখেছে তালিকায়।
সাত নম্বরে এসে তার ভ্রু কুঁচকে উঠলো। সাত নম্বর হলো :'সময়মতো ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিতে হবে।' অথচ কয়েক মাস আগে অমলেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, লাইফ ইন্স্যুরেন্সটা সে আর চালাবে না। সে কথাটি তালিকায় লেখা হয়নি। নতুন বছর শুরু হওয়ার আগেই কোম্পানিকে চিঠি লিখে পলিসিটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। লাল কলম নিয়ে সে সাত নম্বর আইটেমকে চিহ্নিত করল। বড় অক্ষরে লিখলো, 'পলিসি বাতিল করতে হবে।'
তালিকার ২১ নম্বরের রয়েছে :'ছেলেবেলার ছবিগুলো স্ক্যান করে ফেলতে হবে।' এটি তালিকার শেষ আইটেম। অমলেশ ২২ নম্বর দিয়ে নতুন একটি কাজ যোগ করল :'মৃণ্ময়ীর চিঠির জবাব দিতে হবে।'
৪.
গত পরশু মৃণ্ময়ীর চিঠি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। মৃণ্ময়ী সবচেয়ে ছোট ভাই কমলেশের মেয়ে। ওদের শেষ কবে দেখেছে, অমলেশের মনে নেই। কমলেশ হঠাৎ মারা গিয়েছিল। কয়েক বছর পরে মৃণ্ময়ীর মাও মারা যায়। ১৪ বছর ঢাকায় যাওয়া হয়নি অমলেশের। মৃণ্ময়ী খুব অনুরোধ করে লিখেছে, জ্যাঠামশাই যেন তার বিয়েতে অবশ্যই আসেন। অরুণিমা জ্যাঠাইমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে যেন ভুল না করেন।
এ কাগজটার উল্টো পিঠে ছোট আরেকটি তালিকা রয়েছে। এ কাজগুলো সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অথচ সময়সাপেক্ষ। তালিকাটা এ রকম :
(ক) অরুণিমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
(খ) বরানগরের ফ্ল্যাটবাড়ি বেচে দিতে হবে।
(গ) বাবার বন্ধু শুভেন্দু কাকার ঋণের টাকা শোধ দিতে হবে ইত্যাদি।
তালিকাটি অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রাখল অমলেশ। তারপর লাল কলম দিয়ে এক নম্বরে লেখা 'অরুণিমাকে খুঁজে বের করতে হবে' কথাটি কলম টেনে কেটে দিল।
অমলেশের বুকটা হুহু করে উঠলো।
অরুণিমা চলে গেছে ১২ বছরেরও আগে। বিরাট একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলে গেছে অরুণিমা সান্যাল। ডা. অমলেশ ত্রিপাঠী এখনো জানে না কেন একদিন তার জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল অরুণিমা। অরুণিমার সঙ্গে একটিবার দেখা হলে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া যেত।
তাদের বিবাহিত জীবন ছিল সাড়ে তিন বছরের।
মাত্র সাড়ে তিন বছর। তারপর আরো ১২ বছর কেটে গেছে। কোথায় আছে অরুণিমা, কী করছে কিছুই জানতে পারেনি অমলেশ। কিন্তু সে কি অপেক্ষা করে আছে সে কি আশা করে, একদিন প্রত্যাবর্তন করবে অরুণিমা অমলেশ নিজেকে প্রশ্ন করে।
গুরুত্বপূর্ণ ছোট তালিকাটির এক নম্বর আইটেমটি লাল কালিতে কেটে দিয়ে উঠে পড়ল অমলেশ। বিছানায় যেতেই ঘুম তাকে দখল করে নিল।
৫.
শনিবার সকালে নিয়ম করে বাজারে যায় অমলেশ। আজ গেল না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে সে কাজের টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেল। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে পাঠানোর জীবন বীমা বাতিলের চিঠিটা মুসাবিদা করে সে মৃণ্ময়ীকে লিখতে শুরু করল। মৃণ্ময়ীকে চিঠি লেখার বিষয়টা সহজ মনে হলো না। কাটাকুটি করে ১০ লাইনের চিঠিটি লিখতে অনেকখানি বেলা গড়িয়ে গেল।
মরিসনের ফোন এলো লাঞ্চের সময়। সে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
মরিসন এলো দুপুর পার করে বিকেলে। বেলকনিতে বসে কফি খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অমলেশ। সন্ধ্যা হতে দেরি। তবু যেন নির্ধারিত সময়ের আগেই হঠাৎ সূর্য ডুবে গিয়ে পৃথিবীটা অন্ধকার করে দিয়েছে।
মরিসনের হাতে একখ কাগজ। গতকাল সন্ধ্যায় ওর ডাক্তার বাবুর কাছে 'ম্যাডাম' এসেছিলেন। ম্যাডাম ওকে চিনতে পারেননি। রোগীর খুব ভিড় ছিল। মরিসন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি; তবে রোগীদের নাম-ঠিকানা লেখার রেজিস্টারের পাতাটি ফটোকপি করে এনেছে।
অরুণিমার হাতের লেখা আগের মতোই আছে। অক্ষরগুলো ভাঙা, যেন অসম্পূর্ণ। খুব তাড়াহুড়া করে লেখে অরুণিমা। একটি অক্ষর লেখা শেষ হওয়ার আগে আরো দুটো অক্ষর চলে আসে কলমের ডগায়। নামের ঘরে লিখেছে- 'অরুণিমা'। কোন পদবি নেই। ঠিকানার ঘরে মাদ্রাজের ঠিকানা। ফোন নম্বর স্পষ্ট করে লেখা। বোম্বেতে কোথায় উঠেছে, কোথাও উল্লেখ নেই।
ম্যাডামের সঙ্গে হুইল চেয়ারে এসেছিল রোগী। স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেছে কোমরের নিচ থেকে; এটুকুই বলতে পারলো মরিসন।
নাম-ঠিকানার কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রেখে অমলেশ ডাকলো, 'মরিসন'...
'জি স্যার।'
'আমাদের একটা ছবির অ্যালবাম ছিল না ওটা কোথায় থাকে, মনে আছে নিয়ে এসো।'
পুরোনো অ্যালবামে ছেলেবেলার অনেক ছবি রয়েছে। বাবার ছবি রয়েছে, মায়ের ছবি রয়েছে। মায়ের বড় একটি ছবিতে অমলেশের চোখ আটকে গেল।
৬.
তখন মাত্র তিন মাস হল লন্ডনে এসেছে অমলেশ। ছ'মাস পরেই এমআরসিপি ফার্স্ট পার্টের পরীক্ষা। মার স্ট্রোক করার খবর এসেছিল কমলেশের চিঠিতে। স্ট্রোকের কারণে মায়ের শরীরের বাম পাশটা মাথা থেকে পা অবধি সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল অমলেশের; কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। অমলেশ ভেবেছিল, ফার্স্ট পার্টের পরীক্ষা দিয়ে তারপর ঢাকায় যাবে। কিন্তু দু'মাস পরেই কমলেশের দ্বিতীয় চিঠিতে মায়ের চলে যাওয়ার খবর এসেছিলো।
এমআরসিপি হয়ে গেলেও সে দেশে ফিরলো না। ডাবলিনের একটি হাসপাতালে জুনিয়র কনসালট্যান্টের কাজ জুটে গেল। তবে চার বছরের মাথায় সে অস্থির হয়ে উঠলো। সিনিয়র কনসালট্যান্ট অজিত মালহোত্রা বললেন, 'ঢাকায় গিয়ে ক্যারিয়ারে সুবিধা করতে পারবে না হে। তুমি বরং বোম্বে কি মাদ্রাজ চলে যাও। মাসে লাখ টাকা কামাতে পারবে।'
এই পরামর্শ অমলেশের মনে ধরেছিল। বোম্বে এসে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল দ্রুত। বছর দুই পরে একটি ওষুধ কোম্পানির সিঙ্গাপুরে সাত দিনের শিক্ষা সফরের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল অমলেশ। কিন্তু পাকিস্তানি পাসপোর্টটি খুঁজে পেল না সে। এক মাসের মধ্যে নতুন পাসপোর্ট করে সে ভারতীয় নাগরিক বনে গিয়েছিল।
অরুণিমা এসেছিল অসুস্থ বাবাকে দেখাতে। অরুণিমার দিকে তাকিয়ে অমলেশ অস্থিরতা অনুভব করেছিল। তার বুকের ভিতরে গোপন বেহালায় একটি হারানো সুর বেজে উঠেছিল। অরুণিমা এলেই মনে হতো, অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলা কাউকে খুঁজে পেয়েছে অমলেশ।
বয়সের পার্থক্য ছিল। শেষ পর্যন্ত অরুণিমা বিয়েতে রাজি হয়েছিল।
অ্যালবামে রাখা মায়ের ছবি দেখতে দেখতে অমলেশ লক্ষ্য করলো, মায়ের চেহারার আদলে অরুণিমার মুখের ছবি লুকিয়ে আছে। আগে সে খেয়াল করেনি। ভালোভাবে খেয়াল করে সে নিশ্চিত হলো, মা আর অরুণিমার চেহারার আদলের মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য সমিলতা। অরুণিমার মুখাবয়বে সে তবে মাকেই খুঁজে পেয়েছিল?
৭.
শনিবার সকাল ১১টার দিকে ক্রিং ক্রিং করে কলিং বেল বেজে উঠলে অবাক হলো অমলেশ। আজ এখন কারো আসার কথা নেই। সে লাইব্রেরি রুমে বসে বই নাড়াচাড়া করছিল। খিল নামিয়ে দরজা খুলে থমকে গেল অমলেশ :অরুণিমা। অরুণিমা এসেছে। দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে অরুণিমা। অরুণিমা সান্যাল। অরুণিমা ত্রিপাঠী।
চমকটা সামলে নিয়ে অমলেশ বলতে পারলো, 'আরে কী আশ্চর্য! এসো, ভেতরে এসো।'
খুব নিচু স্বরে কথা বলছিল অমলেশ। তারই মধ্যে মনের আহদ্মাদটুকু তাথৈ তাথৈ করে বেজে উঠেছিল। দুই চোখে অনেক আলো আছড়ে পড়ছিল; যেন এইমাত্র সে আবিস্কার করেছে দূর আকাশের নক্ষত্রবীথিতে নতুন কোনো জ্যোতিস্ক। তার মনে হচ্ছিল, তার মনে কোনো দুঃখ নেই। কোনো অপ্রাপ্তি নেই।
শোবার ঘর দেখে চমকে গেল অরুণিমা। ওয়ার্ডরোব খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। বললো, 'আপনি কি পাগল ১২ বছর যাবৎ ঘরটি অবিকল রেখে দিয়েছেন সবকিছু আগলে বসে আছেন?'
'আমার আশা ছিল, একদিন তুমি আসবে।'
'আপনি জানতেন, আমি আসবো
একগাল হেসে অমলেশ বললো, 'না জানলে সবকিছু সাজিয়ে -গুছিয়ে রেখেছি কেন বল তো?'
অরুণিমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। সে বলল, 'কিন্তু আমি তো থাকতে আসিনি। না বলে চলে গিয়েছিলাম। আজ সুযোগ পেয়ে বিদায় নিতে এসেছি। বোম্বে থেকে মাদ্রাজ অনেক দূরের পথ। আবার কবে আসবো, কখন আসবো, আদৌ আর কখনো আসা হবে কিনা, কে জানে! ভাবলাম, খোঁজ করি; দেখা করে যাই। এতদিনে নিশ্চয় আপনি সবকিছু ভুলে গেছেন; ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে এ বাসাতেই এখনো আছেন- এতোটা আশা করিনি।'
অমলেশ বলল, 'তুমি থাকার জন্য ফিরে আসবে- এমন তো আশা কখনো করিনি। আজ তুমি থেকে যাবে বলে প্রত্যাবর্তন করেছ- সে রকমও আমি ভাবছি না। জানি, একটু পরেই তোমার যাবার সময় হয়ে যাবে। তুমি চলে যাবে। কিছুক্ষণ তো থাকলে! তার মূল্য আছে না তোমার বাসায় তুমি আসবে আর তোমার ঘর আমি সাজিয়ে রাখবো না- সে হয়?'
চোখ মুছতে মুছতে অরুণিমা বললো, 'আপনি আমাকে ক্ষমা করতে পারলেন কী করে পারলেন, বলুন তো!'
অমলেশ বলল, 'আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে, কাউকে বোঝাতে পারবো না। এসব কথা থাক অরুণিমা; তুমি চুপ করে বসো তো! কতকাল দেখিনি! আজ চোখভরে তোমাকে দেখি।'
দ্বিতীয়বার যখন ঘুম ভাঙলো তখন কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তার মনে পড়লো, আগে আরো একবার ঘুম ভেঙেছিল এবং টয়লেট করে এসে দ্বিতীয় দফা ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত কি শেষের দিকে? ঘুম ভাঙার আগে সে একটি স্বপ্টম্ন দেখেছে। কারো সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়েছে। দেখা হয়ে সে খুশি হয়েছে। এতটুকুই মনে আছে।
সে হাত বাড়িয়ে বালিশের পেছন থেকে ঘড়িটা বের করল। রাত পৌনে দুটো। আগেরবার ঘড়ি দেখা হয়নি। কতক্ষণ আগে প্রথমবার ঘুম ভেঙেছিল, অনুমান করা যাচ্ছে না। সে বিরক্তি বোধ করল।
কেন ঘুম ভেঙে গেল অসময়ে? হালকাভাবে এ প্রশ্নটা তার মনের ওপর দিয়ে কয়েক দফা এদিক ওদিক করে গেল।
রাতের নিস্তব্ধতা সজোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ইট কিংবা লোহার রডভর্তি একটি লরি ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত ছুটে গেল। দূর থেকে ভেসে এলো নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দ। বেশ শীত পড়েছে। কম্বলটা টেনে নিতেই ঘুমের আমেজ চলে এলো দ্রুত।
তৃতীয়বার যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত ৩টা। ঐ স্বপ্টম্নটা আবার দেখছিল। একটি মুখ। কার মুখ? মনে করতে পারলো না সে। কেবল ভালো লাগার রেশটুকু রয়ে গেছে।
ক্ষুধা ছিল পেটে ক্ষুধার তাড়নায় বারবার ঘুম চটে যাচ্ছে
ফ্রিজ খুলে দেখলো অমলেশ কী কী আছে। একটা আইসক্রিম বের করল। টেবিলের ওপর বিস্কুট রাখা ছিল; প্যাকেটটা খুলে ফেলল। আইসক্রিম খেতে খেতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অরুণিমা যখন চলে যায় তখন সবে সে গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। সেকি সন্তানের জন্ম দিয়েছিল নাকি নির্ঝঞ্ঝাট থাকার জন্য গর্ভপাত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিল এসব বিষয় তার মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
স্কুলে পড়ার সময় কুমিল্লা থেকে জ্যোতিষ রঘুনাথ কাকা এসেছিলেন। একে একে সবার হাত দেখেছিলেন। কিশোর অমলেশের হাত দেখে বলেছিলেন, 'কি-রে, তুই দেখছি বিরাট ভাগ্যবান! দুটি বিয়ে হবে তোর।'
অরুণিমা চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ থেকেছে অমলেশ। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে রাউন্ড শেষ করে বাসায় ফিরে আসার পর কখনো কখনো তার মনে হয়েছে, সে একা হয়ে গেছে। একা তো বটেই কিন্তু সঙ্গিনী জুটিয়ে নেয়ার বদলে অমলেশ ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, সারাদিনে না কেউ তাকে ফোন করে, না সে কাউকে ফোন করে। তার বাসায় অতিথি আসে কালেভদ্রে। সামাজিক নিমন্ত্রণগুলি সে কৌশলে এড়িয়ে চলে।
রাতে থাকার কেয়ারটেকারকে একদিন বিদায় করে দিল অমলেশ। বললো, 'বাসায় তেমন কাজকর্ম তো নেই মরিসন। তুমি অন্য কোথাও কাজ জুটিয়ে নাও। আমি সন্ধ্যায় দু'ঘণ্টার জন্য কাউকে রেখে নেব।'
মরিসন বললো, 'স্যার, আমিই না হয় সন্ধ্যায় এসে বাসাটা গুছিয়ে দিয়ে যাব।'
অমলেশ বলল, 'মরিসন, একজন মানুষ দুটো কাজ ভালোভাবে করতে পারে না। তবে যে ক'টা দিন নতুন কাজ না জোটে, সন্ধ্যার দিকে এসো।'
আগস্ট মাসে নতুন চাকুরি জুটিয়ে ফেলল মরিসন। পরের মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু। অন্য কারো বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ নয়; একজন ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে চাকুরি। রোগী এলে খাতায় নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে সিরিয়াল নম্বর দিয়ে নার্স দিদিমণিদের রুমে পাঠিয়ে দেয়ার কাজ।
'তোমাকে তো এখন থেকে ভালো জামাকাপড় পড়তে হবে। দু'সেট শার্ট-প্যান্ট, জুতো বানিয়ে নিও' বলে কিছু অতিরিক্ত টাকা মরিসনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল অমলেশ।
২.
কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছিল হাসপাতালের নতুন কনসালট্যান্ট ডা. ভূমেন্দ্র গুহ। দিল্লির এপোলো থেকে এসেছে। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি একা থাকো এ অ্যাপার্টমেন্টে এত বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট লাগে তোমার '
এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকবার হয়েছে অমলেশ। সে অক্লেশে মুখস্থ বলেছিল :লাগে না। একলা একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতটুকুন জায়গাই-বা লাগে! শিগগির হয়তো সে ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে উঠে যাবে।
কিন্তু সেরকম কখনো ভাবেনি সে কোনদিন।
'বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। কত বড় এটা '
'চার হাজার স্কয়ার ফুটের মতো।'
'সেরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি করোটা কী তোমার খালি খালি লাগে না '
অনিশ্চিতভাবে সামান্য হেসেছিল অমলেশ। উত্তর দেয়নি কোন। একা লাগে; খুবই একা লাগে। তাই বলে এ অ্যাপার্টমেণ্ট ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা যায় না।
ভূমেন পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরে দেখতে চাইলো। বললো, 'কাউকে যদি কোনো ঘরে লুকিয়ে না রেখে থাকো, তবে দেখাও তোমার এই প্রাসাদ।'
'তুমি ঘুরে ঘুরে দেখে নাও না! কোনো দরজায় তালা লাগানো নেই।'
ফ্রিজ থেকে ক্যানে ভরা টুনা ফিশ, চিজ আর ম্যায়োনিজ বের করে দুটো স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেললো অমলেশ। কফি পারকোলেটারটা চালু করলো। বাড়ি দেখা শেষ করে বেলকনিতে গিয়ে চেয়ারে বসেছে ভূমেন। সেখানে বসে কফি-স্যান্ডউইচে দাঁত ফোটানো, এটা ওটা কথা-বার্তা।
৩.
আইসক্রিম খেলে তার তেষ্টা পায়। পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেলল সে। তার মনে হল, রাত জাগা ঠিক হচ্ছে না। তিনবার ঘুম ভেঙেছে, এখন সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ঘুমোতে হবে; তা না হলে হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখার ফিটনেস থাকবে না।
ঘড়িতে সকাল ৬টায় ওঠার অ্যালার্ম দেয়া ছিল। ওটাকে ৮টা করলো অমলেশ। ঔষধের বাক্স থেকে একটা সিডেটিভ ট্যাবলেট বের করে এক ঢোক পানি দিয়ে পেটে চালান করে দিল।
ঘুমের ওষুধ খেলেই ঘুম আসে না। অমলেশ কাজের ঘরে গিয়ে একটু বসলো। টেবিলে কয়েক পাতা কাগজ ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা আছে। সে খুঁজে বের করলো সেই পাতাটি, যেখানে সে ফেলে রাখা কাজগুলোর তালিকা করে রেখেছে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তালিকাটি সে দেখতে লাগলো।
তালিকার প্রথমে লেখা :'ড্রাইভার্স লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।'
দুই নম্বরে লেখা :'অনলাইনে কয়েকটি বই অর্ডার করতে হবে'। কাগজের উল্টো পিঠে সে সাত-আটটি বইয়ের তালিকা করে রেখেছে। কয়েক দিন আগে সল বিলো নামে একজন মার্কিন কথাসাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তার একটি উপন্যাস ঐবহফবৎংড়হ :যব জধরহ করহম পড়ে বিস্মিত হয়েছে অমলেশ। কী দৃঢ় গদ্য; চিন্তাশক্তির কত না গভীরতা! সল বিলোর তিনটি উপন্যাসের নাম লিখে রেখেছে কিনবে বলে। গার্সিয়া মার্কেস নামে একজন কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক খুব নাম করেছে সম্প্রতি। তারও দুটি বইয়ের নাম সে টুকে রেখেছে তালিকায়।
সাত নম্বরে এসে তার ভ্রু কুঁচকে উঠলো। সাত নম্বর হলো :'সময়মতো ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিতে হবে।' অথচ কয়েক মাস আগে অমলেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, লাইফ ইন্স্যুরেন্সটা সে আর চালাবে না। সে কথাটি তালিকায় লেখা হয়নি। নতুন বছর শুরু হওয়ার আগেই কোম্পানিকে চিঠি লিখে পলিসিটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। লাল কলম নিয়ে সে সাত নম্বর আইটেমকে চিহ্নিত করল। বড় অক্ষরে লিখলো, 'পলিসি বাতিল করতে হবে।'
তালিকার ২১ নম্বরের রয়েছে :'ছেলেবেলার ছবিগুলো স্ক্যান করে ফেলতে হবে।' এটি তালিকার শেষ আইটেম। অমলেশ ২২ নম্বর দিয়ে নতুন একটি কাজ যোগ করল :'মৃণ্ময়ীর চিঠির জবাব দিতে হবে।'
৪.
গত পরশু মৃণ্ময়ীর চিঠি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। মৃণ্ময়ী সবচেয়ে ছোট ভাই কমলেশের মেয়ে। ওদের শেষ কবে দেখেছে, অমলেশের মনে নেই। কমলেশ হঠাৎ মারা গিয়েছিল। কয়েক বছর পরে মৃণ্ময়ীর মাও মারা যায়। ১৪ বছর ঢাকায় যাওয়া হয়নি অমলেশের। মৃণ্ময়ী খুব অনুরোধ করে লিখেছে, জ্যাঠামশাই যেন তার বিয়েতে অবশ্যই আসেন। অরুণিমা জ্যাঠাইমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে যেন ভুল না করেন।
এ কাগজটার উল্টো পিঠে ছোট আরেকটি তালিকা রয়েছে। এ কাজগুলো সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অথচ সময়সাপেক্ষ। তালিকাটা এ রকম :
(ক) অরুণিমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
(খ) বরানগরের ফ্ল্যাটবাড়ি বেচে দিতে হবে।
(গ) বাবার বন্ধু শুভেন্দু কাকার ঋণের টাকা শোধ দিতে হবে ইত্যাদি।
তালিকাটি অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রাখল অমলেশ। তারপর লাল কলম দিয়ে এক নম্বরে লেখা 'অরুণিমাকে খুঁজে বের করতে হবে' কথাটি কলম টেনে কেটে দিল।
অমলেশের বুকটা হুহু করে উঠলো।
অরুণিমা চলে গেছে ১২ বছরেরও আগে। বিরাট একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলে গেছে অরুণিমা সান্যাল। ডা. অমলেশ ত্রিপাঠী এখনো জানে না কেন একদিন তার জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল অরুণিমা। অরুণিমার সঙ্গে একটিবার দেখা হলে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া যেত।
তাদের বিবাহিত জীবন ছিল সাড়ে তিন বছরের।
মাত্র সাড়ে তিন বছর। তারপর আরো ১২ বছর কেটে গেছে। কোথায় আছে অরুণিমা, কী করছে কিছুই জানতে পারেনি অমলেশ। কিন্তু সে কি অপেক্ষা করে আছে সে কি আশা করে, একদিন প্রত্যাবর্তন করবে অরুণিমা অমলেশ নিজেকে প্রশ্ন করে।
গুরুত্বপূর্ণ ছোট তালিকাটির এক নম্বর আইটেমটি লাল কালিতে কেটে দিয়ে উঠে পড়ল অমলেশ। বিছানায় যেতেই ঘুম তাকে দখল করে নিল।
৫.
শনিবার সকালে নিয়ম করে বাজারে যায় অমলেশ। আজ গেল না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে সে কাজের টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেল। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে পাঠানোর জীবন বীমা বাতিলের চিঠিটা মুসাবিদা করে সে মৃণ্ময়ীকে লিখতে শুরু করল। মৃণ্ময়ীকে চিঠি লেখার বিষয়টা সহজ মনে হলো না। কাটাকুটি করে ১০ লাইনের চিঠিটি লিখতে অনেকখানি বেলা গড়িয়ে গেল।
মরিসনের ফোন এলো লাঞ্চের সময়। সে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
মরিসন এলো দুপুর পার করে বিকেলে। বেলকনিতে বসে কফি খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অমলেশ। সন্ধ্যা হতে দেরি। তবু যেন নির্ধারিত সময়ের আগেই হঠাৎ সূর্য ডুবে গিয়ে পৃথিবীটা অন্ধকার করে দিয়েছে।
মরিসনের হাতে একখ কাগজ। গতকাল সন্ধ্যায় ওর ডাক্তার বাবুর কাছে 'ম্যাডাম' এসেছিলেন। ম্যাডাম ওকে চিনতে পারেননি। রোগীর খুব ভিড় ছিল। মরিসন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি; তবে রোগীদের নাম-ঠিকানা লেখার রেজিস্টারের পাতাটি ফটোকপি করে এনেছে।
অরুণিমার হাতের লেখা আগের মতোই আছে। অক্ষরগুলো ভাঙা, যেন অসম্পূর্ণ। খুব তাড়াহুড়া করে লেখে অরুণিমা। একটি অক্ষর লেখা শেষ হওয়ার আগে আরো দুটো অক্ষর চলে আসে কলমের ডগায়। নামের ঘরে লিখেছে- 'অরুণিমা'। কোন পদবি নেই। ঠিকানার ঘরে মাদ্রাজের ঠিকানা। ফোন নম্বর স্পষ্ট করে লেখা। বোম্বেতে কোথায় উঠেছে, কোথাও উল্লেখ নেই।
ম্যাডামের সঙ্গে হুইল চেয়ারে এসেছিল রোগী। স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেছে কোমরের নিচ থেকে; এটুকুই বলতে পারলো মরিসন।
নাম-ঠিকানার কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রেখে অমলেশ ডাকলো, 'মরিসন'...
'জি স্যার।'
'আমাদের একটা ছবির অ্যালবাম ছিল না ওটা কোথায় থাকে, মনে আছে নিয়ে এসো।'
পুরোনো অ্যালবামে ছেলেবেলার অনেক ছবি রয়েছে। বাবার ছবি রয়েছে, মায়ের ছবি রয়েছে। মায়ের বড় একটি ছবিতে অমলেশের চোখ আটকে গেল।
৬.
তখন মাত্র তিন মাস হল লন্ডনে এসেছে অমলেশ। ছ'মাস পরেই এমআরসিপি ফার্স্ট পার্টের পরীক্ষা। মার স্ট্রোক করার খবর এসেছিল কমলেশের চিঠিতে। স্ট্রোকের কারণে মায়ের শরীরের বাম পাশটা মাথা থেকে পা অবধি সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল অমলেশের; কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। অমলেশ ভেবেছিল, ফার্স্ট পার্টের পরীক্ষা দিয়ে তারপর ঢাকায় যাবে। কিন্তু দু'মাস পরেই কমলেশের দ্বিতীয় চিঠিতে মায়ের চলে যাওয়ার খবর এসেছিলো।
এমআরসিপি হয়ে গেলেও সে দেশে ফিরলো না। ডাবলিনের একটি হাসপাতালে জুনিয়র কনসালট্যান্টের কাজ জুটে গেল। তবে চার বছরের মাথায় সে অস্থির হয়ে উঠলো। সিনিয়র কনসালট্যান্ট অজিত মালহোত্রা বললেন, 'ঢাকায় গিয়ে ক্যারিয়ারে সুবিধা করতে পারবে না হে। তুমি বরং বোম্বে কি মাদ্রাজ চলে যাও। মাসে লাখ টাকা কামাতে পারবে।'
এই পরামর্শ অমলেশের মনে ধরেছিল। বোম্বে এসে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল দ্রুত। বছর দুই পরে একটি ওষুধ কোম্পানির সিঙ্গাপুরে সাত দিনের শিক্ষা সফরের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল অমলেশ। কিন্তু পাকিস্তানি পাসপোর্টটি খুঁজে পেল না সে। এক মাসের মধ্যে নতুন পাসপোর্ট করে সে ভারতীয় নাগরিক বনে গিয়েছিল।
অরুণিমা এসেছিল অসুস্থ বাবাকে দেখাতে। অরুণিমার দিকে তাকিয়ে অমলেশ অস্থিরতা অনুভব করেছিল। তার বুকের ভিতরে গোপন বেহালায় একটি হারানো সুর বেজে উঠেছিল। অরুণিমা এলেই মনে হতো, অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলা কাউকে খুঁজে পেয়েছে অমলেশ।
বয়সের পার্থক্য ছিল। শেষ পর্যন্ত অরুণিমা বিয়েতে রাজি হয়েছিল।
অ্যালবামে রাখা মায়ের ছবি দেখতে দেখতে অমলেশ লক্ষ্য করলো, মায়ের চেহারার আদলে অরুণিমার মুখের ছবি লুকিয়ে আছে। আগে সে খেয়াল করেনি। ভালোভাবে খেয়াল করে সে নিশ্চিত হলো, মা আর অরুণিমার চেহারার আদলের মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য সমিলতা। অরুণিমার মুখাবয়বে সে তবে মাকেই খুঁজে পেয়েছিল?
৭.
শনিবার সকাল ১১টার দিকে ক্রিং ক্রিং করে কলিং বেল বেজে উঠলে অবাক হলো অমলেশ। আজ এখন কারো আসার কথা নেই। সে লাইব্রেরি রুমে বসে বই নাড়াচাড়া করছিল। খিল নামিয়ে দরজা খুলে থমকে গেল অমলেশ :অরুণিমা। অরুণিমা এসেছে। দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে অরুণিমা। অরুণিমা সান্যাল। অরুণিমা ত্রিপাঠী।
চমকটা সামলে নিয়ে অমলেশ বলতে পারলো, 'আরে কী আশ্চর্য! এসো, ভেতরে এসো।'
খুব নিচু স্বরে কথা বলছিল অমলেশ। তারই মধ্যে মনের আহদ্মাদটুকু তাথৈ তাথৈ করে বেজে উঠেছিল। দুই চোখে অনেক আলো আছড়ে পড়ছিল; যেন এইমাত্র সে আবিস্কার করেছে দূর আকাশের নক্ষত্রবীথিতে নতুন কোনো জ্যোতিস্ক। তার মনে হচ্ছিল, তার মনে কোনো দুঃখ নেই। কোনো অপ্রাপ্তি নেই।
শোবার ঘর দেখে চমকে গেল অরুণিমা। ওয়ার্ডরোব খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। বললো, 'আপনি কি পাগল ১২ বছর যাবৎ ঘরটি অবিকল রেখে দিয়েছেন সবকিছু আগলে বসে আছেন?'
'আমার আশা ছিল, একদিন তুমি আসবে।'
'আপনি জানতেন, আমি আসবো
একগাল হেসে অমলেশ বললো, 'না জানলে সবকিছু সাজিয়ে -গুছিয়ে রেখেছি কেন বল তো?'
অরুণিমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। সে বলল, 'কিন্তু আমি তো থাকতে আসিনি। না বলে চলে গিয়েছিলাম। আজ সুযোগ পেয়ে বিদায় নিতে এসেছি। বোম্বে থেকে মাদ্রাজ অনেক দূরের পথ। আবার কবে আসবো, কখন আসবো, আদৌ আর কখনো আসা হবে কিনা, কে জানে! ভাবলাম, খোঁজ করি; দেখা করে যাই। এতদিনে নিশ্চয় আপনি সবকিছু ভুলে গেছেন; ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে এ বাসাতেই এখনো আছেন- এতোটা আশা করিনি।'
অমলেশ বলল, 'তুমি থাকার জন্য ফিরে আসবে- এমন তো আশা কখনো করিনি। আজ তুমি থেকে যাবে বলে প্রত্যাবর্তন করেছ- সে রকমও আমি ভাবছি না। জানি, একটু পরেই তোমার যাবার সময় হয়ে যাবে। তুমি চলে যাবে। কিছুক্ষণ তো থাকলে! তার মূল্য আছে না তোমার বাসায় তুমি আসবে আর তোমার ঘর আমি সাজিয়ে রাখবো না- সে হয়?'
চোখ মুছতে মুছতে অরুণিমা বললো, 'আপনি আমাকে ক্ষমা করতে পারলেন কী করে পারলেন, বলুন তো!'
অমলেশ বলল, 'আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে, কাউকে বোঝাতে পারবো না। এসব কথা থাক অরুণিমা; তুমি চুপ করে বসো তো! কতকাল দেখিনি! আজ চোখভরে তোমাকে দেখি।'
বিষয় : প্রচ্ছদ ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
মন্তব্য করুন